সম্প্রতি ভারতের ওয়েব সিরিজগুলো আন্তর্জাতিক বাজারে নাম করছে। নেটফ্লিক্স ভিত্তিক স্যাক্রেড গেমস দিয়ে শুরু। এরই ধারাবাহিকতায় এ বছর অনি সেন পরিচালিত ‘অসুর’ সিরিজটি এনেছে স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম ভূত। তার পরপরই অ্যামাজন প্রাইমে এসেছে অবিনাশ অরুণ ও প্রসিত রায় পরিচালিত ‘পাতাল লোক’। শেষেরটি আবার প্রযোজনা করেছে আনুশকা শর্মার প্রতিষ্ঠান ক্লিন স্লেট। আমাদেরকে এন.এইচ-টেন এর মতো সিনেমা উপহার দিয়েছে এই প্রতিষ্ঠানটি।
অসুর আর পাতাল লোক- দুটি সিরিজই প্রায় নিও-নয়্যার ঘরানার ক্রাইম থ্রিলার। অর্থাৎ এখানে প্রধান চরিত্রগুলো প্রায়ই বিদ্বেষ দোষে দুষ্ট এবং যথেষ্ট বক্র মানসিকতাসম্পন্ন। তথাকথিত ভিলেন তো বটেই, নায়কোচিত চরিত্রের মাঝে চলতে থাকা ভালো-মন্দের জটিল মিথষ্ক্রিয়ার মাঝ দিয়ে কাহিনীর অমোঘ পরিণতির দিকে এগিয়ে যায়। দর্শকরাও এই স্রোতে নিজের অজান্তেই মিশে যায়। তবে এই দুটি সিরিজের (এবং কিছুটা স্যাক্রেড গেমসেরও) একটি মৌলিক সাধারণ সূত্র হচ্ছে হিন্দু মিথলজির বর্ণিল প্রেক্ষাপট। পৌরাণিক মিথের সাথে বর্তমান সমাজের নানা অসঙ্গতি মিলিয়ে এক দারুণ টানটান কাহিনীবিন্যাসের মুন্সিয়ানা দেখিয়েছেন অনি সেন, অবিনাশ অরুণ ও প্রসিত রায়েরা।
যেহেতু এটা একটা ঘরানা হিসেবে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে, তাই আজ আমরা জেনে নেবো এই পাতাল লোক সম্পর্কে হিন্দু পুরাণসমূহে আসলে কী লেখা আছে। আর এই যে ভয়ংকর অসুর– এরাই বা কারা? কোথা থেকে এলো তারা? তাহলে চলুন, পুরাণ বা হিন্দু মিথলজির অসুর আর তাদের পাতাল লোকের বহুবর্ণিল জগত নিয়ে একটা ঝাঁকিদর্শন হয়ে যাক।
পুরাণের আলোকে গহীন লোকের সাকিন সন্ধান
পুরাণে এই মহাবিশ্বকে অনেকটা আধুনিক অট্টালিকার মতো স্তরে স্তরে বিভক্ত করে দেখা হয়েছে। মোটাদাগে সেখানে তিনটি স্তর বা ‘লোক’ আছে। স্বর্গলোক, পৃথিবী বা মর্ত্যলোক এবং পাতাল লোক। উপরের স্বর্গলোক আমাদের আলোচ্য নয়, আর পৃথিবী বা মর্ত্যলোকে তো আমরা আছিই। আমরা তাই সরাসরি চলে যাবো পাতাল লোকের সুলুক সন্ধানে।
