Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

ডোন্ট লুক আপ: কেবল একটি মুভিই নয়, আছে অনেক লুকোনো বার্তা

২০২১ সালে নেটফ্লিক্সের তারকাখচিত স্যাটায়ার, ব্ল্যাক কমেডি ঘরানার সিনেমা ডোন্ট লুক আপ সম্ভবত অনেকেই দেখেছেন। ২০২১ সালের অস্কারে সেরা সিনেমার পুরষ্কারের জন্য মনোনীতও হয়েছিল এটি। বিজয়ী না হলেও এই মুভিটি অনেক দিন মুভিবোদ্ধাদের মনে গেঁথে থাকবে নিঃসন্দেহে। এই মুভিতে কিছু গুরুত্বপূর্ণ বিষয় বা সামাজিক অসংগতি পরিচালক অ্যাডাম ম্যাকেয় এত সুনিপুণভাবে তুলে ধরেছেন যা আসলেই প্রশংসা করার মতো। এখানে এমনই কিছু অংশ তুলে ধরছি। কেউ যদি মুভিটা না দেখে থাকেন তাহলে লেখাটি পড়ার আগে একবার মুভিটি দেখার পরামর্শ থাকলো।  

ক্রেডিট নাও, প্রিয়

জ্যোতির্বিদ প্রফেসর ডক্টর মিন্ডি (লিওনার্দো ডিক্যাপ্রিও) আর তার পিএইচডি স্টুডেন্ট  কেইট ডিবিয়াস্কি (জেনিফার লরেন্স) যখন প্রেসিডেন্টের সাথে দেখা করতে যান তখন প্রফেসর মিন্ডির স্ত্রী তাকে বলেছিল তার প্রাপ্য ক্রেডিট নিতে। বিজ্ঞানীদের অনেকেই প্রচণ্ড অন্তর্মুখী হন। কথা বলতে সংকোচ বোধ করেন এজন্য তার যতটুকু প্রশংসা, সুবিধা পাওয়ার কথা তার চেয়ে কমই পান। এজন্য ডক্টর মিন্ডির স্ত্রী আগেই তাকে বলেছিলেন একটু উচ্চকণ্ঠ হতে, নিজের কাজটুকু সবাইকে তুলে ধরতে।

সিনেমার দৃশ্য; Credit: Netflix

কোন ইউনিভার্সিটির তুমি

ডক্টর মিন্ডি, কেইট এবং ডক্টর ওগলথ্রোপ (রব মর্গান) যখন হোয়াইট হাউজে প্রেসিডেন্টের (মেরিল স্ট্রিপ) সাথে মিটিংয়ে জানায় যে একটা দানবাকার ধূমকেতু পৃথিবীর দিকে ধেয়ে আসছে তখন প্রেসিডেন্টের হেড অফ স্টাফ যে আবার প্রেসিডেন্টের ছেলে জেসন জিজ্ঞাসা করল যে কেইট ডিবিয়াস্কি কোন ইউনিভার্সিটির? কেইট যখন বলল যে সে মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটির তখনই তার মধ্যে একটা তাচ্ছিল্য ফুটে ওঠে। একটু পরে প্রেসিডেন্ট অর্লিনও বলে উঠে যে ডক্টর মিন্ডি বা কেইটের দাবিগুলো কোনো আইভি লীগভুক্ত ইউনিভার্সিটির গবেষক বা ছাত্রছাত্রীদের দিয়ে ক্রসচেক করাতে। আইভি লীগভুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রীদের তুলনায় অন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রী/গবেষকদের যে আমেরিকায় কী দৃষ্টিভঙ্গিতে দেখা হয় বা উচ্চপদস্থ কর্মকর্তারা কীভাবে দেখেন সেটা এখানে ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করা হয়েছে।

সিনেমার দৃশ্য; Credit: Netflix

জনগণকে অন্ধকারে রাখো

একই দৃশ্যে ডক্টর মিন্ডি, কেইট এবং ডক্টর ওগলথ্রোপ যখন প্রেসিডেন্টকে বোঝানোর চেষ্টা করছিল যে এই ঘটনাটা ঘটবেই এটাকে এখনই আটকানোর কাজকর্ম শুরু করতে হবে, তখন প্রেসিডেন্ট বললেন যে এই নিউজ কাউকে জানানো যাবে না। জানালে মানুষের মধ্যে বিভ্রান্তি ও ভীতি দেখা দেবে। যেখানে ধূমকেতুটির পৃথিবীতে আঘাত করাটার সম্ভাবনা ছিল প্রায় শতভাগ সেখানে প্রেসিডেন্ট সেটাকে কমিয়ে ৭০ ভাগ বলতে বলেন সবাইকে।

