শুরুতেই নব্বইয়ের দশকের শেষের দিককার আমেরিকার কথা বলে নেয়া যাক। সারা বিশ্বের উন্নত দেশগুলোর সাথে পাল্লা দিয়ে আমেরিকা এগিয়ে যাচ্ছিল দুর্বার গতিতে। নতুন নতুন ব্যবসা, পররাষ্ট্র খাতে ব্যয়, শিক্ষা-গবেষণায় চোখধাঁধানো সব উন্নতি আর পুরো দেশজুড়ে আকাশছোঁয়া দালানের জয়জয়কার মিলিয়ে এক নতুন আমেরিকা প্রতিষ্ঠা পায়, যার ফলাফল এখন আমাদের সবার চোখের সামনে। কিন্তু এই উন্নতিই কি সব?এতকিছুর ভীড়েও ছিল মানুষের না পাওয়ার ব্যথা, ক্যারিয়ার গড়তে না পারার হাহাকার- যদিও দেশটিকে সবাই ‘ল্যান্ড অব অপর্চুনিটি’ বলেই জানে!
উন্নয়নের পাশে পিছিয়ে পড়া গল্পগুলোর হাত ধরেই সেসময়ে মনোবিজ্ঞানীদের চাহিদা বাড়তে থাকে, সেই সাথে নতুন এক মাধ্যম গড়ে ওঠে ‘মোটিভেশনাল ইন্ডাস্ট্রি’ নামে। একদিকে মানুষের মনস্তাত্ত্বিক চিকিৎসা, অন্যদিকে মানুষের নিজ শক্তিকে অনুপ্রেরণা দিয়ে জাগিয়ে তোলার কাজ- এসবের পরিপ্রেক্ষিতেই ১৯৯০ সালের দিকের আমেরিকায় দুজন মোটামুটি প্রতিষ্ঠিত ব্যক্তি মার্ক ভিক্টর হানসেন এবং জ্যাক ক্যানফিল্ড নিজেদের কাজের বাইরে মোটিভেশনাল কাজের দিকেও মনযোগ দেন এবং খুব অল্প সময়ের ভেতর মোটিভেশনাল স্পিকার হিসেবে পরিচিত হতে শুরু করেন। তাদের লক্ষ্য ছিল অত্যাধুনিক আমেরিকার সাথে তাল মেলাতে না পেরে যারা পিছিয়ে যাচ্ছিল তাদের নিয়ে কাজ করা।
যে-ই ভাবনা সে-ই কাজ! মানুষের পিছিয়ে যাওয়ার ব্যথাগুলোকে ইতিবাচক কথা আর গল্প দিয়ে সাহসে রূপান্তরিত করার স্বপ্নে বিভোর দুজন মানুষ ভাবতে থাকলো এমন কিছু একটা করা দরকার যেন সহজেই সবার কাছে মানুষের সুন্দর গল্পগুলো পৌঁছে দেয়া যায়। এতে অন্যরা জীবনের বাধাগুলো পেরিয়ে যেতে সাহস পাবে। কিন্তু এখনকার মতো অনলাইন যোগাযোগ ব্যবস্থা সেসময় ছিল না, তাই অনেক ভেবে-চিন্তে তারা পা বাড়ালেন বই প্রকাশের দিকে।
হ্যাঁ, আমেরিকায় তখনও মানুষ বই পড়তো, যেমন পড়ে এখনও। জ্যাক ক্যানফিল্ড আর মার্ক ভিক্টর সেই চিন্তার উপর ভর করেই বাজারে নিয়ে আসেন ‘চিকেন স্যুপ ফর দ্য সোল’ বইটি। নামটি শুনে খাবারের কথা মাথায় আসলেও দোষ দেয়া যাবে না, কারণ বইটিকে বলাই হচ্ছে আত্মার জন্য মহৌষধ!
কেমন ছিল প্রথম বইটি?
