২০২০ সালের কথা মনে হলেই হয়তো আমাদের ভেতরটা একটা মোচড় দিয়ে ওঠে! করোনা ভাইরাসের কারণে আমাদের সকলের জীবনযাপনই পরিবর্তিত হয়ে গিয়েছিল। কতকিছু দেখতে হলো আমাদের, বিশেষ করে আমাদের শিশুরা দেখেছে এক অন্যরকম পৃথিবী। স্কুল, কলেজ সব বন্ধ! সুযোগ ছিল না চিরচেনা সহপাঠীর পাশাপাশি বসে কথা বলার! তবুও এতকিছুর ভীড়ে ছিল ভালো কিছু ব্যাপার যা তাদের মানসিকভাবে বেড়ে উঠতে সাহায্য করার মতন ছিল। আর আনন্দের বিষয়টা হল সারা পৃথিবীর শিশুরা সেসব ভালো দিকগুলো গ্রহণও করেছে, যার ভেতর অন্যতম হলো বই। সেসব বই থেকে থেকে বাছাইকৃত কিছু বইয়ের তালিকা করেছে ওয়াশিংটন পোস্ট। সেগুলো নিয়ে থাকলো সামান্য আলোচনা।
ব্ল্যাক ইজ এ রেইনবো কালার (Black is a rainbow color)
বলা যেতে পারে বইটি একেবারে ছোট বাচ্চাদের জন্য, তবে মজার ব্যাপার হলো বইটি বড়দের মাঝেও ব্যাপক আলোড়ন তুলেছিল। বইটির ভেতর বলার মতো তেমন কোনো গল্প নেই কিন্তু অল্প অল্প কথায় আসে বিস্তৃত সব চিত্র আর সেসব চিত্র কালো রঙের নিখাদ সৌন্দর্য বয়ান করেছে। কালো পাখি,পাখির খাচা থেকে কতকিছু যে আঁকা হয়েছে যেন আমাদের শিশুরা কালো রঙের প্রতি মমতা নিয়ে বড় হতে শিখে। কালো রং অথবা কালো মানুষ যে আমাদের জীবনেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ তা যেন কখনো ভুলে না যায়। শিশুদের বয়সের সাথে সাথে মন মানসিকতায় বড় করে তুলতেই এই উদ্যোগ নিয়েছেন এঞ্জেলা জয় এবং অনলাইনে ব্যাপক আলোচনার দিকে তাকালে খুব সহজেই বুঝা যায় যে বইটির সৃষ্টি সফল।
শোয়াসবি এন্ড দ্যা সি (Swashby and the Sea)
ছোটদের জন্য চমৎকার এই বইটি লিখেছেন বেথ ফেরি। বইটি একদিকে যেমন নিউইয়র্ক টাইমসের বেস্ট সেলার আবার সেইসাথে ওয়াশিংটন পোস্টের বর্ষসেরা তালিকায়ও জায়গা করে নিয়েছে। বুঝাই যাচ্ছে শিশুদের মাঝে বইটি কেমন জনপ্রিয়তা পেয়েছিল। এবার আসি গল্পের কথায়। গল্পটি মিষ্টি আবার সমুদ্রের নোনা জলের মতো একটু ভিন্ন স্বাদেরও। ক্যাপ্টেন শোয়াসবি তার সমুদ্রের কাছাকাছি থাকা নির্মল শান্ত জীবনটাকে ভালবাসে, এভাবে দিন কাটিয়েই সে অভ্যস্ত কিন্তু একদিন তার প্রতিবেশি হিসেবে আসে এক ছোট্ট বালিকা আর তার দাদু। শোয়াসবির শান্ত জীবনে যেন শব্দের আগমণ ঘটে সব এলোমেলো করে দেয় তাই সে খুব করে চাচ্ছিল যেন তারা চলে যায় এমনকি সে সমুদ্রের বালিতে চলে যাওয়ার বার্তাও লিখে রাখতো যদিও ঢেউয়ের আনাগোনায় তা মুছে যাচ্ছিল! তবে কি সমুদ্র তাকে কিছু জানাতে চাচ্ছিল যা সে জানে না! না রহস্য গল্প মনে করার কারণ নেই তবে পুরো ঘটনা জানতে আমাদের গল্পের কাছেই যেতে হবে।
এ হোয়েল অব দ্যা ওয়াইল্ড (A Whale of the Wild)
