হাতে ধারালো অস্ত্র নিয়ে ঘোড়া ছুটিয়ে কখনও স্পার্টা কখনও গ্রিসের রাস্তায় ছুটে চলেছেন ধুলো উড়িয়ে। এই বুঝি দেখা হয়ে গেল সক্রেটিসের সাথে, ওখানে দেখা যাচ্ছে ইতিহাসবেত্তা হেরোডোটাসকে! কখনও ইতিহাসের ধার না ধেরেই শিকার করছেন গ্রিক পুরাণের দানবীয় সব জন্তু জানোয়ার। বাদ যাচ্ছে না হারিয়ে যাওয়া আটলান্টিসের বুকে সময় কাটানোও! ভাবতে পারছেন, এ সবকিছুই একটি গেমেই পাওয়া যায়! আর ইতিহাস আর পুরাণের মিশেল যেহেতু, সেটি অ্যাসাসিন্স ক্রিড না হয়ে যায় না। কথা হচ্ছে সিরিজের সর্বশেষ গেম ‘অডিসি‘ (Assassin’s Creed: Odyssey) নিয়েই।
অ্যাসাসিন্স ক্রিড সিরিজের একাদশ বড় গেম ‘অডিসি’ ২০১৮ সালের ৫ অক্টোবর মুক্তি পাওয়ার সাথে সাথেই জয় করে নেয় গেমারদের মন। আগের পর্ব ‘অ্যাসাসিন্স ক্রিড: অরিজিন্স‘ (Assassin’s Creed: Origins) এর যোগ্য সিকুয়েল হিসেবে আসলেই প্রশংসার দাবিদার অডিসি। খ্রিস্টপূর্ব ৪৩১ সালে অ্যাথেন্স এবং স্পার্টার মাঝে হয়ে যাওয়া পেলোপনেশিয়ান যুদ্ধের (Peloponnesian War) পটভূমিতে এগিয়ে যায় গেমটির কাহিনী, আর গেমারের সামনে ধীরে ধীরে উন্মোচিত হয় সিরিজের সবচেয়ে বড় ও নিখুঁত মানচিত্র, এবং এযাবতকালে দেখা সিরিজের দীর্ঘতম কাহিনী।
সিকুয়েল হলেও অডিসি গেমটির কাহিনী প্রাচীন মিশরের উপর নির্মিত অরিজিন্স গেমের প্রায় চারশ বছর আগের; বিশেষ করে ‘থ্রি হান্ড্রেড‘ (300) সিনেমার ভক্তদের জন্য গেমের শুরুটা যেন খুবই পরিচিত- হ্যাঁ, এখানে দেখা মেলে সেই লিওনিদাসেরও।
গেমারকে খেলতে হবে দুই ভাইবোনের একজন হিসেবে, যাকে বেছে নিতে হবে গেমের শুরুতেই। গেমারের ভাই কিংবা বোনকে পাহাড়চূড়ার ওপর থেকে দেবতার জন্য বলি হিসেবে ফেলে দেবার মধ্য দিয়ে শুরু হয় গেমের ঘটনা, যে মুহূর্তটি ভেঙে দেয় সাজানো গোছানো পরিবারটিকে। এতটুকু মোটামুটি গেমের ট্রেলার থেকেই পরিষ্কার হয়ে যায়। গেমারের চরিত্রটি নিজেকে সাগরপাড়ে আবিষ্কার করে অনাথ এক শিশু হিসেবে, আর ধীরে ধীরে বড় হবার পর হয়ে যায় একজন মিস্থিওস (Misthios), অর্থাৎ যার কাজ টাকার বিনিময়ে বিভিন্নজনের ‘মিশন’ সম্পন্ন করা, ভাড়াটে খুনি বা মার্সেনারি (Mercenary) যাকে বলে।
ফ্ল্যাশব্যাকের মাধ্যমে আগের কাহিনী ধীরে ধীরে উন্মোচিত হতে থাকে। আর প্লেয়ারকে গ্রিসের বিশাল মানচিত্র জুড়ে খুঁজে বেড়াতে হবে তার পরিবারের রহস্যের সমাধানে। আর সেই সাথে নির্মূল করতে হবে কাল্ট অফ কসমস নামের এক বিষাক্ত সংগঠনকে। এই সংগঠনের মূল হোতা কে? কসমসের প্রধান অস্ত্র কী? গেমারের চরিত্র কাসান্দ্রা কিংবা অ্যালেক্সিওসের মা কে? আর তারচেয়েও অবাক করা ব্যাপার, তাদের বাবাই বা কে? এ রহস্যগুলো তাড়া করতে করতে প্লেয়ার পরিচিত হবেন হেরোডোটাস কিংবা সক্রেটিসের মতো ঐতিহাসিক চরিত্রের সাথে, আর সাথে থাকবে নিত্যসঙ্গীর মতো কিছু বন্ধু।
