দর্শন শব্দবন্ধটি শুনলেই সক্রেটিস, প্লেটো, এরিস্টটল, রেনে দেকার্তে এদের কথাই সর্বাগ্রে মনে পড়ে। কারণ, দর্শন বিষয়টি ঐকান্তিক আগ্রহের সাথে পাঠ না করলে, বরং স্রেফ কৌতুহল বা সাধারণ জ্ঞান লাভের জন্য দর্শন বিষয়ক প্রাথমিক পাঠ নিতে চাইলে সচরাচর কাউকে কেবল এসব পণ্ডিতের দর্শনশাস্ত্রই পড়তে দেওয়া হবে।
আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়গুলো পশ্চিমা ভাবধারায় গঠিত। পশ্চিমের উদ্ভাবিত জ্ঞানের চর্বিত চর্বনই এখানে আলোচনা করা হয়। এতে কোনো দোষ নেই অবশ্যই, কিন্তু অনুসন্ধিৎসার অভাব রয়েছে। আর রয়েছে নিজস্বতার রাহিত্য। তাই, আমরা যা জানি, যা বুঝি, যা ভাবি; সবই কিন্তু অন্যের ভাবনার ছাঁচের আদলে। যা কিছু নতুনত্ব আমরা তৈরি করি, সেটা করি ওসব আইডিয়াকে আশ্রয় করে। বৈদেশিক জ্ঞানের নিরিখেই আমাদের যাবতীয় আবিষ্কারের আমিত্বের সৃষ্টি।
বিতর্ক করা যেতে পারে এই বলে যে, যা বিদেশী বলা হচ্ছে তা যদি বর্জন করা হয় বা হতো, তবে আমরা এগোতাম কী করে। সন্দেহ নেই, বিমানপোতের প্রকৌশলবিদ্যা যদি আমরা অপর হতে আমদানি না করতাম, তাহলে এ বিষয়ক জ্ঞান আমাদের লভ্য হতো না। সুতরাং, এ বিদ্যার ক্ষেত্রে আমিত্বের অহংবোধ নেহায়েতই বাতুলতা। বিদ্যাচর্চার এমন সব শাখা রয়েছে যার অস্তিত্ব আমাদের এ বাংলা অঞ্চলে কস্মিনকালেও ছিল না। সেসব বিদ্যা আমরা বিদেশীদের কাছ থেকে আমদানি করে নিজেরা তার ওপর মস্তিষ্কের শাণ দিচ্ছি। যদি এই বিদ্যাসমূহ ধার করা না হতো, তাহলে তদ্বিষয়ক জ্ঞান আমাদের মধ্যে কখনোই জ্ঞাত হতো না।
সুতরাং, শিক্ষার এমন সব আধুনিক শাখা রয়েছে, যার সূচনা বাংলার বাইরে; এ মানতেই হবে। চিকিৎসাবিদ্যার চর্চা এ অঞ্চলেও হতো, আবার সুদূর ইউরোপেও হতো। কিন্তু কালের আবর্তনে এখানকার নিজস্ব চিকিৎসাবিদ্যা হয়তো অনেকক্ষেত্রেই পশ্চিমের অত্যাধুনিক চিকিৎসাশাস্ত্রের নিকট হার মেনেছে। আমরা শোষিত হয়েছি তখনই যখন আমাদের জ্ঞানবিজ্ঞানে শ্রীবৃদ্ধি হওয়ার বয়ঃসন্ধিকাল ছিল। যারা আমাদের কাছ থেকে নিয়েছে, সেই সম্পদে বলীয়ান হয়ে তারাই শেষ পর্যন্ত জয়ী ও অনুসরণযোগ্য বলে বিবেচিত হয়েছে। তাদের ওপর নির্ভরশীল হয়েই আমাদেরকে পথ চলতে হয়েছে।
কিন্তু তা-ই বলে বাংলা অঞ্চলের মহত্তর কোনো বিদ্যা, গুপ্তবিদ্যা, একান্ত নিজস্ব সমৃদ্ধ কোনো শিল্পের চর্চা একেবারেই ছিল না? এমন প্রশ্নের উত্তর হচ্ছে, না। আমাদের এমন সব সমীহযোগ্য কৃষ্টি, চর্চা, শিক্ষা বা গুণ ছিল, যা কালের গহ্বরে হারিয়ে গেছে। আর এই হারানোর জন্য যারা আমাদের শোষণ করে আমাদেরকে বিজিত হিসেবে রূপান্তরিত করেছে তারা যেমন দায়ী, ঠিক তেমনিভাবে আমরাও অনেকাংশেই দায়ী। কারণ, আমাদের এ বিদ্যা, এ শক্তিসমূহ আমরা নিজেরাই পরবর্তীকালে আর খুঁজতে যাইনি। আমরা ডুবে গিয়েছিলাম অপরের সরবরাহকৃত বিদ্যার অন্বেষণে।
