গডফাদার; বেশ গম্ভীর, শিহরণ জাগানিয়া অনেকগুলো বিষয় প্রকাশ করার জন্য যদি কোনো শব্দ থাকে, তবে এই শব্দের মাঝে সেটা আছে। গডফাদার শব্দের উচ্চারণেই আমাদের কল্পনায় ভেসে ওঠে এমন একজন ব্যক্তির অবয়ব, যিনি লোকচক্ষুর অন্তরালে থেকে সমাজের অনেক ঘটনার কলকাঠি নাড়েন। সাধারণ মানুষের সাথে ‘গডফাদার’ নামের সেই প্রভূত ক্ষমতাধর আবছায়া চরিত্রটিকে খুব একটা ঘেঁষতে দেখা যায় না। এজন্য চিরকালই তিনি সাধারণ মানুষের কাছে একজন আগ্রহোদ্দীপক ব্যক্তিত্ব। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীও কোনো অদৃশ্য বেড়াজালে বন্দী হয়ে তাকে ঘাটাতে সাহস পায় না।
গডফাদারেরা নিজেদের অঘোষিত সাম্রাজ্য গড়ে তোলেন রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলার প্রতি বুড়ো আঙুল দেখিয়ে। নাগরিক-সমাজের প্রত্যাশা থাকে রাষ্ট্র তাকে বিপদের সময়ে রক্ষা করতে এগিয়ে আসবে, ন্যায়বিচার ও সামাজিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে। কিন্তু রাষ্ট্র সাধারণ নাগরিকের প্রতিনিধি না হয়ে যখন সমাজের উঁচু তলার স্বার্থ রক্ষার হাতিয়ারে পরিণত হয়, তখন স্বাভাবিকভাবেই দুটি রাস্তা খোলা থাকে আমজনতার সামনে। হয় বিপ্লবের মাধ্যমে পুরো ব্যবস্থার মূলোৎপাটন, নয়তো রাষ্ট্রকে সকল নাগরিকের সমান সুবিধা নিশ্চিত করতে বাধ্য করা।
এসবের বাইরেও নাগরিকের স্বার্থ সংরক্ষণের দায়িত্ব নিয়ে একদল মানুষের উত্থান ঘটতে পারে, যারা রাষ্ট্রের অক্ষমতার সুযোগ নিয়ে নিজেরাই আরেকটি রাষ্ট্র গড়ে তোলে, জনগণকে ন্যায়বিচারের আশ্বাস দিয়ে বসিয়ে রাখবে না, সেটা নিশ্চিত করতেও কিছুটা তৎপর থাকবে। ইতিহাসে সিসিলিয়ান মাফিয়াদের উত্থান আমাদের সামনে সেদিকটিই উন্মোচিত করে দেয়।
মারিও পুজোর ‘দ্য গডফাদার’ পৃথিবীর সবচেয়ে পঠিত, বিক্রিত উপন্যাসগুলোর একটি। এই উপন্যাসের উপর ভিত্তি করেই মুভি ট্রিলজি তৈরি হয়েছে, যেগুলো প্রতিটিই ব্যবসাসফল। ধারণা করা হয়, ইংরেজি ভাষাতেই প্রায় তিন কোটি কপির বেশি বিক্রি হয়েছে এই উপন্যাসটি। ক্রাইম ফিকশন ঘরানার কল্পনাশ্রয়ী এই উপন্যাসের পরতে পরতে উত্তেজনা ছড়িয়ে আছে, যা পাঠককে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা ধরে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে; কখনও স্নায়ুর চাপ বাড়িয়ে দেয়, কখনও গভীর ভাবনার জগতে নিয়ে যায়। অপরাধজগতের অনেকগুলো ‘সত্য’কে সাধারণ মানুষের সামনে এসেছে এই উপন্যাসের কল্যাণে। পুজোর লেখনীতে মনে হবে আপনি যেন ১৯৫০ এর দশকের ম্যানহাটনের রাস্তায় হাঁটছেন, মাফিয়া পরিবারগুলোর ক্ষমতার লড়াই নিজ চোখে প্রত্যক্ষ করছেন।
উপন্যাসের প্রেক্ষাপট গেল শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ের, যখন ক্রমশ জাতীয়তাবাদ মাথা চাড়া দিয়ে উঠছে, উপনিবেশবাদের কফিনে শেষ পেরেকটি ঠোকা হচ্ছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। নিউ ইয়র্কের আন্ডারওয়ার্ল্ডে ডন ভিটো কর্লিয়নি ও তার পরিবার কীভাবে বাকি মাফিয়া পরিবারগুলোকে সমানে টেক্কা দিয়ে নিজেদের বিশাল প্রভাব-প্রতিপত্তির বলয় গড়ে তুললো, নিজেদেরকে আর সবার থেকে আলাদা করে সবচেয়ে ক্ষমতাধর হয়ে উঠল, তার চমৎকার ধারাবাহিক বর্ণনা পাওয়া যায় উপন্যাসে।