গুরুত্বহীন সংবাদ

প্রেসিডেন্টের কাছে বড় রকমের ধাক্কা খেয়ে ডক্টর মিন্ডি আর কেইট যায় একটা জনপ্রিয় নিউজ শো  দ্যা ডেইলি রিপ-এর দরজায়।  ছয় মাসের মধ্যে একটা বিশালাকার ধূমকেতু পৃথিবীতে আঘাত করতে যাচ্ছে, এই নিউজ হওয়া দরকার সবার আগে। কিন্তু অনুষ্ঠানে সেলিব্রেটিদের (আরিয়ানা গ্রান্ডে) পারসোনাল লাইফে কী ঘটছে এরকম তুচ্ছ ব্যাপার তুলে ধরা হচ্ছিল অনেক রঙ চড়িয়ে। শেষে যখন  ডক্টর মিন্ডি আর কেইট বলা শুরু করে তাদেরকেও উদ্ভট প্রশ্ন করা হয়, বারবার থামিয়ে দিচ্ছিল উপস্থাপক (কেট ব্লানশেট, টাইলার পেরি)। ফলশ্রুতিতে কেইট ধৈর্য হারিয়ে রাগত স্বরে পুরো ব্যাপারটা বুঝিয়ে বলে আর মানুষজন সেটাকে নিয়ে উপহাস করা শুরু করে, মিম বানাতে শুরু করে। অথচ পুরো ব্যাপারটা ছিল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।

সিনেমার দৃশ্য; Credit: Netflix

অযোগ্যরা বসে আছে সবখানেই

ধূমকেতুর আঘাতের বিষয়টা জানাজানি হবার পরেই তড়িঘড়ি করে ডক্টর মিন্ডি, কেইট এবং ডক্টর ওগলথ্রোপকে তুলে এনে মিটিং বসায় প্রেসিডেন্ট। যেখানে দোষ ঢাকার জন্য পদত্যাগ করতে বলা হয় নাসার হেড অফ সিকিউরিটিকে যিনি ছিলেন একজন চিকিৎসক। এরপর মহাকাশে গিয়ে পৃথিবীর দিকে ধাবমান ধূমকেতুকে লক্ষ্য করে পারমাণবিক বোমার আঘাত করার জন্য এমন একজনকে নির্বাচিত করা হয় যে প্রেসিডেন্টের পরিচিত। তার যোগ্যতার কথা বলতে গিয়ে প্রেসিডেন্ট বলে যে তার গলার আওয়াজ ভালো আর সে দেখতেও সুন্দর।

সিনেমার দৃশ্য; Credit: Netflix

বিজ্ঞানীর কষ্টের জীবন

ডক্টর মিন্ডি আর দ্যা ডেইলি রিপ-এর উপস্থাপিকা ব্রি’র (কেট ব্লানশেট) মধ্যের সম্পর্ক যখন মিন্ডির স্ত্রী জানতে পারে তখন সে রাগে মিন্ডির যেসব ওষুধ আছে সেগুলো মিন্ডির দিকে ছুড়ে মারতে থাকে। মিন্ডি ব্লাড প্রেশার, হাঁটুর সমস্যা, প্যানিক এট্যাক ইত্যাদি সমস্যায় ভুগছিল। অ্যাকাডেমিয়াতে যারা আছেন তারা এই বিষয়গুলোর সাথে পরিচিত। বিজ্ঞানীদের সবসময়ই সংগ্রাম করে যেতে হয়। ফান্ড যোগাড় করা, টিচিং পজিশন চলে যাবার ভয়, দীর্ঘক্ষণ বসে কাজ করা এগুলোর কারণে নানাধরনের শারীরিক সমস্যা দেখা দেয়। যেটা এই দৃশ্যে বোঝানো হয়েছে।

সিনেমার দৃশ্য; Credit: Netflix

ডাটার দাপট: তোমার চেয়েও আমরা তোমাকে বেশি জানি

বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে শুরু করে বিভিন্ন ওয়েবসাইট গ্রাহকের তথ্য সংগ্রহ করে সে অনুযায়ী তাদের ব্যবসায়িক কাঠামো দাঁড় করায়। কিছু কিছু প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের কাছে এখন এত পরিমাণ ডাটা আছে যে তারা এখন তাদের গ্রাহকদের চাহিদা কিংবা পছন্দকে পর্যন্ত পরিবর্তন করতে পারে। ডক্টর মিন্ডি যখন ব্যাশ কোম্পানি সিইও পিটারের কাছে বিভিন্ন অনিয়ম এবং ব্যাশের ড্রোনের কার্যকারিতা নিয়ে প্রশ্ন করে তখন পিটার দম্ভভরে জবাব দেয়- তোমার সব ডাটা আমার কাছে আছে। তোমার ভবিষ্যতে কী হবে তাও আমি জানি।