পাতাল শব্দটির সন্ধিবিচ্ছেদ এরকম, পা + তাল। পা মানে আমাদের পদযুগল। আর তাল মানে নিচে। তার মানে ‘পাতাল’ শব্দের মানে ‘পায়ের নিচে’। সহজ ভাষায়, মাটির নিচে বা আন্ডারগ্রাউন্ড। আজকাল অপরাধীদের মাঝে মাঝেই যে আন্ডারওয়ার্ল্ড বলা হয়, বা অপরাধ-কর্মের পর অনেক অপরাধী গা ঢাকা দেয়, তাকে যে আন্ডারগ্রাউন্ডে যাওয়া বলে সেটার একটা যোগসূত্র পাতালের নামের সাথে জড়িয়ে থাকতে পারে। সেটা ওই সিরিজের নামকরণেও স্পষ্ট। তবে এখানে পার্থক্য হলো, পৌরাণিক জগতের বিন্যাস উল্লম্ব বা ভার্টিক্যাল। আর ‘পাতাল লোক’ সিরিজে অপরাধভিত্তিক শহরবিন্যাস আনুভূমিক বা হরাইজন্টাল।
পাতাল লোকের গঠন কেমন? আধুনিক পুরাণ বিশেষজ্ঞদের মতে, পাতাল লোকেরও আছে সাতটি স্তরভাগ। দেবী ভাগবত পুরাণ, বিষ্ণুপুরাণ ও অন্যান্য পুরাণাদিতে এর কাব্যিক বর্ণনা আছে। সংক্ষপে সেটা এ রকম।
প্রথমে, ঠিক মর্ত্যলোকের নীচেই অতল লোক। দানব ‘ময়’ এর ছেলে বালা এর শাসক। এই ময়দানবই পাণ্ডবদের (বিশেষতঃ সব্যসাচী অর্জুনের) প্রকোপে খান্ডবপ্রস্থকে সুশোভিত ইন্দ্রপ্রস্থে রূপান্তরিত করে তোলে। সে গল্প আরেকদিন।
এরপর বিতল। এখানকার রাজা হর-ভাব। পুরাণ অনুযায়ী, এখান থেকেই পাতাল লোকের বাকি ভাগে বহুলবর্ণিত সোনার মজুদ শুরু হয়। তারপর সুতল। ধার্মিক রাজা বালি এর শাসক। তিনি দেবলোক আক্রমণ করে দেবরাজ ইন্দ্রকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলেন। তখন বিষ্ণুর বামনরূপী পঞ্চম অবতার তাকে পরাজিত করে এই লোকে পাঠিয়ে দেন।
সুতলের নিচেই তলাতল। এটি প্রথম পাতাল লোক অতলের রাজা বালার পিতা ময়দানব বা মায়াসুরের সাম্রাজ্য। মেধাবী নগর-পরিকল্পনাকারী এই অসুরের তৈরী করা ত্রিপুর (তিন মায়া নগর) ধ্বংস করেন বলেই দেবাদিদেব মহাদেবের আরেক নাম ত্রিপুরান্তক।
এরপর মহাতল। এটি নাগলোক। মানে সাপেদের রাজত্ব। পুরাণের বিভিন্নস্থানে উল্লিখিত নাগসমূহ, যেমনঃ কালীয় (ভাগবত পুরাণে বর্ণিত) বা তক্ষক (মহাভারতের আদি পর্বে বর্ণিত) এরা এই তলেই সপরিবারে থাকে।
এবারে রসাতল। দৈত্য ও দানবের এলাকা। অনেক রকম বিদ্যা আর সুপ্রচুর সম্পদের মালিক এরা। তবুও প্রশান্তিহীন। উপরে বর্ণিত কিছু সংঘর্ষ থেকে আন্দাজ করা যায় যে, দেবতারাই এদের প্রধানতম শত্রু। আবারও সেই ভার্টিক্যাল অপারেশন্স।
সবশেষে পাতাল লোক। সর্বনিম্ন স্তর, রাজা বাসুকি (গরুড় পুরাণে বর্ণিত)। তার আনে এটাও নাগলোকের মতোই। সাপের মাথায় বহুমূল্য মণির ধারণা এই লোকের বর্ণনা থেকেই এসেছে।
