প্রাচীন রাশিয়ার একটি নগর রাষ্ট্র। এক অদ্ভুত প্রথা চালু ছিল সেখানে। বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে একটি মেয়েকে কনের সাজে সজ্জিত করা হতো। এরপর একটি নৌকায় শুইয়ে তাকে একটি ছোট্ট হ্রদে ভাসিয়ে দিয়ে ড্রাগনের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করা হতো। একটি অদ্ভুত সঙ্গীতের মাধ্যমে ড্রাগনকে আহ্বান করা হতো উৎসর্গকৃত মেয়েটিকে গ্রহণ করার জন্য। এই আহ্বানে সাড়া দিয়ে ড্রাগন এসে মেয়েটিকে তুলে নিয়ে যেত তার নিজস্ব আবাসস্থলে, সমুদ্রের মাঝখানের একটি বিচিত্র দ্বীপে। সেখানে ড্রাগন উৎসর্গকৃত মেয়েটিকে নিজ আগুনে পুড়িয়ে মেরে ফেলত, আর এর থেকে সৃষ্টি হতো নতুন ড্রাগনের! এভাবে ড্রাগনদের বংশ পরম্পরা টিকে থাকতো।
বস্তুত ড্রাগনদের অত্যাচার থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্যই নগর রাষ্ট্রটির অধিবাসীরা ড্রাগনদের সঙ্গে এই সমঝোতায় আবদ্ধ হয়েছিল। কিন্তু একবার এক মেয়েকে এভাবে ড্রাগনের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করার পর মেয়েটির শোকগ্রস্ত প্রেমিক ড্রাগনের পিছু ধাওয়া করে। ড্রাগন দ্বীপে পৌঁছে সে দেখতে পায়, তার প্রেয়সীকে ড্রাগন ইতোমধ্যে মেরে ফেলেছে। ক্রুদ্ধ লোকটি ড্রাগনকে অসতর্ক অবস্থায় আক্রমণ করে এবং মেরে ফেলে। এর মধ্য দিয়ে নগর রাষ্ট্রটিতে ড্রাগনদের দৌরাত্ম্যের অবসান ঘটে। কিন্তু বিয়ের সময় কনেকে নৌকায় শুইয়ে ছোট্ট হ্রদটিতে ভাসিয়ে দেয়া এবং হ্রদের অপর প্রান্ত থেকে বর কর্তৃক নৌকাটিকে নিজের কাছে টেনে নেয়া নগর রাষ্ট্রটির একটি সামাজিক প্রথায় পরিণত হয়।
বহু বছর পরে নগর রাষ্ট্রটির রাজকন্যা মিরোস্লাভার সঙ্গে ড্রাগন-হন্তার নাতি ইগরের বিয়ে ঠিক হয়। মিরোস্লাভা (মিরা) অল্পবয়সী এবং রূপকথার কাহিনীতে বিশ্বাস করে, এজন্য তার বড় বোন ইয়ারোস্লাভা তার ওপরে বিরক্ত। বিয়ের সময় প্রথা অনুযায়ী মিরাকে কনের বেশে নৌকায় শুইয়ে হ্রদটিতে ভাসিয়ে দেয়া হয়। হ্রদের অপর প্রান্ত থেকে ইগর নৌকাটির দড়ি ধরে সেদিকে টেনে নিতে শুরু করে। ইগরের লোকজন ড্রাগনকে উৎসর্গ করা সেই সঙ্গীতটি গাইতে শুরু করে। সকলকে হতবাক করে সত্যি সত্যি একটি ড্রাগন উড়ে এসে হাজির হয় এবং নৌকা থেকে মিরাকে তুলে নিয়ে যায়।
ড্রাগনটি মিরাকে ড্রাগন দ্বীপে নিয়ে একটি গর্তে ফেলে দেয়। সেখানে মিরার সঙ্গে এক তরুণের সাক্ষাৎ হয়। তরুণটি অদ্ভুত, কারণ সে নিজের নাম মনে করতে পারে না, এবং স্বাভাবিক মানবিক রীতিনীতি সম্পর্কে তার কোনো ধারণা নেই। মিরা তাকে আরমান নামে ডাকতে শুরু করে। রুশ ভাষায় আরমান (Арман) শব্দটির অর্থ স্বপ্ন। এদিকে ইগর মিরাকে খুঁজতে একটি জাহাজ নিয়ে বেরিয়ে পড়ে, কিন্তু ড্রাগন দ্বীপটির চারপাশ মায়াজাল দিয়ে ঘেরা, এজন্য সে দ্বীপটির আশেপাশে ঘুরতে থাকে, কিন্তু দ্বীপটি খুঁজে পায় না।
