আধুনিক মুভি স্টারের মৃত্যু বর্তমান হলিউডের অন্যতম আলোচ্য বস্তু। বড় তারকার নামের কারণে এখন আর মুভির টিকেট বিক্রি হয় না। মুভিতে বড় তারকা মানেই বক্স অফিসে সাফল্য- এমন গ্যারান্টি দিনে দিনে উবে যাচ্ছে। ব্র্যাড পিটের মুভি যখন বক্স অফিসে পাত্তা পায় না, তখন তো এই বিষয় নিয়ে গভীর আলোচনায় যাওয়াই যায়। মুভি স্টারের এই সংকট বুঝতে হলে আগে জানতে হবে মুভি স্টার মূলত কী, কীভাবে শুরু হলো এই প্রথা, হলিউড ইন্ডাস্ট্রির গঠনপ্রণালি, ইন্ডাস্ট্রির পরিবর্তন কীভাবে মুভি স্টারের প্রতিপত্তিকে প্রভাবিত করছে ইত্যাদি বিষয় নিয়েই। এসব আলোচনাই আজকের লেখার বিষয়বস্তু। সাথে আলোচনা হবে হলিউডের বর্তমান পরিস্থিতি এবং মুভি স্টারের ভবিষ্যৎ নিয়ে।
মুভি স্টার কী?
দর্শকদের কাছে সুপরিচিত অভিনেতা-অভিনেত্রী, যারা সচরাচর মুভিতে লিড বা প্রধান ভূমিকায় অভিনয় করেন, তাদেরই মুভি স্টার তকমা দেয়া হয়। এই স্টার বা তারকাদের নাম ব্যবহার করা হয় মুভির বিজ্ঞাপনে, পোস্টারে, ট্রেইলারে। দর্শকদের কাছে তাদের খ্যাতি মুভির টিকেট বিক্রিতে সাহায্য করে।
সকলের সাথে তো এই বর্ণনা মেলে না। এখানেই আসে তারকা আর অভিনেতার পার্থক্য। মুভি স্টারদের পরিচিতিই একেকটা ব্র্যান্ড, যেকোনো চরিত্রকে তারা নিজেদের করে নেন। আর অভিনেতারা চরিত্রের মাঝে হারিয়ে যান। অভিনেতার পরিচিতির থেকে যে চরিত্রে অভিনয় করছেন সেই চরিত্র প্রাধান্য পায়। এটাই মূলত মুভি স্টার আর অ্যাক্টরের মধ্যে পার্থক্য।
প্রথম মুভি স্টার
হলিউডের প্রথম মুভি স্টার ছিলেন ফ্লোরেন্স লরেন্স নামক এক নির্বাক চলচ্চিত্রের অভিনেত্রী। লরেন্সের মুভি স্টার হওয়ার ঘটনা খুবই চমকপ্রদ। তিনি মুভিতে কাজ শুরু করেন ‘Birth of a Nation’-খ্যাত পরিচালক ডি ডব্লিউ গ্রিফিথের বায়োগ্রাফ কোম্পানির হয়ে। ১৯০৯ সালের মধ্যে পঞ্চাশের বেশি মুভির লিড রোলে থাকা সত্ত্বেও দর্শকরা লরেন্সের নাম জানত না। বায়োগ্রাফ কোম্পানি ইচ্ছাকৃতভাবে তার নাম জনসাধারণের কাছ থেকে লুকিয়ে রাখত। এটা তৎকালীন হলিউডে অতি প্রচলিত এক প্রথা ছিল। তারকাখ্যাতি পেয়ে গেলে অভিনেতাদের যে অতিরিক্ত ক্ষমতা, প্রভাব তৈরি হবে তা ঠেকানোর জন্য স্টুডিওগুলো অভিনেতাদের নাম দর্শকদের কাছে পৌঁছাতে দিত না। এমনকি মুভির ক্রেডিটেও কোনো অভিনেতার নাম থাকত না।
