সুপারপাওয়ার বা অতিমানবীয় শক্তির কল্পনা শুরু হয়েছে মানবসভ্যতার শুরুর দিক থেকেই। হাজার বছর ধরে মানুষ স্বপ্ন দেখে আসছে অতিমানবীয় শক্তি অর্জনের। মূলত এ চেষ্টা থেকেই মানুষ তৈরি করেছে কিছু কাল্পনিক সুপারহিরো চরিত্র।
সাধারণত সুপারহিরো বলতে আমরা এখনকার মার্ভেল এবং ডিসি কমিকসের সুপারম্যান, স্পাইডারম্যান কিংবা ওয়ান্ডারওম্যানের মতো চরিত্রগুলোকেই বুঝে থাকি। কিন্তু বাস্তবে সুপারহিরোর কল্পনা তৈরি হয়েছিল আজ থেকে হাজার হাজার বছর আগে। মূলত সে সময় প্রাচীন গ্রীক, রোমান ও নরওয়েজিয়ান মানুষরা তাদের নিজস্ব সুপারহিরোদের তৈরি করেছিল অতিমানবীয় শক্তি দিয়ে। তাদের বীরদেরকে তারা অস্বাভাবিক শক্তির অধিকারী মনে করত। সেই থেকেই মূলত কাল্পনিক এই চরিত্রগুলোর উদ্ভব ঘটতে থাকে।
এই প্রাচীন পৌরাণিক মহাশক্তিধরদের এখনকার মার্ভেল এবং ডিসি ফুটিয়ে তুলেছে মানুষের সামনে। বলা যায়, পৌরাণিক সেই চরিত্রগুলোকেই ডিসি কমিকস ফুটিয়ে তুলেছে কিছুটা আধুনিক রঙচঙ মেখে। তো চলুন জেনে নেয়া যাক প্রচীন কোন চরিত্রগুলোর সাথে এখনকার সুপারহিরোদের মিল রয়েছে।
মহা ক্ষমতাশালী হাতুড়ি: যেমন থর
মার্ভেল কমিকসে হাতুড়ি হাতে মারমুখী থরের ঝাঁপিয়ে পড়ার দৃশ্য বেশ পরিচিত। নরওয়েজিয়ান পুরাণে থর হলো অতিমানবীয় ক্ষমতাসম্পন্ন হাতুড়িধারী দেবতা। তিনি ছিলেন ঝড়, বজ্র, ওক গাছ, শারীরিক শক্তি এবং মানবজাতির সুরক্ষার দেবতা। গ্রীক পুরাণে যেমন বজ্রদেবতা হিসেবে আছেন জিউস, ঠিক তেমনই নরওয়েজিয়ান পুরাণের বজ্রদেবতা থর।
রোমান ঔপনিবেশিক যুগ এবং ভাইকিং যুগে থর ছিলেন খুব জনপ্রিয় দেবতা। সেসময় থরের প্রতীক হাতুড়ি মিয়োলনির মানুষ গর্বের সঙ্গে ধারণ করত। আধুনিক যুগেও জার্মানিক অঞ্চলের লোককথায় থরের উল্লেখ পাওয়া যায়। মজার ব্যাপার হলো, ‘থার্সডে’ (বৃহস্পতিবার) কথাটি “থর’স ডে” বা “থরের দিন” কথাটি থেকেই এসেছে।
হাতুড়িধারী বিশালদেহী এই সুপারহিরোকে রঙচঙ মেখে সর্বপ্রথম মানুষের সামনে নিয়ে আসে মার্ভেল কমিকস। ১৯৬২ সালের আগস্টে স্ট্যানলির সম্পাদনায় এবং ল্যারি লিবারের গল্পে জ্যাক কিরবির চিত্রকর্মে আত্মপ্রকাশ করে থর। মার্ভেল স্টুডিওজের প্রযোজনায় ‘থর’কে নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্রে থর চরিত্রে অভিনয় করেন ক্রিস হেমসওর্থ।
অ্যাকিলিস: যেমন ক্রিপ্টোনাইট
গ্রীকদের মধ্যে সেরা যোদ্ধা ছিল অ্যাকিলিস। গ্রিক রাজা পেলুস ও সমুদ্রের পরী থেটিসের পুত্র ছিল সে। অ্যাকিলিস একদিকে যেমন ছিল তার সময়ের সেরা বীর, তেমনই তার একটি দুর্বলতাও ছিল- তার গোড়ালি, যাকে ‘অ্যাকিলিস হিল’ নামে অভিহিত করা হয়।