দর্শনশাস্ত্রের কথা দিয়ে এ আলাপখানি শুরু হয়েছিল। প্রকৌশল বা চিকিৎসাবিদ্যা না হয় আমাদের পক্ষে তৈরি করা সম্ভব হয়নি, কিন্তু সমাজ বিজ্ঞান, মানব বিজ্ঞানের মতো চিরন্তন, নিখিলসৃষ্টিব্যাপী জ্ঞানের শাখায়ও কি আমাদের নিজস্ব কোনো অবদান ছিল না? দর্শনশাস্ত্রের যুক্তি, তর্ক তো কেবল কোনো সুনির্দিষ্ট গণ্ডির মানুষের মননে বিরাজ করে না। দর্শন সহজাত বিদ্যা, এর চর্চা চাইলে যে কেউই করতে পারে। আর এই জ্ঞানের ধাঁচ নির্ভর করে সমাজের ওপর; কৃষ্টি, সংস্কৃতি, বিশ্বাস, জীবনযাপনের রীতি এসবের ওপর।
লেখক, গবেষক, শিক্ষক রায়হান রাইন দর্শনকে দেখেছেন একেবারে দেশজ দৃষ্টিকোণ থেকে। তার গ্রন্থ বাংলার দর্শন: প্রাক্–উপনিবেশ পর্ব-এ তিনি দেখিয়েছেন দর্শন কেবল পাশ্চাত্যের আবিষ্কৃত বা চর্চিত কোনো বিদ্যা নয়, বরং বাংলা অঞ্চলেও রয়েছে দর্শনচর্চার শক্তিশালী নিদর্শন। সেই নিদর্শনগুলোকেই তিনি বিস্তারিতভাবে তুলে ধরেছেন সহজ ভাষায় তার বইটিতে। যদিও ভাষাটি সহজ, তথাপি এর মর্ম উদ্ধার করা আমাদের সকলের পক্ষে সহজ না-ও হতে পারে।
বাংলার দর্শন গ্রন্থটির সূচনা হয়েছে দর্শন সম্পর্কে ইউরোপীয়ান ধারণা বনাম বাংলা অঞ্চলে দর্শনের দৃষ্টিকোণের তুলনার মাধ্যমে। পশ্চিমে দর্শনের ধারণায় নিহিত রয়েছে যুক্তিলব্ধ জ্ঞান। অন্যদিকে বাংলা অঞ্চলে দর্শনের ধারণার বিস্তার ঘটেছে দেহ বা জগৎসত্তার অন্তঃস্থ বিষয়সমূহকে অনুধাবন করার চর্চার মধ্য দিয়ে। দেহতত্ত্ব নিয়ে আলাদা দার্শনিক মতামত সৃষ্টি হয়েছে এ অঞ্চলে। লেখক দাবি করেছেন বাংলার দার্শনিক সম্প্রদায় ও দার্শনিকদের চিন্তা ও তত্ত্বগত অবস্থানকে বুঝতে হলে স্মরণে রাখতে হবে তাদের সাংস্কৃতিক পরিমণ্ডলের কথাও।
বইয়ের ভূমিকা অংশে লেখক দর্শনের সংজ্ঞা, ধারণা, দর্শনচর্চার ইতিহাস, বাংলা অঞ্চলে তত্ত্বজ্ঞানের ক্রমবিকাশ ইত্যাদি সবিস্তারে বর্ণনা করেছেন। দর্শনের ইতিহাস ঘাঁটলে দেখা যায়, ইউরোপীয় ও আমেরিকান পণ্ডিতেরা দর্শন নিয়ে কিছুটা গোঁড়া ধারণা পোষণ করেন। তাদের মতে, বিশুদ্ধ দর্শনচর্চা কেবল ইউরোপেই সম্ভব হয়েছে। বাংলা অঞ্চলের দর্শন সম্পর্কে তাদের ধারণা ছিল এগুলোতে চিন্তার গ্রহণযোগ্য বিকাশ ঘটেনি। অর্থাৎ, পশ্চিমা দর্শনচর্চায় আমাদের দর্শন একেবারেই বাদ পড়ে গেছে। আর এ পশ্চিমাদর্শনের ওপর যেহেতু এখানকার দর্শনশিক্ষার বুনিয়াদ গঠিত, তাই আমরাও আর কখনো নিজেদের দার্শনিক ও তাদের চিন্তাধারা নিয়ে ভাবার অবকাশ পাইনি। উপনিবেশপূর্ব জ্ঞান ও ভাবজগতকে হারিয়ে ফেলার এ প্রক্রিয়াকে রায়হান রাইন স্মৃতিবিলোপ বা অ্যামনেশিয়ার (Amnesia) সঙ্গে তুলনা করেছেন।
