‘দ্য লাস্ট ডুয়েল’ ভেটেরান পরিচালক রিডলি স্কটের এপিক পিরিয়ড ড্রামা। এই সিনেমার ধরন বাকি দশটা পিরিয়ড ড্রামার মতো হলেও এর মূল বিষয় একেবারেই ভিন্ন ধারার। চতুর্দশ শতাব্দীর এই ড্রামায় সিস্টেম্যাটিক মিসোজিনির কঠোর বিশ্লেষণ করা হয়েছে। সিনেমার কাহিনী ১৩৭০-৮৬ সালের মাঝে সংঘটিত। তখন নারীদের একমাত্র পরিচয় ছিল বাবার সম্পত্তি থেকে স্বামীর সম্পত্তিতে পরিণত হওয়া। এমন সমাজে লিঙ্গবৈষম্য, নারীবিদ্বেষ ছিল সমাজের ভিত্তির অংশ। এমনকি ধর্ষণকে ধর্ষণের শিকার নারীর বিরুদ্ধে নয়, বরং তার ‘মালিক’ যে পুরুষ, তার সম্পত্তির বিরুদ্ধে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হতো। এমনই এক সমাজে ঘটে যাওয়া এক ধর্ষণের কাহিনী নিয়েই ‘দ্য লাস্ট ডুয়েল’ তৈরি হয়েছে। সত্য ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত এই সিনেমায় দেখানো হয়েছে ফ্রান্সের রাষ্ট্র-অনুমোদিত শেষ ডুয়েলের ঘটনাবলী।
‘দ্য লাস্ট ডুয়েল’ সিনেমাটি ভাগ করা হয়েছে তিনটি চ্যাপ্টারে। তিন প্রধান চরিত্রের দৃষ্টিকোণ থেকে মুভির কেন্দ্রে ঘটে যাওয়া ধর্ষণের ঘটনা দেখানো হয়েছে। প্রথমে আমরা দেখতে পাই ম্যাট ডেমনের ‘স্যার জন ডি ক্যারুজ’-এর দৃষ্টিকোণ। ধর্ষণের শিকার লেডি মার্গারিটের স্বামী জন ডি ক্যারুজ— খুবই সাহসী, দাম্ভিক একজন নাইট, যার কাছে নিজের সম্মান সবচেয়ে দামী। জনের চ্যাপ্টারের নাম: ‘The truth according to Jean de Carrouges’।
তার প্রেক্ষাপটে যতক্ষণ আমরা থাকি, ততক্ষণ আমরা দেখতে পাই এই নাইটের কাছে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়াদি। সম্পত্তি, সমাজে নিজের স্থান, বিয়ে করে বংশধর তৈরি করা ইত্যাদি নিয়ে তার চিন্তাভাবনা; অন্তর্দ্বন্দ্ব, ঝগড়া-বিবাদ এসব নিয়েই এই অধ্যায়ের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত হয়। স্যার জনকে দিয়ে পরিচালক আমাদের সাথে পরিচয় করিয়েছেন সেই সময়ের সমাজের মতে একজন ‘গুড ম্যান’ বলতে কী মনে করা হতো। তৎকালীন সমাজের সকল বিধিনিষেধ মেনে নিয়েও জন তার স্ত্রী মার্গারিটের সাথে যথেষ্ট অমায়িক ও ভালোবাসার সম্পর্ক প্রদর্শন করে। এই চ্যাপ্টারের একদম শেষের দিকে জন জানতে পারে- তার এককালের বন্ধু, জাক লে গ্রি তার স্ত্রী মার্গারিটকে ধর্ষণ করেছে। বাকি সব দৃশ্যের মতো এই দৃশ্যও আমরা দেখি জনের দৃষ্টিকোণ থেকে। এখানে আমরা দেখি, মার্গারিট এই কথা বলার সাথে সাথে জন মার্গারিটকে বিশ্বাস করে এবং লে গ্রির বিরুদ্ধে প্রতিশোধের সিদ্ধান্ত নেয়।
এই একই দৃশ্য পরে যখন আমরা মার্গারিটের দিক থেকে দেখব, তখন যদিও পুরোপুরি ভিন্ন এক অংশ দেখতে পাব। সিনেমার এই পর্যায়ে শুধুমাত্র আমরা জনের চোখ দিয়ে সব ঘটনা প্রত্যক্ষ করেছি। এজন্যই আস্তে আস্তে আমরা বুঝতে পারি একই ঘটনা প্রত্যেকটি মানুষের জন্য কতটা ভিন্ন হতে পারে।
