সময় এবং সমাজকে ধারণ করে যেসব মনীষী বাঙালির জীবনে শ্রদ্ধা এবং ভালবাসার বিশেষ আসনে ঠাঁই পেয়েছেন, তাদেরই একজন আবুল মনসুর আহমদ। ধর্মীয় ও রাজনৈতিক কুসংস্কার, বিরোধ, ভণ্ডামি এবং ধর্মব্যবসার বিপক্ষে তিনি সারাজীবন সোচ্চার ছিলেন। সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে মানুষের বিভ্রম এবং বিপথগামিতাকে তিনি যেমন নিষ্ঠার সাথে লক্ষ করেছেন, একইসাথে তা হাস্যরসের মাধ্যমে তুলে ধরে তার অন্তর্নিহিত বেদনাটুকু পাঠকের অন্তরে জাগ্রত করার চেষ্টা করেছেন। এজন্যই তার পক্ষে ‘আদুভাই’য়ের মতো সূক্ষ্ম রসবোধসম্পন্ন সুপরিচিত হাস্যরসের গল্প লেখা যেমন সম্ভব হয়েছে, একইসাথে সমাজে জেঁকে বসা পীরপ্রথার কুৎসিত দিকগুলোকে যথাযথ রূপে উপস্থাপন করতে ‘হুযুর কেবলা’র মতো কালজয়ী শক্তিশালী গল্পও তিনি লিখতে পেরেছেন।
সাহিত্যিক, সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ- একজন বহুল পরিচয়ের মানুষ হওয়া সত্ত্বেও সময়ের সাথে সাথে তাই তার ‘সাহিত্যিক’ পরিচয়টিই ক্রমশ মুখ্য হয়ে উঠেছে এবং তার সব রচনার মধ্যে ব্যঙ্গরচনা বাংলা সাহিত্যে ব্যাপকভাবে সমাদৃত। অন্য সব রচনাকে বাদ রাখলেও এই ব্যঙ্গরচনাগুলোর জন্য তিনি বাংলাসাহিত্যে চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।
আবুল মনসুর আহমদ রচিত সর্বাধিক সমাদৃত ব্যঙ্গগল্পের সংকলন ‘আয়না’। ১৯৩৫ সালে এ গ্রন্থটি প্রথম প্রকাশিত হয় এবং লেখকের জীবদ্দশাতেই এ বইটির সাত-আটটি সংস্করণ বের হয়েছিল। ‘আয়না’র বেশিরভাগ গল্পই ১৯২২ থেকে ১৯২৯ সালের মধ্যে রচিত এবং ‘সওগাত’ পত্রিকায় বিভিন্ন সময়ে তা প্রকাশিত হয়। তৎকালীন সমাজের রাজনৈতিক, সামাজিক এবং ধর্মীয় কুসংস্কারগুলোকে যথার্থরূপে প্রতিফলিত করে ‘আয়না’ বাংলা সাহিত্যের ব্যঙ্গরচনার ধারায় একটি অনন্য সংযোজন।
রক্ষণশীল মুসলমান পরিবার ‘ফরাযী’ বংশে আবুল মনসুর আহমদের জন্ম। অত্র অঞ্চলে মোহাম্মদী ঐতিহ্যের ধারক ছিল ফরাযী পরিবার। জীবনকালে তার সর্বশেষ প্রকাশিত গ্রন্থ ‘আত্মকথা’য় (১৯৭৮) তিনি তার পারিবারিক পরিবেশকে ‘গোঁড়ামির পরিবেশ’ হিসেবেই উল্লেখ করেছেন। শৈশবে তিনিও ধর্মকর্মে অত্যধিক মনোযোগী এবং উৎসাহী হয়ে পড়েন। ফলস্বরূপ ‘পারিবারিক গোঁড়ামি’ তাঁর নিজের ভেতরেও ঢুকে যায়। রাত জেগে নফল ইবাদাত করতে করতে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এমনকি তার পোশাক-আশাকেও এর প্রভাব পড়ে। নিজের ‘টুপি নিষ্ঠা’ সম্পর্কে ‘আত্মকথা’য় তিনি লিখেছেন,
