
এই পৃথিবীর একটা প্রজন্ম বেড়ে উঠেছে হ্যারি পটারের মোহময় স্মৃতি সাথে নিয়ে। গাদা গাদা মুভি, সিরিজ, ও বইয়ের ভিড়ে হ্যারি পটারের জ্বলজ্বলে দীপশিখা এখনো স্বতেজে বিদ্যমান। হ্যারি পটার ভক্তরা (পটারহেড) কল্পনার সীমারেখা ভেদ করে অসংখ্যবার ঘুরে বেড়িয়েছে হগওয়ার্টসের আঙিনায়, ছড়ি ঘুরিয়ে উচ্চারণ করেছে প্রিয় মন্ত্রসমূহ, কিংবা অতি আগ্রহের সাথে ব্যবহার করেছে বিভিন্ন রকমের পোশন। মাগল হওয়ার দরুন কপাল চাপড়ানো বা দু-পায়ের ফাঁকে ঝাড়ু উড়িয়ে শৈশবে আকাশে উড়তে চেয়েছে, এমন মানুষের সংখ্যাও নেহাত কম নয়। বই বা সিনেমায় কাহিনির ফাঁকে ফাঁকে এমন কিছু প্রশ্ন থেকে যায় যেগুলোর উত্তর সেখানে দেওয়া হয়নি। তাই, বিভিন্ন যুক্তি ও ফ্যান থিওরির সমন্বয়ে জনমনে জেগে উঠা সেসব প্রশ্নের উত্তর নিয়েই আজকের এই আয়োজন।

১) সাধারণ মাগল পরিবারে জন্মেও মাগল-বর্নদের মধ্যে জাদুকরী ক্ষমতা আসে কীভাবে?
আকর্ষণীয় এ উত্তরটা পাওয়া যাবে স্কুইবদের কাছে। স্কুইব হলো মাগল-বর্নদের ঠিক বিপরীত, অর্থাৎ জাদু পরিবারে জন্মেও যাদের কোনো জাদু ক্ষমতা নেই। আর মাগল-বর্ন বলতে এমন জাদুকরদের বোঝায়, যাদের পিতা-মাতা জাদু-ক্ষমতাহীন সাধারণ মানুষ, অথচ তারা নিজেরা জন্মেছে জাদুকরী ক্ষমতা নিয়ে। জাদুজগতে পরিচিত কয়েকজন স্কুইব হলো হগওয়ার্টসের তত্ত্বাবধায়ক অ্যারগাস ফ্লিচ, প্রফেসর গিল্ডেরয় লকহার্টের দুই বোন, ডলোরেস আমব্রিজের ভাই, ম্যারিয়াস ব্ল্যাক প্রমুখ। এ রকম স্কুইবদের জাদুর জগতে থাকার অনুমতি মেলে না। এর পরিবর্তে তারা ঠাঁই পায় জাদুহীন মাগল সমাজে। পরবর্তী সময়ে তারা কোনো মাগলের সাথে বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হয়ে সাধারণ মাগল হিসেবে জীবনযাপন শুরু করে।

স্কুইবদের মধ্য জাদুকরী ক্ষমতা প্রকাশ না পেলেও, তাদের ডিএনএ-তে নিহিত প্রচ্ছন্ন জাদুকরী ক্ষমতা সুপ্ত অবস্থায় থাকে। পরবর্তী কয়েক প্রজন্মে তারা মাগলের সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হলে, একসময় তাদের পরিবার তাদের বংশের উইজার্ডিং লিগ্যাসি ভুলে যায়। কিন্তু সুপ্তাবস্তায় থাকা সেই জাদুর জিন কয়েক প্রজন্ম পরে কোনো সন্তানের মধ্যে দেখা দিলে, সেই জাদু ক্ষমতা হয়ে উঠে প্রকট। এভাবে মাগল দম্পতির ঘরে জন্ম নিলেও তারা আপাদমস্তক একজন জাদুকর হিসেবে চিহ্নিত হয়। জাদুজগতের এমন কয়েকজন বিখ্যাত মাগল-বর্ন হলেন হারমায়োনি গ্রেঞ্জার, লিলি ইভান্স প্রমুখ।

