ক্রিপ্টোমুদ্রা। বেশি অতীতের নয়, মাত্র এক যুগ আগের সময়ের দিকেও যদি ফিরে তাকানো হয় তাহলে দেখা যাবে, দুনিয়া জুড়ে ডলার, ইউরো, রুপি, ইয়েন, লিরা, টাকার মতো এত শত মুদ্রার ভিড়ে ক্রিপ্টোমুদ্রা নামক এমন আজব মুদ্রার নাম কেউ কোনোদিন শোনেনি। অথচ দেখুন, মাত্র এক যুগের ব্যবধানে এখন সময়ের সবচেয়ে আলোচিত বাজওয়ার্ড— ক্রিপ্টোমুদ্রা।
বর্তমান বিশ্বের সবচেয়ে জনপ্রিয় ক্রিপ্টোমুদ্রার নাম বিটকয়েন। শুরুতে তাবৎ দুনিয়া যাকে হুজুগ বলে উড়িয়ে দিচ্ছিল, এক যুগ পরে এসে সেই বিটকয়েনের নাম কমবেশি সকলেই জানে। বিটকয়েনের মূলে যে ব্লকচেইন প্রযুক্তি তার ওপর ভিত্তি করে তৈরি হয়েছে সহস্রাধিক ক্রিপ্টোমুদ্রা। এ নিয়ে লোকের আগ্রহ আর কানাঘুষার অন্ত নেই। কিন্তু সঠিক তথ্য ও বিবরণের অভাবে এর বিস্তারিত খুব কম লোকই জানে।
বিটকয়েন নিয়ে জানতেই হবে— এমন কোনো বাধ্যবাধকতা নেই। তবে প্রযুক্তির এই যুগে প্রতিনিয়ত পরিবর্তনের সাথে খাপ খাওয়াতে সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে ধারণা থাকাটা জরুরি। যে যতটা নতুন সব সম্ভাবনা নিয়ে খোঁজখবর রাখছে, সে অন্যদের তুলনায় ততটাই এগিয়ে থাকছে। তবে ইন্টারনেট ও মুঠোফোনের সহজলভ্যতার এই সময়ে বিচিত্র সব তথ্য মুহূর্তেই ছড়িয়ে পড়ছে। এগুলোর মধ্যে কোনটি সঠিক আর কোনটি স্রেফ প্রমাদ আলাপ তা নির্ণয় করা মুশকিল।
ক্রিপ্টোমুদ্রা নিয়ে তথ্যবহুল বই খুব বেশি নেই। তবে জ্ঞানপিপাসুদের হতাশ হওয়ারও কিছু নেই। ক্রিপ্টোমুদ্রা, বিটকয়েন ও ব্লকচেইনের মতো জটিল সব বিষয় সম্পর্কে জানতে পারবেন নির্ভরযোগ্য উৎসের তথ্যসমূহ ঘাটলে। বিষয়টি ঠিক অসম্ভব না হলেও, যথেষ্ট সময়সাপেক্ষ বটে। তবে বাংলা ভাষী পাঠকদের জন্য ভালো খবর হলো, বিটকয়েন, ব্লকচেইন প্রযুক্তি এবং অন্যান্য মুদ্রা নামে আস্ত এক বই আছে। বলা যায়, এটি বাংলা ভাষায় বিটকয়েনের ওপর প্রকাশিত সর্বপ্রথম তথ্যবহুল বই। ক্রিপ্টোমুদ্রার গোড়া থেকে শুরু করে বর্তমান হয়ে ভবিষ্যত যাত্রার কথা বর্ণিত হয়েছে এখানে। অত্যন্ত সহজ ও প্রাঞ্জল শব্দবিন্যাসে দুর্দান্ত কাজটি করেছেন লেখক মোস্তফা তানিম।
