মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী আমাদের জাতীয় জীবনের এক অমীমাংসিত চরিত্র। তিনি বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের ইতিহাসের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হলেও সেই প্রচার এখন আর নেই বললেই চলে। তিনি এখন অনেকটাই বিস্মৃত। কেন বিস্মৃত, সেই প্রশ্নের উত্তর এককথায় দেওয়া সম্ভব নয়।
‘মাওলানা ভাসানী’ প্রবন্ধে ছফা বলেছেন,
“বাঙলার কৃষক সমাজের সত্যিকার নেতা ছিলেন মরহুম মাওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী। মাওলানা সাহেব কৃষক সমাজের একেবারে ভেতরে গাছের মতো বেড়ে উঠেছিলেন। গাছের বেড়ে ওঠার জন্য যেটুকু আলো, জল, হওয়ার প্রয়োজন কৃষক সমাজের দাবিগুলোকে অনেকটা সেই চোখেই দেখতেন তিনি। পড়ে পাওয়া কোনো কেতাবী উপলব্ধি দ্বারা তাড়িত হয়ে মাওলানা রাজনীতি করতে আসেননি। পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি তাঁকে রাজনীতির দিকে ধাবিত করেছে। তাঁর ছিল এক অনন্য সংবেদনশীল সহজাত প্রবৃত্তি। এই সহজাত প্রবৃত্তিই তাঁকে ‘জীবনে জীবন যোগ’ করতে অনুপ্রেরণা যুগিয়েছে।”
এরপর সৈয়দ আবুল মকসুদের ‘ভাসানী কাহিনী’ পড়তে গিয়ে এ কথাগুলোরই সত্যতা পাওয়া যায়। এ বইয়ের প্রতিটি পাতায় ভাসানীর জীবনের খণ্ড খণ্ড চিত্র গল্পের আদলে ফুটে উঠেছে এবং সেই গল্প যেন রূপকথাকেও হার মানায়। সৈয়দ আবুল মকসুদ সেই গল্পগুলো বইয়ে লিপিবদ্ধ করার আগে যাচাই-বাছাই করেছেন। শুধু গল্পের আদলে লেখাগুলো লেখেননি, বরং বয়ানদাতার তখনকার পরিচয় তুলে ধরার পাশাপাশি তিনি ভাসানীর সাথে কীভাবে সম্পর্কযুক্ত ছিলেন, সেই অনুসন্ধানও করেছেন। এর ফলে গল্পগুলো শুধু আর গল্প থাকেনি, হয়ে উঠেছে প্রামাণ্য দলিল। এ বই পড়ার পর মওলানার জীবনের অনেকগুলো বিষয় সম্বন্ধে পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাবে।
মওলানা একাধারে ছিলেন পীর, রাজনৈতিক নেতা; যদিও অন্যদের সাথে তার তফাৎ ছিল এই যে, তিনি কৃষকদের অধিকার নিয়ে কথা বলতেন। এর পাশাপাশি এ বইয়ে উঠে এসেছে মওলানার অনাড়ম্বর জীবনের নানা অজানা কাহিনী। উঠে এসেছে তার অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের গল্প। সামনে থেকে মওলানা সবসময় সব আন্দোলনে নেতৃত্ব দিয়েছেন। আবার যখন মতের অমিল হয়েছে, সেখান থেকে বের হয়ে গেছেন চাওয়া-পাওয়ার হিসেব না মিলিয়েই; কিন্তু নীতির সাথে কখনও আপোষ করেননি।
মওলানা ভাসানী একদিকে যেমন রাজনীতি সচেতন ছিলেন, অন্যদিকে ছিলেন সমাজ সংস্কারক। তিনি ঠিকই উপলব্ধি করেছিলেন, সমাজের অর্ধেক নারীকে অশিক্ষিত রেখে সমাজের উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই নারীশিক্ষার পাশাপাশি তাদেরকে ঘোড়ায় চড়াসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণের কথাও বলেছেন। টাঙ্গাইলের মির্জাপুর এলাকার অধিবাসী রণদা প্রসাদ সাহা সেই সময়ে মেয়েদেরকে আধুনিকভাবে গড়ে তুলছিলেন দেখে মওলানা বলেছিলেন,
সেই পঞ্চাশের দশকে রণদা বাবু তাঁর মেয়েদের ঘোড়ায় চড়া শিখিয়েছেন, রক্ষণশীল ও কুসংস্কারাচ্ছন্ন বাঙালি সমাজে এটা কম বড় কথা নয়।