দেবলোক (বা স্বর্গলোক) আর পাতাল লোকের বাসিন্দাদের তফাৎ কোথায়? দেবলোকে আনন্দ আর ভোগের ছড়াছড়ি। খেয়াল করলেই বোঝা যাবে, ঊর্বশী, রম্ভাদি অপ্সরাদের নিবাস দেবলোকেই। কিন্তু তারা সর্বদা আতংকে থাকে, কখন জানি পাতাল লোকের অসুরেরা এই চমৎকার বাতাবরণ আক্রমণে নষ্ট করে দেয়! অন্যদিকে পাতালের অসুররা সম্পদে সমৃদ্ধ। কিন্তু সোমরস পান করা অনন্ত যৌবনের অধিকারী দেবতাদের অফুরন্ত ভোগ-আনন্দে তারা প্রবলভাবে ঈর্ষান্বিত।
পুরাণকারেরা কি এভাবেই, রূপকের মাধ্যমে, এক অপ্রিয় সত্য বলে গেছেনঃ সম্পদের প্রাচুর্য (যা অসুর অধিকৃত) কিংবা বিনোদনের প্রাবল্য (যা দেবতাদের অধিকৃত) – এর কোনটাই স্থায়ী তৃপ্তি দিতে পারে না! দেখা যাক।
অসুর: জন্মই কি তার আজন্ম পাপ?
প্রশ্ন হচ্ছে, দেবতা আর অসুরের মাঝে এই দ্বৈরথের শুরু কোথায়। এটার সাথেই জড়িত অসুরের জন্মকথারও। ইন্ডোলজিস্টদের বিচারে আমরা সেখানেই যাবো।
পুরাণকথা অনুযায়ী, ব্রহ্মার পুত্র ঋষি কাশ্যপের দুই স্ত্রী, দিতি আর অদিতি। অদিতির সন্তানদের বলা হয় আদিত্য বা দেবতা। তাদের নিবাস ঊর্ধ্বে দেবলোকে। দিতির সন্তানদের বলে দৈত্য যারা থাকে পাতাললোকে। কোথাও কোথাও দিতিকে ‘দানু’ বলেও সম্বোধিত করা হয়েছে। সে অনুসারে তার সন্তানাদিকে দানবও বলা হয়ে থাকে। এই দৈত্য বা দানব নামের সমার্থক শব্দই অসুর।
দিতি আর অদিতির মাঝে কে স্বামী কাশ্যপের মনোযোগ বেশি পাবে, তা নিয়ে শুরু থেকেই দ্বন্দ্ব ছিল। অবধারিতভাবে, তাদের এই পারস্পরিক দ্বন্দ্বই সন্তানদের মাঝেও দ্বৈরথ তৈরি করে। তাই সৃষ্টির শুরু থেকেই বৈমাত্রীয় ভাইদের মাঝে, মানে দেবতা আর অসুরদের মাঝে, অগণিত সংঘর্ষ হয়ে আসছে। একেক সময় একেক ইস্যুতে, আবার কখনো কখনো সম্পূর্ণ অস্পষ্ট ইস্যুতে।
ঊর্ধ্বলোকে বা দেবলোকে দেবতাদের কী আছে দেখা যাক। ইচ্ছাপূরণকারী কল্পতরু, মানে যে গাছের কাছে যা চাওয়া যায় তাই পাওয়া যায়। আছে কামধেনু, প্রার্থীর সব ইচ্ছা পুরণ করে যে গাভী। আছে মহামূল্যাবান চিন্তামণি। আর আছে সঙ্গীতে পারদর্শী গন্ধর্বগণ আর নৃত্যে পারদর্শী অপ্সরা। এসবের কিছু না থাকায়, অসুররা দিন রাত কঠোর তপস্যা করে এগুলো পাবার জন্যে। মার্ক্সীয় ধারণার আদলে অনেকে তাই বলে, দেবতারা মোটামুটি বুর্জোয়া শ্রেণি বা শোষকের প্রতীক আর অসুররা শাসিত বা প্রলেতারিয়েতের। কিন্তু পুরাণ বিশ্লেষণ করলে এটাকে অতি-সরলীকরণ ছাড়া আর কিছুই মনে হয় না।