মোস্তাফা তানিম বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ চুকিয়ে উচ্চশিক্ষার উদ্দেশ্যে পাড়ি জমান যুক্তরাষ্ট্রে। সেখানকার টেক্সাস এ এন্ড এম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করে সেখানেই থিতু হয়েছেন। বিজ্ঞান নিয়ে লেখকের আগ্রহ কৈশোরকাল থেকেই। একসময় পত্রিকার জন্য প্রচুর লিখেছেন। এখনও লিখছেন। এভাবে লিখতে লিখতে একসময় মন দেন বই লেখার কাজে। আর এখন, বাংলাদেশের যে কয়জন সায়েন্স ফিকশন লেখক তাদের লেখা দিয়ে পাঠক হৃদয়ে জায়গা করে নিয়েছেন, তাদেরই একজন তিনি। ২০১৮ সালে তার লিখিত মৌলিক গ্রন্থ হিসেবে প্রকাশ পায় বিটকয়েন, ব্লকচেইন প্রযুক্তি এবং অন্যান্য মুদ্রা।
বইটিতে বিভিন্ন ক্রিপ্টোমুদ্রা সম্পর্কিত মৌলিক, নির্ভরযোগ্য, হালনাগাদ এবং সম্ভাবনাময় তথ্য তুলে ধরেছেন। সুলিখিত এই বইটি পড়লে এ বিষয় নিয়ে মোটামুটি অনেক কিছুই জানা হয়ে যাবে।
যেকোনো ঘটনার গভীরে প্রবেশের আগে তার একটি শক্ত ভিত্তি গড়ে তুলতে হয়। বইটির ভূমিকা অংশ সেই কাজটি করা হয়েছে। একজন খাঁটি খনি শ্রমিকের মতো মূল থেকে থেকে বিটকয়েন ও ক্রিপ্টোমুদ্রার প্রকৃত পরিচয় সকলের নিকট তুলে ধরেছেন।
অলীক বিষয় মনে হলেও, আমরা এমন এক মুদ্রা পেয়েছি যা ধরা যায় না, ছোঁয়া যায় না। কিন্তু মুদ্রাসুলভ সকল গুণাবলি এর আছে। আবার আপনি এটি ক্রয়-বিক্রয় করতে চাইলেও ব্যাংকের মতো কোনো মাধ্যমের প্রয়োজন পড়েছে না, পুরো প্রক্রিয়াটিই অনলাইনে সেরে ফেলতে পারবেন। এর না আছে কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ, না আছে লেনদেনের কোনো ভৌগোলিক কিংবা রাজনৈতিক সীমারেখা। এখনও বিশ্বাস হতে চায় না, তারপরেও এটিই সত্য। ক্রিপ্টোমুদ্রার আবিষ্কার বহুল প্রত্যাশিত বৈপ্লবিক কোনো আবিষ্কার থেকে কম কিছু না। কিন্তু কেন? ক্রিপ্টোমুদ্রাকে বৈপ্লবিক আবিষ্কার বলার পেছনের যে যথোচিত কারণসমূহ বইতে তুলে ধরা হয়েছে, তা যতটা না অর্থনৈতিক তার চেয়ে বেশি বৈজ্ঞানিক। সেগুলো থেকে যে পাঠকেরা বিপুল রসদ পাবেন, তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
কিন্তু পৃথিবীতে এত শত মুদ্রা থাকার পরেও, ক্রিপ্টোমুদ্রা কেন এলো? কিংবা ক্রিপ্টোমুদ্রার অগ্রসরেরই কারণ কী? এই প্রশ্নগুলোর উত্তর খুঁজতে হলে আমাদের চোখ বুলাতে হবে মুদ্রার বিবর্তনের বাঁকে বাঁকে। লেখক দেখিয়েছেন কীভাবে একটি মুদ্রা অপর মুদ্রাকে পেছেনে ফেলে বিনিময়ের মাধ্যম হিসেবে অর্থব্যবস্থায় প্রবেশ করে তার সামগ্রিক চিত্রই বদলে দেয়। এই অনুসন্ধানের পথে অগ্রসর হতে হতেই স্পষ্ট হয়ে উঠবে অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ক্রিপ্টোমুদ্রার অবির্ভাব তথা অগ্রসরের কারণ। আর মুদ্রা সম্পর্কে আমাদের যে প্রচলিত ধারণা তারও আমূল পরিবর্তন ঘটে মুদ্রার এই বাঁকবদলের দিকে তাকালে। এগুলো আলোচিত হয়েছে বইটিতে।
