১৭৬৪ সাল। বক্সার যুদ্ধ পরবর্তী এক বৃষ্টিস্নাত বিকেলে শেরগড় দুর্গের বাইরের বিশাল বটগাছে ইংরেজরা কোম্পানি বাহাদুরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করা ভারতীয়দের ফাঁসিতে চড়াচ্ছে— এমনটাই ছিল লাল কাপ্তান সিনেমার ওপেনিং সিকোয়েন্স। আর পেছনে পতৌদির নবাব সাইফ আলি খানের ভরাট কণ্ঠে ধারা বিবরণী। লাল কাপ্তান সিনেমাটি তার প্রথম দৃশ্য থেকেই দর্শকের মনোযোগ আকর্ষণে সমর্থ হয়। এই সিনেমাটি মুক্তি পায় ২০১৯ সালে, পরিচালনা করেছেন নবদ্বীপ সিং, যিনি এর আগে ‘মনোরমা ৬০ ফিট আন্ডার’ ও ‘এন এইচ ১০’ এর মতো সিনেমা বানিয়েছেন, যুক্ত ছিলেন ‘পাতাল লোক’ নামের অসাধারণ সিরিজটির দলেও।
দুই ঘণ্টা পঁয়ত্রিশ মিনিট লম্বা এই সিনেমাটির জনরা হলো ওয়েস্টার্ন। ভারতীয় সেট আপে ওয়েস্টার্ন ঘরানার একটা সিনেমার গল্প ভাবা ও সেটাকে সূচারুভাবে পর্দায় তুলে ধরার কাজে পরিচালক শতভাগ সফল। গোঁসাই নামের এক নাগা সাধুর প্রতিশোধ নেবার রাস্তা ধরে সিনেমাটি এগিয়ে যেতে থাকে। বলে রাখা ভালো গোঁসাই কোনো নাম না। নাগা সাধুদের কোনো নাম নাকি থাকে না। ‘গোঁসাই’ শব্দটির অর্থ হলো ঠাকুর। গোসাঁই বলে ডাকা তাই সম্বোধন হিসেবেই ব্যবহার হয়েছে।
সিনেমা পরিচালনার পাশাপাশি, এর গল্প ও চিত্রনাট্য দুটোই লিখেছেন নবদ্বীপ সিং। ১৮ শতকের সময়ে ইংরেজ কোম্পানি যখন পুরো ভারতে প্রভাব বিস্তার করতে শুরু করেছে, সেই সময় রাজস্থানের মরুভূমিতে প্রতিশোধের নেশায় ঘুরে বেড়াচ্ছে এক দুর্ধর্ষ নাগা সাধু— এই গল্পটিকে নবদ্বীপ যেভাবে কল্পনা করেছেন ও উপস্থাপনা করেছেন তা প্রশংসার দাবিদার। তিনি গল্পের প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত গোঁসাইয়ের পরিচয়, ও কেনইবা সে রেহমত খানের উপর প্রতিশোধ নিতে চায়, সেই সাসপেন্স ধরে রাখতে পেরেছেন। আমরা সবসময় সময়কে উপজীব্য করে বানানো সিনেমাগুলোতে বাস্তবতা বা সেই সময়ের যে ঐতিহাসিক ঘটনা ঘটেছিল সেগুলোর ছোঁয়া দেখতে পাই।
আবার এমন সিনেমা বা সিরিজ আছে যেগুলো ঐতিহাসিকভাবে অনেক আগের সময়ের প্রেক্ষাপটে বানানো; কিন্তু সেই সময়ের ইতিহাসের সাথে সম্পৃক্ত নয়; যেমন, ভাইকিংস, গেম অফ থ্রোন্স। ব্রেকিং ব্যাড সিরিজটার কথা ধরা যাক, সেখানে যে ঘটনাগুলো দেখানো হয়, সেগুলো কাল্পনিক হলেও তার প্রেক্ষাপট কিন্তু আমাদের চেনা, কিন্তু জর্জ আর আর মার্টিন গেম অফ থ্রোন্সে যে জগত সৃষ্টি করেছেন তার রাজনীতি, সম্পর্ক, নৈতিক টানাপোড়েন আমাদের পরিচিত গণ্ডির ভেতরে হলেও প্রেক্ষাপট ও আবহ কিন্তু একেবারেই আলাদা, অচেনা।
বলতে গেলে জর্জ রেমন্ড মার্টিন তার একটা কাল্পনিক পৃথিবীই তৈরি করেছেন। এই একই চেষ্টাই করেছেন নবদ্বীপ সিং। তার লেখা লাল কাপ্তানেও এমন অন্য এক পৃথিবীর স্বাদ পাওয়া যায়। আমাদের উপমহাদেশের যে সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য ও ঐতিহাসিক প্রাচুর্য্য, তাতে কেন এর আগ পর্যন্ত কেউ এই চেষ্টা করলো না— এটা বিস্ময়কর। আশা করা যায় নবদ্বীপের দেখানো পথে আরো অনেকে উপমহাদেশ নিয়ে ‘ফিকশনাল ওয়ার্ল্ড’ তৈরির চেষ্টা করবে।
