১৯৫৯ সালে প্রকাশিত হয় রবার্ট ব্লকের হরর উপন্যাস ‘সাইকো’। ১৯৫৭ সালের নভেম্বরে উইসকনসিনের প্লেইনফিল্ড থেকে দুই নারীকে হত্যার দায়ে গ্রেপ্তারকৃত এড গেইনের ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে উপন্যাসটি লিখেছিলেন ব্লক। সমালোচকরা সাদরেই গ্রহণ করেছিল উপন্যাসটি। বিশেষত, নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত পজিটিভ রিভিউ ছিল উপন্যাসটির জন্য এক পরম প্রাপ্তি।
তবে সমালোচকদের প্রশংসার বৃষ্টিতে ভিজলেও, শুরুতে বাণিজ্যিকভাবে খুব একটা লাভের মুখ দেখেননি ব্লক। কারণ, বুকস্টোরগুলোতে বইটির কাটতি ছিল না আহামরি কিছু। ব্লক যখন ‘সাইকো’-র স্ক্রিপ্ট নিয়ে হলিউডের প্রযোজকদের দ্বারে দ্বারে ঘুরছিলেন, তখনো বারবার কেবল প্রত্যাখ্যাতই হতে হচ্ছিল তাকে। কেউই আগ্রহী ছিল না তার স্ক্রিপ্টটি কিনতে।
ফলে এ যেন অনেকটা নিয়তি নির্ধারিতই ছিল যে, অন্য অধিকাংশ সাহিত্যের মতো, ব্লকের ‘সাইকো’-ও হারিয়ে যাবে কালের গহবরে। কেউ মনে রাখবে না উপন্যাসটি। তবে না, ‘সাইকো’-র পথপরিক্রমায় অপেক্ষা করে ছিল আরো বড় একটি টুইস্ট। যে টুইস্টের কথা স্বয়ং ব্লকও ঘুণাক্ষরেও চিন্তা করতে পারেননি!
টাইমসে প্রকাশিত রিভিউটি চোখে পড়েছিল হিচককের। ঠিক ধরেছেন, বলা হচ্ছে হলিউডের নামি চলচ্চিত্র নির্মাতা আলফ্রেড হিচককের কথাই। শুধু রিভিউটিই নয়, তিনি পড়ে ফেলেন মূল উপন্যাসটিও। আর তারপরই তার মাথায় খেলে যায় এক আশ্চর্য চিন্তা, যা অন্তত তখনকার দিনে অস্বাভাবিক হিসেবেই গণ্য হত।
হিচকক ঠিক করে ফেলেন, উপন্যাসের স্বত্ত্বটি কোনো প্রযোজনা সংস্থার হাতে পড়তে দেবেন না। কিনে নেবেন তিনি নিজেই। এবং সেই ভাবনা থেকেই, নিজের গাঁটের সাড়ে ৯ হাজার ডলার খরচ করে, তিনি পেয়ে যান ‘সাইকো’-র চলচ্চিত্র নির্মাণ স্বত্ত্ব।
তবে হিচকক স্বত্ত্ব কিনে নেয়ার পরও কিন্তু তাৎক্ষণিকভাবে উপন্যাসটির জনপ্রিয়তা বাড়েনি। কারণ হিচকক নিজেই তা হতে দেননি। তিনি মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন, এই কাহিনীর প্রায় পুরোটাই নির্ভর করে আছে এর সারপ্রাইজ এন্ডিংয়ের উপর। কেউ যদি সেই সারপ্রাইজ এন্ডিংয়ের কথা আগেভাগেই জেনে যায়, তাহলে তো তার যাবতীয় পরিশ্রম মাঠে মারা যাবে!
হিচকক ততদিনে ইতোমধ্যেই বিশ্বনন্দিত চলচ্চিত্র নির্মাতা। তার প্রতি গণমাধ্যমের রয়েছে ব্যাপক আগ্রহ। তিনি জানতেন, কোনোভাবে যদি একবার ফাঁস হয়ে যায় যে তিনি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একটি উপন্যাসের স্বত্ত্ব কিনে নিয়েছেন, তাহলে সেটি নিয়ে সংবাদ প্রচারিত হবেই। আর সেই সংবাদ প্রচারিত হওয়ার পর, অতি-উৎসাহী অনেকেই হুমড়ি খেয়ে পড়বে উপন্যাসটি পড়ার জন্য।
এমন কিছু যাতে না হয়, সেজন্য আগাম সতর্কতা হিচককের ছিল। ফলে ‘সাইকো’-র স্বত্ত্ব তিনি নিজের নামে কেনেননি। কিনেছিলেন ছদ্মনামে। জেনে অবাক হবেন, এমনকি ব্লকও জানতেন না কে সেই মহামানব, যিনি এত ডলারের বিনিময়ে কিনে নিচ্ছেন তার উপন্যাসটির স্বত্ত্ব!