ঐতিহাসিক ‘ট্রয়’ মুভিটি দেখেছেন অনেকেই। সেখানে বিখ্যাত ট্রোজান যুদ্ধের সেরা বীর হিসেবে উপস্থাপন করা হয় অ্যাকিলিসকে। অ্যাকিলিস যেমন ছিল ট্রোজান যুদ্ধের সেরা বীর, তেমনই তার গোড়ালির দুর্বলতা সম্পর্কেও সবাই অবগত ছিল। অবশেষে কালজয়ী এই বীর গোড়ালিতে মাত্র একটি তীরের আঘাতেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে। তার এই দুর্বলতা অনেকটা সুপারম্যানের ক্রিপ্টোনাইট বা উলভারিনের মারুসামা ব্লেডের মতো। এখনও ইউরোপ ও আমেরিকায় কারো দুর্বলতা প্রকাশ করতে ‘অ্যাকিলিস হিল’ কথাটি ব্যবহৃত হয়।
হারকিউলিস: যেমন হাল্ক
গ্রীক বীর হারকিউলিসের নাম কম-বেশি আমাদের সবারই জানা। দেবতা জিউস ও সুন্দরী আলকমেনের পুত্র হারকিউলিস ছিলেন অতিমানবীয় শক্তি-সামর্থ্যের অধিকারী। তাছাড়া ধ্রুপদী পুরাণবিদ্যা অনুসারে হারকিউলিস বিখ্যাত দুর্গম অভিযাত্রা এবং তার প্রকাণ্ড দেহের জন্য।
হারকিউলিস তার সব অতিমানবীয় কাজ করেন স্ত্রী এবং সন্তান হত্যার পূর্ণ প্রায়শ্চিত্ত করার জন্য। কারণ গ্রীক পুরাণ অনুযায়ী, হারকিউলিস একবার উন্মাদ হয়ে পড়ে। এই অপ্রকৃতিস্থ অবস্থায় তিনি তার স্ত্রী-পুত্রদের হত্যা করে ফেলেন। পরে চেতনা ফিরে আসলে যখন তিনি জানতে পারলেন যে তিনি নিজেই তার স্ত্রী-সন্তানদের হত্যা করেছেন, তখন তিনি লজ্জা, ক্ষোভে এবং দুঃখে আত্মহত্যা করতে চান। কিন্তু ইউরেস্থিউসের পরামর্শক্রমে তিনি প্রায়শ্চিত্ত করার সিদ্ধান্ত নেন।
অনেক অসম্ভব কৃতিত্বের মধ্যে হারকিউলিস ১২টি অসম্ভব কাজ সম্পন্ন করেন। এর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য কিছু কৃতিত্ব হলো, আকাশকে ধরে রাখা, অসংখ্য দানবকে হত্যা করা, এমনকি কুস্তিতে তিনি মৃত্যুকেও পরাজিত করেন বলে কিংবদন্তী রয়েছে।
হারকিউলিসকে কেন্দ্র করে এ পর্যন্ত বেশ কিছু চলচ্চিত্র ও টিভি সিরিজ নির্মিত হয়েছে। তাকে নিয়ে ওয়ার্ল্ড ডিজনি ১৯৯৭ সালে ‘হারকিউলিস’ নামে অ্যানিমেটেড ছবি তৈরি করে। এছাড়া ১৯৯৫-৯৯ পর্যন্ত একই নামে একটি টিভি সিরিজ বেশ জনপ্রিয়তা অর্জন করে। মার্ভেল কমিকসের প্রকাণ্ডদেহী হাল্কের কাল্পনিক ধারণার মূলেও কিন্তু রয়েছে হারকিউলিস। আজকের হাল্ক কিংবা হাজার বছর আগের হারকিউলিস- সুপারহিরোদের জনপ্রিয়তা কিন্তু কখনোই কম ছিল না।
ওয়ারিয়র ওমেন: যেমন ওয়ান্ডার ওম্যান
গ্রীক পৌরাণিক কাহিনীতে অ্যামাজন নামে একদল যোদ্ধাগোষ্ঠীর বর্ণনা রয়েছে। এই গোষ্ঠীর সদস্যরা ছিল খুবই নিষ্ঠুর প্রকৃতির। তবে এই গোষ্ঠীতে কোনো পুরুষ সদস্য ছিল না, বরং সবাই ছিল আগ্রাসী নারী।
নারী বলে যে তাদের শারীরিক শক্তি কিংবা সাহস কম ছিল তা কিন্তু নয়। আগ্রাসী এই নারীদের শারীরিক শক্তি, সাহস, দৃঢ়তা এবং দক্ষতা সবই ছিল যেকোনো পুরুষ যোদ্ধার চেয়ে বেশি।
অনেকের কাছেই হয়তো এই যোদ্ধা নারীদেরকে বেশ পরিচিত মনে হচ্ছে। হ্যাঁ, এই আগ্রাসী নারীদের সাথে মিল রয়েছে ডিসি কমিকসে আমাদের দেখা ওয়ান্ডার ওম্যানের।