এই প্রথার মাঝেই প্রথম মুভি স্টারের জন্ম হয় কার্ল লেইমলি নামক এক স্টুডিও মগুলের হস্তক্ষেপে। বায়োগ্রাফ কোম্পানি লরেন্সকে বরখাস্ত করে দিলে লেইমলি তাকে নিজের কোম্পানি IMP-তে নিযুক্ত করেন। ১৯১০ সালে লেইমলি লরেন্সকে ‘পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ মুভিং পিকচার অ্যাক্ট্রেস’ হিসেবে বর্ণনা করেন। IMP প্রযোজিত এক সিনেমাতেই হলিউডে প্রথমবারের মতো ক্রেডিটে লরেন্সের নাম দেখা যায় অভিনেতা হিসেবে। এই ফ্লোরেন্স লরেন্স শুধুমাত্র হলিউডের প্রথম মুভি স্টারই ছিলেন না, তিনি একাধারে টার্ন সিগন্যাল ও ব্রেক লাইটেরও উদ্ভাবক। অন্যদিকে, কার্ল লেইমলি পরবর্তীতে ইউনিভার্সাল স্টুডিওজ এবং হলিউডের স্টার-সিস্টেম প্রতিষ্ঠা করেন।
সোনালী যুগের মুভি স্টার
সাইলেন্ট ফিল্ম বা নির্বাক চলচ্চিত্র থেকে সাউন্ড এবং টেকনিকালারের হাত ধরে ১৯৩০-এর দশকে শুরু হয় হলিউডের গোল্ডেন এইজ। এই সোনালী যুগ উপহার দিয়েছে ‘The Wizard of Oz’, ‘Gone with the Wind’, ‘Casablanca’, ‘Citizen Kane’-এর মতো ক্ল্যাসিক সিনেমা। সোনালী যুগের পেছনে আরেকটি বড় চালকশক্তি ছিল হলিউডের বিগ ফাইভ স্টুডিওর আবির্ভাব। MGM, Paramount, Fox, Warner Bros, RKO- এই পাঁচটি মেজর স্টুডিও হলিউডে প্রভাববিস্তার করে। এই যুগের বড় বড় মুভি স্টারদের পেছনে ছিল এই পাঁচ স্টুডিও। সব স্টুডিও নিজেদের চুক্তিতে তারকাদের রাখতেন যারা বক্স অফিসে সাফল্যের নিশ্চয়তা হিসেবে কাজ করতেন। ক্যারি গ্র্যান্ট, জেমস স্টুয়ার্ট, গ্রেস কেলি, পল নিউম্যান, ইনগ্রিড বার্গম্যান, অড্রি হেপবার্ন, জেমস ডিন, ম্যারিলিন মনরো, হামফ্রি বোগার্ট, এলিজাবেথ টেইলরের মতো কিংবদন্তিতুল্য মুভি স্টারের জন্ম দিয়েছিল এই গোল্ডেন এইজ। মুভি স্টারদের তারকাখ্যাতি সর্বোচ্চ পর্যায়ে ছিল এই যুগে, কারণ স্টুডিওগুলো তাদের তারকাখ্যাতির উপর নির্ভরশীল ছিল ব্যবসায়িক সাফল্যের জন্য।
ইন্ডাস্ট্রির উপরে মেজর পাঁচ স্টুডিওর হস্তক্ষেপ বাড়তে বাড়তে একপ্রকার মনোপলির সৃষ্টি হয়। স্টুডিওগুলো এমনভাবে মার্কেট নিয়ন্ত্রণ করতে থাকে যে এই পাঁচ স্টুডিওর বাইরে অন্য কারো মুভি থিয়েটারে কোনো স্ক্রিনই পেত না। এমতাবস্থায় ১৯৪৮ সালে আমেরিকার সুপ্রিম কোর্ট Anti-trust Legislation এর মাধ্যমে পাঁচ স্টুডিওকে ভেঙে দেয়। এই রায়ের কল্যাণে ১৯৬০-এর দিকে স্টুডিও সিস্টেমের সাথে হলিউডের গোল্ডেন এইজের পতন ঘটে। সোনালি যুগের অধিকাংশ মুভি স্টারও ’৬০-এর দশকের মধ্যে হারিয়ে যান। একটা শূন্যস্থান তৈরি হয় মেইনস্ট্রিম সিনেমায় এই পর্যায়ে এসে। এই সময়েই আবর্তন ঘটে নিউ হলিউডের।
নিউ হলিউডের মুভি স্টার
