মানুষ বইয়ের পাতায় রহস্য পছন্দ করে। সে চায় সেই রহস্যঘেরা দুনিয়ায় নিজেকে পুরোপুরি হারিয়ে ফেলতে। কিন্তু একটা সময় আবার সে-ই চায় ক্রমাগত জট পাকাতে থাকা সেই রহস্যের হাত থেকে মুক্তি। এই যে ‘রহস্য’ নামক শব্দকে ঘিরে তার এতসব আকাঙ্ক্ষা, সেই চাহিদাগুলো মেটাতে সাহিত্যের দুনিয়ায় বেশ গুরুত্বপূর্ণ স্থান দখল করে আছে হরেক রকম গোয়েন্দাকাহিনি।
গোয়েন্দাদের কাজকর্ম কার না ভাল লাগে? হুট করে কোনো এক রহস্যের সন্ধান পাওয়া যেটা তার কাছে বেশ চমকপ্রদ বলে মনে হচ্ছে, এরপর সেই রহস্যের ভেতরে ঢুকতে ঢুকতে কেঁচো খুঁড়তে সাপের সন্ধান পাওয়া, কাহিনির পরতে পরতে নানা রকম অপ্রত্যাশিত বাঁক… এভাবেই চলতে থাকে গোয়েন্দাকাহিনিগুলো। শেষপর্যন্ত অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অপরাধীর সন্ধান মেলে, কখনও আবার লেখক ইচ্ছা করেই রহস্য অমীমাংসিত অবস্থায় রেখে দেন, পাঠককে দেন ‘শেষ হইয়াও হইল না শেষ’ ঘরানার অদ্ভুত এক স্বাদ।
এভাবেই শৈশব থেকে এদেশের গোয়েন্দাকাহিনিপ্রিয় পাঠকসমাজ পড়ে এসেছে তিন গোয়েন্দা (সেবা প্রকাশনী), মাসুদ রানা (সেবা প্রকাশনী), ফেলুদা (সত্যজিৎ রায়), শার্লক হোমস (স্যার আর্থার কোনান ডয়েল), ব্যোমকেশ বক্সী (শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়) এর মতো সিরিজসহ আরও অনেক গোয়েন্দাকাহিনিই, যার মাঝে সিরিজ, একক, মৌলিক এবং অনুবাদ সবকিছুর মিশ্রণই রয়েছে। এই চার বিভাগের যেটাতেই পড়ুক না কেন, দিনশেষে এই বইগুলো ঠিকই পাঠকের মনে জায়গা করে নিতে পেরেছে, এর মূল চরিত্রগুলো হয়ে উঠেছে রহস্যপ্রেমী কিশোর-কিশোরীদের ভাললাগার ব্যক্তিত্ব, কল্পনার অনুকরণীয় আদর্শ।
কিন্তু আপনি কি একটা জিনিস খেয়াল করেছেন? উপরে যে সাহিত্যকর্মগুলোর ব্যাপারে বলা হলো, এগুলোর সবই কিন্তু কাল্পনিক চরিত্র, কাল্পনিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে এগিয়ে গিয়েছে। অনেক সময় লেখক হয়তো বাস্তব জীবনেই চলাফেরা করা কোনো ব্যক্তিকে দেখে কোনো চরিত্র সৃষ্টি করেছেন, কিংবা সত্যি সত্যিই ঘটে যাওয়া কোনো ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে তার গল্পের প্লট গড়ে তুলেছেন, কিন্তু তারপরও দিনশেষে তা কখনোই পুরোপুরি বাস্তব হয়ে ওঠেনি, বাস্তব সাথে মেলানোর ইচ্ছেও সেই সাহিত্যিকের ছিল না।
ঠিক এই শূন্যস্থানই যেন খুঁজে পেয়েছিলেন বর্তমান সময়ের অন্যতম জনপ্রিয় ফিচার লেখক, মধ্যপ্রাচ্য বিষয়ক রাজনীতি ও ইতিহাস বিশ্লেষক মোজাম্মেল হোসেন ত্বোহা। তাই তো জীবনের প্রথম বই হিসেবে তিনি নিয়ে আসলেন এমন এক সৃষ্টিই যা কিনা গোয়েন্দাকাহিনিই বলবে, তবে কাল্পনিক নয়, সত্য! যে গোয়েন্দাকাহিনিতে বর্ণিত প্রতিটি চরিত্র একককালে দুনিয়ার বুকে হেঁটে বেড়িয়েছে, কখনও সদর্পে, কখনও চারিদিকে অতি সতর্ক নজর রেখে, দিনশেষে নিজ নিজ মিশন সাকসেসফুল করাই ছিল যাদের একমাত্র উদ্দেশ্য।
