১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বাংলাদেশে প্রায় শতাধিক চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছে, যার শুরুটা হয়েছিল ১৯৭২ সালে চাষী নজরুল ইসলামের হাত ধরে। সদ্য স্বাধীন দেশে চাষী নজরুল নির্মাণ করেছিলেন তার প্রথম পূর্ণদৈর্ঘ্য বাংলা চলচ্চিত্র ওরা ১১ জন। এরপর প্রথম বছরেই আরও ৩টি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্র নির্মাণ হয়েছিল। সেই থেকে শুরু করে এ পর্যন্ত যেসকল পরিচালক পর্দায় মুক্তিযুদ্ধকে ফুটিয়ে তুলেছেন, তাদের মধ্যে মোরশেদুল ইসলাম অন্যতম।
মোরশেদুল ইসলামের চলচ্চিত্র পরিচালনায় হাতেখড়ি হয়েছিল ১৯৮৪ সালে, মুক্তিযুদ্ধের প্রেক্ষাপট নিয়ে তৈরি আগামী নামের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মাণের মধ্য দিয়ে। এরপর পরিচালক স্বল্পদৈর্ঘ্য-পূর্ণদৈর্ঘ্য মিলিয়ে আরো ১৩টি চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছেন, যার মধ্যে ১টি স্বল্পদৈর্ঘ্য (শরৎ ৭১) আর ৩টি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রের (খেলাঘর, আমার বন্ধু রাশেদ, অনিল বাগচীর একদিন) কাহিনী জুড়ে আছে আমাদের স্বাধিকার আন্দোলন ‘মুক্তিযুদ্ধ’। চলুন আজ জেনে নেওয়া যাক মোরশেদুল ইসলাম নির্মিত ২টি মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক স্বল্পদৈর্ঘ্যের চলচ্চিত্র সম্পর্কে।
আগামী (১৯৮৪)
যুদ্ধ পরবর্তী সময়ের গল্প তুলে ধরা হয়েছে ২৫ মিনিটের এই স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্রে, যে গল্পে দেখানো হয়েছে যুদ্ধ আসলে এখনও শেষ হয়ে যায়নি। একটি গ্রাম, যেখানকার মাতব্বর একজন রাজাকার আর সেখানের মুক্তিযোদ্ধারা অবহেলিত, দারিদ্র্যপীড়িত। সেই গ্রামের অবস্থা এতটাই ভয়াবহ যে, সদ্য স্বাধীন দেশের একজন মুক্তিযোদ্ধাকে রাজাকারের পা ধরে কিছু টাকার জন্য কান্নাকাটি করতে হয়।
এ সময় পাশে দাঁড়িয়ে থাকা অপর যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার যুদ্ধকালীন স্মৃতি মনে পড়ে যায়। যুদ্ধের সময় তারা এই রাজাকার মাতব্বরকেই আটক করেছিল মুক্তিযোদ্ধাদেরকে পাকিস্তানি সৈন্যদের কাছে ধরিয়ে দেবার অপরাধে। কিন্তু আজ বাস্তবতা এমনই যে, সেই রাজাকারের কাছেই তারা নতি স্বীকার করতে বাধ্য হচ্ছে।
আবার মাতব্বরের লালসার বস্তু হতে না চাওয়ায়, একজন বীরাঙ্গনাকে গ্রাম্য সালিসের মাধ্যমে বিচার করে মাথা ন্যাড়া করে গ্রাম থেকে তাড়িয়ে দেয়া হয়। এসব অন্যায় যখন হচ্ছে তখন কেউ এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদও করতে পারছে না। কিন্তু এক কিশোর, যার জন্ম ১৯৭১ সালে বিজয়ের মাসে, সে তার নিজের মতো এসব অনিয়মের প্রতিবাদ করতে শুরু করে। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধার এই ছেলেটি সালিসের পর দূর থেকে মাতব্বরকে লক্ষ্য করে গুলতি ছুঁড়ে মারে, সেটা মাতব্বরের মাথায় গিয়ে লাগে। আবার যে সময় তার মুক্তিযোদ্ধা বাবার বন্ধু মাতব্বরের পা ধরে কিছু টাকা ভিক্ষা চাইছিল, তখন হাসু নামের সেই ছোট কিশোর মাতব্বরকে মারতে হাতে ইট তুলে নেয়। আহত মুক্তিযোদ্ধা সেই যাত্রায় ছেলেকে থামিয়ে দিলেও তিনি টের পেয়েছিলেন আগামী প্রজন্মের হাত ধরে এসব অন্যায়, অবিচারের পতন ঘটবে।