একশো একটি অনুপ্রেরণামূলক গল্প নিয়ে ‘চিকেন স্যুপ ফর দ্য সোল’ সিরিজের প্রথম বইটি বাজারে আসে ১৯৯৩ সালে। বইটির প্রধান বিশেষত্ব ছিল প্রায় প্রতিটি গল্পের লেখকই সাধারণ মানুষ, তারা নিজেদের অথবা অন্য কারো জীবনের গল্পগুলো লিখেছেন, যেন সবাই কিছুটা হলেও আশার আলো খুঁজে পায়, যে আলো আর সাহস মিলিয়ে সবাই চেষ্টা করবে জীবনের বাধাগুলোকে পাশ কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়াতে।
ব্যাপারটা এমন ছিল না যে এটিই আমেরিকার বাজারের প্রথম মোটিভেশনাল বই, কিন্তু এটি ছিল প্রকাশের প্রথম বছরে সর্বাধিক বিক্রি হওয়া বইগুলোর একটি, কারণ এই বইয়ে দুটো ব্যাপার খুব স্পষ্ট-
১) মানুষ এখানে নিজেকে দেখতে পেত ও নিজের চিন্তার যে উন্নয়ন দরকার ছিল তার কিছু সম্ভাব্য পথও খুঁজে পেত!
২) পাঠকরা চলার পথে সাহসের সন্ধান পাওয়ার সাথে সাথে চিন্তার জগতে পরিবর্তন আনার মতো উপাদানও পেয়ে যেত, কারণ আসলে গল্পগুলো ছিলই এমন যে পাঠকের জন্য নিজের জীবন ও পৃথিবী নিয়ে নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে চিন্তার করার সুযোগ তৈরি হত।
বলা যাক একটি গল্পের সারসংক্ষেপ। ‘One At a time’ নামের মাত্র এক পাতার গল্পটি আকারে যতটুকু ছোট, উপলব্ধির দিক থেকে তার চেয়ে সহস্রগুণ বড়!
আমাদের এক বন্ধু মেক্সিকোর সী বীচে হাঁটছিল এবং সে সমুদ্রের কাছাকাছি যেতে যেতে দেখছিল স্থানীয় এক বাসিন্দা একটু পর পর নুয়ে কিছু একটা নিচ্ছে আর সমুদ্রে ছুড়ে ফেলছে! এবং বিরতিহীনভাবে সে এটা করেই যাচ্ছিল!
আমাদের বন্ধু যখন সেই মানুষটির কিছুটা কাছাকাছি গেল, তখন সে দেখলো সেই লোকটি আসলে বীচ থেকে স্টারফিশ ধরে ধরে পানিতে ছুঁড়ে মারছে।
বন্ধু কিছুটা অবাক হয়ে লোকটির সাথে কথা বলতে এগিয়ে গেল এবং জানতে চাইলো তিনি কী করতে চাইছেন?
তিনি বললেন, আমি স্টারফিশগুলোকে সমুদ্রে ফেরত পাঠাচ্ছি। দেখছো তো জোয়ারের কারণে মাছগুলো এখানে এসে আটকা পড়েছে,আমি যদি তাদের ফেরত না পাঠাই তবে এখানেই তারা অক্সিজেনের অভাবে মারা পড়বে!
মাথা নাড়িয়ে বুঝতে পারার ইঙ্গিত দিয়ে আমাদের বন্ধু লোকটিকে বলল, কিন্তু এখানে তো হাজার হাজার মাছ আটকা পড়ে আছে, আপনি কখনোই তাদের সবাইকে রক্ষা করতে পারবেন না। এর থেকেও বড় ব্যাপার হলো- শুধু এখানে নয়, মেক্সিকোর শত শত বীচে এভাবে হাজার হাজার মাছ পড়ে আছে! আপনি সারাদিন এ কাজটি করলেও আসলে তেমন একটা পার্থক্য হবে না, মাছগুলো বীচেই মারা যাবে।
মনোযোগ দিয়ে সব কথা শুনে সেই লোকটি হাসি দিয়ে আবারও নুয়ে একটি মাছ ধরে সমুদ্রে ছুঁড়ে দিয়ে বললো, এই তো, কমপক্ষে আরও একটি পার্থক্য হলো, অন্তত আরও একটি মাছ বেঁচে গেল!