ক্রিপ্টোমুদ্রার উদ্ভাবন যতটা যুগান্তকারী তার থেকেও বেশি রহস্যের ঘ্রাণ এর আবিষ্কারকের নামকে ঘিরে। আজকের দুনিয়ায় যে এত বড় আবিষ্কার করে ফেলেছে, সে জনসমক্ষে আসবে, আবিষ্কার নিয়ে জোরেশোরে কাজ করবে; সেটাই যেন স্বাভাবিক। কিন্তু না, বিটকয়েনের আবিষ্কারকের ক্ষেত্রে ঠিক তার উল্টো। এই রহস্যকে ঘিরেই বইয়ের দ্বিতীয় অধ্যায়ের অবতারণা। বহুদিন ধরে গবেষকদের ক্রিপ্টোমুদ্রা আবিষ্কারের ব্যাপক প্রচেষ্টা, দুই যুগেরও বেশি সময় ধরে তার সমস্যা সমাধানে রত থাকা, হঠাৎ অনলাইন দুনিয়ায় সমস্যার সমাধান নিয়ে কোনো রহস্যময় ব্যক্তির আবির্ভাব, আবার পর্দার আড়ালে থেকে থেকেই হারিয়ে যাওয়া— অধ্যায়ের প্রতিটি লাইনের অবতারণা রহস্য গল্পের মতোই রোমাঞ্চকর। লেখক এই অধ্যায়ের সমাপ্তিও টেনেছেন এক অমীমাংসিত রহস্যের জানান দিয়ে।
বর্তমানে হাজারেরও বেশি ক্রিপ্টোমুদ্রা আছে বাজারে। বিটকয়েন হলো প্রচলিত হাজারখানেক ক্রিপ্টোমুদ্রার একটি। বিটকয়েন ছাড়া যেকোনো ক্রিপ্টোমুদ্রাকে বলা হয় অল্টকয়েন। বইয়ের নামে অন্যান্য মুদ্রা বলতে অল্টকয়েনকেই বুঝানো হয়েছে। বর্তমান সময়ে বিটকয়েনের প্রতিদ্বন্দ্বী হিসেবে যে সকল অল্টকয়েন সাড়া জাগাতে পেরেছে, সে সকল ক্রিপ্টোমুদ্রার কথা সংক্ষিপ্ত কিন্তু আকর্ষণীয় ভাষায় উঠে এসেছে বইটির পঞ্চম অধ্যায়ে। উল্লেখ্য, সম্ভাবনাময় অল্টকয়েন হিসেবে শুধু ইথারিয়াম নিয়ে রচিত হয়েছে একটি স্বতন্ত্র অধ্যায়।
দুনিয়াজোড়া এত এত ক্রিপ্টোমুদ্রা থাকলেও এদের মধ্যে জনপ্রিয়তম নিঃসন্দেহে বিটকয়েন। প্রথম ক্রিপ্টোমুদ্রা হিসেবে বিটকয়েনের অধিক আলোচনা ও জনপ্রিয়তার কেন্দ্রে থাকার মোক্ষম কারণ উঠে এসেছে লেখকের সাবলীল বর্ণনায়। অবিশ্বাস্য মূল্য বিস্ফোরণে অনেকে তো একে মুদ্রার চেয়ে সম্পদ হিসেবে বেশি দেখছেন। বলা যায়, বিশ্বেজুড়ে রীতিমতো তোলপাড় শুরু করে দিয়েছে বিটকয়েন। কিন্তু বিটকয়েনের কেন এত মূল্য? বিটকয়েন কীভাবে তৈরি হয়? কিংবা মাইনিং করা হয়? এগুলোর সবই মৌলিক প্রশ্ন। এরকম আরও অনেক প্রশ্ন প্রতিনিয়ত শোনা যাচ্ছে এবং লোকমুখে বিচিত্র তথ্য ছড়াচ্ছে। এজন্য এসব প্রশ্নের সঠিক উত্তর জানা প্রয়োজন, প্রয়োজন বিভ্রান্তির অপনোদন। লেখক শুধু বিটকয়েনের আগাগোড়া তুলে ধরেই ক্ষান্ত হননি, বিটকয়েন ঘিরে প্রচলিত বহু জটলারও সমাধান করেছেন।