একটি পরিবারের উত্থান, সময়ের ব্যবধানে প্রতিপত্তি কমে যাওয়া, ব্যবসার আধিপত্যে অন্যান্য পরিবারগুলোর সাথে তুমুল লড়াই, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কিংবা রাজনীতিকদের হাতে রাখা– সবকিছুই উঠে এসেছে এই এক উপন্যাসে। একজন অর্থনৈতিকভাবে অসচ্ছল, পারিবারিক চাপে থাকা লেখক মারিও পুজো যেভাবে নিখাঁদ কল্পনার আশ্রয় নিয়ে একটি উপন্যাসেই আমেরিকান-ইতালিয়ান আন্ডারওয়ার্ল্ডের পরিস্থিতি সম্পর্কে ঠান্ডা মাথায় পাঠককে ভাবতে শিখিয়েছেন, তা এককথায় অনন্য।
দ্য গডফাদার উপন্যাসের ডন ভিটো কর্লিয়নি কৈশোরেই মৃত্যু-পরোয়ানা মাথায় নিয়ে সিসিলি থেকে পালিয়ে আসেন। তার বাবাকে অত্যন্ত নির্মম কায়দায় গুলি করে মারে সিসিলির সেই সময়ের মাফিয়ারা। পূর্ণবয়স্ক হলে ভিটো কর্লিয়নি হয়তো বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নেবেন– এরকম ভাবনা থেকে তার বাবার খুনিরা কর্লিয়নিকেও হয়তো মেরে ফেলতেন। সেটি বিবেচনা করে কর্লিয়নির প্রাণরক্ষার খাতিরে তাকে আমেরিকায় পাঠিয়ে দেয়া হয়।
সিসিলির মাফিয়াদের উদ্ভব ঘটে রাষ্ট্রের অক্ষমতা, সরকারের প্রতি জনগণের বিতৃষ্ণার সুযোগ নিয়ে। জনগণ যখন দেখতে পেল রাষ্ট্র তার দায়িত্ব থেকে সরে এসে অভিজাতদের হাতের পুতুলে পরিণত হয়েছে, তখন জনগণ মাফিয়াদের উত্থানে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে, তাদেরকে ত্রাণকর্তা হিসেবে বরণ করে নেয়। মাফিয়ারা অপরাধ কর্মকান্ড কিংবা অনৈতিক ব্যবসায় জড়িত থাকলেও সাধারণ মানুষের তাতে খেদ ছিল না।
গডফাদার ভিটো কর্লিয়নি আমেরিকায় এসে একটি সাধারণ নির্ঝঞ্ঝাট জীবন চেয়েছিলেন, বাবার রাস্তায় পা বাড়াতে তার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা ছিল না। কিন্তু সামাজিক ও আর্থিক পরিস্থিতি এমন হয়ে দাঁড়াল যে, তার পক্ষে অপরাধের নিকষ কালো জগতে পা না বাড়িয়ে আর উপায় ছিল না। অপরাধ সংঘটিত হওয়ার পেছনে অর্থনৈতিক কারণ সবসময় যুক্ত থাকে, কর্লিয়নির অপরাধ জগতে পা দেয়ার ঘটনা সেটিকেই চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয়।
নিউ ইয়র্কে মাত্র মাত্র সাতশো ডলারের জন্য এক গুন্ডাকে হত্যা করার মধ্যে দিয়ে কর্লিয়নির অপরাধের হাতেখড়ি হয়। এরপর অসংখ্য মানুষ হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছে কিংবা তার নির্দেশে স্রেফ হাওয়া হয়ে গিয়েছে।
ডন কর্লিয়নি যখন নিউ ইয়র্কে আর পাঁচটা পরিবারের প্রবল প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে ম্যানহাটনের বিশাল সাম্রাজ্যের অধিপতি হয়ে বসলেন, তখন যে তিনি সাধারণ মানুষের থাকে আলাদা হয়ে থাকবেন, সেটা একেবারেই প্রত্যাশিত বিষয়। কিন্তু তিনি সেরকম হননি, সাধারণ মানুষ বিপদে-আপদে তার সাক্ষাৎ পেত। তিনি একেবারেই গম্ভীর হয়ে যাননি, আবার আত্মমর্যাদা হারিয়ে সস্তাও হননি। তার দেয়া প্রতিশ্রুতি কখনও ভঙ্গ হতে দেখেনি নিউ ইয়র্কবাসী।
তিনি কখনোই চাইতেন না তার সন্তানেরা তাদের বাবার পথে পা বাড়াক। কারণ কর্লিয়নি দেখেছিলেন সেই পথ অনেক মানুষের রক্তের ছোপ ছোপ দাগ দিয়ে গড়া, অনেক নির্মমতার স্বাক্ষী হতে হতে তৈরি হওয়া। এই পথে জীবন টিকিয়ে রাখা অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এই পথে শত্রুপক্ষের একটি বুলেটেই জীবনের হিসাব-নিকাশ সব চুকে যেতে পারে, সমস্ত মানবীয় চঞ্চলতা নিশ্চল হয়ে যেতে পারে। তাই কর্লিয়নির পুত্ররা বাবার পথে গিয়ে নিজেদের জীবন বিপন্ন করুক, এটা কোনোভাবেই তিনি চাইতেন না।