মিরা বুঝতে পারে যে, আরমানই প্রকৃতপক্ষে ড্রাগন। ইতোপূর্বে নিহত ড্রাগনটি ছিল আরমানের বাবা। ছোটবেলায় আরমান তার বাবাকে ড্রাগন রূপে উড়তে দেখে তার মতো হতে চাইত, কিন্তু একদিন একটি ডুবে যাওয়া জাহাজ থেকে কিছু জিনিস দ্বীপটিতে ভেসে আসে, যাতে ছিল একজোড়া পুতুল (একটি ছেলে এবং একটি মেয়ে)। এই ঘটনাটি বালক আরমানের মনে বিচিত্র এক অনুভূতির সৃষ্টি করে, এবং সে ড্রাগন না হয়ে মানুষ রূপে বাঁচার সিদ্ধান্ত নেয়। তার বাবা তাকে ড্রাগনে রূপান্তরিত করার চেষ্টা করে, কিন্তু ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো ড্রাগন বালককে ড্রাগনে পরিণত করা যায় না।
কিন্তু আরমানের বাবা যখন ড্রাগন-হন্তার হাতে নিহত হয়, তখন ক্রুদ্ধ আরমান ড্রাগনে রূপান্তরিত হয় এবং তার চোখে তার পূর্বপুরুষদের কার্যকলাপ ভেসে ওঠে। তারা কীভাবে মানুষদের পুড়িয়ে মারত সেটা দেখে আরমান আতঙ্কিত হয় এবং তার ড্রাগন রূপ কখনো প্রকাশ না করার সিদ্ধান্ত নেয়। কিন্তু মিরার বিয়ের সময় ড্রাগনকে আহ্বান করে যে গানটি গাওয়া হয়েছিল, সেটি শ্রবণের পর আরমানের ড্রাগন রূপটি বেরিয়ে আসে এবং সে ড্রাগন হয়ে মিরাকে নিয়ে আসে। মিরা আরো জানতে পারে যে, তারা যে দ্বীপটিতে রয়েছে, সেটি প্রকৃতপক্ষে দ্বীপ নয়, বরং আরমানের এক পূর্বপুরুষের কঙ্কাল! আতঙ্কিত মিরা পরবর্তীতে কী করে, সেটি নিয়েই এগিয়ে চলে ‘অন দ্রাকন’ চলচ্চিত্রের কাহিনী।
চলচ্চিত্রটি পৌরাণিক ঘটনার ওপরে নির্মিত একটি রোমান্টিক চলচ্চিত্র। সাইবেরিয়ার তীব্র শীতে আচ্ছন্ন নগর রাষ্ট্রের দৃশ্য, গভীর সমুদ্রে অবস্থিত নাতিশীতোষ্ণ ড্রাগন দ্বীপের বিচিত্র চিত্র, প্রাচীন রুশদের অদ্ভুত সামাজিক প্রথা, রূপকথার কল্পিত দানব ড্রাগনের সঙ্গে একজন কমবয়সী রাজকন্যার মিথষ্ক্রিয়া এবং হিংস্রতা ও মানবিকতার মধ্যে তীব্র অন্তর্দ্বন্দ্বে ভুগতে থাকা আরমানের জীবন দর্শককে মন্ত্রমুগ্ধ করে রাখে চলচ্চিত্রটির পুরোটা সময় জুড়ে।
‘অন দ্রাকন’ (রুশ: Он — дракон) বা ‘সে ড্রাগন’ একটি রুশ পৌরাণিক কাহিনীভিত্তিক ফ্যান্টাসি চলচ্চিত্র। বর্তমানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাসরত ইউক্রেনীয় ঔপন্যাসিক দম্পতি সের্গেই দিয়াচেঙ্কো ও মারিনা দিয়াচেঙ্কো কর্তৃক ১৯৯৬ সালে রচিত পৌরাণিক কল্পকাহিনীমূলক উপন্যাস ‘The Ritual’ এর ওপরে ভিত্তি করে চলচ্চিত্রটি তৈরি করা হয়েছে। অবশ্য চলচ্চিত্রটির কাহিনীতে উপন্যাসটির মূল কাহিনী থেকে বেশকিছু পরিবর্তন আনা হয়েছে।
চলচ্চিত্রটি পরিচালনা করেছেন রুশ পরিচালক ইন্দার ঝেন্দুবায়েভ এবং চলচ্চিত্রটির মূল প্রযোজক ছিলেন কাজাখ বংশোদ্ভূত রুশ চলচ্চিত্রকার তিমুর বেকমাম্বেতভ। ১ ঘণ্টা ৫০ মিনিটের এই চলচ্চিত্রটি নির্মাণ করেছিল রুশ কোম্পানি ‘বাজেলেভস’। ২০১৫ সালের ৩ ডিসেম্বর রুশ ভাষার এই চলচ্চিত্রটি রাশিয়া এবং অন্যান্য প্রাক্তন সোভিয়েত রাষ্ট্রগুলোতে মুক্তি লাভ করে। পরবর্তীতে এটি I Am Dragon (2015) শিরোনামে ইংরেজি ভাষায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ব্রিটেনে মুক্তি লাভ করে।
চলচ্চিত্রটি যেহেতু পৌরাণিক ঘটনাবলি নিয়ে নির্মিত, এজন্য চলচ্চিত্রটির ৮৫% দৃশ্যই কম্পিউটার গ্রাফিক্সের সাহায্যে নির্মাণ করা হয়েছে। চলচ্চিত্রটির চিত্রগ্রহণ সম্পন্ন হয়েছিল বুলগেরিয়ার কৃষ্ণসাগর উপকূল অঞ্চলে এবং রাশিয়ার রাজধানী মস্কো শহরে। চলচ্চিত্রটিতে মিরা চরিত্রে অভিনয় করেছেন রুশ অভিনেত্রী মারিয়া পোয়েঝায়েভা এবং আরমান চরিত্রে অভিনয় করেছেন রুশ অভিনেতা মাৎভেই লাইকভ। চলচ্চিত্রটি নির্মাণে ব্যয় হয়েছিল প্রায় ৩০ কোটি (বা ৩০০ মিলিয়ন) রুশ রুবল।
কিন্তু ‘অন দ্রাকন’ চলচ্চিত্রটি রাশিয়ায় বাণিজ্যিক সাফল্য অর্জন করতে পারেনি। রাশিয়ায় চলচ্চিত্রটি মাত্র ১২ কোটি ৬০ লক্ষ (বা ১২৬ মিলিয়ন) রুবল আয় করেছে, যা চলচ্চিত্রটির নির্মাণব্যয়ের এক–তৃতীয়াংশের সামান্য বেশি। শুধু তা-ই নয়, চলচ্চিত্রটি সমালোচকদের কাছ থেকে কেবল মিশ্র প্রতিক্রিয়াই লাভ করেছিল।
চলচ্চিত্রটি মুক্তি লাভের পর ধারণা করা হয়েছিল যে, চীনে এটিকে খুবই নেতিবাচকভাবে গ্রহণ করা হবে। কারণ, চলচ্চিত্রটিতে ড্রাগনদের অত্যাচারী ও হিংস্র দানব হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। উল্লেখ্য, চীনা রূপকথায় ড্রাগনকে মহান দেবতা হিসেবে বিবেচনা করা হয় এবং চীনের প্রতীক হিসেবে অনেক ক্ষেত্রেই ড্রাগনকে ব্যবহার করা হয়। অন্যদিকে, ইউরোপীয় রূপকথায় ড্রাগনকে উপস্থাপন করা হয়েছে ধ্বংসাত্মক ও নিষ্ঠুর দানব হিসেবে। রাশিয়া যেহেতু ইউরোপ ও চীনের মাঝখানে অবস্থিত, রুশ রূপকথায় উভয় অঞ্চলেরই প্রভাব রয়েছে। এজন্য রুশ রূপকথায় কখনো কখনো ড্রাগনকে ভয়ঙ্কর দানব হিসেবে, আবার কখনো কখনো বোকাসোকা বৃহৎ প্রাণী হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে।
কিন্তু সব হিসাব-নিকাশকে পরিবর্তন করে দিয়ে ‘অন দ্রাকন’ চলচ্চিত্রটি চীনাদের মধ্যে বিপুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে এবং চীনে এই চলচ্চিত্রটিকে ইন্টারনেট থেকে কমপক্ষে ৫৬ লক্ষ বার ডাউনলোড করা হয়। চীনারা ইন্টারনেটে চলচ্চিত্রটি সম্পর্কে প্রচুর ইতিবাচক মন্তব্য করে এবং এমনকি ‘Game of Thrones’ ও ‘Twilight’–এর সঙ্গেও এটির তুলনা করে। এটি থেকে চলচ্চিত্রটির রুশ নির্মাতারা এটিকে আনুষ্ঠানিকভাবে চীনে প্রচার করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং চীনা চলচ্চিত্র নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সহায়তায় চলচ্চিত্রটি চীনে মুক্তি লাভ করে। চলচ্চিত্রটি চীনে আয় করেছে ৬ কোটি ১ লক্ষ (বা ৬০.১ মিলিয়ন) ইউয়ান, যা রুশ মুদ্রায় প্রায় ৬০ কোটি ৭৭ লক্ষ (বা ৬০৭.৭ মিলিয়ন) রুশ রুবল। অর্থাৎ রাশিয়ায় বাণিজ্যিকভাবে ব্যর্থ এই রুশ চলচ্চিত্রটি চীনে আয় করেছে এর নির্মাণব্যয়ের দ্বিগুণেরও বেশি!
চীনা ড্রাগনের দেশে ‘অন দ্রাকন’ চলচ্চিত্রটির ব্যাপক জনপ্রিয়তায় উৎসাহিত হয়ে চলচ্চিত্রটির রুশ নির্মাতারা চীনা চলচ্চিত্রকারদের সঙ্গে যৌথভাবে এটির দ্বিতীয় খণ্ড নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। বাংলাদেশে যেসব দর্শক পৌরাণিক (এবং রোমান্টিক) চলচ্চিত্র পছন্দ করেন, তাদের জন্য ‘অন দ্রাকন’ একটি চমৎকার সময় উপহার দিতে পারে।