পবিত্র কুরআনের সুরা মায়েদার ৩২ নম্বর আয়াতের বাংলা অনুবাদ এসেছে ‘নিঃশ্বাস’ সিনেমায়। পরিচালক রায়হান রাফি এই আয়াতের সূত্র ধরে দেখাচ্ছেন ‘নরহত্যা’র ব্যাপারে ইসলামের বিধি, নিরপরাধ কাউকে হত্যা করাকে গোটা মানুষজাতিকে হত্যার সমতুল্য বলা হয়েছে এই আয়াতে। প্রশ্নটা আসে পরিচালকের সূক্ষ্ম নজর নিয়ে। ‘নর’ শব্দ দিয়ে বাংলায় সাধারণ অর্থে পুরুষ বোঝানো হয়। ইসলামের এই মতবাদটি নর-নারী-যেকোনো লিঙ্গের, তথা যেকোনো মানুষকে হত্যার ক্ষেত্রেই একই মত দেয়। সিনেমার শেষ দিকের গানে মানবতার জয়গান দেখানো রায়হান রাফি এই আয়াতের অনুবাদে ‘নরহত্যা’ না বলে কি ‘মানুষ হত্যা’র কথা উল্লেখ করতে পারতেন না?
ওটিটি প্লাটফর্ম ‘চরকি’তে মুক্তি পেয়েছে রায়হান রাফির পরিচালনায় ওয়েব ফিল্ম ‘নিঃশ্বাস’। যেটিকে তিনি পরিচয় দিয়েছেন তার ‘এক্সপেরিমেন্ট’ হিসেবে। প্রয়াত চলচ্চিত্র নির্মাতা তারেক মাসুদের কাজ দিয়ে অনুপ্রাণিত রায়হান রাফি এই সিনেমায় অনেকটাই ‘রানওয়ে’ জনরার একটা মুসলিম-কেন্দ্রিক প্যারাডাইম নিয়ে গল্প হাজির করেছেন। একটি মধ্যবিত্ত দম্পতির বোঝাপড়া নিয়ে গল্পটি তৈরি হয়েছে। আধুনিক শিক্ষায় শিক্ষিত, বায়োকেমিস্ট্রি থেকে পড়ালেখা করা একজন যুবক, যিনি তার ব্যাংকের চাকরি ছেড়ে দিয়েছেন কিংবা যার চাকরি চলে গিয়েছে, তিনি হঠাৎ কড়া ধার্মিক হয়ে উঠছেন, তার বউকে বোরকা পড়ার তাগাদা দিচ্ছেন, শেষে ওতপ্রোতভাবেই জড়িয়ে পড়ছেন জঙ্গিবাদের দিকে। একসময় ওই যুবকের এমন কাজের সাথে যুক্ত হন তার স্ত্রী, যিনি পেশায় একজন নার্স। সেই নারী সংসারের টানাপোড়েন, সদ্যোজাত সন্তানের মৃত্যু এসবের ভেতর দিয়ে যেতে যেতে জীবন নিয়ে সন্দিহান হয়ে পড়েন। গল্পের সাথে সমান্ততালে এগোয় ঢাকার এক প্রেমিক-প্রেমিকার গল্প।
এই পুরো গল্পটিকেই ফ্ল্যাশব্যাকে তুলে ধরা হয়েছে একটি হাসপাতালের ভেতরে জঙ্গি হামলাকে বর্তমানে রেখে। সেই জঙ্গি হামলার পরিকল্পনাকারী ওই নার্স, সহযোগী তার স্বামী। সেই হামলায় কী ঘটে, হামলার পরের ঘটনাপ্রবাহ কোনদিকে মোড় নেয়, তা বরং দর্শকের দেখার জন্যই রেখে দেওয়া যাক। গল্পটা বেশ আগ্রহ জাগায়। সেই সাথে গল্পে ব্যবহৃত তথ্য, সমান্তরাল চরিত্রগুলো, গল্পের বাস্তবতার প্রমাণ সবই দারুণ। রায়হান রাফি এমন এক সময়ে এই সিনেমা বানিয়েছেন, যখন বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ইসলামোফোবিয়া নিয়ে অনেকে কথা বলছে, মানুষের বোঝাপড়ার জায়গাটা কিছুটা পরিস্কার হতে শুরু করেছে। আগে যেমন গড়পড়তা বাংলাদেশি সিনেমায় দাড়ি-পাঞ্জাবিসমেত মানুষগুলোকেই কেবল জঙ্গি হিসেবে দেখানো হতো, রায়হান রাফি তা থেকে বের হয়ে আসতে পেরেছেন। ‘ইসলামি লেবাস’ মানেই জঙ্গি আর ‘আধুনিক লেবাস’ মানেই প্রগতিশীল, এই বাইনারির বাইরে এসে পরিচালক দেখিয়েছেন দুই ক্ষেত্রেরই প্যারাডাইম শিফট হচ্ছে। এই বিবেচনাবোধ নিজেই ‘নিঃশ্বাস’ সিনেমাকে সিনেমার প্যারাডাইম শিফটের অংশ করে তুলেছে।