এরপরে আমরা যাই দ্বিতীয় অধ্যায়ে, জাক লে গ্রি’র অধ্যায়। এই চ্যাপ্টারের নাম: ‘The truth according to Jacques Le Gris’। এখানে আমরা দেখতে পাই সবচেয়ে বিরল দৃষ্টিকোণ, একজন ধর্ষকের দৃষ্টিকোণ থেকে ধর্ষণের ঘটনা। পরিচালক রিডলি স্কটের অসামান্য প্রতিভা ফুঠে উঠেছে এই চ্যাপ্টারে। আমরা দেখতে পাই ‘গ্যাসলাইটিং’-এর চরম একটি উদাহরণের সাথে ধর্ষকদের নিচু ও ক্রিমিনাল মানসিকতা। আরেকটা দিক আমাদের মনে করিয়ে দেয়া হয় যে, এই ধরনের মানুষগুলো নারীদের কেমন চোখে দেখে।
মার্গারিটের হাজার প্রত্যাখ্যান, অনুনয়-বিনয় যেন লে গ্রির চোখেই পড়েনি। আক্ষরিকভাবেই ‘চোখে’ পড়েনি, কারণ লে গ্রির দৃষ্টিকোণ থেকে আমরা যে ধর্ষণের দৃশ্য দেখি, সেটা বাস্তবে ঘটে যাওয়া ঘটনা থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। লে গ্রির কাছে মার্গারিট পরিপূর্ণ একজন মানুষই না, তাই মার্গারিটের হাজারো প্রত্যাখ্যান তার কানেই প্রবেশ করেনি। এমনকি, এই পুরো ঘটনা তার কাছে কোনো ব্যাপারই মনে হয়নি, যার কারণে এই চ্যাপ্টারে ধর্ষণের দৃশ্য লক্ষ্যণীয়ভাবে সংক্ষিপ্ত। যে ঘটনা ছিল মার্গারিটের জীবনের সবচেয়ে ট্রম্যাটিক এবং অসহ্যকর, সেটার ভার লে গ্রির কাছে নিতান্তই তুচ্ছ।
সিনেমার এই অংশটি দেখা খুবই দুর্বহ হলেও আমার মতে, খুবই গুরুত্বপূর্ণ ছিল এই দৃষ্টিকোণ সংযোজন করা। এখানেই আমরা ফার্স্ট হ্যান্ডে দেখতে পাই সমাজ কীভাবে, কত পর্যায়ে চেষ্টা করে ভিক্টিমদের কণ্ঠরোধ করতে। কীভাবে নারীদের মানুষ হিসেবে না দেখে আনুষ্ঠানিকভাবে কোনো পুরুষের সম্পত্তি হিসেবে গণ্য করা হতো। কীভাবে বিচার ব্যবস্থার প্রতিটি ধাপ ভিক্টিমদের বিরুদ্ধে কাজ করে। কীভাবে ধর্মের অপব্যবহার করা হয় ধর্ষক পুরুষদের পক্ষে। একদম তৎকালীন রাজত্ব, আমলাতন্ত্র, ধার্মিক প্রতিষ্ঠান ও বিচারতন্ত্রের গোড়ায় গিয়ে এসব বিষয়কে প্রকাশ করা হয়েছে।
এরপরের অধ্যায়, লেডি মার্গারিটের অধ্যায়ে সিনেমার সিংহভাগ পার করি আমরা। এই চ্যাপ্টারের স্ক্রিনটাইম এবং টাইটেলের মধ্য দিয়েই যথেষ্ট বলে দিয়েছেন নির্মাতারা। চ্যাপ্টারের নাম: ‘The truth according to Lady Margueirite’, কিন্তু এখানে টুইস্ট হলো চ্যাপ্টার টাইটেলটি ঝাপসা হয়ে যাওয়ার আগে ‘The truth’ শব্দ দুটি কিছুক্ষণ স্ক্রিনে ভেসে থাকে। এর মধ্য দিয়ে দর্শকদের জানানো হলো এখন আমরা যা দেখতে চলেছি এটাই আসল এবং সম্পূর্ণ সত্যি। এই চ্যাপ্টারে এখন পর্যন্ত দেখানো ঘটনাবলীর প্রায় পুরোটা দেখতে পাই লেডি মার্গারিটের দৃষ্টিকোণ থেকে এবং বিস্ময়ে হতবাক হতে হয় যে সত্যের কতটা হারিয়ে যায় মানুষের পক্ষপাত এবং সঙ্কীর্ণ দৃষ্টির কারণে। সিনেমার সবগুলো দৃশ্যেই অনেক বিস্তারিত অনুষঙ্গ এবং মর্মার্থ ছিল যা আমাদের আগের দুই প্রটাগনিস্টদের চোখেই পড়েনি। তাদের দৃষ্টিতে পৃথিবী যে আসলে কতটা সঙ্কীর্ণ সেটাই দেখানো হয়েছে এখানে।