ডনের বড় ছেলে সনি কর্লিয়নি ছিল বাবার চেয়েও বেশি নিষ্ঠুর, বেশি বেপরোয়া। ডন কর্লিয়নি যুক্তি দিয়ে সমস্ত ঝামেলার মোকাবিলা করতেন, নিজের মাথা ঠান্ডা রাখতেন। কিন্তু সনি কর্লিয়নি নিজেকে দানবীয় শক্তির অধিকারী হিসেবে কল্পনা করে বাস্তবে এর প্রতিফলন ঘটাতে চেষ্টার ত্রুটি রাখত না। তার নিষ্ঠুরতাকে ডন কর্লিয়নির প্রতিপক্ষ নিউ ইয়র্কের বাকি পাঁচ পরিবার ভয় পেতো। কিন্তু নিজের গোয়ার্তুমির জন্য তার আর শেষরক্ষা হয়নি, প্রতিপক্ষের সুপরিকল্পিত ফাঁদে পা দিয়ে বেঘোরে প্রাণটা হারাতে হয়।
গডফাদারের আরেক ছেলে মাইকেল কর্লিয়নি বাবার পেশায় আসতে চায়নি। সবার কাছ থেকে সম্মান পাওয়া গডফাদারের কথার সাথে দ্বিমত করতে একমাত্র মাইকেলই, সেই সাহস তার ছিলো। কলেজে পড়ে নিজের ক্যারিয়ার গড়তে চেয়েছিল, প্রথা ভেঙে প্রেম করেছিল একজন নেটিভ আমেরিকানের সাথে। কিন্তু বিভিন্ন ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে তার আর নিজের ক্যারিয়ার গড়ে তোলা হয়নি। তাকে পরিবারের হাল ধরতে হয়, ভিটো কর্লিয়নির অবসরের পর তাকেই ডন বানানো হয়। ঠান্ডা মাথা, নিখুঁত পরিকল্পনা ও বিচক্ষণতা তাকে ভিটো কর্লিয়নি-পরবর্তী ডন হতে বেশ সাহায্য করে।
রাষ্ট্রের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সাথে ডনের সম্পর্ক ভালো। ডনকে নিজের স্বার্থেই পুলিশকে হাতে রাখতে হয়। উপন্যাসে দেখা যায় অসংখ্য অপরাধ করার পরও ডনের লোকদের কখনও নিউ ইয়র্কের পুলিশ ঘাঁটাতে সাহস পায় না।
ডনের দার্শনিকতা পাঠককে ভাবাবে, এ কথা নিশ্চিতভাবে বলা যায়। তিনি গোয়ার্তুমির আশ্রয় না নিয়ে নিজের মানবিক যুক্তি খাটিয়ে সমস্যার সমাধান কিংবা কোনো কৌশল হাতে নেন উপন্যাসে। তার ছেলে সনি কর্লিয়নিকে নির্মমভাবে হত্যার পরও হতভম্ব হয়ে রাগের মাথায় কোনো প্রতিশোধ নেননি, বরং শান্তি প্রতিষ্ঠার আলোচনার আয়োজন করে বাকি পরিবারগুলোর সাথে সমঝোতা করেন। উপন্যাসের আরও অনেক জায়গায় দেখা যায়- ডন কর্লিয়নি চাইলেই তুমুল আক্রোশের সাথে প্রতিপক্ষকে নিশ্চিহ্ন করতে পারেন কিংবা নির্মম প্রতিশোধ নিতে পারেন। কিন্তু তা না করে তিনি সুযোগের অপেক্ষায় থাকেন। তাকে একজন ঠান্ডা মাথার গডফাদার হিসেবে উপন্যাসে নিপুণভাবে চিত্রায়িত করা হয়েছে।
বেশ বড় আকারের এই উপন্যাসের প্রতিটি পাতা পাঠককে ভাবায়, উত্তেজিত করে, পরের পাতায় চোখ বোলানোর জন্য পাঠক উন্মত্ত হয়ে থাকে। ডন কর্লিয়নির দার্শনিকতা, মাফিয়া পরিবারগুলোর ক্ষমতার লোভে নোংরা লড়াই, সনি কর্লিয়নির নৃশংস গোয়ার্তুমি কিংবা ডনের ছেলে মাইকেলের সাথে নেটিভ আমেরিকান মেয়ের প্রণয় পাঠককে বুঁদ করে রাখে। হলিউডের কথাও উপন্যাসে উঠে এসেছে। মাফিয়াদের হাত এতটাই প্রশস্ত যে হলিউডকেও ডনের কাছে আত্মসমর্পণ করতে হয়।
ইতালিয়ান-আমেরিকান মাফিয়া পরিবারগুলোর ভেতরের খবর জানতে, তাদের জীবন সম্পর্কে সম্যক ধারণা পেতে ‘দ্য গডফাদার’-এর চেয়ে ভালো কোনো উপন্যাস আর হয় না।
অনলাইনে কিনুন- দ্য গডফাদার