জ্বি পাঠক, আপনি যদি বইটি পড়ে থাকেন, তাহলে এতক্ষণে বুঝে যাবার কথা কোন বইয়ের কথা বলা হচ্ছে। ‘স্পাই স্টোরিজ – এসপিওনাজ জগতের অবিশ্বাস্য কিছু সত্য কাহিনি’- এটিই আজকের রিভিউয়ের আলোচ্য বই, যার রচয়িতা হিসেবে ইতোমধ্যেই পাঠকসমাজে আলোড়ন সৃষ্টি করেছেন মোজাম্মেল হোসেন ত্বোহা। এটি এমনই এক বই যা থাকা উচিত রহস্যপ্রেমী সকল পাঠকের বুকশেলফেই; না, সেখানে কোনো তাকের শোভাবর্ধনের উদ্দেশ্যে নয়, বরং আপনার মস্তিষ্কের জ্ঞানভাণ্ডার বৃদ্ধির উদ্দেশ্যেই।
কিন্তু কী আছে এই বইয়ে যার জন্য এত প্রশংসা করা হচ্ছে এর? চলুন তাহলে এখন সেই বিষয়গুলোর প্রতিই নজর দেয়া যাক।
মোট ছ’জন গোয়েন্দার কাহিনি উঠে এসেছে ‘স্পাই স্টোরিজ’ বইটিতে। এদের সবাই যে ইতিহাসে খুব বেশি আলোচিত, সংবাদমাধ্যমে যে তারা নিয়মিতভাবেই আলোচনায় উঠে আসেন এমনটা না, কিন্তু তাদের কাজ এবং এর প্রভাবকে উপেক্ষা করার উপায় নেই মোটেই। উদাহরণ হিসেবে বইয়ের একেবারে প্রথম গোয়েন্দাকাহিনির কথাই বলা যাক।
অ্যাডলফ জর্জিয়েভিচ তোলকাচভ; মানুষের কাছে যিনি অ্যাডলফ তোলকাচভ নামেই বেশি পরিচিত। সোভিয়েত এই ইলেক্ট্রনিক ইঞ্জিনিয়ার ১৯৭৯ থেকে ১৯৮৫ পর্যন্ত মাত্র ছ’বছর মার্কিন গোয়েন্দা সংস্থা সিআইএ (সেন্ট্রাল ইন্টেলিজেন্স এজেন্সি) এর হয়ে কাজ করেন। কিন্তু এই অল্প সময়েই তিনি যে পরিমাণ প্রভাব রাখতে সক্ষম হয়েছেন, তা অবিশ্বাস্য; অর্থমূল্যে পরিমাপ করতে গেলেও চোখ ছানাবড়া হয়ে যেতে বাধ্য। তিনি আমেরিকার হাতে সোভিয়ের সামরিক বাহিনীর বৈজ্ঞানিক গবেষণা কার্যক্রমের এমন সব গোপন তথ্য তুলে দেন, যার বদৌলতে চোখ খুলে যায় মার্কিন কর্তৃপক্ষের, তারা জেনে যায় তৎকালে তাদের সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষের দুর্বলতা সম্পর্কে।
ওদিকে সেই তথ্যগুলো আমেরিকার পাশাপাশি তার মিত্র দেশগুলোকেও যেন দু’হাত ভরে তথ্যের সাগরে ভাসিয়েছে। অবধারিতভাবেই এই তথ্যগুলো চলে যায় ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের হাতেও। সেসময় আবার আরব দেশগুলো সোভিয়েত প্রযুক্তি ব্যবহার করত। ফলে ইসরায়েল সহজেই আরব রাষ্ট্রগুলোর উপর শ্রেষ্ঠত্ব অর্জনে সক্ষম হয়। ধারণা করা হয়, ছয় বছরে তোলকাচভ সিআইএ-কে যে পরিমাণ তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করেছেন, তার আর্থিক মূল্য ১০ বিলিয়ন ডলার হওয়াও অসম্ভব কিছু নয়! তাই তো লেখক এই অধ্যায়ের নামও দিয়েছেন ‘অ্যাডলফ তোলকাচভ: বিলিয়ন ডলার স্পাই’।
এভাবেই একে একে এসেছে বইয়ের পরবর্তী পাঁচ গল্প, যার মাঝে আছে বানানজ্ঞান না থাকা গোয়েন্দা ব্রায়ান রিগ্যান, বৈরুতের ইসরায়েলি মাতাহারি শুলা কোহেনসহ আরও ক’জন।