সোনালী যুগ-পরবর্তী শূন্যস্থান পূরণ করতে আবির্ভাব ঘটে স্টিভেন স্পিলবার্গ, জর্জ লুকাস, মার্টিন স্করসেজি, ফ্র্যান্সিস ফোর্ড কোপোলা, ব্রায়ান ডি পা’মা, রবার্ট অল্টম্যান, উডি এলেনের মতো ফিল্মমেকারদের। উক্ত নির্মাতাদের হাত ধরেই নিউ হলিউড ও মডার্ন ব্লকবাস্টারের উত্থান ঘটে। স্টুডিও ফিল্মের জায়গা নেয় ব্লকবাস্টার সিনেমা, যার মূল নিয়ন্ত্রণ স্টুডিও নয় বরং খ্যাতনামা পরিচালকদের হাতে চলে যায়। নিরাপদ বক্স অফিস সাফল্যের ফর্মুলা মুভির জায়গায় বিচিত্র ধরনের সিনেমা আসতে থাকল মেইনস্ট্রিমে।
এই বিচিত্র সিনেমার সাথে আসল একঝাঁক নতুন মুভি স্টার। এই যুগের মুভি স্টাররা স্টুডিও সিস্টেমের পণ্য নয়, বরং নিজেদের স্বতন্ত্র শৈল্পিক পরিচয় তৈরিতে আগ্রহী ছিলেন। মার্টিন স্করসেজির মুভিতে রবার্ট ডি নিরো এবং পরবর্তীতে লিওনার্দো ডি ক্যাপ্রিও; স্টিভেন স্পিলবার্গের মুভিতে হ্যারিসন ফোর্ড, টম হ্যাংকস; টম ক্রুজের প্রেস্টিজ ড্রামা অ্যাক্টর থেকে অ্যাকশন মুভি স্টার বনে যাওয়া; রোম্যান্টিক কমেডি জনরায় স্যান্ড্রা বুলক, জুলিয়া রবার্টসের তারকাখ্যাতি; ভারসেটাইল রোলে ব্র্যাড পিট, জর্জ ক্লুনি ডেনজেল ওয়াশিংটনের মতো মুভি স্টারদের দেখা মেলে নিউ হলিউড যুগে।
বর্তমানের মুভি স্টার
বর্তমানে হলিউড যাচ্ছে আরেক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে। নিউ হলিউডের মুভি স্টারদের দ্বারা চালিত ব্লকবাস্টার বা মিড বাজেটের সিনেমা যেন আর চলে না। এমন সময় ছিল যে টম ক্রুজ মুভি বা ব্র্যাড পিটের নামই যথেষ্ট ছিল থিয়েটারে দর্শকদের নিয়ে আসতে। ২০২২ সালে গেলে কী দেখতে পাই আমরা? ব্র্যাড পিটের ৯০ মিলিয়ন ডলার বাজেটের ‘Bullet Train’ টেনেটুনে ২৩৯ মিলিয়ন ডলার তুলতে পেরেছে বক্স অফিসে। তারই আরেক ৮০ মিলিয়ন ডলার বাজেটের মুভি ‘Babylon’ ওপেনিং উইকেন্ডে মাত্র ৫ মিলিয়ন আয় করে বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়েছে। অজস্র মুভি স্টারের মধ্যে শুধুমাত্র দুজন এখন পর্যন্ত নিশ্চিন্তভাবে দর্শক আনতে পারছেন সিনেমাহলে- টম ক্রুজ ও লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও। কেন এবং কীভাবে হলিউডের মুভি স্টার সিস্টেমের এই দুর্দশার সৃষ্টি হলো?
প্রথমত, ব্লকবাস্টার সিনেমায় কমিকবুক এডাপ্টেশন প্রবেশের সাথে সাথে মুভির তারকার পরিবর্তে মূল আকর্ষণ হয়ে দাঁড়িয়েছে ভক্তদের পরিচিত সুপারহিরো। কুয়েন্টিন টারান্টিনো কিছুদিন আগে এক পডকাস্টে বলেছেন,
“Part of the Marvel-isation of Hollywood is you have all these actors who have become famous playing these characters. But they’re not movie stars, right? Captain America is the star. Thor is the star.”