এই ওয়েবফিল্মের চিত্রনাট্য কিছুটা কাঁচা হাতে করা মনে হয়েছে। এত বেশি ফ্ল্যাশব্যাক, এত বেশি রোমন্থন দিয়ে সিনেমার গল্প এত অল্প সময়ে প্রতিষ্ঠা করা কেবল কষ্টকরই নয়, একরকম অসম্ভবও বটে। তবুও সেটাকে মানিয়ে নেওয়া যায় যদি ফ্ল্যাশব্যাকগুলো নিজেরাই তাৎপর্যপূর্ণ হয়। রাফি এই সিনেমায় তিনটি সমান্তরাল গল্প বলে গিয়েছেন তিনটিরই খণ্ড খণ্ড ফ্ল্যাশব্যাক দিয়ে। তাতে কোনো খণ্ডই মাথায় গেঁথে যাওয়ার মতো অবস্থায় পৌঁছাতে পারেনি। হায়! তিনি চেয়েছিলেন দর্শকের সময় বাঁচাতে, অথচ সময় নষ্টই হলো।
ডায়ালগের একটি উল্লেখযোগ্য অংশই ‘ক্লিশে’। মনে হচ্ছিল, কিছু একটা আওড়াতে হবে, তাই-ই যেন আওড়ে গেছেন সকলে। চাকরি থেকে আরো এক মাসের ছুটি নেবেন বলেছিলেন শামীম। তার স্ত্রী নিপা জিজ্ঞেস করলেন, সমস্যা হবে কিনা, তিনি এক কথায় উত্তর দিলেন ”না”, আর নিপা তা মেনেও নিলেন। একবিংশ শতাব্দীর এই কর্পোরেট রাজত্বের কালে কি কোনো প্রতিষ্ঠান তার একজন কর্মীকে তিন মাস ছুটিতে থাকতে দেয়! সুমাইয়ার বাবার সাথে টাকা নেওয়ার আলাপচারিতায় যে তৃতীয় নারীকে দেখা যায়, তিনি কে? তার এই অধিকারবোধের উৎস কী, তা পরিষ্কার করা হয়নি গল্পে।
স্ক্রিনপ্লেতে একের পর এক ফ্ল্যাশব্যাক, সাথে ট্রানজিশনে কাল স্ক্রিন এসব না থাকলে সিনেমাটি আরো বেশি উপভোগ্য হতো। নীলচে-সবুজাভ একটা ছাপ ছিল গোটা সিনেমাজুড়েই। মোবাইল কিংবা ল্যাপটপের স্ক্রিনে দেখার জন্য তা ভালোই। লাইটিংয়ের কাজ এক কথায় বলতে গেলে বলতে হয়, ‘উপভোগ্য’। শুরুর দৃশ্য দেখেই যে কেউ সবার আগে লাইটিংটাই খেয়াল করবেন। একদম শেষের দৃশ্যে যখন ‘ক্রেডিট নেইম’গুলো নিচ থেকে উপরে উঠছে, তখন এক কোনায় কিছুক্ষণ পর পর একটা বেগুনি আলো মিটিমিটি করবে। সেটিও খেয়াল করবেন। শেষ আর শুরুর মাঝখানের গোটা সময়েই লাইটিংটা প্রাণ দিয়েছে সিনেমাকে। আরেকটি জিনিস উল্লেখযোগ্য। তা হলো ‘প্রপস অ্যান্ড কস্টিউম’। সিনেমার সেটের সাথে প্রপস, কস্টিউমের চমৎকার একটা সমাহার তৈরি হয়েছে। ইমতিয়াজ বর্ষণের কস্টিউম, বাকি জঙ্গিদের কস্টিউম সবকিছুই যেন বাস্তবিকভাবে দেখাচ্ছিল আধুনিক ধারার নিষিদ্ধ ঘোষিত জঙ্গি সংগঠনগুলোকে।