আশির দশকের শুরুতে মোরশেদুল ইসলাম ‘বাংলাদেশ ফিল্ম ইন্সটিটিউট এন্ড আর্কাইভ’ এর চলচ্চিত্র নির্মাণ কোর্স করার সময় সিনেমা নির্মাণের স্বপ্ন দেখেছিলেন। ১৯৮২ সালের অক্টোবর মাসে ‘আগামী’র দৃশ্যধারণ শুরু হয়ে ডিসেম্বর মাসের মধ্যেই সেটা শেষ হয়ে যায়। এছাড়া সিনেমার অন্যান্য কাজ হয়েছিল ১৯৮৩ সালে। অর্থনৈতিক কারণে সিনেমাটির নির্মাণ কাজ শেষ হতে দেরি হচ্ছিল। ৭০ হাজার টাকা বাজেট হলেও শেষপর্যন্ত খরচ হয়েছিল প্রায় দ্বিগুণের কাছাকাছি। মোরশেদুল ইসলাম তখন ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্সের ছাত্র। ফলে তার পক্ষে এত টাকা নিজে যোগাড় করা ছিল অসম্ভব। চলচ্চিত্র সংসদের প্রযোজনায় অনেক ধার-দেনা মাথায় নিয়ে সিনেমাটি শেষপর্যন্ত ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে সেন্সর বোর্ডে জমা পড়েছিল ।
তারপর সেন্সর বোর্ড ছাড়পত্র না দিয়ে সিনেমাটিকে সেখানেই আটকে দেয়। সেন্সর বোর্ড থেকে জানানো হয়, সিনেমা থেকে ‘জয় বাংলা’ শ্লোগান একেবারে বাদ দিতে হবে আর ‘রাজাকার’, ‘পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী’ শব্দগুলো বাদ দিয়ে সেখানে শুধু ‘হানাদার বাহিনী’ বলতে হবে। স্বাভাবিকভাবেই এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে সারাদেশে প্রতিবাদের ঝড় উঠেছিল। মোরশেদুল ইসলামরা এর বিরুদ্ধে সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করলে পত্রিকাগুলোতে বেশ গুরুত্বের সাথে সেটি প্রচার পায়। এত কিছুর পর সেন্সর বোর্ড ছাড়পত্র দিতে বাধ্য হয়েছিল। ১৯৮৪ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতে চট্টগ্রামে সিনেমাটি প্রথম প্রিমিয়ার শো অনুষ্ঠিত হয়।
সিনেমাটি প্রথমবার বাণিজ্যিকভাবে প্রদর্শিত হয় ফেব্রুয়ারি মাসের ১৬ তারিখে ঢাকার ব্রিটিশ কাউন্সিলে। সেখানে দর্শকদের ভিড় এতটাই ছিল যে একপর্যায়ে ব্রিটিশ কাউন্সিলের দরজা ভেঙে যায়, তাতে মোরশেদুল ইসলাম আহতও হন। এরপর পাবলিক লাইব্রেরিতে বড় পরিসরে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করা হয়। একটা শো বাড়িয়ে দিয়েও দর্শকদের ভিড় কমানো যাচ্ছিল না, বরং টিকেট কেনার লাইন রাস্তায় নেমে গিয়েছিল। এককথায় বলতে গেলে পীযুষ বন্দ্যোপাধ্যায়, আলী যাকের, ফাহমিদা পারভীন মিঠু, রওশন জামিল অভিনীত ‘আগামী’ দর্শকের মন জয় করতে সমর্থ হয়েছিল।
১৯৮৫ সালে ‘আগামী’কে সরকারিভাবে ভারতের নয়াদিল্লির ১০ম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসবে পাঠানো হলে সিনেমাটি সেখানে শ্রেষ্ঠ পরিচালক বিভাগে ‘রৌপ্য ময়ূর’ পুরষ্কার জেতে। অবশ্য সময়মতো প্রয়োজনীয় তথ্য না পাওয়ার কারণে মোরশেদুল ইসলাম দিল্লিতে যেতে পারেননি। সেই উৎসবে কলকাতার একটি সিনেমা আর ‘আগামী’র মধ্যে যেকোনো একটিকে পুরস্কার দেয়া নিয়ে বিচারকদের মধ্যে ভোটাভুটি হলে ফলাফল টাই হয়েছিল। পরে জুড়ি বোর্ডের চেয়ারম্যান হিসেবে আফ্রিকান এক নির্মাতা ‘আগামী’কেই বিজয়ী ঘোষণা করেন। তাছাড়া ‘আগামী’ বাংলাদেশের ৯ম জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে শ্রেষ্ঠ স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র হিসেবেও বিজয়ী হয়েছিল।
শরৎ ৭১ (২০০০)
বাংলাদেশ শিশু একাডেমির প্রযোজনায় মোরশেদুল ইসলাম ২০০০ সালে নির্মাণ করেন মুক্তিযুদ্ধের সময়কার গল্প নিয়ে ৩০ মিনিটের স্বল্পদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র ‘শরৎ ৭১’। ওয়াহিদা মল্লিক জলি, রহমত আলী, বন্যা মির্জা অভিনীত এই সিনেমার কাহিনী ও চিত্রনাট্য লিখেছিলেন গিয়াস উদ্দিন সেলিম। যুদ্ধের সময় ঢাকায় বসবাসকারী দুই পরিবারের গল্প চিত্রায়িত হয়েছে এই সিনেমায়। পরিবারের কর্তা জামিলুর রহমানকে ধরে নিয়ে গিয়েছে পাক সৈন্যরা, তার স্ত্রী আর তিন সন্তান জানে না তাদের বাবা এখনও বেঁচে আছেন, নাকি তাকে মেরে ফেলা হয়েছে!