ক্রিপ্টোমুদ্রা নিয়ে বই অথচ সকল ক্রিপ্টোমুদ্রার মূলে যে ব্লকচেইন প্রযুক্তি, তা নিয়ে বিশদ আলোচনা থাকবে না, সেটা তো হতে পারে না। বইয়ে মূলত ক্রিপ্টোমুদ্রার মূলে যে ব্লকচেইন প্রযুক্তি তার ওপর অধিক জোর দেওয়া হয়েছে। অনেকে যে ব্লকচেইনের দৌড় ক্রিপ্টোমুদ্রা পর্যন্ত ভেবে ভুল করেন, তারও খোলাসা হয়। যদিও এটি নিয়ে বইয়ের একাধিক অধ্যায়ে বিস্তর আলোচনা রয়েছে, তবুও এর ভবিষ্যৎ সম্ভাবনার বিষয়টি মাথায় রেখে, ব্লকচেইন প্রযুক্তি নিয়ে রচিত হয়েছে পুরো একটি স্বতন্ত্র অধ্যায়।
অনেক যুগান্তকারী আবিষ্কারের কিছু না কিছু অভিশাপ ছিল। ক্রিপ্টোমুদ্রার বেলায়তেও এর ব্যত্যয় ঘটেনি। এক্ষেত্রে আমির-ফকিরের পাল্টাপাল্টি যে অনুমান রয়েছে, তাও সম্পূর্ণ অমূলক নয়। ক্রিপ্টোমুদ্রা যে যুগান্তকারী আবিষ্কার এতে কোনো সন্দেহ নেই, তবে কোনো প্রকার কেন্দ্রীয় নিয়ন্ত্রণ না থাকায় প্রচলিত বিনিময়ের মাধ্যম থেকে ক্রিপ্টোমুদ্রার যে বিবর্তন এটাকে স্বাভাবিক বলে মনে হচ্ছে না অনেকের। এ নিয়ে তর্ক-বিতর্কের কোনো শেষ নেই। বইয়ে বিটকয়েন তথা ক্রিপ্টোমুদ্রা ভালো নাকি মন্দ সেই তর্কে যাওয়া হয়নি, তবে লেখক তার নিরপেক্ষ অবস্থান থেকে ক্রিপ্টোমুদ্রা সম্পর্কিত প্রতিটি প্রত্যয়ের খোলাসা করেছেন।
এত এত বিপত্তির পরেও, ক্রিপ্টোমুদ্রার জনপ্রিয়তা দিন দিন বেড়েই চলেছে। তাই সকল সীমাবদ্ধতাকে একপাশে রেখে ক্রিপ্টোমুদ্রাই কি হতে চলেছে ভবিষ্যতের মুদ্রা? আর হলেও, কোন মুদ্রাটি? বিটকয়েন? ইথারিয়াম? লাইটকয়েন? রিপল? মনেরো? নাকি অন্য কিছু? তা বলা মুশকিল। বিটকয়েন প্রথম ক্রিপ্টোমুদ্রা হলেও, সহস্রাধিক ক্রিপ্টোমুদ্রার ভীড়ে ধোপে টিকবে কি টিকবে না, কিংবা ক্রিপ্টোমুদ্রা ভবিষ্যতের মুদ্রা হবে কিনা, তার জুতসই আন্দাজ বইতে পাওয়া যাবে।
ক্রিপ্টোমুদ্রাই যদি হয় ভবিষ্যতের মুদ্রা, সেক্ষেত্রে কেমন হবে ভবিষ্যৎ পৃথিবীর চিত্র? ক্রিপ্টোমুদ্রা নিয়ে সচেতন সকলের মনেই এই প্রশ্ন মাথায় আসার কথা। বইয়ে বিশ্ব অর্থনীতি, রাজনীতি, সমাজ ব্যবস্থা এবং প্রযুক্তিতে এর প্রভাব সহ বিভিন্ন দিক নিয়ে সুবিন্যস্তভাবে আলোচনা রয়েছে। এক্ষেত্রে যেমন সংশ্লিষ্ট বিষয়ের সহজ বিশ্লেষণ উঠে এসেছে, তেমনই এসেছে প্রাসঙ্গিক উদাহরণ; যার হাত ধরে ভবিষ্যৎ পৃথিবীর একটি প্রাসঙ্গিক চিত্র আপনা আপনিই মস্তিষ্কে ধরা দেয়।
পরিশেষে বলে রাখা ভালো, সমগ্র বইটিতে লেখক বিটকয়েন বা ক্রিপ্টোমুদ্রায় বিনিয়োগে উৎসাহিত কিংবা অনুৎসাহিত কোনোটিই করেননি। এর উদ্দেশ্য স্রেফ পাঠকের জ্ঞানতৃষ্ণা নিবারণ।