ডায়ানা নামে এই চরিত্রটি প্রথম দেখা যায় ১৯৪১ সালের অক্টোবরে অল স্টার কমিকসের ব্যানারে। এরপর ১৯৪২ সালের জানুয়ারিতে কভারে আসে সেন্সেশন কমিকসে। ১৯৮৬ সাল; এই এক বছর ব্যতীত প্রায় নিয়মিতই ডিসি কমিকস থেকে ওয়ান্ডার ওম্যান শিরোনাম প্রকাশ হয়ে আসছে। কালজয়ী এই কাল্পনিক চরিত্রের বিকাশ সীমাবদ্ধ নেই শুধু বই কিংবা ম্যাগাজিনের মধ্যেই। ওয়ান্ডার ওম্যানের এই চরিত্র নিয়ে অনেক মুভি, ড্রামা, টিভি শো কিংবা অ্যানিমেশন টিভি শো-ও নির্মিত হয়েছে।
এসবের পাশাপাশি নির্মিত হয়েছে বেশ কিছু ভিডিও গেমসও। এগুলোর মধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য হলো, ১৯৭০ এর দশকে লাইভ অ্যাকশন টেলিভিশন শো ‘ওয়ান্ডার ওম্যান’, ২০১৪ সালে কম্পিউটার অ্যানিমেশন চলচ্চিত্র ‘দ্য লেগো মুভি’, ২০১৬ সালে লাইভ-অ্যাকশন ডিসি কমিকস চলচ্চিত্র ‘ব্যাটম্যান ভার্সেস সুপারম্যান: ডন অব জাস্টিস’ এবং ২০১৭ সালে ডিসি ফিল্মের ব্যানারে ‘ওয়ান্ডার ওম্যান’।
দেবী সারসি: যেমন উইচফায়ার
সুপারহিরোরা যে শুধু অতিমানবীয় শক্তি ও প্রকাণ্ড শারীরিক গঠনের অধিকারী হয়ে থাকে তা কিন্তু নয়। আজকের সুপারহিরোদের অনেকেরই অস্ত্রভাণ্ডার বা শক্তির উৎস হলো ম্যাজিক বা যাদু।
ডিসি কমিক্সের উইচফায়ারের কথাই ধরুন, একদিকে সে যেমন সুন্দরী মডেল, প্রতিভাবান অভিনেত্রী, গায়িকা, আবার অন্যদিকে শক্তিশালী জাদুকরও। আবার র্যাভেনের কথা চিন্তা করুন। সে সহজেই মানুষের মনের ভাষা বুঝে ফেলতে পারে। এভাবে সে শত্রুর নাড়িনক্ষত্র জেনে নেয়। এরপর সেই অনুযায়ী আক্রমণ করে। আবার মার্ভেল কমিক্সের দাম্ভিক নিউরোসার্জন স্টিফেন স্ট্রেঞ্জ এক সড়ক দুর্ঘটনায় মারাত্মকভাবে আহত হযন, যার ফলে তার চিকিৎসক জীবনের ইস্তফা দিতে হয়। হাত হারিয়ে ফেললেও তিনি দৌড়ে বেড়ান রহস্যময় শিল্পের পেছনে।
কমিক বই কিংবা চলচ্চিত্রের এসব চরিত্রের মূল উৎস গ্রীক দেবী সারসি। দেবী সারসিকে নির্বাসন দেওয়া হয় একটি রহস্যময় পৌরাণিক দ্বীপে। সেখানে তিনি নিজের অতিমানবীয় ক্ষমতা সম্পর্কে জানতে পারেন। সেখান থেকেই তিনি শিখে নেন মানুষকে বিভ্রান্ত করার জাদু। অর্জন করে নেন মানুষের মন বোঝার অস্বাভাবিক ক্ষমতা।
যুগে যুগে অতিমানবীয় এই কাল্পনিক চরিত্রগুলোর মধ্যে অনেক পরিবর্তনই ঘটেছে। পৌরাণিক প্রাচীন চরিত্রগুলো আধুনিকতার রঙ মেখে ভিন্ন নামে কিংবা ভিন্ন ধাঁচে যেমন উঠে এসেছে আমাদের সামনে, তেমনই তৈরি হয়েছে নতুন অনেক কাল্পনিক সুপারহিরোও। সে যুগের ওডিসি, হারকিউলিস, অ্যাকিলিস কিংবা থর যেমন মানুষের কল্পনার জগতে জায়গা করে নিয়েছিল, ঠিক একইভাবে আমাদের কল্পনায় রয়েছে হাল্ক, ওয়ান্ডার ওম্যান কিংবা সুপারম্যান। সুতরাং একথা নির্দ্বিধায় বলে দেওয়া যায় যে সুপারহিরোদের জনপ্রিয়তা কখনই কম ছিলনা।
Featured Image: freecreatives.com