“টুপি ছাড়া আমি কোথাও যাইতাম না, স্কুলে-মকতবে তো নয়ই। ক্লাশে কখনও মাথা হইতে টুপি নামাইতাম না। আমার টুপিটা ছিল লাল তুর্কী টুপি। ঐ ধরনের টুপিতে মাথায় বাতাস যাতায়াতের কোনো রাস্তা ছিল না। গরমের দিনে ঘামে মাথা ভিজিয়া যাইত। কপাল, গলা, চিপ ও ঘাড় বাইয়া ঘাম পড়িত। তবু টুপি খুলিতাম না।”
শৈশবে এমন গোঁড়া ধর্মভক্তি সত্ত্বেও ময়মনসিংহ জিলা স্কুলে পড়ার সময় কয়েকজন গুণী মানুষের সংস্পর্শে এসে তার মধ্যে ধর্মীয় উদারতা জন্ম নেয়। চারপাশের ধর্মীয় কুসংস্কার এবং অপসংস্কৃতির বিরুদ্ধে তিনি সচেতন হয়ে ওঠেন। এই সচেতনতা তার ধর্মবিশ্বাসকে দুর্বল না করে বরং আরও দৃঢ় করেছিল। এ প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন,
“আমি যতই মোল্লা-বিরোধী, গোঁড়ামি-বিরোধী হইয়া উঠিতে লাগিলাম, মুসলমানদের প্রতি দরদ ও টান আমার ততই বাড়িতে লাগিল।”
কাজেই রক্ষণশীল ধর্মীয় পরিবেশে বেড়ে ওঠায় হানাফী-মোহাম্মদী দুই মাজহাবের মধ্যে বিরোধসহ ভণ্ডপীর এবং ধর্ম ব্যবসায়ীদের স্বরূপ তিনি খুব ভালোভাবে অনুভব করেছিলেন। তার এই পর্যবেক্ষণকে তিনি পাঠকের সামনে তুলে ধরেছেন বিশেষত ব্যঙ্গরচনার মাধ্যমে। ‘আয়না’ যেহেতু তাঁর প্রথম গল্পগ্রন্থ, ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তার সচেতন প্রতিবাদ বিশেষভাবে প্রতিফলিত হয়েছে এর গল্পগুলোতে।
অজিতকুমার ঘোষ তার ‘বঙ্গ সাহিত্যে হাস্যরসের ধারা’ গ্রন্থে লিখেছিলেন, “ব্যঙ্গকার বড় কঠোর, বড় নির্মম, তিনি মানুষের দোষ ও ব্যাধি নগ্ন করে পৈশাচিক উল্লাসে মত্ত হয়ে ওঠেন; তাঁর হাসি একক, দর্শক ও শ্রোতাদের মধ্যে তা প্রতিধ্বনিত হয় না।” আবুল মনসুর আহমদ হাস্যরসের এই ধারা থেকে ছিলেন সম্পূর্ণ পৃথক। সমাজ, ধর্ম এবং মানুষের প্রতি তার গভীর ভালবাসা ও মমত্ববোধ ছিল। ব্যঙ্গ-বিদ্রুপের মাধ্যমে সমাজের এসব অসঙ্গতির বিরুদ্ধে মানুষকে জাগিয়ে তোলাই ছিল তার একমাত্র উদ্দেশ্য। তার হাসি একক নয়, বরং তার রচিত সাহিত্যে সব সময় হাসির মাধ্যমে পাঠক ও লেখকের মধ্যে একটি মেলবন্ধন সৃষ্টি হয়েছে।
‘আয়না’ গল্পগ্রন্থের ভূমিকায় আবুল মনসুর আহমদের বন্ধুবর জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখেছিলেন,
“…ব্যঙ্গ-সৃষ্টিতে অসাধারণ প্রতিভার প্রয়োজন। এ যেন সেতারের কান মলে সুর বের করা- সুরও বেরুবে, তারও ছিঁড়বে না। …ভাষার কান মলে রস-সৃষ্টির ক্ষমতা আবুল মনসুরের অসাধারণ। এ যেন পাকা ওস্তাদী হাত।”