এরপরও কোনো একভাবে মিডিয়া পাড়ায় চাউর হয়েই যায়, হিচককের পরবর্তী ছবি নির্মিত হতে চলেছে একটি উপন্যাসের কাহিনী অবলম্বনে। ফলে সবার মুখে তখন একটিই প্রশ্ন: কোন সেই উপন্যাস? হিচকক কাউকে নামটি বলেন না।
তবুও হিচককের মনের ভয় দূর হয় না। তিনি আশঙ্কা করেন, শেষমেশ কেউ-না-কেউ নিশ্চিতভাবেই দুইয়ে দুইয়ে চার মিলিয়ে ফেলবে, উদ্ঘাটন করে ফেলবে যে ‘সাইকো’ অবলম্বনেই নির্মিত হচ্ছে হিচককের পরের ছবি। (আসলেও, ছবিটির ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক ঘোষণার আগেই একদল সাংবাদিক পৌঁছে গিয়েছিলেন সত্যের অনেকটাই কাছাকাছি। তারা প্রতিবেদন করেছিলেন, ছবিটির নাম নাকি হবে ‘সাইকি’!)
তখন হিচকক ভাবতে শুরু করেন, এমন কী করা যায়, যাতে ‘সাইকো’ উপন্যাসটির কথা লোকে জেনে ফেললেও, সেটি পড়া এবং সারপ্রাইজ এন্ডিং সম্পর্কে জেনে যাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব না হয়?
অনেক ভাবনা-চিন্তা করে এরও একটি সমাধান বের করে ফেলেন হিচকক। তিনি তার দীর্ঘদিনের সহকারী পেগি রবার্টসনকে নির্দেশ দেন, প্রকাশকের কাছে বইটির যত কপি আছে, এবং বিভিন্ন বুকস্টোরেও যত কপি ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে, সব যেন কিনে ফেলার ব্যবস্থা করা হয়।
সেই নির্দেশনা অনুযায়ী, আসলেই বাজার থেকে ‘সাইকো’-র প্রায় সব কপি তুলে ফেলার ব্যবস্থা করা হয়। তাই অন্তত ‘সাইকো’ চলচ্চিত্র আকারে মুক্তির আগে, উপন্যাসটি খুব বেশি লোকের পক্ষে পড়া হয়ে ওঠে না। ছবিটির সারপ্রাইজ এলিমেন্টও অক্ষুণ্ণ থাকে।
তাছাড়া ছবিটি নির্মাণকালে হিচকক প্রযোজনা সংস্থা প্যারামাউন্টের থেকেও যথাসম্ভব দূরত্ব বজায় রাখার চেষ্টা করেন। তার আশঙ্কা ছিল, মূল কাহিনীটি জেনে ফেললে প্যারামাউন্টের কর্মকর্তারা সেটি চেপে রাখতে পারবেন না। কাহিনীর স্পর্শকাতর বিষয়বস্তু নিয়েও তারা আপত্তি তুলতে পারেন। তাই তিনি তাদেরকে জোসেফ স্টেফানোর তৈরি করা ছবির চিত্রনাট্যটি পর্যন্ত দেখাননি। প্রায় অন্ধের মতোই হিচককের উপর আস্থা রেখে ৮ লক্ষ ডলারের বাজেট অনুমোদন করে দেয় প্যারামাউন্ট কর্তৃপক্ষ।
‘মাস্টার অব সাসপেন্স’ খ্যাত হিচকক তখন ছবিটির সাথে যুক্ত করেন এডিটর জর্জ থমাইসিনি এবং কম্পোজার বার্নার্ড হারমানকে। এছাড়া সিনেমাটোগ্রাফির জন্য নিয়োগ দেন জন এল রাসেলকে, যেন কম খরচে অথচ দ্রুততম সময়ের মধ্যে শুটিং সম্পন্ন করা যায়।
আরো একটি মজার ব্যাপার হলো, প্যারামাউন্ট প্রযোজিত হওয়া সত্ত্বেও, ‘সাইকো’-র শুটিং হয় ইউনিভার্সাল স্টুডিওসের সেটে। এখানেও কাজ করে হিচককের প্যারামাউন্ট কর্তৃপক্ষ থেকে দূরে থাকার প্রবণতা। তিনি কী করছেন না করছেন, সে ব্যাপারে যেন প্যারামাউন্টের নির্বাহী কর্মকর্তারা কোনো আঁচ না পান, সেজন্যই এমন অদ্ভুত সিদ্ধান্ত।
এমন গোপনীয়তা বজায় রাখতে চাওয়ায় হিচককের পক্ষে এই ছবির জন্য চিরাচরিত সম্মানী লাভ সম্ভব হয়নি। তবে সেই ক্ষতি তিনি পুষিয়েও নিয়েছিলেন বিশাল অঙ্কের ব্যাক-এন্ড ডিলের মাধ্যমে। কী সেটি, তা জানাব খানিক পরেই।