এ বইয়ে ঘুরেফিরেই এসেছে ভাসানীর আটপৌরে জীবনবোধের গল্প। যা পড়লে মনেই হয় না, এসব কোনো রাজনৈতিক নেতার জীবনের গল্প। মনে হয়, গ্রামের কোনো সাধারণ কৃষকের কথা বলা হচ্ছে। তিনি কখনও নদীর বুকে জেগে থাকা চরে আটকে যাওয়া নৌকা ঠেলছেন, কখনও তাকে দেখা যাচ্ছে অতিথির জন্য রান্না করার কাঠ চোরাই করতে। আবার তাকে দেখা যাচ্ছে, সাধারণ মানুষের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে রাস্তা তৈরি করতে। পাশাপাশি এসেছে মওলানার ভাষা এবং রাজনৈতিক জ্ঞান ও প্রজ্ঞার গল্প। তিনি বাংলার পাশাপাশি দরকার হলে হিন্দি ও উর্দু ভাষাতেও বক্তব্য দিতেন, এমনকি তাকে দেখা যায় বিদেশি প্রতিনিধিদের সাথে ইংরেজিতেও আলাপ করতে। তবে সবকিছু ছাপিয়ে এসেছে তার আন্তরিকতার গল্পগুলো। মানুষকে আপ্যায়ন না করে ছাড়তেন না কখনও। দরকার হলে নিজে হাতে রান্না করে খাওয়াতেন।
মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর প্রথম জীবনের রাজনীতি থেকে শুরু করে জীবনের একেবারে শেষ পর্যায়ের বিভিন্ন ঘটনা এ বইয়ে স্থান পেয়েছে,
“বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের শেষ দিকে তিনি সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলোর সাথে যুক্ত হন। পরবর্তীতে তিনি উপলব্ধি করেন এভাবে লুটতরাজ করে ভারতের স্বাধীনতা অর্জনে সম্ভব নয়। তখন তিনি সন্ত্রাসবাদী আন্দোলন থেকে সরে আসেন।”
ভাসানী তার রাজনৈতিক জীবনে সবসময়ই সাধারণ জনমানুষের অধিকারের জন্য লড়েছেন। আর শোষকবিরোধী বিভিন্ন বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি ওয়াজ মাহফিলেও শোষকবিরোধী বক্তব্য রাখতেন, তাই তার ওয়াজ মাহফিলে সব ধর্ম-বর্ণর শ্রোতার সমাবেশ ঘটত। তিনি ব্যক্তিগত জীবনে ইসলামের নিয়ম-কানুন পালন করতেন এবং মনে-প্রাণে ছিলেন পুরোপুরি অসাম্প্রদায়িক। পাকিস্তানের প্রতিষ্ঠাতাদের একজন হয়েও তিনি কিন্তু জিন্নাহর দ্বিজাতিতত্ত্বের সমর্থক ছিলেন না। তিনি ছিলেন বাঙালি জাতিরাষ্ট্রের পক্ষে। পাকিস্তান শুধু মুসলমানদের আবাসভূমি হবে- এ রীতির তিনি ছিলেন ঘোর বিরোধী। তিনি বলতেন,
পাকিস্তান কোনো ইসলামী রাষ্ট্র বা ধর্ম রাষ্ট্র হবে না; পাকিস্তান হবে একটি আধুনিক গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র।
তিনি বলতেন,
পূর্ব বাংলা থেকে হিন্দুরা চলে গেলে বাঙালি কালচার নষ্ট হয়ে যাবে।
পশ্চিম পাকিস্তানের লোকেরা বাংলা ভাষার সাথে নামাজ তথা ধর্মের সাংঘর্ষিক একটা ব্যাখ্যা পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই দেয়ার চেষ্টা করে আসছিল। একবার এক পশ্চিম পাকিস্তানী প্রতিনিধি দলের সাথে মওলানা ভাসানীর কথা হলে তিনি বলেন,
ধর্মের সঙ্গে ভাষার কোনো সম্পর্ক নাই। ধর্ম এক জিনিস আর ভাষা আর একটি জিনিস। একটির সঙ্গে অন্যটিকে যারা মেশায় তারা অসৎ ও মতলববাজ। উর্দুর সঙ্গে ইসলামের সম্পর্ক কী? আরব দেশের মানুষ উর্দুতে কথা বলে নাকি? ইরানের মানুষ কি উর্দু জানে? উর্দু কি দুনিয়ার সব মুসলমানের ভাষা? বাংলাকে যারা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা চায় তারা পাকিস্তানের দুশমন নয়। যারা চায় না তারাই পাকিস্তানের দুশমন। পাকিস্তানের যদি ক্ষতি হয় তাহলে বাংলাবিরোধীদের দ্বারাই হবে।”
তিনি আবার সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে তাদের উদ্দেশে বলেছেন,
“যেসব মুসলমান হিন্দুদের বিধর্মী মনে করে তাদের ক্ষতি করতে চায় আমি তাদের বলি, তোমরা কারা? খুব বেশি হইলে চার-পাঁচ পুরুষ আগে তোমরা কারা ছিলা? তোমাদের বাপ-দাদার বাপ-দাদারা ছিলেন হয় হিন্দু, নয় নমঃশূদ্র। এ দেশের হিন্দু আর মুসলমানের একই রক্ত। কতজন আরব ইরান-আফগানিস্তান হইতে আসিয়াছে? পাঁচ পুরুষ আগে যারা ছিল তোমাদের পূর্বপুরুষ আজ তাদের গায়ে হাত তুলতে তোমাদের বুক কাঁপে না? তোমরা কি মানুষ না পশু?”
মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানী শেকড়কে ভালোবাসতে তার সমস্যা, সুবিধার খোঁজ রাখতে বলেছেন। একবার এক কৃষকের ছেলে, যে এলাকার কৃষকদের খবর জানে না, কিন্তু ছাত্র রাজনীতি করার সিদ্ধান্ত নিলে তিনি তাকে জিজ্ঞেস করেন, “তোমার বাপ কী করে?” ছেলেটি উত্তর দেয়, “কৃষক”। তখন মওলানা বলেন,
“কৃষকের ছেলে হইয়া এলাকার কৃষকদের অবস্থা বলতে পারো না। তুমি করবা ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতি। তোমারে দিয়া ছাত্র ইউনিয়নের রাজনীতি হইব না। কলেজে পড়তে গিয়া বাপ-দাদার পেশার কথা ভুইলা গেছ। সমাজতন্ত্রের আন্দোলন তোমারে দিয়া হইব না। ভালো কইরা পড়ালেখা কইরা পাশ করো গিয়া। চাকরি-বাকরি করো। তবে ঘুষ খাইয়ো না, দুর্নীতি কইরো না। ছাত্রনেতা হওয়ার দরকার নাই, ভালো মানুষ হওয়ার চেষ্টা করো।”
ভাসানী মোটেও বৈষয়িক ছিলেন না। আসাম মুসলিম লীগ নেতা ও স্বাধীনতার পর পাকিস্তানের মন্ত্রী আবদুল মতিন চৌধুরীর স্ত্রীর ভাষ্য অনুযায়ী,
“মওলানা থাকেন ছনের ঘরে। সেটাও এমন বড় কিছু নয়। ঘরে ঢুকে দেখি চেয়ার-টেবিল খাট-পালঙ্ক তো দূরের কথা, একটি সাধারণ চৌকি পর্যন্ত নেই। মেঝেতে খড় বিছানো। তার ওপর শীতলপাটি বিছানো। তার ওপর একটা পাতলা তোষক।”
তার দীর্ঘ রাজনৈতিক জীবনে ঢাকাতে কোনো স্থায়ী আবাস ছিলো না। তিনি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্নজনের বাসায় থাকতেন, আর থাকতেন হোটেলে। তবে নিজে বৈষয়িক না হয়েও অনেককে বৈষয়িক উপদেশ দিতেন।
ভাসানী সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গের লেখক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় বলেছেন,
আসলে তিনি সোজা-সরল ধরনের মানুষ। রেখেঢেকে মেপেবুঝে কথা বলতে জানেন না। মনে যা ভাবেন, মুখে তা-ই বলেন। খোলামেলা মানুষ। তাতে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়। তাছাড়া তিনি মাটির মানুষের একেবারে কাছে আছেন। তাদের সুখ-দুঃখ-অনুভূতি তিনি ভালো বোঝেন, যা উপমহাদেশের আর কোনো নেতা অনুভব করতে পারেন না। ভাসানীর রাজনীতি সম্পূর্ণ অন্য ধরনের রাজনীতি- প্রথাগত রাজনীতির সঙ্গে যার মিল নেই।
‘ভাসানী কাহিনী’র মুখবন্ধে লেখক বলেছেন,
“জাতীয় জীবনের রাজনীতির অঙ্গনে মওলানা ভাসানী আজ অবহেলিত। দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকদের কাছে তাঁর প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে।”
উপক্রমণিকায় বলেছেন,
“অন্য জাতীয়তাবাদী নেতার সাথে সঙ্গে তাঁর পার্থক্য এখানে যে, তিনি অবিচ্ছিন্নভাবে দরিদ্র কৃষক ও গ্রামের খেটে-খাওয়া মানুষের অধিকার রক্ষার জন্য জমিদার-মহাজন প্রভৃতি শোষকশ্রেণীর বিরুদ্ধে লড়াই করেছেন।… পাকিস্তানের রাজনীতিতে তাঁকে সময়ে তিনি ছিলেন সবচেয়ে জনপ্রিয় নেতা। যদিও সব সময়ই তিনি ছিলেন ক্ষমতার বাইরে।… ১৯৩০-এর দশকের মাঝামাঝি থেকে তাঁর মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত দেশের এমন কোন রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল না যার নেতৃত্ব দেননি মওলানা ভাসানী।”