সিনেমার দৃশ্য; Credit: Netflix

একতার বড়ই অভাব

ডক্টর মিন্ডি দ্যা ডেইলি রিপের একটা প্রোগ্রামে নিজের সংযম হারিয়ে হড়বড় করে বিভিন্ন কথা বলতে থাকে। তার কথাগুলো আসলে বর্তমান প্রেক্ষাপটে অত্যন্ত যুক্তিসংগত। এখন আর কোনো ব্যাপারেই মানুষকে একতাবদ্ধ রাখা যায় না। তারা বিভিন্ন পক্ষেই চলেই যায়। এমনকি গুরুত্বপূর্ণ জাতীয় ইস্যুতেও তাদেরকে একত্রিত করা যায় না। কারণ আমাদের স্তরবিন্যাসে এমন বড় ধরনের পরিবর্তন এসেছে যে কোনো না কোনো ব্যাপার আমাদের ঐক্যকে বাধাগ্রস্ত করেই ফেলে বা একতা ভিন্ন খাতে মোড় নেয়।

সিনেমার দৃশ্য; Credit: Netflix

নতুন শুরু

শেষ দৃশ্যে দেখা যায়, গোল্ডিলক জোনে অবস্থিত একটা নতুন গ্রহে সবাই উলঙ্গ হয়ে মাটিতে নেমে আসে। এটাকে অনেকরকম ভাবেই ব্যাখ্যা দেয়া যায়। তবে আমার মনে হয়েছে এখানে বোঝানো হয়েছে যে পৃথিবীই মানুষের সবচেয়ে সুখের জায়গা। মানুষ যখন অন্য গ্রহের বুকে বসতি গড়তে চাইবে তখন একেবারে শূন্য থেকে সবকিছু শুরু করতে হবে।

সিনেমার দৃশ্য; Credit: Netflix

 সিলিকন ভ্যালির ধনকুবের

এই মুভির গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র পিটার, যে একটা বড় টেক কোম্পানির মালিক এবং সবাইকে তার অতি উচ্চাভিলাষী প্রজেক্টে সবাইকে রাজি করিয়ে ফেলে। এই চরিত্রটা মূলত স্টিভ জবস, জেফ বেজোস বা ইলন মাস্কের মতো অতি-ধনীদের কথা মাথায় রেখেই করা হয়েছে বা সিলিকন ভ্যালির সিইওদের মতো করে গড়া হয়েছে। তাদের কিছু প্রজেক্ট মানুষের জন্য কল্যাণকর কিন্তু কিছু প্রজেক্ট খুব বেশি মানুষের কাজে আসবে তা নয়। তাদের কাজের চেয়েও বড় হয়ে উঠে পাবলিসিটি আর বাড়াবাড়ি রকমের আড়ম্বর। যেমন ইলন মাস্কের টানেল প্রজেক্টে কথা আমরা বলতে পারি। সিলিকন ভ্যালির কিছু কিছু কোম্পানি যে কারসাজি করেও যে অর্থ উপার্জন করে সেটাও প্রমাণিত হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ থেরানোস কোম্পানির এলিজাবেথ হোমসের কথা বলা যায়। এদের যেকোনো কথায় সাত পাঁচ না ভেবেই এগোনো হিতে বিপরীত যে হতে পারে সেটা এই মুভিতে চমৎকারভাবে দেখানো হয়েছে।

পরিশেষে, ডোন্ট লুক আপ একটা দারুণ উপভোগ্য মুভি যাতে বিনোদনের পাশাপাশি চমৎকার একটা বার্তা দিয়েছে মানবজাতিকে। তিনবারের অস্কারজয়ী মেরিল স্ট্রিপ এই মুভিকে তার ক্যারিয়ারেরই অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ছবির আখ্যা দিয়েছেন। এতে মহাকাশ থেকে ধেয়ে আসা কমেটের আড়ালে আদতে পৃথিবীর বৈশ্বিক উষ্ণায়ণের মত ব্যাপারকে তুলে ধরা হয়েছে। সব পরিবেশ বিজ্ঞানী একমত যে, এটা ঘটছে এবং শিগগিরই যদি ব্যবস্থা না নেওয়া না হয়, তবে ভয়াবহ বিপর্যয় অপেক্ষা করছে আমাদের জন্য। কিন্তু বিশ্বনেতা থেকে শুরু করে সাধারণ জনতা কাউকেই ঐক্যমতে আনা যাচ্ছে না। বরং কিছু তুচ্ছ জিনিসের প্রতি আমরা এত বেশি ঘনিষ্ঠ হয়ে পড়েছি যে গুরুত্বপূর্ণ অনেক কিছুই আমাদের আর স্পর্শ করছে না।

গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে এক হয়ে কাজ করার বদলে আমরা হয়ে পড়ছি দ্বিধান্বিত, খণ্ডিত। আশা করি একদিন আমরা সবাই অন্তত জলবায়ু পরিবর্তন ও  বৈশ্বিক উষ্ণায়ণের মতো বিষয়গুলোতে জাতিভেদ ভুলে এক হয়ে কাজ করব। আর সেটা না হলে হয়তো ডোন্ট লুক আপ মুভির শেষের দৃশ্যটা হয়তো বাস্তবে আমাদের সাথেই ঘটবে।

Featured Image: Netflix

Related Articles