এই সিনেমার প্রাণ ভোমরা হলেন সাইফ আলি খান। গোসাঁই চরিত্রটা মনে হয় না তার থেকে ভালোভাবে কেউ ফুটিয়ে তুলতে পারতো। গোসাঁই চরিত্রটির ভেতরের যে ক্রোধ, আকাঙ্ক্ষা সেটা সাইফ সাবলীলতায় ফুটিয়েছেন। তার হাঁটা, ঘোড়ায় চড়া থেকে অ্যাকশন সিকোয়েন্স— সবগুলোতেই সাইফ ছিলেন অনবদ্য। সাইফ যে, কোনো চরিত্রের মৌলিক বৈশিষ্ট্যলোকে ধারণ করতে পারেন— তার প্রমাণ আমরা ‘দিল চাহতা হ্যায়’ এর সামির, ‘ওমকারা’ এর ল্যাংড়া ত্যায়াগীর চিত্রায়ণে পেয়েছি।
সাইফের বিপরীতে অভিনয় করেছেন মানব ভিজ, রেহমত খান চরিত্রে। তিনিও তার অভিনয়ে স্বচ্ছন্দ ছিলেন। তার ক্রূর চাহনী, হিমশীতল কণ্ঠস্বর সবই রেহমত খান চরিত্রটিকে পূর্ণতা দিয়েছে। ধূর্ত, বিশ্বাসঘাতক, ও নিজের আখের গোছাতে ব্যস্ত এক এন্টাগনিস্টের চরিত্রে মানব ভিজ একদম মানিয়ে গিয়েছিলেন। সিনেমায় অনুসরণকারী চরিত্র দীপক দোবরেয়াল নিজের সেরাটা দিয়েছেন। তার কমিডিক টাইমিংয়ের পরিচয় আমরা ‘তানু ওয়েডস মানু’-তে পেয়েছি, লাল কাপ্তানে তা পূর্ণতা পেয়েছে। তাই বলে আবার তিনি কোনো ভাড়ামি করেননি বা জোর করে হাসানোর ও চেষ্টা করেননি। তার চরিত্রটি তিনি খুবই নিপুণভাবে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছেন।
একজনের কথা না বললেই নয় তিনি হচ্ছেন, ভিভা রাণী যিনি লাল পরী চরিত্রটি করেছেন। তিনি খুবই কম সময়ের জন্য পর্দায় ছিলেন কিন্তু সেটুকুর মধ্যেই নিজেকে একেবারে নিংড়ে দিয়েছেন। রেহমত খান ও তার সহধর্মিনী যখন তার কাছে যায়, তাদের সন্তানের ভবিষ্যৎ গণনা করতে তখন আমরা তাকে দেখি। তবে ওই একবারই, এরপর আর তার দেখা মেলেনি। ওইটুকু সময়েই ভয়েস মডুলেশন, এক্সপ্রেশনের সাথে ওই দৃশ্যের পরিবেশ সব মিলিয়ে একটি পরাবাস্তব আবহ সৃষ্টি হয়েছিল।
অভিনয় ও গল্প ছাড়াও এই সিনেমা একটা টেকনিক্যাল ব্রিলিয়ান্স। বিশেষ করে সিনেমাটোগ্রাফি তো অসাধারণ; লোকেশন, কালার গ্রেডিং সবই একদম উৎকৃষ্ট। এই সিনেমাটির সিনেমাটোগ্রাফার হলেন বর্ষীয়ান ও অভিজ্ঞ শংকর রমন। লাল পরীর কাছে ভবিষ্যৎ গণনার দৃশ্য, অন্ধকারে আফগানদের সাথে গোসাঁইর যুদ্ধ, বৃষ্টির মধ্যে ফাঁসির দৃশ্য, যমুনা নদী দিয়ে পাথরের খাড়ির ধার ঘেঁষে ভেলা চালানোর সময় পেছন থেকে সাইফ আলি খানের ভেসে ওঠা ছাড়াও অনেক চোখে লেগে থাকার মতো দৃশ্য আমাদের উপহার দিয়েছেন রমন সাহেব। সিজিআই প্রযুক্তির বদলে বাস্তব লোকেশনের ব্যবহার, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জিনিস মনে রাখা ও সূক্ষ্মভাবে তুলে ধরা সব মিলিয়ে সিনেমাটি মনে দাগ কাটবে অবশ্যই। তবে কিছু কিছু জিনিস একটু চোখে লেগেছে; পিন্ডারিদের সাবপ্লট অথবা বারবার রেহমত খানকে বাগে পেয়েও গোঁসাইর তাকে ছেড়ে দেয়া এগুলো চাইলে বাদ দেয়া যেত। তাহলে রানটাইম আধঘণ্টার মত কমতো।
বলিউডে ইতিহাস নির্ভর অনেক ছবি হলেও এমন ছবি এর আগে কখনো বানানো হয়নি। ইংরেজদের শাসনামলের শুরুর দিকের সময়কে উপজীব্য করে একটা ওয়েস্টার্ন ওয়ার্ল্ড তৈরি করে ফেলা মোটেই সহজ কাজ নয়। পরিচালক নবদ্বীপ সিং তো এজন্য ধন্যবাদ পাবেনই, বরং এমন আরো কাজের প্রত্যাশা তৈরি হয় সিনেমা ইন্ডাস্ট্রির কাছে।