এই চমৎকার বইটি লিখেছেন রোজেন পেরি। জলবায়ু পরিবর্তনের গল্পগুলোয় শুধু আমাদের কথাই উঠে আসে, আমাদের লাভ ক্ষতির ব্যাখ্যা বিশ্লেষণই হয়। তাই হয়তো লেখক একটু অন্য পথে হেটেছেন। অল্প কথায় এবার সেই গল্পটাই শোনাই। মূল কাহিনী একটি তিমি মাছের পরিবার নিয়ে, প্রধান চরিত্র ভেগাকে নিয়েই গল্পের যাত্রা শুরু হয়। সে এবং তার পরিবারের জীবন মূলত টিকে থাকে মাছ শিকারের দক্ষতার উপর।তাই সে প্রশিক্ষণ নিচ্ছিল যেন পরিবারের দায়িত্ব নিতে পারে কিন্তু হুট করে একদিন সমুদ্রে ভূমিকম্প আঘাত হানে যার কারণে তার ভাই হারিয়ে যায়। ভেগা তার সমস্ত দক্ষতা কাজে লাগিয়ে ভাইকে খুঁজতে শুরু করে আর এই খোঁজাখুঁজির ভিতর দিয়েই সে নতুন জীবনের দেখা পায়। হাঙ্গরের আক্রমণ, দূষিত পানিতে পথচলা মিলিয়ে এগিয়ে চলা কঠিন হতে থাকে। একে একে পাঠকের চোখে ধরা দিতে থাকে জলবায়ুর পরিবর্তন কীভাবে সমুদ্রে থাকা প্রাণীদের জীবন কঠিন করে দিচ্ছে, সেই কঠিন জীবন পাশ কাটিয়ে ভেগা কি পারবে পুরো পরিবারের এক করে সবার দায়িত্ব নিতে? চিন্তার কারণ নেই, গল্পটির পাতায় পাতায় আমরা সব রকম প্রশ্নেরই উত্তর পেয়ে যাব।
লোরেটা লিটল লুকস ব্যাক: থ্রি ভয়েসেস গো টেল ইট (Loretta Little Looks Back: Three Voices Go Tell It)
ঐতিহাসিক বিষয় নিয়ে লেখা বইয়ের কথা শুনলেই আমাদের মাথায় আসে বড়দের বইয়ের কথা। কিন্তু এই বইটি পুরোপুরি ব্যতিক্রম, কারণ বাচ্চাদের জন্যই এটি লেখা হয়েছে। যদিও মূল বিষয়বস্তু বাস্তব প্রেক্ষাপটের উপর ভিত্তি করে লেখা। পুরো বইটিতে তিন প্রজন্মের ঘটনা পর্যায়ক্রমে বর্ণনা করা হয়েছে। উনিশ শতকের শুরুর দিকে দাসের মতো জীবন যাপন থেকে একেবারে ১৯৬৮ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন অবধি বিস্তৃত হয়েছে। মানুষের এই পৃথিবীতেই মানুষ অসস্মান পেতো শুধুমাত্র গায়ের রঙ কালো হলে, এমন ভয়ংকর পরিস্থিতি একদিনে তৈরি হয়নি আবার এক দিনেই ভালোর দিকে পরিবর্তিত হয়নি। ধীরেধীরে অন্ধকার থেকে আলোতে আসার যাত্রাটা নিয়েই এই গল্প যদিও লেখক আন্ড্রিয়া ডেভিস পিঙ্কনি পুরোপুরি বাচ্চাদের উপযোগী করেই লিখেছেন তবে নিশ্চিতভাবে বড় পাঠকরা পড়লেও আগ্রহের সাথে জানতে পারবে ইতিহাসের সেসব কথা।
টুইনস (Twins)
এই গল্পটি একটু অন্যরকম। কেন বলছি? কারণ হিসেবে বলা যায়, এই বইটি মনে হয় বাচ্চাদের থেকে বেশি বড়রা আর কিশোররা পড়েছে। আমরা যদি ইন্টারনেট দুনিয়ায় ঘুরি তবে বিভিন্ন সাইটে দেখা যাবে বয়সে বড় এমন পাঠকদের নিজস্ব মতামত আছে হাজার হাজার, যেখানে তাদের কথা শুরুই হয়েছে বইটিকে অতুলনীয় বলে! এবার তাহলে গল্পটা একটু শুনে নেয়া যাক। দুই যমজ বোনের কাহিনী, যাদের খাবার থেকে পোশাকের পছন্দে মিল আছে, বন্ধুত্বও আছে কিন্তু ঠিক সিক্স গ্রেডে উঠার পর তাদের মাঝে একটু একটু করে দূরত্ব বাড়তে থাকে। ক্লাস প্রেসিডেন্ট পদের নির্বাচনে দাঁড়িয়ে যাওয়ার ফলে দুজনের আগের বন্ধুত্বও কেমন যেন ফিকে হতে শুরু করে।
পুরো গল্পে লেখক ভেরিয়ান জনসন আমাদের একটা প্রশ্নের ভিতর দিয়ে নিয়ে যাবে, বোনেরা কি আসলেই আজীবন সম্পর্ক টিকিয়ে রাখতে পারে? না কি মিডল স্কুলে এসে তা ধীরেধীরে কমতে থাকে? এসব প্রশ্নের উত্তর আর পুরো গল্পের স্বাদ গ্রহণ করতে আমাদের অবশ্যই যেতে হবে ‘টুইনস’র কাছে।
উই আর ওয়াটার প্রটেক্টরস (We Are Water Protectors)