এই সিনেমার সিনেমাটোগ্রাফিকে বাংলাদেশি সিনেমায় একটি নতুন রেফারেন্স বলা যায়। শুরুর দুই-তিনটি বড় বড় দৃশ্য ‘সিঙ্গেল টেকে’ নেওয়া হয়েছে। এমন না যে তাতে কেবলই কিছু আলাপচারিতা অথবা স্থির শট ছিল। প্রত্যেক শটেই বিশৃঙ্খলা ছিল, সহিংসতা ছিল, অনেকগুলো আলাদা আলাদা চরিত্র ছিল। সিনেমাটোগ্রাফার শেখ রাজিবুল ইসলাম চমকেই দিয়েছেন তার শৈলী দিয়ে। সেই সাথে কৃতিত্ব পাবে প্রোডাকশন দল। বিশেষ করে সেট, ফ্রেম এসবকিছু এত দারুণভাবে তারা নির্মাণ করেছেন প্রশংসা না করে উপায় নেই। শামীমরা যে রুমটায় থাকতেন তার ওয়াইড অ্যাঙ্গেল শটগুলো নেওয়ার সময়ে দরজাকে মাঝখানে রেখে দু’পাশের দেয়াল সহ ফ্রেম নেওয়া, কিংবা হাসপাতাল দেখানোর শটের অ্যাঙ্গেল, নিপা চরিত্রটির একের পর এক হাঁটার দৃশ্য নেওয়া- সবকিছুই যেন একেবারে ‘খাপে খাপ’।
সম্পাদনা আর গ্রাফিক্স ডিজাইনিংয়ের কাজ করেছেন সিমিত রায় অন্তর। সম্পাদনা তত বেশি ভালো বলা যায় না, ‘রাফকাট’ থেকেই মূলত সিনেমার দৈর্ঘ্য নিয়ে দোলাচল তৈরি হয়েছে বলে মনে হয়েছে। তবে গ্রাফিক্সের কাজ ছিল দারুণ। বিশেষ করে টাইটেলের নামগুলোর সজ্জা, ফন্ট, ‘নিঃশ্বাস’ এর নামের লোগোসহ বাকি সবকিছুতেই একটা রোমাঞ্চকর ব্যাপার উপস্থিত ছিল।
সিনেমার সাউন্ড ডিজাইনার ছিলেন রিপন নাথ। তিনি সবমিলিয়ে খুব ভালো করেছেন, এমনটা বলা যায় না। ডাবিং ভালো হয়নি। সাউন্ডেও কোথাও ‘অ্যামবিয়েন্স’ কম-বেশি, কোথাওবা ভয়েসের ভাবগাম্ভীর্যতার সাথে অভিব্যক্তি মিলছিল না, কোথাও নিঃশ্বাসের শব্দ নেই। ক্লোজ শটগুলোয় অভিব্যক্তির সাথে পার্থক্য রয়ে গেছে ভয়েসের। ভায়োলেন্সের গল্প, চিৎকারে সব ছেয়ে যাওয়ারই কথা। কিন্তু তার মানে তো এই নয় যে, আশেপাশে আর কোনো শব্দও থাকবে না।
ব্যাকগ্রাউন্ড মিউজিক দারুণ, ঝরঝরে। গল্পের সাথে মানানসইও বটে। কিন্তু সেই অ্যামবিয়েন্স-এর কমবেশটার কারণে একটা খটকা থেকেই যায়। গানগুলোও দারুণ। একটা সলো ট্র্যাক ছিল, বারবার শোনার মতো। আবহ সঙ্গীতও বেশ ভালো ছিল। মাশা ইসলাম আর জাহিদ নীরবের পরিণত কাজই বলা চলে। কিন্তু চরিত্র হিসেবে নিপার রূপান্তরের সময়ে যে ‘মাওলা ইয়া সাল্লি ওয়া সাল্লিম’ নাশিদের সুরটা বাজানো হয়েছে, তার উদ্দেশ্য পরিষ্কার নয়। এই নাশিদ বরং আধুনিক লিবারেল মুসলমানদেরকেই বেশি চিত্রিত করে, এবং তা একটা ‘পজেটিভ মেসেজ’ই বহন করে থাকে। এটা এমন একটা সময়ে স্ক্রিনে দেখানো হয়েছে, যতক্ষণে দর্শক বুঝে যাচ্ছে নিপার এই পরিবর্তন ভালো কিছু বয়ে আনবে না। এই জায়গাটি নিয়ে আমার ব্যক্তিগত প্রশ্ন থাকল।
অভিনয়ের কথা যদি বলতে হয়, তবে বলা যায় নিঃশ্বাস সিনেমাটি হলো তাসনিয়া ফারিণ আর ইমতিয়াজ বর্ষণের অভিনয়ের প্রতিযোগিতা। দুজনই যেন বারবার দুজনের সীমানাকে ভেঙে ভেঙে হাজির হচ্ছিলেন পর্দার সামনে। একদম শুরুর দৃশ্যেই শামীম অর্থাৎ ইমতিয়াজ বর্ষণ চশমা চোখে, লম্বা চুল নিয়ে, হাতে রাইফেল সমেত এমন এক অভিব্যক্তি নিয়ে হাজির হয়েছেন, তা চমকে ওঠার মতোই। অভিনয়ের ক্ষেত্রে ইমতিয়াজ বর্ষণের চোখই সবচেয়ে বেশি কথা বলে। তারপর কথা বলে তার নীরব অভিব্যক্তি। এই দুটো বিশেষত্ব এতই প্রকট যে, বাকি যতটুকু ডায়ালগ তা প্রচ্ছন্নই থেকে যায়। তবে ইমতিয়াজ বর্ষণ আরো ভালো করতে পারতেন, তার বিগত কাজগুলো সেটাই বলে। কিন্তু তার পূর্বশর্ত চিত্রনাট্যও ভালো হওয়া। হাসপাতালে হামলার পুরো সময়টাতেই বর্ষণ অভিনয়ে ছিলেন জ্বলজ্বল। আশরাফ ভাই তথা রাশেদ মামুন অপুর দিকে তাকানো, তারপর ইশারায় সিদ্ধান্ত নেওয়া- এসব দৃশ্যও মনে রাখার মতোই।
এখন পর্যন্ত তাসনিয়া ফারিণকে সবচেয়ে বেশি ভালো দেখা গেছে ‘লেডিস এন্ড জেন্টলম্যান’ ওয়েব সিরিজে। সম্ভবত তার অন্যতম কারণ, তিনি যথেষ্ট স্ক্রিন শেয়ার করতে পেরেছিলেন। ঠিক তেমনটাই দেখা যায় ‘নিঃশ্বাস’ সিনেমায়। ফারিণ একদম সাবলীলভাবে ‘ভাঙব তবু মচকাব না’ ধাঁচের অভিব্যক্তি ফুটিয়ে তুলতে পারেন সংকটময় মুহূর্তে। এটা তার বড় শক্তির জায়গা। স্বামীকে আহত অবস্থায় দেখেও আবার তার গুলি হাতে তুলে নেওয়ার দৃশ্যটিতে তার কাজ ছিল অসাধারণ। কমবেশি প্রত্যেকটি দৃশ্যেই বেশ প্রাণবন্ত ছিলেন তিনি, তার এই প্রচেষ্টা ছিল চোখে পড়ার মতো।
আকাশ-সুমাইয়ার সমান্তরাল গল্পটি একটি প্রয়োজনের অতিরিক্ত সংযোজন বলে মনে হয়েছে। তবুও সেটি আরো ভালো হতে পারত, যদি আকাশ চরিত্রে সায়েদ জামান শাওন আর সুমাইয়া চরিত্রে সাফা কবির যদি নিজেদের পুরোটাই ঢেলে দিতে পারতেন। শাওনের ট্যাটু করা শরীর, কস্টিউম সবই ভালো ছিল। চরিত্রটাও দারুণ। কিন্তু এই দুজনই অভিনয়ে পুরোটা দিতে পারেননি। রাশেদ মামুন অপু আশরাফ ভাই চরিত্রে বেশ ভালো করেছেন। কিন্তু এধরনের প্রোটাগনিস্ট চরিত্র যতটুকু ‘ঠান্ডা ধাঁচের’ হওয়া দরকার তা হতে পারেননি তিনি। এটি চিত্রনাট্যেরই দায় বলে মনে হয়েছে। দিলারা জামান, ফারজানা ছবি, নীল হুরেজাহান- তারা সবাই-ই যার যার জায়গা থেকে ভালো করেছেন।
‘নিঃশ্বাস’ সিনেমার গ্রহণযোগ্যতা এই যে, এই সিনেমা সময়কে ধারণ করার চেষ্টা করেছে। এই সিনেমা বাংলাদেশের মুসলিম ‘পপ কালচার’ নিয়ে সমসাময়িক একটি বড় দলিল, যে কালচারে সামাজিকভাবে ‘রেডিক্যাল ইসলাম’ জনপ্রিয় হয়ে উঠতে পারেনি। সিনেমায় দেখা যায়, ধর্মীয় এবং সামাজিক উভয় বিচারেই ‘নিষিদ্ধ’ সম্পর্কে থাকা ডাক্তার যুগলও রোগীকে আল্লাহর কাছে সাহায্য চাইতে বলে। আর তা দেখে একজন প্রতিক্রিয়াশীল জঙ্গিরও বোধোদয় হয়, সে ভুল ছিল। নিপার মতো বিভ্রমের মাঝে থাকা মেয়েরাও নিজেদের বিশ্বাস করাতে পারে, নিরপরাধ মানুষ মারার নাম ইসলাম নয়। ‘নিঃশ্বাস’ সে জায়গায় সফল। এই সিনেমা আধুনিক উগ্রপন্থী জঙ্গিদের সন্ত্রাসের পুঙ্খানুপুঙ্খ ‘ন্যারেটিভ’ ধরতে পারেনি হয়তো, কিন্তু এই সাহসী কাজের সাধুবাদ না জানালে অন্যায় হবে।