Quentin Tarantino Says Marvel Actors Are ‘Not Movie Stars’ (esquire.com)
টারান্টিনো সম্পূর্ণ সঠিক এই বিষয়ে। মার্ভেল, ডিসির বাণিজ্যিকভাবে সফল মুভিগুলো সফল পোস্টারে থাকা সুপারহিরোদের জন্য, সুপারহিরো চরিত্রে থাকা তারকাদের জন্য নয়। এই থিওরি খুব সহজেই নিরীক্ষা করে দেখা যায়। ক্যাপ্টেন আমেরিকা, থর ও আয়রন ম্যান- এই তিন ট্রিলজি একত্রে বক্স অফিসে ৭ বিলিয়ন ডলারের বেশি আয় করেছে। এর মানে অবশ্যই তিন ট্রিলজির লিড অ্যাক্টর সফল মুভি স্টার। কিন্তু ক্রিস ইভান্স, ক্রিস হেমসওয়ার্থ অথবা রবার্ট ডাউনি জুনিয়র কারোরই মার্ভেলের বাইরে তেমন সুপারহিট কোনো মুভি নেই। তাহলে এখানে আসল তারকা কে? ক্রিস হেমসওয়ার্থ নাকি থর?
এরপরে আসে স্ট্রিমিং। এককালে টিভি আর মুভির মাঝে পরিষ্কার এক লাইন ছিল। মুভি স্টাররা সুপারহিট মুভি করে বক্স অফিসে টাকা তুলতেন আর টিভি অ্যাক্টররা দর্শকদের ক্যাবল চ্যানেলে থেকে ঘরোয়া নামে পরিণত হতেন। কিন্তু স্ট্রিমিংয়ের কল্যাণে দিনে দিনে টিভি আর মুভির লাইন ক্রমাগতই ক্ষীণ হচ্ছে। মেরিল স্ট্রিপ, কেভিন ব্যাকন, ম্যাথু ম্যাককোনাহে, নিকোল কিডম্যান, জুলিয়া রবার্টস, ভায়োলা ডেভিসের মতো তারকাদের স্ট্রিমিং/টিভিতে দেখা যাচ্ছে।
আরেকটি বড় ফ্যাক্টর রয়েছে মুভি স্টার সংকটের। মুভি স্টার আর অ্যাক্টরের মাঝের পার্থক্যটা আকাশছোঁয়া হয়ে যাচ্ছে দিনে দিনে। সম্ভাবনাময়, প্রতিভাধর অভিনেতাদের বেছে নিতে হচ্ছে প্রেস্টিজ ড্রামা অথবা বড় বাজেটের ব্লকবাস্টারের মধ্যে। প্রেস্টিজ ড্রামা মুভি করে মুভি স্টার হওয়া যায় না, আবার ব্লকবাস্টারে নেই কোনো শিল্পের ছোঁয়া। এটা অনেক বড় কারণ হাল আমলে ভালো মানের অভিনেতাদের থেকে বড় মুভি স্টার বের হয়ে না আসার। তবে কিঞ্চিৎ আশার আলো দেখা যাচ্ছে ২০২১ সালের ‘Dune’-এর মতো সিনেমার কল্যাণে। এরকম হাই কনসেপ্টের ব্লকবাস্টারে অভিনেতারা তারকা বনে যাওয়ার সাথে নিজের শিল্পকেও কাজে লাগানোর সুযোগ পায়। ডেনি ভিলেন্যুভের মতো পরিচালকদের হাত ধরেই হয়তো টিমোথি শ্যালামের মতো মুভি স্টারের পুনরূত্থান হতে পারে। হলিউডকে সচেতনভাবে এই ঘরানার ব্লকবাস্টারের সাথে মিড বাজেটের সিনেমাকে আরো বেশি স্থান করে দিতে হবে। তবেই ভবিষ্যৎ প্রজন্মে হয়তো নতুন ধাঁচের মুভি স্টারের প্রচলন হবে।