বাংলার দর্শনকে আলোয় তুলে ধরার প্রথম ধাপ হিসেবে লেখক দেখিয়েছেন কীভাবে উপনিবেশিকতার আগ্রাসন আমদের সংস্কৃতিতেও প্রবেশ করে এ অঞ্চলে একটি সাংস্কৃতিক উপনিবেশ সৃষ্টি করেছে। যার ফলে আমাদের নিজস্ব তত্ত্বজগতকে ঘিরে আমাদের মধ্যে তৈরি হয়েছে একধরণের ‘ছায়া-চেতনা’। অর্থাৎ, আমরা এই তত্ত্বজ্ঞানকে নিয়ে কখনো-সখনো ভেবেছি বটে, কিন্তু তাকে আর শীর্ষের আসনে বসাতে পারিনি। বরং, আমরা ইউরোপীয় ভাবনার জগতকে পরম ভেবে তার ওপর আশ্রয় করে আমাদের তত্ত্বজ্ঞানকে নিয়ে কেবল কালেভদ্রে আলোচনার পরিসর তৈরি করেছি।
স্থানীয় দর্শনের আলোচনায় লেখক প্রথমে উল্লেখ করেছেন বৃহৎ বঙ্গের দেহাত্মবাদী মতের কথা। যে সময় বাংলা অঞ্চল বঙ্গ বলে পরিচিত ছিল, তখন এ অঞ্চলে তন্ত্রমত গড়ে উঠেছিল। কৃষিভিত্তিক এ অঞ্চলে ক্ষেত্র তথা ভূমির গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। সেই ভূমিকে মানবদেহের সাথে তুলনা করে তন্ত্রমতো শরীরের ওপর গুরুত্ব প্রদান করেছিল। কারণ দেহাত্মবাদ দেহের বাইরে আর কোনো বস্তুকে পরম বলে স্বীকার করে না। প্রাচীন তন্ত্রদর্শন কালক্রমে প্রভাব ফেলেছিল এখানকার বৌদ্ধ, বাউল, ও বৈষ্ণব ধর্মমতে।
তন্ত্রদর্শন, দেহাত্মবাদ প্রসঙ্গে লেখক একাধিক অধ্যায়ে বিস্তর আলোচনা করেছেন। আত্মসত্তা ও মুক্তির ধারণা যেমন তন্ত্রমতে ছিল, তেমনি সনাতন ধর্মের গীতা বা উপনিষদ ইত্যাদি ধর্মগ্রন্থে, বৌদ্ধ সহজিয়া, নাথপন্থা, সুফিতত্ত্ব, গোড়ীয় বৈষ্ণবমত, বাউল মত ইত্যাদি দর্শনেও এই ধারণাসমূহের স্ব স্ব ব্যাখ্যা রয়েছে। লেখক এই ব্যাখ্যাগুলো ভিন্ন ভিন্নভাবে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন।
প্রাচীন বাংলার দর্শনচর্চায় নারীর স্থান কোথায় তা নিরূপণের জন্য লেখক ঐ সময়ের কৃষিজীবী ও ব্রাহ্মণ্য সমাজে নারীকে কীভাবে দেখা হয়েছে তা নিয়ে স্বতন্ত্র অধ্যায়ে আলোচনা করেছেন। বেদ ও উপনিষদে নারীর উপস্থাপন, মনুসংহিতায় নারীর বিচার ইত্যাদি বিষয়ে পাঠককে জ্ঞাত করার পাশাপাশি প্রাচীন কৃষিজীবী সমাজে নারীর স্থান নিয়েও তুলনামূলক আলোচনা করেছেন। নারীর প্রতি প্রাচীন বৌদ্ধসমাজের দৃষ্টিভঙ্গি আরেকটি স্বতন্ত্র পরিচ্ছেদে আলোকপাত করা হয়েছে।