থিয়েটারে বসে ‘সাইকো’ দেখার ক্ষেত্রেও হিচকক এক নতুন নিয়মের জন্ম দেন। তখনকার দিনে দেখা যেত, যার যখন খুশি থিয়েটারে প্রবেশ করছে। কেউ হয়তো একটি ছবির দ্বিতীয়ার্ধ্বে থিয়েটারে প্রবেশ করল, ছবির ক্লাইম্যাক্স দেখল, তারপর পরবর্তী শোয়ে প্রথমার্ধ্বের মিস করা অংশগুলো দেখে নিল— অনেকটা এমন ছিল ব্যাপারটা। কিন্তু হিচকক জানালেন, অন্তত ‘সাইকো’ দেখার ক্ষেত্রে এমন যাচ্ছেতাই কাণ্ডকারখানা চলবে না।
এর পেছনে হিচককের যুক্তিতে আবারো ঘুরে-ফিরে এলো ছবির সারপ্রাইজ এন্ডিংয়ের প্রসঙ্গ। তার দাবি, ছবির এন্ডিংটাই তো সবচেয়ে জরুরি। আর সেই এন্ডিংকে পুরোপুরি বুঝতে গেলে একদম শুরু থেকে ছবিটি দেখতে হবে। তা না করে কেউ যদি আগেই এন্ডিং জেনে যায়, তারপর শুরু থেকে আবার খানিকটা দেখে, এতে কাহিনীর মূল স্বাদ থেকে সে বঞ্চিত হবে। এর ফলে অন্য অনেকের কাছেও কাহিনীটি স্পয়েল হয়ে যাবে।
তাই ‘সাইকো’-র মাধ্যমেই হিচকক নতুন নিয়ম প্রচলন করলেন : ছবি প্রদর্শনী শুরু হবার পর কেউ আর থিয়েটারে প্রবেশ করতে পারবে না। অর্থাৎ ছবির মাঝখান থেকে দেখা শুরু করলে হবে না, একদম গোড়া থেকেই দেখতে হবে!
অনেকের কাছেই, এমনকি হিচককের অনেক সহকর্মীর কাছেও, তার এরূপ আচরণ ও কর্মকাণ্ড বাড়াবাড়ি মনে হলেও, শেষ পর্যন্ত কিন্তু হিচককের এই প্রচেষ্টা বৃথা যায়নি। প্রমাণিত হয়েছে, তিনি যা করেছেন ভালোর জন্যই করেছেন। তাই তো হিচককের ৫৩টি চলচ্চিত্রের মধ্যে, ‘সাইকো’-ই সবচেয়ে বেশি আলোচিত। হিচককের নাম উচ্চারিত হলে অবধারিতভাবেই চলে আসে ‘সাইকো’-র নামও! বিশ্ব চলচ্চিত্র ইতিহাসের সেরা ছবিগুলো, বিশেষত হরর-সাসপেন্স ঘরানার শ্রেষ্ঠ ছবিগুলোর তালিকা করতে বসলে, শুরুর দিকেই থাকে ‘সাইকো’।
শুধু তা-ই নয়, বক্স-অফিসেও ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল ১৯৬০ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ছবিটি। ৫০ মিলিয়ন ডলার আয় করে এটি। অর্থাৎ আজকের দিনের হিসাবে প্রায় ৬০০ মিলিয়ন ডলার। আর পূর্বোল্লিখিত ব্যাক-এন্ড ডিলের সুবাদে, হিচককের নিজের ব্যাংক অ্যাকাউন্টে ঢোকে ৬ মিলিয়ন ডলার, যা তৎকালীন সর্বোচ্চ। সমালোচকরাও উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে ছবিটির। হিচকক অ্যাকাডেমি অ্যাওয়ার্ডে পান সেরা পরিচালকের মনোনয়ন। এছাড়া জ্যানেট লেইয়ের ভাগ্যেও জোটে সেরা পার্শ্ব-অভিনেত্রীর মনোনয়ন।
শুরু করেছিলাম ব্লককে দিয়ে। শেষও করা যাক তাকে দিয়েই। ‘সাইকো’-কে চলচ্চিত্রে রূপদান করে হিচকক যতটা নাম কামিয়েছেন, মূল উপন্যাসটি লিখে ব্লক তার ছিটেফোঁটাও পাননি। তাতে হয়তো তার মনে কিছুটা আক্ষেপ থাকতেই পারে। কিন্তু এ কথাও অনস্বীকার্য যে, হিচককের ছবিটির বদৌলতেই ‘সাইকো’ কাহিনীটির জনপ্রিয়তা উঠেছিল তুঙ্গে, যে কারণে ব্লক মূল উপন্যাসের দুইটি সিক্যুয়েল প্রকাশের সাহস পেয়েছিলেন।
১৯৮২ সালে প্রকাশিত হয় ‘সাইকো টু’ এবং ১৯৯০ সালে প্রকাশিত হয় ‘সাইকো হাউজ’। দুটোর কোনোটিই অবশ্য বেস্টসেলার হতে পারেনি। সেগুলো রূপান্তরিত হয়নি বড় পর্দায় চলচ্চিত্র হিসেবেও।