২) মাগল-বর্ন জাদুকরেরা হগওয়ার্টসে ভর্তি হয় কীভাবে?
হগওয়ার্টসে ‘বুক অভ অ্যাডমিটেন্স‘ নামে এক জাদুকরী বইয়ের অস্তিত্ব বিদ্যমান, যেটা ব্রিটেনের জাদুকর সমাজে কোনো সন্তান জন্মের সাথে সাথেই তার বিস্তারিত লিপিবদ্ধ করে রাখে। মাগল-বর্ন জাদুকরেরা এগারো বছর বয়সে পা রাখলে তাদের জাদু স্কুলে ভর্তির বার্তা পাঠানো হয় ওই স্কুলের কোনো প্রতিনিধির মাধ্যমে। এতে পেঁচার মাধ্যমে চিঠি পাঠানোর কোনো যোগসাজশ নেই। এর কারণ একটাই, ওই প্রতিনিধি যাতে মাগল-বর্ন জাদুকরের অভিভাবককে জাদুর স্কুল এবং জাদু জগতের অস্তিত্ব সম্পর্কে সবকিছু ঠিকঠাক মতো বুঝিয়ে আসতে পারে। নইলে জাদুর স্কুলের কথা শুনলে যেকোনো মাগল অভিভাবকই হকচকায়ে উঠার পাশাপাশি, তা হেসে উড়িয়ে দিতে পারেন। দরকার পড়লে তাদের সামনে বিশ্বাসযোগ্য হবার জন্য জাদুও প্রদর্শন করা হয়।

তাদেরকে সতর্ক করা হয়, তারা যাতে উইজার্ডিং ওয়ার্ল্ডের গোপনীয়তা মাগলদের সামনে প্রকাশ না করে। প্রতিনিধি ওই মাগল-বর্ন ও তার অভিভাবকদের উপর এমন মন্ত্র প্রয়োগ করে আসেন, যাতে তারা মাগলদের কাছে জাদুজগতের গোপনীয়তা ফাঁস করতে চাইলেও তাদের মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বের না হয়। কোথায় স্কুলের যাবতীয় সরঞ্জাম পাওয়া যাবে এবং কীভাবে সেখানে যেতে হবে, সে ব্যাপারেও তাদেরকে অবহিত করে আসা হয়। হ্যারি পটার মাগল-বর্ন ছিল না, কিন্তু সে মাগলদের সাথে বাস করত বিধায় সেখানে হগওয়ার্টসের প্রতিনিধি হিসেবে হ্যাগ্রিডকে পাঠানো হয়েছিল। হারমায়োনি মাগল-বর্ন হওয়াতে তার কাছে মিনার্ভা ম্যাকগোনাগল, আর এতিমখানায় টম রিডলের কাছে এসেছিলেন মহামতি অ্যালবাস ডাম্বলডোর।

৩) ব্যাটল অভ হগওয়ার্টসের পর ডেথ ইটারদের ডার্ক মার্কের কী হয়েছিল?
লর্ড ভলডেমর্টের প্রতি ডেথ ইটারদের আনুগত্য প্রকাশের একমাত্র নিশানা ছিল সর্প-চিহ্নিত ‘ডার্ক মার্ক‘। হ্যারি পটার ফ্র্যাঞ্চাইজির বইয়ে বর্ণনা করা আছে, ভলডেমর্ট নিজ শরীরে জীবিত থাকলেই ডেথ ইটারদের হাতের এই ডার্ক মার্ক সক্রিয় থাকত। ডেথ ইটারদের ডাকার উদ্দেশ্যে ভলডেমর্ট এই ডার্ক মার্ক ব্যবহার করত। হ্যারির মা-বাবাকে খুন করার পর হ্যারিকে মারতে গিয়ে কিলিং কার্স যখন ভলডেমর্টের নিজের উপর ফিরে এসেছিল, তখন সে প্রচণ্ড দুর্বল হয়ে পড়ে। শুধু আত্মা অবশিষ্ট থাকে তার।

কিছু বছরের জন্য ভলডেমর্ট গায়েব হবার পর ডেথ ইটারদের হাতে থাকা ডার্ক মার্কও ম্লান হয়ে গেছিল। ডার্ক লর্ডের পর তা আবারও হয়ে উঠে ঝলমলে। ব্যাটেল অভ হগওয়ার্টসের পর ভলডেমর্টের অস্তিত্ব যখন পুরোপুরি মিটে যায়, তখন ডেথ ইটারদের হাতের ডার্ক মার্ক ধীরে ধীরে হালকা হতে শুরু করে। তবে ক্ষীণ বর্ণে এই চিহ্ন তাদের হাতে রয়ে গিয়েছিল ঠিকই। এটা চিরস্থায়ী ডার্ক ম্যাজিক দিয়ে তৈরি ছিল বিধায়, এটা মলম, ঔষধ বা অন্য কোনো জাদু দিয়ে পুরোপুরি মুছে ফেলা সম্ভব ছিল না।