অনেকের মাথায়ই প্রশ্ন আসতে পারে, যে মানুষ গোয়েন্দাদের ইতিহাস নিয়ে একটা আস্ত বই লিখে ফেলল, তাকে তো অনেক গোয়েন্দাকাহিনি সম্পর্কেই জানতে হয়েছে, তাহলে ফিকশন না লিখে কেন নন-ফিকশনের দিকে এগিয়ে গেলেন লেখক মোজাম্মেল হোসেন ত্বোহা? এই প্রশ্নের উত্তর তিনি দিয়েছেন বইয়ের শুরুতেই, ‘লেখকের কথা’ অংশে। তার মতে, “পৃথিবীতে সত্যিকার গোয়েন্দাকাহিনির সংখ্যাই এত বেশি, সেগুলো পড়তে গেলেই একজীবন ফুরিয়ে যাবে।” পাশাপাশি এই সত্যিকারের কাহিনিগুলো যে একজন পাঠককে গল্প, ইতিহাস, আন্তর্জাতিক রাজনীতির থ্রি-ইন-ওয়ান ফ্লেভার এক জায়গায়, এক মলাটের ভেতরেই দেয়, সেটাও উল্লেখ করতে ভোলেননি তিনি।
প্রশ্ন আসতে পারে, “বইয়ের কাহিনিগুলো যে সত্য তা কীভাবে বুঝব? লেখক যে একচোখা নীতিতে লেখেননি তারই বা গ্যারান্টি কী?” এই প্রশ্নের জবাব আপনি খুঁজে পাবেন দুটো জায়গায়। বইয়ের শুরুতেই লেখক জানিয়ে দিয়েছেন, এই বইয়ের কাহিনিগুলো লেখার জন্য তিনি বেশ কিছু নন-ফিকশন থ্রিলার বইয়ের পাশাপাশি তথ্যবহুল ডকুমেন্টারি, অনলাইনে নির্ভরযোগ্য বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের আর্টিকেল এবং ফাঁস হয়ে যাওয়া বিভিন্ন ডকুমেন্টের সাহায্য নিয়েছেন। প্রতিটি কাহিনির শেষে আপনি সেই লেখার প্রস্তুতিতে যেসব তথ্যসূত্রের সহায়তা নেয়া হয়েছে, সেসবের উল্লেখও দেখতে পাবেন। সেই সাথে বিগত বেশ কয়েক বছর ধরে লেখক মোজাম্মেল হোসেন ত্বোহার সাথে ব্যক্তিগতভাবে কাজ করার সুবাদে জানি, তিনি নিজস্ব মতবাদ প্রতিষ্ঠার পরিবর্তে নিজের লেখাকে তথ্যবহুল করে তুলতে, সকল পক্ষের বক্তব্য সুন্দরভাবে উপস্থাপন করতেই পছন্দ করেন, যার ছাপ খুঁজে পাওয়া যাবে এই বইয়ের প্রতিটি লেখাতেও।
বর্ণনাভঙ্গি, কাহিনির মাঝে জায়গামতো রহস্য ঘনীভূতকরণ, চমৎকারভাবে সেই জট ছাড়ানো, প্রতিটি চরিত্রকে সুন্দরভাবে ফুটিয়ে তুলে পাঠকের মনের মাঝে গেঁথে দেয়া- এককথায় প্রতিটি কাজই বেশ চমৎকারভাবে করতে সক্ষম হয়েছেন লেখক। অনলাইনে ‘স্পাই স্টোরিজ’ বইয়ের যাবতীয় রিভিউও এর পাঠকপ্রিয়তার সাক্ষ্যই দেয়। তাই কল্পনা ছেড়ে গোয়েন্দাদের বাস্তব জগতের সন্ধান পেতে, তাদের সত্যিকার রোমাঞ্চ আর সংগ্রামের ব্যাপারে জানতে আজই ‘স্পাই স্টোরিজ’ বইটি সংগ্রহ করতে ভুলবেন না যেন!
…
রোর বাংলার পাঠকদের জন্য এই ‘স্পাই স্টোরিজ’ বইয়ের বেলায় রয়েছে একটি সুখবর। কারণ এখন মাত্র ৯৯ টাকায় রোর বাংলায় অনলাইনেই আপনি কিনতে পারছেন বইটি, যার ভেতরে থাকছে চমৎকার সব রঙিন ছবি, যা গোয়েন্দাদের অবিশ্বাস্য সব কর্মকান্ডকে আরও জীবন্ত করে তুলবে নিঃসন্দেহে! সেই সাথে মূল বইয়ের সবগুলো কাহিনির পাশাপাশি বোনাস হিসেবে থাকছে আরও একটি কাহিনিও!
রোর বাংলা থেকে বইটি কিনতে ভিজিট করুন নিচের লিঙ্কটি:
…
বই: স্পাই স্টোরিজ
লেখক: মোজাম্মেল হোসেন ত্বোহা
প্রকাশনী: স্বরে অ
প্রকাশকাল: ফেব্রুয়ারি ২০২০
হার্ডকপি বইয়ের মুদ্রিত মূল্য: ২৭০ টাকা
রোর বাংলায় অনলাইন বইয়ের মূল্য: ৯৯ টাকা