এই বইয়ের নামটি ধরে যদি বলতে চাই তাহলে বলতে হয় আসলে আমাদেরও তা-ই হওয়া উচিত। পানি নিয়ে সতর্ক ও সচেতন থাকা উচিত। খুব ছোট ছোট বাক্যে চিত্রের সাহায্যে বইটিতে পানির অপর নাম যে জীবন সে কথাই শিশু মনে গেথে দিতে চেয়েছেন ক্যারল লিন্ডস্ট্রম। গল্পে দেখা যায় এক বিষাক্ত সাপ পানিতে বিষ মিশিয়ে দিতে চায় কিন্তু একজন বাচ্চা শপথ নেয় যে, সে পৃথিবীকে রক্ষা করবে কারণ পানি সুরক্ষিত না থাকলে পৃথিবীও থাকবে না। খুব অল্প কথায় এভাবেই প্রকৃতির টিকে থাকার মূল উপাদানের সুরক্ষার দিকে ইঙ্গিত করেছেন লেখিকা। আমাদের শিশুরা এই বিচার বোধ নিয়ে বড় হলেই তো এক একজন পানির মূল্য বুঝবে। এই বইয়ের একটি উক্তি না উল্লেখ করলেই নয়, যা শুধু ছোটদের নয় আমাদেরও মনে রাখা উচিত, “পানি হলো প্রথম ওষুধ, এটা আমাদের প্রভাবিত করে, সবাইকে একত্রিত করে।”
ফিনিশ দ্যা ফাইট (Finish the Fight)
বইটি কিছু সাহসী মানুষদের কথা বলার জন্যই লিখেছেন ভেরনিকা চেম্বার। এভাবে বললে হয়তো মনে হতে পারে একটু বড়দের জন্যই লেখা হয়েছে। আসলে তা নয়। বইটি মূলত সেসব নামেও আলো ফেলতে চেয়েছে যেসব নাম সবার মুখে মুখে নেই। নারীদের ভোট দিতে পারার অধিকার অর্জনের জন্য সে আন্দোলন সংগ্রাম হয়েছিল তার সাথে জড়িত কয়েকটি সাহসী নাম সবাই জানে কিন্তু তারা কোথায় যারা আফ্রিকান, এশিয়ান, ল্যাটিন হয়েও ভোটের অধিকারের জন্য যুদ্ধ করেছে? তাদের কথা চুপিচুপি স্মরণ করিয়ে দিতেই ‘ফিনিশ দ্যা ফাইট’ এর আয়োজন, আর ঠিক এজন্যই বইটি সম্পর্কে বলা হয়, আমেরিকান সাহসী নারীদের খুঁজতে হলে এখান থেকেই শুরু করা যেতে পারে। সে হিসেবে শিশুদের সাহসী করে তুলতে এবং ন্যায্য আদায়ের লড়াইয়ের সাথে জুড়ে থাকার প্রত্যয় দিতে চাইলে বইটি খুব ভালো একটি মাধ্যম হতে পারে।
দ্যা ওল্ড ট্রাক (The Old Truck)
দ্যা ওল্ড ট্রাকের লেখক দুজন। জ্যারেট পামফেরি ও জেরম পামফেরি। ছোট বাচ্চাদের জন্য একেবারে আদর্শ বই। পুরো বই জুড়ে আছে বড় বড় চিত্র আর ছোট ছোট বাক্য। একটি পুরো গল্পের সাথে দেখা না হলেও বইটি শিশুদের খুব বেশি ভালোর লাগার মতোই। অনন্ত আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম তা-ই বলে। শিশুদের কল্পনা শক্তির দারুণ প্রকাশ ঘটেছে প্রতিটি পাতায়। একটি পুরাতন ট্রাক নিয়ে নানান রঙের স্বপ্ন, ফার্মের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর কাজের প্রতি লেগে থাকার দৃঢ় প্রত্যয়, এ সব কিছুই আছে ছোট এই বইটিতে। একটু চোখ বুলিয়ে নিলেই যেন একটা রঙিন গল্পের ভ্রমণ হয়ে যায়! সহজ শব্দ আর সুন্দর সুন্দর চিত্রের বিন্যাসের কারণে বইটি প্রকাশের অল্প সময়ের ভেতরই বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছিল।
শেষের কথা
শিশুদের মানসিকভাবে বেড়ে উঠাকে নিশ্চিত করতে আমাদের অবশ্যই তাদের হাতে বই তুলে দেয়া উচিত, এমন বই যা তাদের আগ্রহকে ধরে রাখতে পারবে এবং তাদের উন্নত মানসিকতার মানুষ হিসেবে গড়ে উঠতে সাহায্য করবে সেজন্য আমরা নিঃসঙ্কোচে ওয়াশিংটন পোস্টের তালিকার দিকে হাত বাড়াতেই পারি।