দ্য মেটামরফোসিস: অবাস্তবতার বৃত্তে পুঁজিবাদী সমাজের নির্মমতার চিত্রায়ন

বিশ্বসাহিত্য সম্পর্কে জানাশোনা আছে কিন্তু ফ্রাঞ্জ কাফকার নাম শোনেননি এমন মানুষ খুঁজে পাওয়া যাবে না। বিশ্বনন্দিত এই সাহিত্যিক খুব বেশি দিন বাঁচতে পারেননি। তার সাহিত্যকর্মের ঝুলিও খুব বেশি বড় নয়। কিন্তু তার লেখাগুলো অসাধারণত্ব অর্জন করেছে, বিশেষ করে তার ছোটগল্পগুলো। ‘মেটামরফোসিস’ তার ঠিক সেরকমই একটি ছোটগল্প। অবশ্য একে উপন্যাসিকা বললেও ভুল হবে না।

‘মেটামরফোসিস’ গল্পের শুরুটা অদ্ভুত ঠেকবে যেকোনো পাঠকের কাছেই। কাফকা’র ভাষায়, “নানান আজেবাজে স্বপ্ন দেখার পর একদিন সকালে ঘুম ভেঙে উঠে গ্রেগর সামসা দেখল যে, এক বিশাল পতঙ্গে রূপান্তরিত হয়ে সে তার বিছানায় শুয়ে আছে।” একজন জলজ্যান্ত মানুষ কোনো কারণ ছাড়াই পতঙ্গে রূপান্তরিত হয়ে গেল– বিষয়টি কেমন গোলমেলে মনে হচ্ছে না? বাস্তবে কি কখনও এমন হয়? দর্শনের কার্যকারণ নিয়ম কি তবে খাটছে না এখানে? ভুল করে কি রূপকথা শুরু হল গল্পে বদলে? এমন ‘প্রথাবিরোধী’ প্রথম লাইনের পর পাঠকের মনে এরকম অসংখ্য প্রশ্ন আসবে। কিন্তু এরকম অদ্ভুতুড়ে শুরুর পরও যে গভীর মূল্যবোধসম্পন্ন লেখা পাঠকের সামনে তুলে ধরা যায়, সেই সাহস কাফকা দেখিয়েছেন। আর এরকম সূচনা-ই পরবর্তীতে গল্পের গতিপথ নির্ধারণ করে দিয়েছে।

হয়নসননস
গল্পকার ফ্রাঞ্জ কাফকা; image source: latimes.com

পতঙ্গে রূপান্তরের পর গ্রেগর সামসার জীবনে রাজ্যের বিড়ম্বনা শুরু হয়। সে যে প্রতিষ্ঠানের হয়ে কাজ করতো সেই প্রতিষ্ঠানের প্রধান কেরানি তার খোঁজ নিতে আসেন। কিন্তু তার পক্ষে কিছুই করা সম্ভব ছিল না, কিছুই না। কারণ সে তখন আর ‘হোমো স্যাপিয়েন্স’ নেই। একটি নিছক পতঙ্গের পক্ষে তো আর সেলস্যানের কাজ করা সম্ভব নয়। কিন্তু এরকম ট্রাজেডির পরও সে আশাবাদী ছিল, সে স্বাভাবিক হয়ে কাজে ফিরতে পারবে। কিন্তু সে আশায় গুড়েবালি। সে কখনই আর পতঙ্গের জীবনের ঘেরাটোপ থেকে বের হতে পারেনি।

মানুষের তো কত ধরনের সমস্যারই মুখোমুখি হতে হয় প্রাত্যহিক জীবনে! কোনো জটিল সমস্যার কারণে কর্মক্ষেত্রে একদিন অনুপস্থিত থাকাটা তাই কোনো অস্বাভাবিক বিষয় নয়। কিন্তু সামসার অফিস সেটা মানতে নারাজ। তাই তারা প্রধান কেরানির মাধ্যমে তাকে কাজে আসতে বাধ্য করতে চায়। তার পরিবারের সামনেই প্রধান কেরানি তার সাথে দুর্ব্যবহার করে, তাকে বরখাস্তের হুমকি দেয়। কিন্তু কোনোভাবেই তার সমস্যা বুঝতে চায় না। পুঁজিবাদের আসল চরিত্র ধরা পড়ে যায় এখানে। এখানে মানবিকতা কিংবা নৈতিকতার কোনো বালাই নেই। এখানে মুনাফা এখানে মূল কথা, কর্মচারী বেঁচে থাক কিংবা মারা যাক, সেটা ধর্তব্য নয়।

নয়হহয়নময়
পুঁজিবাদের কালো দিক, যেটা আপনাকে কখনও দেখানো হয় না; image source: fool.com