৪) ভলডেমর্টের মৃত্যুর পর হ্যারির কপালে থাকা নিশানার কী হয়েছিল?
এই প্রশ্নের উত্তর উপরে বর্ণিত উত্তরের সাথেই সম্পর্কিত। হ্যারি পটারকে সকলেই চিনতে পারত তার কপালে থাকা বজ্রের ন্যায় নিশানা দেখে, যেটা তাকে দিয়েছিল স্বয়ং ডার্ক লর্ড। ডেথ ইটারদের ডার্ক মার্কের মতো সময়ের সাথে সাথে ম্লান হয়ে এসেছিল এই নিশানা, তবে এই চিহ্নের অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিল ঠিকই। ব্যাটল অভ হগওয়ার্টসের ১৯ বছর পর হ্যারি-রন-হারমায়োনি তাদের সন্তানদের হগওয়ার্টস এক্সপ্রেসে তুলে দেওয়ার দৃশ্য, সিনেমায় দৃশ্যায়ন করা হয়েছিল। ওখানে দেখা যায় হ্যারির কপালে নিশানা প্রায় মিলিয়ে গিয়েছিল। তবে এটা আগের মতো আর ব্যথা করত না।

বাকি রইলো হ্যারির পার্সলমাউথ কিংবা সর্প-ভাষা বলা অনন্য ক্ষমতা। স্লিদারিনের বংশধর না হয়েও সাপের ভাষা বলতে ও বুঝতে পারত হ্যারি পটার। কারণ, হ্যারির ভিতরে ছিল ভলডেমর্টের আত্মার একটি অংশ। এই ক্ষমতা সে ভলডেমর্ট থেকেই অর্জন করেছিল, যেটা অ্যালবাস মুভির মধ্যেই বলেছিলেন। ব্যাটেল অভ হগওয়ার্টসের সময় জঙ্গলে হ্যারিকে মারতে গিয়ে নিজের অজান্তে হ্যারির ভেতরে থাকা স্যুডো হরক্রাক্সকে ধ্বংস করে ফেলে ভলডেমর্ট। সেই থেকে সাপের ভাষা বোঝা কিংবা সাপের ভাষায় কথা বলার ক্ষমতা চিরতরে হারিয়ে ফেলে হ্যারি।

৫) হগওয়ার্টসের অস্তিত্ব কি বাস্তবে বিদ্যমান?
‘হগওয়ার্টস স্কুল অভ উইচক্র্যাফট অ্যান্ড উইজার্ড্রি‘ এমন এক স্কুল, যেখানে কিশোর-কিশোরী জাদুকরদের জাদু প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। ৯৯৩ সালে তৎকালীন ব্রিটেনের খ্যাতনামা চার জাদুকর গড্রিক গ্রিফিন্ডর, সালাজার স্লিদারিন, রোয়েনা র্যাভেনক্ল, এবং হেলগা হাফলপাফ মিলে স্কটল্যান্ডের এক দুর্গম উপত্যকায় গড়ে তুলেছিলেন এই স্কুল। তবে উইজার্ডিং ওয়ার্ল্ডের পুরো কাহিনিই ব্রিটিশ লেখিকা জে.কে. রোলিংয়ের কল্পনাপ্রসূত। তিনি বিভিন্ন ইতিহাসের আশ্রয় ও কল্পনার অনুপম মিশ্রণে বুনেছেন উইজার্ডিং ওয়ার্ল্ডের প্রতিটি গল্প। বাস্তবে হগওয়ার্টস স্কুলের কোনো অস্তিত্ব নেই।

কিন্তু তার মানে এই না দুনিয়ার কোথাও কোনো উইজার্ডিং স্কুল নেই। ‘দ্য গ্রে স্কুল অভ উইজার্ড্রি‘ নামে এক জাদুর স্কুলের অস্তিত্ব রয়েছে নিউ-ইয়র্কে, যেখানে অনলাইনে নানারকম কোর্স শিখানো হয়। সাথে রয়েছে ভর্তি ব্যবস্থা, জাদুর বই, জাদুকরী উদ্ভিদ, আলকেমিসহ জাদু সম্পর্কিত নানা উপাদান। এই স্কুল তৈরি করা হয়েছে হগওয়ার্টস থেকে অনুপ্রেরণা নিয়েই। তবে কেউ যদি সত্যি সত্যি উইজার্ডিং ওয়ার্ল্ড থেকে ঘুরে আসতে চায়, তবে সে কাজটাও তেমন কঠিন নয়। সেজন্য তাকে শুধুমাত্র জে.কে. রোলিং হ্যারি পটার ফ্র্যাঞ্চাইজির বইগুলো সংগ্রহ করে ডুবে যেতে হবে জাদু জগতের অতল গহীনে।
[গত পর্ব: হ্যারি পটার সিরিজের অজানা কিছু প্রশ্নের উত্তর | পর্ব ১]