দেবতাদের অতকিছুর বিপরীতে, অসুরদেরও একেবারে কম কিছু নেই। পুরাণে পাতাল লোকের বিভিন্ন স্তরের বর্ণনায় আমরা দেখেছি একেক লোকে সোনা, মাণিক্য আর সম্পদের কোন ঘাটতি নেই। অসুরদের কাছে আছে স্থাপত্য বিদ্যা (যেমন: ময়দানবের কাছে), বহুমূল্যবান মণি (নাগ লোক আর পাতাল লোকে সাপেদের কাছে), আছে বিপুল সোনার সম্ভার (যেমন: বিতল লোকে), আছে এমনকি স্বাধীন নগর নির্মাণের সক্ষমতা (তলাতলের রাজা ময়দানবের ত্রিপুর নির্মাণ)। এছাড়াও অসুররা বিভিন্ন বিদ্যা, যেমন: সিদ্ধযোগ, তন্ত্রবিদ্যা ও মায়াবিদ্যায় সবিশেষ পারদর্শী।
অনেকে বলেন দেবতারা ছলনা করে সমুদ্রমন্থন করে পাওয়া অমৃত নিজেদের কাছে রেখে দিয়েছে। সেটা পান করেই তারা অনন্ত যৌবন লাভ করে অমর হয়েছে। দেবতাদের ঋষি বৃহস্পতি এই পুরো প্রক্রিয়ার অধিকর্তা। কিন্তু এখানেও কথা থেকে যায়। অসুরদের কাছেও তো আছে সঞ্জীবনী বিদ্যা যা দিয়ে মৃতদের জীবিত করা যায়। দানবাসুরদের ঋষি শুক্রাচার্য এই পুরো প্রক্রিয়ার নিয়ন্ত্রক। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ‘বিদায়-অভিশাপ’ গীতিনাট্যে বৃহস্পতি-পুত্র কচ, শুক্রাচার্য-কন্যা দেবযানী মনোরঞ্জন করে কিভাবে সেই বিদ্যা দেবলোকে নিয়ে যান, তার অতুলনীয় কাব্যিক বর্ণনা দিয়েছেন।
তাহলে দেবসুরের মাঝে লড়াইয়ের মূল কারণ কি? শুধুই কি পারস্পরিক ঈর্ষা? নাকি একে অন্যকে হারানোর জন্মান্ধ আক্রোশে ভাইয়ের দুই দল হত্যা আর ছলনার আশ্রয় নিচ্ছে সৃষ্টির শুরু থেকে?
পুরাণকারেরা বলছেন, অসুররা চায় দেবতাদের যা আছে, আর দেবতারা চায় অসুরদের যা আছে। দেবতারা নিজেদের অতুল ভোগের মাঝেও সুখী না। অসুররা নিজেদের অসীম সম্পদ নিয়েও তৃপ্ত না। দুই দলেরই আরও চাই। আগেই যেমন বলা হয়েছে যে, সম্পদের প্রাচুর্য (যা অসুর অধিকৃত) তাদের শান্তি দেয়নি। আবার বিনোদনের প্রাবল্য (যা দেবতাদের অধিকৃত) তাদের তৃপ্তি দিতে পারেনি। দেবাসুরের রূপক দিয়ে পুরাণকারেরা কি তবে মানব-মনের গহীনে থাকা চিরকালীন হাহাকার তুলে ধরেছেন, সম্পদের প্রাচুর্য বা অনিঃশেষ ভোগ, দিনশেষে কোনটাই স্থায়ী তৃপ্তি দেয় না।