আবার ‘আয়না’ গ্রন্থটি লেখক তার আরেক বন্ধু সুসাহিত্যিক আবুল কালাম শামসুদ্দীনকে উৎসর্গ করে উৎসর্গপত্রে তিনি লিখেছেন,
“বন্ধুরা বলছেন, এই বইয়ে আমি সবাইকে খুব হাসিয়েছি। কিন্তু এই হাসির পেছনে যে কতটা কান্না লুকানো আছে, তা তুমি যেমন জান, তেমন আর কেউ জানে না।”
এ থেকেই পরিষ্কার হয় যে, আবুল মনসুর আহমদ নিছক ব্যঙ্গরসে পাঠকদেরকে আমোদিত করার উদ্দেশ্যে এ গল্পগুলো লেখেননি। বরং সমাজের কুসংস্কার এবং গোঁড়ামির বিরুদ্ধে পাঠক হৃদয়ে সচেতনতা সৃষ্টিই ছিল তার সাহিত্যের মুখ্য উদ্দেশ্য।
‘আয়না’র সাতটি গল্পের প্রায় সবগুলোতেই ধর্মকে ব্যবহার করে প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া ধর্মব্যবসায়ীদের মুখোশ উন্মোচন করা হয়েছে। এ গ্রন্থের প্রথম গল্প ‘হুযুর কেবলা’য় তিনি একজন ভণ্ডপীরের স্বরূপ প্রকাশ করেছেন। ভক্তকূলকে মুগ্ধ করার উদ্দেশ্যে যিনি চোখ বন্ধ করে মিটিমিটি হেসে ওঠেন, আবার হঠাৎ করে ‘কুদরতে-ইয্দানী, কুদরতে-ইয্দানী’ বলে চিৎকার করে ভক্তকূলের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। চোখ মেলে হঠাৎ বলে ওঠেন, “আমরা কত বৎসর হইল এখানে বসিয়া আছি?” কিছুক্ষণ পর নিজেই আবার তার ব্যাখ্যা দেন, “…এখানে আসিবার পর আমি আমার রুহকে ছাড়িয়া দিয়াছিলাম। সে তামাম দুনিয়া ঘুরিয়া সাত হাজার বৎসর কাটাইয়া তারপর আমার জেসমে পুনরায় প্রবেশ করিয়াছে।” পরবর্তী সময়ে নিজের কামনা চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে নিজের মুরিদের ছোট ছেলে রজবের স্ত্রী কলিমনকে জোরপূর্বক বিয়ে করতে তিনি দ্বিধাবোধ করেন না।
এই অনাচার এবং ভণ্ডামির বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানানো একমাত্র তরুণ এমদাদ আসলে লেখকের সচেতন প্রতিবাদী সত্ত্বারই প্রতিরূপ। সে প্রতিবাদ করে বটে, কিন্তু অন্ধকারে ডুবে থাকা কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজের বিরুদ্ধে একা লড়াই করা তার পক্ষে রীতিমতো অসম্ভব হয়ে ওঠে। ধর্মব্যবসায়ীদের ভণ্ডামির বিরুদ্ধে এমদাদের মতো হাজার তরুণের উত্থান ঘটানোর প্রয়াসেই লেখক এই গল্পটি লিখেছেন। ‘আয়না’র অন্য গল্পগুলোতেও ব্যঙ্গের মাধ্যমে সমাজের ধর্মীয় ভণ্ডামি ও কুসংস্কারের প্রকাশ ঘটেছে। ধর্মব্যবসায়ীরা আপন স্বার্থ চরিতার্থ করার উদ্দেশ্যে সাধারণ মানুষের ধর্মীয় অনুভূতিকে কীভাবে কাজে লাগায়, তার সরস বর্ণনার মাধ্যমে লেখক পাঠকের অন্তরে নাড়া দেওয়ার চেষ্টা করেছেন। ‘নায়েবে নবী’ অথবা ‘মুজাহেদিনে’র মতো গল্পগুলো তার এ প্রচেষ্টারই সার্থক ফসল।
শুধু মুসলমানদের নয়, হিন্দুদের ধর্মান্ধতাকে ব্যঙ্গ করেছেন এ গ্রন্থের ‘গো-দেওতা-কা দেশ’ গল্পে। স্বার্থান্বেষীরা কিভাবে যুগে যুগে ধর্মকে ব্যবহার করে আত্মপ্রতিষ্ঠার পথ খোঁজে, তা সুনিপুণভাবে ফুটে উঠেছে ‘লীডারে কওম’ গল্পটিতে। এছাড়া ভণ্ড বিদ্রোহীদের বিদ্রূপ করে লেখা হয়েছে ‘বিদ্রোহী সংঘ’ গল্পটি এবং হিন্দু মুসলিম সাম্প্রদায়িক দাঙ্গাকে বিদ্রূপ করে রচিত ‘ধর্মরাজ্য’ গল্পটি দিয়ে গ্রন্থটির সমাপ্তি ঘটেছে।
খুব সহজ ভাষায় কথা বলে মানুষের মনোযোগ আকর্ষণ করা অনেক সময় দুরূহ হয়ে পড়ে। কিন্তু কথার মাঝে দুর্বোধ্যতা থাকলে তা মানুষের মনোযোগ আকর্ষণে যথেষ্ট সহায়ক হয়। এজন্যই হয়তো বা আমাদের সমাজের ধর্মব্যবসায়ীগণ তাদের বক্তব্য উপস্থাপনের সময় কথার মাঝে প্রচুর পরিমাণে আরবি-ফারসি শব্দের ব্যবহার করেন এবং সাধারণ মানুষ সে সব শব্দ শুনে অনেক সময় না বুঝেই মুগ্ধ হয়ে নিজেদেরকে তাদের পায়ে সঁপে দেয়। সমাজের ধর্ম ব্যবসায়ীদের এই চিরকালীন কৌশল এবং সাধারণ মানুষের ধর্মব্যবসায়ীদের কাছে নিঃসঙ্কোচ আত্মসমর্পণের দিকটি আবুল মনসুর আহমদ খুব ভালোভাবে অনুভব করেছিলেন। গোঁড়া ‘মোহাম্মদী’ পরিবারে জন্ম নেওয়ায় তার আরবি-ফারসি শব্দভাণ্ডার যথেষ্ট সমৃদ্ধ ছিল। পাশাপাশি ধর্মীয় কুসংস্কার, মাযহাব ভিত্তিক বিরোধ এবং ধর্মব্যবসায়ীদের স্বরূপ সম্বন্ধে তার পরিষ্কার ধারণা থাকায় তার পক্ষে এমন বিশ্বাসযোগ্য ভঙ্গিতে এবং যথাযথরূপে চরিত্র চিত্রণ সম্ভব হয়েছে।
লেখায় পরিস্থিতির যথার্থ বর্ণনার উদ্দেশ্যে শব্দের ব্যবহারে বিশেষ মুন্সিয়ানার পরিচয় দিয়েছেন আবুল মনসুর আহমদ। আরবি-ফারসি ভাষায় গুরু গাম্ভীর্য প্রকাশের পাশাপাশি সময়ের প্রয়োজনে সবধরনের শব্দের যথার্থ প্রয়োগ ঘটিয়েছেন তিনি।
‘আয়না’ শিরোনামে এ গল্পগ্রন্থটিতে কোনো নামগল্প নেই। লেখক ‘আয়না’য় এমন এক প্রতিচ্ছবি সৃষ্টি করতে চেয়েছেন, যাতে কুসংস্কারাচ্ছন্ন সমাজ নিজেই তার আসল রূপটি দেখতে পায়।
তার সময়ের এতটা বছর পেরিয়ে এসেও ‘আয়না’ গল্পগ্রন্থের চরিত্রগুলোকে এখনও সমাজে দেখা যায়। হাস্যরসের মাধ্যমে যাদের স্বরূপ প্রকাশ করে তিনি যে বিদ্রোহের ঝংকার তুলেছিলেন, তার প্রয়োজনীয়তা এতদিন পরেও আমরা অনুভব করি। এজন্যই আবুল মনসুর আহমদের ‘আয়না’ গ্রন্থটি চিরকালীন এবং বর্তমান সময়ে এসেও অতিমাত্রায় প্রাসঙ্গিক।
অনলাইনে কিনুন- আয়না