বৌদ্ধধর্মের একজন ক্ষণজন্মা মহাপণ্ডিত ছিলেন অতীশ দীপঙ্কর। তার প্রচারিত তত্ত্ব আলাদা দর্শন হিসেবে খ্যাতিলাভ করেছে। কিন্তু তারও আগে আচার্য শান্তরক্ষিত ৮ম শতকে তিব্বত ও নেপালে বৌদ্ধমত প্রকাশ করেন। শান্তরক্ষিতের তত্ত্বদর্শনের মধ্যে রয়েছে মাধ্যমিকবাদ, স্বসংবেদন তত্ত্ব, অর্থক্রিয়াত্ব তত্ত্ব ইত্যাদি। এ তত্ত্বসমূহ একজন সাধারণ পাঠকের পক্ষে হৃদয়ঙ্গম করা বেশ কঠিন হতে পারে তবে লেখক যথাসম্ভব ঝরঝরে ও সহজ ভাষায় এগুলো ব্যাখ্যা করেছেন।
অতীশ দীপঙ্কর বা শান্তরক্ষিতের কঠিন কঠিন তত্ত্বজ্ঞানের পাশাপাশি বাদ যায়নি চর্যাপদের দর্শনও। চর্যাসমূহের ভাবাদর্শ; বজ্রযান, মহাযান, হীনযান ইত্যকার মতের মধ্যে মিল-অমিল, বিবর্তন ইত্যাদির কালানুক্রমিক বর্ণনা পাঠককে প্রাচীন বাংলার দর্শনের বিভিন্ন শাখা সম্পর্কে একটি সামগ্রিক ধারণা প্রদান করবে।
বাংলার দর্শনে আরও ঠাঁই পেয়েছে নাথপন্থার ইতিবৃত্ত, বৈষ্ণব দর্শন ও ভক্তিবাদ এবং তার সমসাময়িক সুফিবাদ, রঘুনাথ শিরোমণির দার্শনিক ভাষাতত্ত্ব ও নব্য-ন্যায়, সৈয়দ সুলতানের জ্ঞানচৌতিশা, এবং বাউল দেহাত্মবাদ। বাউল মতের সঙ্গে আলাদা করে বর্ণনা করা হয়েছে ফকির লালন সাঁইয়ের দর্শনের কথা। বিস্মৃতির অতল থেকে চিরুণি অভিযান চালিয়ে লেখক আমাদের দর্শনের এই সমৃদ্ধশালী শাখাসমূহকে অধুনায় তুলে এনেছেন।
বইটি একটি পুরোদস্তুর গবেষণামূলক গ্রন্থ। অর্থাৎ, এর প্রতিটি তথ্যই যথাযথ সূত্রের দ্বারা সংহত। গবেষণাধর্মী বইয়ে রেফারেন্স বা তথ্যসূত্র একটি অতীব গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। লেখক তার গ্রন্থের প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে সংশ্লিষ্ট সহায়ক গ্রন্থের তথ্যসূত্র রেখেছেন। কখনো কখনো প্রয়োজন মতো টীকাও রচনা করছেন। পাঠের ও অনুসন্ধানের সুবিধার্থে বইয়ের পরিশেষে রয়েছে নির্ঘণ্ট।
আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে বাংলার দর্শন বইটির ভাষা নিতান্তই সহজ ও প্রমিত হলেও এর অর্থ বোধগম্য হওয়ার ক্ষেত্রে আমাদেরকে কিছুটা আয়াস পেতে হতে পারে। এর কারণ হচ্ছে, দর্শনের অভ্যন্তরীণ বিষয় সম্পর্কে আমরা খুব কমই জানি। বাউল দর্শনের কথা পড়তে গেলে আমরা হয়তো তা অনায়াসে বুঝতে পারব, কিন্তু লেখক যখন মহাযান বা হীনযান বৌদ্ধদর্শন নিয়ে আলোচনা করেছেন, অথবা রঘুনাথের নব্য-ন্যায় প্রসঙ্গে বিমূর্ত গুণ, নিষেধন (negation), অভাব (absence), অনবস্থা দোষ (infinite regress) ইত্যাদি নিগূঢ় দার্শনিক পরিভাষা উল্লেখ করে সেগুলোর ওপর বিস্তারিত আলোকপাত করছেন, তখন লেখকের কথার ওপর স্রেফ বিশ্বাস রেখে একটানে এই আলোচনাসমূহ পড়ে যাওয়া ছাড়া আমাদের আর কোনো গত্যন্তর নেই। কারণ, একজন সাধারণ পাঠক হুট করে দর্শনের, তা-ও কিনা প্রায় অপ্রচলিত, বিস্মৃতির অন্তরাল থেকে উথিত হয়ে সবেমাত্র আমাদের সাহিত্য ও শিক্ষায়তনিক পরিসীমায় যেগুলো পরিচিতি লাভ করলো, এমন সব জটিল ও সূচীভেদ্য প্রত্যয়ের দার্শনিক অর্থ বুঝতে পারবেন না। তবে, লেখক যে পরিমাণ নিষ্ঠার সাথে তার আলোচনা চালিয়ে গিয়েছেন, তাতে একজন দর্শন-সমঝদার এ বইয়ের প্রতিটি পাতাই উপভোগ করবেন বলে প্রতীয়মান হয়।
তার অর্থ এই নয় যে, দর্শন বিষয়ে ধারণা না রাখা কোনো ব্যক্তিকে এ বইটি পাঠ করা হতে বিরত থাকতে বলা হচ্ছে। বরং, একজন সচেতন ও অনুসন্ধিৎসু পাঠক মাত্রই বইটি পাঠ করা বাঞ্ছনীয়। বরঞ্চ, বলা যায়, বইটি পাঠশেষে যে কেউই দর্শন বিষয়ে আরও জ্ঞান লাভ করার ব্যাপারে আগ্রহবোধ করবেন।
পরিভাষা প্রসঙ্গে এখানে যুক্ত করতে হয় যে, লেখক পশ্চিমা পরিভাষার বাইরে গিয়ে বাংলার দর্শনকে একান্তই বাংলার মতো করে উপস্থাপন করেছেন যার জন্য তাকে সাধুবাদ জ্ঞাপন করতে হয়। দর্শনের প্রচলিত ইংরেজি শব্দের সরাসরি ব্যবহারের বদলে সেগুলোর সমার্থক, অর্থবহ বাংলা পরিভাষার ব্যবহার বইটির আধেয়ের সাথে পুরোপুরি মানানসই।
দীর্ঘকায় এ বইটি পড়তে হলে হাতে অন্য কোনো বই না রাখাই ভালো। কারণ, এ বইটি পড়ার পাশাপাশি অন্য বইও পাঠ করলে বইটির নির্যাস গ্রহণে ছেদ পড়তে পারে। যেহেতু কিছুটা কঠিন বই, তাই একটানা পড়ে যাওয়াই উচিত বলে মনে হয়। কেননা মাঝপথে বিরতি দিয়ে পরবর্তী সময়ে আবার পড়া শুরু করলে আগের পাঠের মূলভাব ভুলে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
পরিশেষে বলা যায়, প্রাক–ঔপনিবেশিক বাংলা অঞ্চলের দর্শন বিষয়ক গ্রন্থ হিসেবে গবেষণাগত তাৎপর্যের দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলার দর্শন: প্রাক্–উপনিবেশ পর্বকে নীহাররঞ্জন রায়ের বাঙ্গালীর ইতিহাস: আদি পর্ব-এর সাথে তুলনা করা চলে। যেহেতু এ গ্রন্থটিতে কেবল উপনিবেশপূর্ব সময়ের দর্শন সংশ্লিষ্ট আলাপ করা হয়েছে, এবং বইটির শিরোনামও সময়সীমা নির্দেশক, তাই আমরা উপনিবেশ-পরবর্তী বাংলা অঞ্চলের দর্শনচর্চা বিষয়ক আরেকটি গ্রন্থ লেখকের কাছ থেকে ভবিষ্যতে আশা করতে পারি। তবে এক সাক্ষাৎকারে লেখক জানিয়েছেন এ প্রসঙ্গে তার ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা সুস্পষ্ট নয়। অবশ্য, পাশাপাশি তিনি মত ব্যক্ত করেছেন উনিশ শতকের বাংলার দর্শন নিয়ে অনুসন্ধান চালানো একটি রোমাঞ্চকর ব্যাপার হবে। সুতরাং, আমরা আশা জিইয়ে রাখতেই পারি।