জামিলুর রহমানের তিন সন্তানের মধ্যে বড় ছেলে এবং মেয়ের বয়স ১৬-২০ বছর, আর ছোট ছেলে তপুর বয়স ৭-৮ বছর হবে। আর তাদের কাছের প্রতিবেশী পরিবারের একমাত্র ছেলে রুমেল জামিলুরের বড় ছেলে শিবলীর বন্ধু, রুমেলের বোনও প্রায় তার ভাইয়ের সমবয়সী। শিবলী মনে মনে সিদ্ধান্ত নিয়েছে, সে-ও তার বন্ধু রুমেল, রবির মতো দেশের জন্য যুদ্ধে যাবে। যুদ্ধে যাবার ইচ্ছার কথা জানিয়ে রবিকে চিঠি লেখার পর একরাতে রবি লুকিয়ে শিবলীদের বাড়িতে আসে। শিবলী যে যুদ্ধ যাবে সেই কথা তার মাকে আগে থেকে না জানতে দেয়ার জন্য রবি শিবলীর মাকে বলে যে, সে ঢাকায় এসেছে বিশেষ এক মিশন নিয়ে।
একদিন পরেই তারা দুজন মাকে না জানিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়। শিবলী তার বোনের কাছে একটি চিঠি রেখে যায় তার প্রেমিকা রুমেলের বোনকে দেবার জন্য। চিঠিতে শিবলী জানিয়ে যায় যুদ্ধে আহত মুক্তিযোদ্ধাদের চিকিৎসার জন্য তৈরি হাসপাতালে কাজের জন্য বেশ কিছু মেয়ে শহর ছাড়বে, সেখানে তারাও যোগ দিতে পারে। রুমেলের বোন অর্থাৎ শিবলীর প্রেমিকা হাসপাতালের কাজে যাবে বলে জানালে শিবলীর বোনও তার সাথে যেতে চায়। শেষমেশ এই দুই কিশোরী পরিবারের অনুমতি নিয়ে বাড়ি থেকে বের হয়ে যায়।
সিনেমাতে দেখা যায়, জামিলুরের ছোট ছেলে তপু তাদের পোষা ময়নাকে ‘জয় বাংলা’ বুলি শেখানোর জন্য বারবার চেষ্টা করে যাচ্ছে। একসময় ময়না এই বুলি শিখে নেয়। একদিন ময়নাকে নিয়ে তপু রাস্তায় বের হলে পাকসেনাদের সাথে তার দেখা হয়ে যায়। একজন সেনা ময়নাকে দেশে নিয়ে যাবার কথা বলে, সেসময় ময়না তার শেখা বুলি ‘জয় বাংলা’ বলতে থাকে। এই ঘটনায় সেনা সদস্য প্রথমে তপুর দিকে বন্ধুক তাক করে রেগে গিয়ে ময়নাকে গুলি করে মেরে ফেলে। এই দৃশ্য দিয়েই শেষ হয় ‘শরৎ ৭১’।
মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক চলচ্চিত্রগুলো একদিন দিয়ে যেমন ইতিহাসের প্রামাণ্য দলিল, অন্যদিকে এগুলোই বর্তমান ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য প্রেরণার উৎস। যে চেতনার জন্য বাংলাদেশের বীর যোদ্ধারা মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, সেই চেতনাকে আমাদের অন্তরে লালন করতে হবে।