এই চ্যাপ্টারেই আমরা মার্গারিটের দিক থেকে ধর্ষণের দৃশ্যটি দেখি। যে ঘটনা লে গ্রির চোখে মিনিটের মধ্যেই শেষ হয়ে গেছে, আসলে সেই ঘটনা পাঁচ মিনিটের ও বেশি সময় ধরে চলেছে। মার্গারিটের অনুনয়-বিনয়, শক্ত প্রত্যাখ্যান, সাহায্যের জন্য বারবার চিৎকার, সর্বোচ্চ শক্তি দ্বারা প্রতিরোধের চেষ্টা এসবই অনুপস্থিত লে গ্রির দৃষ্টিতে। এই দৃশ্যে জোডি কোমারের অভিনয়ের মতো হৃদয়বিদারক অভিনয় এ বছরে বিরল। প্রতিটি পরিস্থিতিকেই অনেক বেশি বাস্তবিক লেগেছে কোমারের নিখুঁত পারফরমেন্সের কল্যাণে।
আরেকটি চোখে পড়ার মতো বিচ্যুতি হচ্ছে স্যার জনকে মার্গারিটের ধর্ষণের কথা বলার পরে তার প্রতিক্রিয়া। আমরা জনের চ্যাপ্টারের দেখেছি প্রায় সাথে সাথে মার্গারিটকে বিশ্বাস করে লে গ্রির বিরুদ্ধে প্রতিশোধের শপথ করতে। কিন্তু আসল দৃশ্য অনেক বিস্তারিত এখানে। মার্গারিটকে অবিশ্বাস করা, ভিক্টিম ব্লেমিং করা থেকে শুরু করে শারীরিকভাবে আক্রমণ করার পরে তখনই জন প্রতিশোধের শপথ করেছে যখন তার নিজের অহংবোধে লেগেছে ঘটনাটি।
এই একটি দৃশ্যের মধ্য দিয়ে পরিচালক খুবই বাস্তবিক একটি দিক তুলে ধরেছেন। জন দ্য ক্যারুজ মার্গারিটকে সাপোর্ট করেছেন তখনই যখন তার নিজের গর্বে আঘাত লেগেছে এবং এই একটি কারণেই। কখনোই নিজের ধর্ষণের শিকার স্ত্রীর জন্য একবিন্দু সহমর্মিতা বা সহানুভূতির প্রকাশ দেখা যায়নি। এবং এটাই ছিল সিনেমার মূল আলোচ্য বিষয়। একটি ধর্ষণের ফলাফলে একজন নারীর সারাজীবন ওলটপালট হয়ে মানসিক, শারীরিক সকল দিকে অসামান্য ক্ষতির সৃষ্টি হয়, যা দেখা যায় এই সিনেমায় লেডি মার্গারিটের ক্ষেত্রে। কিন্তু এই ঘটনা নিয়ে যত আলোচনা, কথাবার্তা সব দুই পুরুষকে কেন্দ্র করে। যেন মার্গারিট এখানে কোনো বিবেচনার পাত্রই নন। সিনেমার সবচেয়ে প্রশংসনীয় দিক হচ্ছে খুবই স্পষ্টভাবে এই ব্যাপারগুলোর দৃষ্টিগোচর করা হয় দর্শকদের। ধর্ষণের শিকার নারীকে উপেক্ষা করে দুজন পুরুষ নিজেদের সম্মান ও গৌরবের জন্য ডুয়েল করছে— এই বিষয়টি যে মৌলিকভাবে গ্রহণযোগ্য নয় তা অকাট্যভাবে তুলে ধরা হয়েছে।
‘দ্য লাস্ট ডুয়েল’ সমাজের অন্তর্নিহিত নারীবিদ্বেষের সত্তা তুলে ধরেছে অত্যন্ত বাস্তবিক লেন্সে। চতুর্দশ শতকের চরম নারীবিদ্বেষী, পুরুষতান্ত্রিক সমাজের এক ঘটনা দিয়ে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে এই সত্ত্বা। তবে আফসোস বা দুঃখের বিষয় এই যে- এখানে ফুটিয়ে তোলা সেই কঠোর পুরুষতান্ত্রিক সমাজের সাথে আমাদের বর্তমান সমাজের পার্থক্যগুলো নিতান্তই প্রদর্শনমূলক। সমাজের চেহারা, রূপেরই পরিবর্তন হয়েছে, নারীদের বিরুদ্ধে ঘটে যাওয়া অন্যায়-অপরাধের মূলে যে কাঠামোবদ্ধ নারীবিদ্বেষ রয়েছে, তা এখনো আমাদের সমাজের অনেক বড় এক অংশ।