একান্নবর্তী পরিবারগুলোর আয় করা ব্যক্তিটি কোনোভাবে অক্ষম হয়ে পড়লে কী নিদারুণ দুর্দশা ভোগ করতে হয় পরিবারের সবাইকে, সে দিকটিও তুলে এনেছেন কাফকা। সামসা’র বাবার ব্যবসা পাঁচ বছর আগেই লাটে উঠেছিল। তাই সামসাকে জীবিকার তাগিদে সেলসম্যান হিসেবে কাজে জড়িয়ে পড়তে হয়। একদিকে তার বাবার ঋণ শোধ করা, অপরদিকে পরিবারের ভরণপোষণ চালানো– দুটো বিরাট দায়িত্বই তার কাঁধে এসে পড়ে। তবে কাজে মনোযোগী সামসা’র আয় দিয়ে তার পরিবার সুন্দর চলছিল। কিন্তু সমস্যা হয় তার রূপান্তরের পর। বৃদ্ধ বয়সে তার বাবার যেখানে অবসর উপভোগের কথা ছিল সেখানে তাকে ব্যাংকের বার্তাবাহকের কাজ নিতে হয়। তার বৃদ্ধ মায়ের হাঁপানির সমস্যা ছিল। তাকেও অন্তর্বাস সেলাইয়ের কাজ নিতে হয়। সুখ-শান্তি সব বিসর্জন দিয়ে নির্মম বাস্তবতার কাছে হেরে যেতে হয় তার পরিবারকে।

গ্রেগর সামসা পতঙ্গে রূপান্তরিত হওয়ার পর সবকিছুতেই প্রচণ্ড বাধার সম্মুখীন হচ্ছিল। তাকে সাহায্য করার মতো মানুষের ভূমিকা পালন করছিলো শুধু তার বোন, আর কেউ নয়। তার বোন তার রুমে ঢুকত, খাবার দিতো। তবে সেও পুরোপুরি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করতো, এমনটা নয়। চুপচাপ খাবার দিয়ে দ্রুত ঘর থেকে বেরিয়ে যেতো। বিপদের সময় গুটিকয়েক মানুষকেই পাশে পাওয়া যায়, সবাইকে নয়।

নয়নাবা
‘দ্যা মেটামরফোসিস’; Image source: literatenolohitura.com

গ্রেগর সামসা’র পতঙ্গে পরিবর্তিত জীবন মনে করিয়ে দেয় ছোঁয়াচে রোগীদের কথা। রূপান্তরের পর ঘরেই সারাদিন বন্দী হয়ে থাকতে হতো সামসাকে। কোথাও যাওয়ার জো ছিল না। এমনকি জানালাও খোলা রাখার অনুমতি ছিল না, পাছে কেউ দেখে ফেলে এই ভয়ে। আমাদের সমাজেও ছোঁয়াচে রোগীদের মূলধারা থেকে একদম বিচ্ছিন্ন করে ফেলা হয়। তাদেরকে একঘরে করে ফেলা হয়, মেলামেশা বন্ধ করে দেয়া হয়। শুধু বিচ্ছিন্ন করেই ক্ষান্ত হয় না এই সমাজ। একটি অসহ্যকর রসকষহীন জীবন বেছে নিতে বাধ্য করে। ফলে এসব রোগীর শেষ জীবনীশক্তিটুকুও নিঃশেষ হয়ে যায়।

আর দশজনের মতো গ্রেগর সামসারও স্বপ্ন ছিল। তার বোনকে সে একটি নামকরা সঙ্গীত শেখার প্রতিষ্ঠানে ভর্তি করতে চেয়েছিল। ঋণ শোধ হয়ে গেলে তার সেলসম্যানের বিরক্তিকর চাকরি ইস্তফা দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তার স্বপ্ন আর পূর্ণতা পায়নি। বোনকে আর ভর্তি করানো হয়নি। ঋণ শোধ হওয়ার আগেই চাকরি থেকে বরখাস্ত হতে হয়েছে। পরিবারটিকে আর আগলে রাখা যায়নি।

নসনসনসনস
স্বপ্নভঙ্গ; Image source: mybrokenheart.de

গল্পের শেষটা হয় আরও নির্মমভাবে। গ্রেগর সামসা মারা যায়। তার মৃত্যুতে যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচে তার পরিবার। কারণ সামসা’র জন্য তাদের আর বিড়ম্বনা পোহাতে হবে না। প্রতিবেশীরা যেন না দেখে সেই ভয়ে থাকতে হবে না। বাসায় কোনো ঝঞ্ঝাট ছাড়াই থাকতে পারবে তারা।

পুঁজিবাদী সমাজ কতটা নির্মম হয়ে ওঠে একজন অক্ষম শ্রমিকের জন্য, তার একটি সার্বিক চিত্র ফুটে উঠেছে মেটামরফোসিস গল্পে। কেউই পক্ষে থাকে না সেই অভাগা শ্রমিকের। সমাজ, পরিবার, অফিস– কেউ না। সেই সমাজ শুধু টাকা চেনে, মুনাফা চেনে। শ্রমিকের অসহায়ত্ব চেনে না। শ্রমিকের সামাজিক পরিস্থিতি বোঝে না।

গল্পের শুরুটা যেই অদ্ভুত রূপান্তরের মাধ্যমে, তার পরবর্তী ঘটনা যেন তারই ফলাফল। গল্পের পরবর্তী ঘটনাপ্রবাহ সম্পূর্ণ সামসা’র বিড়ম্বনাকে ঘিরে। আর এসব বিড়ম্বনার আড়ালে কাফকা তুলে এনেছেন পুঁজিবাদী সমাজের নির্মম বাস্তবতাকে।

This Bengali article is a book review. 'The Metamorphosis' is a novella written by Franz Kafka and it is one of Kafka's best-known works.

Feature Image: gz.diarioliberdade.org

Related Articles

Exit mobile version