গেমের গ্রাফিক্স প্রসঙ্গে বলতেই হয়, আগের যেকোনো গেমের তুলনায় অ্যাসাসিন্স ক্রিড অডিসির গ্রাফিক্স ভালো। তবে একই ইঞ্জিনে বানানো বিধায় অরিজিন্সের সাথে এর মিল আছে, থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে প্রাচীন গ্রিসের রাত আর দিনের নৈসর্গিক দৃশ্যগুলো যে বর্তমান সময়ে এর চেয়ে সুন্দর করে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব নয়, তা নিশ্চিত করেই বলা যায়।
অরিজিন্সের সাথে এবারও মিল আছে গেমটির লেভেল সিস্টেমে। মিশন কমপ্লিট করে এবং কমব্যাটের মাধ্যমে এক্সপি অর্জনের মাধ্যমে লেভেল বাড়াতে হবে ক্যারেক্টারের, এবং নিজের জাহাজের। অনেক সময় কিছু মিশনের জন্য নির্দিষ্ট লেভেল না হলে খেলাটাই দুরূহ হয়ে যাবে; এই লেভেল বাড়ানোটা আসলে এই আরপিজি (RPG) গেমের সাইড মিশনগুলো খেলানোর একটা মোক্ষম উপায়, যেন কেবল মূল স্টোরিলাইন শেষ করেই খেল খতম না হয়ে যায়। ঈগল ভিশন (Eagle Vision) এবারও আক্ষরিক অর্থেই ঈগলের দৃষ্টি, এবার বায়েকের সেনুর বদলে আছে ইকারস নামের এক সোনালি ঈগল।
সিনক্রোনাইজেশন সিস্টেম আছে আগের মতোই। নতুন যোগ হয়েছে বিভিন্ন পরিস্থিতিতে প্লেয়ার কী উত্তর দেবেন তার নানা অপশন, তাই আপনার পছন্দের উপর ভিত্তি করে বদলে যাবে গেমের কাহিনীর ইতিটুকু। আর ঘোড়ায় চড়ে পুরো গ্রিস ঘুরে বেড়ানো, নৌকা কিংবা জাহাজে করে সমুদ্রের বুকে ছুটে চলা, অতল সাগরের গহ্বর থেকে ধনরত্ন তুলে আনা, ফাস্ট ট্রাভেল- সবই আগের চেয়ে বেশি নিখুঁত। নেভাল ব্যাটেল অবশ্য ‘অ্যাসাসিন্স ক্রিড ব্ল্যাক ফ্ল্যাগ’ (Assassin’s Creed: Black Flag) এর মতো কঠিন নয়।
কমব্যাট সিস্টেমও আছে আগের মতোই, তবে পার্থক্য এক জায়গায়, যেটি কিনা এ গেমের একটি খারাপ দিক হিসেবেও বলা যায়- তা হলো, প্লেয়ারের কোনো ঢাল বা শিল্ড (Shield) নেই; শত্রুর দুর্বল মার ঠেকানো যায় বটে, কিন্তু কঠিন মারের বেলায় ডজ (Dodge) করতে হয়। অন্যান্য মিস্থিওস ঢাল ব্যবহার করলেও সকল অস্ত্রের নিপুণ কারিগর অ্যালেক্সিওস বা ক্যাসান্দ্রা কেন ঢাল ব্যবহার করে না সে প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যায় না। তাছাড়া অ্যাসাসিন্স ক্রিড সিরিজের ‘অ্যাসাসিন’ (assassin) বলে কিছু নেই, এটাও সমালোচনা করবার মতো একটা দিক, নেই অ্যাসাসিনের ব্লেডও! এদিকটা হতাশ করবেই ক্লাসিক ভক্তদের। তবে সত্যি বলতে, অ্যাসাসিনের সূচনাই হয় আগের অরিজিন্সের শেষ দিকে এসে, তাই এ গেমেই অ্যাসাসিন আশা করাও ঠিক নয়।
মেটাক্রিটিকে ৮৬, আইজিএন-এ ৯.২ এরকম অসংখ্য উচ্চ রেটিং এটাই নির্দেশ করে যে কেবল ভক্তরাই নয় সমালোচকরাও খুবই পছন্দ করেছেন গেমটিকে। মূল গল্প শেষ করতে মোটামুটি ৫০/৬০ ঘণ্টা তো লেগে যাবেই। তবে সেই মূল গল্প শেষ করে বসে থাকা নয়, বরং নির্দিষ্ট সময় পর পর নতুন নতুন গল্প (সিজন পাস/ডিএলসি) যোগ হচ্ছে অ্যাসাসিন্স ক্রিড অডিসিতে, যা জিইয়ে রাখছে প্লেয়ারদের মন। তাই প্রায় সব দিক থেকেই অডিসি গেমটিকে বলা যায় একটি যোগ্য সিকুয়েল আর সিরিজের খ্যাতি ধরে রাখতে পারা এক চমৎকার ‘কামব্যাক’।
অ্যাসাসিন্স ক্রিড নিয়ে আরও পড়তে ক্লিক করুন এখানে: “অ্যাসাসিন্স ক্রিড: গেমের মাধ্যমে হারিয়ে যাওয়া ইতিহাসের গহীনে“।