এমন সহজ, সুন্দর আর ইতিবাচক গল্পই আছে পুরো বই জুড়ে, যেখানে মানুষ শুধু নিজেকে নিয়ে নয়, বরং পুরো দুনিয়া নিয়ে ভাবতে সাহস করে, আর সেজন্যই হয়তো পাঠক বইটিকে শুরু থেকে আজ অবধি ধারাবাহিকভাবে গ্রহণ করে আসছে।
এই সিরিজের অন্য বইগুলোর কথাও একটু বলা যাক।
এই সিরিজের বইয়ের সংখ্যা আসলে আমাদের কল্পনার থেকেও বেশি! প্রায় ২৫০টি বই ইতোমধ্যে প্রকাশিত হয়েছে, এবং সারা পৃথিবীতে ৫০ কোটিরও বেশি কপি বিক্রি হয়েছে! আর যদি নকল কপি ও পিডিএফ মিলিয়ে হিসেব করা হতো, সেই সংখ্যা নিঃসন্দেহে আকাশ ছুঁয়ে ফেলতো!
এই সিরিজের বইগুলো বিষয়বস্তু হিসেবে আলাদা আলাদা করে সাজানো। একটি বই আরেকটি থেকে প্রায় আলাদাই বলা যায়, যেমন- প্রথম বইটি ছিল ইতিবাচক চিন্তা নিয়ে, তারপর বাজারে এসেছিল অফিশিয়াল কাজের চাপ নিয়ে, সংসার, স্মৃতি, বন্ধুত্ব এমন নানা ধরনের জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশগুলো নিয়ে একটি করে বই আছে, এবং প্রতিটি বই-ই রেকর্ড পরিমাণ বিক্রি হয়েছে, অথচ কোনো বড় প্রকাশনী প্রথমে এই সিরিজ ছাপাতে রাজি হয়নি!
কোনো বই যখন আমাদের এগিয়ে যেতে সাহায্য করে তখন সেটা আসলে কাগজ থেকে আমাদের জীবনের অংশ হয়ে যায়। আর ঠিক এটাই এই বইকে ইতিহাসের সর্বোচ্চ সফলতা এনে দিয়েছে। তবে দুঃখজনক ব্যাপার হলো, আমাদের দেশে এই বইটির প্রচার নেই বললেই চলে, এমনকি এই সিরিজের খুব বেশি হলে ২-৩টি বই বাজারে আছে, আর বাংলা অনুবাদ তো অনেক পরের কথা!
প্রতিদিনকার জীবনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় আরও একটু উৎসাহ পেতে, বিশেষ করে নিজের গন্ডির বাইরে যেতে বইটির কাছে আমাদের যাওয়া উচিত, কারণ ‘চিকেন স্যুপ ফর দ্য সোল’ সত্যিকার অর্থেই আত্মার জন্য মহৌষধ! আমাদের আলো-আঁধারের জীবনে এগিয়ে যেতে তো আসলেই ইতিবাচক মনোভাবের বিকল্প নেই, কারণ ইতিবাচক চিন্তাশক্তিই আমাদেরকে নতুন ইতিহাস গড়তে সাহসী করে তোলে, আর সিরিজটির প্রতিষ্ঠাতা জ্যাক ক্যানফিল্ডও আমাদের সেই কথাই জানাচ্ছেন,
তুমি আসলে যা করে দেখাতে চাও, তার প্রায় সবই তোমার নিজস্ব বলয়ের বাইরে