স্পেনের রাজা দ্বিতীয় চার্লসের মৃত্যুর সাথে সাথে পুরো রাজবংশই বিলুপ্ত হয়ে যায়। না, কোনো যুদ্ধে তার মৃত্যু হয়নি। সতেরো প্রজন্ম ধরে নিজেদের বংশের মধ্যে বিয়ের ধারা বজায় রেখেছিল তারা। বংশগতির রোগে এ রাজবংশের বিলুপ্তিই ছিল যার শেষ পরিণতি! অন্যদিকে, পাশ্চাত্য ধ্রুপদী সঙ্গীতের বিখ্যাত নাম নিকোলো প্যাগানিনির জন্য শাপে বর হয়ে এসেছিল বংশগতিরই এক রোগ! হাতের আঙুলগুলো অদ্ভুতভাবে বাঁকিয়ে বেহালার চার তারে আশ্চর্য সুর তুলতে পারদর্শী ছিলেন তিনি। শেষমেশ, তার এ অতিমানবীয় কর্মকাণ্ডে জনসমাজে ‘শয়তানের উপাসক’ হিসেবে পরিচিত পান তিনি। প্যাগানিনির সাফল্য কিংবা রাজা দ্বিতীয় চার্লসের মৃত্যু, দুটি ঘটনার পেছনে কলকাঠি নেড়েছে মূলত বংশগতির একটি উপাদান- জিন। জিন হলো বংশগতির আণবিক একক যা ডিএনএ-তে লিপিবদ্ধ থাকে। বংশগতিবিদ্যা বিজ্ঞানের একটি বিশাল শাখা। বংশগতিবিদ্যার এই বিশাল জগতের সাথে খুব ভালোভাবেই পরিচয় করিয়ে দিতে সক্ষম হবে আরাফাত রহমানের ‘জেনেটিক্স: বংশগতিবিদ্যার সহজ পাঠ‘ বইটি।
প্রাণের অন্যতম একটি বৈশিষ্ট্য হলো বংশগতি। আমরা কেন মা-বাবার মতো দেখতে, বিভিন্ন রোগ কীভাবে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বাহিত হয়- এ সব কিছুর উত্তর লুকায়িত আছে বংশগতির ধারণায়। মটরশুঁটি নিয়ে গবেষণায় মেন্ডেলের পর্যবেক্ষণকৃত ‘ফ্যাক্টর’ই পরবর্তীতে ‘জিন’ নামে পরিচিত হয়েছে আমাদের কাছে। মাঝে গড়িয়েছে অনেকটা সময়, বিজ্ঞানীদের পাড়ি দিতে হয়েছে নানা বন্ধুর পথ। বংশগতির গবেষণার শুরু থেকে আজ অবধি একটা সংক্ষিপ্ত কিন্তু চমৎকার ইতিহাস মলাটবন্দী করতে পারা এ বইয়ের অন্যতম সাফল্যের জায়গা। পুঁজ থেকে নিউক্লিন তথা ডিএনএ পৃথক করা কিংবা ডিএনএ-র প্রকৃত কাঠামো উন্মোচনের পেছনের কাহিনী যথেষ্ট রোমাঞ্চকর। অবাক করার বিষয়, চার অক্ষরের তৈরি ডিএনএ না বরং বিশ ধরনের অ্যামাইনো অ্যাসিডের তৈরি প্রোটিনকেই একটা সময় বিজ্ঞানীরা বংশগতির ধারক ও বাহক মনে করতেন। বিজ্ঞানীদের সেই ভুল কীভাবে ভাঙল? ৬০/৭০ বছর পূর্বেও যে ডিএনএ-র কাঠামোই আমরা জানতাম না কীভাবেই বা সেখানে আজ ইচ্ছামতো পরিবর্তন করা সম্ভব হচ্ছে? বইটিতে এসব প্রশ্নের একটি ধারাবাহিক ইতিহাস-সচেতন উত্তর দেওয়ার চেষ্টা করেছেন লেখক।
প্রসঙ্গক্রমেই জিন, জিনোম, ডিএনএ, ডিএনএ অনুলিপন, ডিএনএ ট্রান্সলেশন প্রভৃতি বিষয়ের সচিত্র আলোচনাও উঠে এসেছে বইটিতে। পুরোপুরি রঙিন ছবিতে সমৃদ্ধ বইটি জেনেটিক্সের জটিল সব বিষয়কে যেন অনেকটাই সহজ করে দিয়েছে। পাশাপাশি জেনেটিক্সের নানা জটিল টার্মের সংক্ষিপ্ত ধারণাও দেওয়া আছে বইয়ের একদম শেষে।
আশ্চর্যের বিষয়, আমাদের দেহে ভিটামিন সি তৈরির জিন থাকলেও আমরা এই ভিটামিনটি তৈরি করতে পারি না। বাইরে থেকে তা গ্রহণ করতে হয়। ‘মিউটেশন’-এর ধারণার মধ্যে এ ধাঁধার উত্তর লুকিয়ে আছে। মিউটেশন হলো ডিএনএ-র সিকোয়েন্সে কোনো পরিবর্তন। মিউটেশন কীভাবে হয়? মিউটেশনের ফল কীরূপ হতে পারে? মিউটেশন কীভাবে মেরামত করা হয়? এসব প্রশ্নের সহজ ও সাবলীল উত্তর বর্ণনা করা হয়েছে বইটিতে।
পাশাপাশি এপিজেনেটিক্সের মাধ্যমে যেভাবে ডিএনএ সিকোয়েন্সে কোনো পরিবর্তন না হয়েও যে এর বহিঃপ্রকাশ ভিন্ন হতে পারে তা-ও দারুণভাবে তুলে ধরেছেন লেখক। বইটির একদম শেষ অংশে উঠে এসেছে হাল আমলের আলোচিত বিষয় ক্রিসপার প্রযুক্তির নানাদিকের আলোচনা। ক্রিসপারের মাধ্যমে নিমিষেই জিনের মধ্যে পরিবর্তন আনার যে আলাদীনের চেরাগ হাতে পেয়েছেন বিজ্ঞানীরা, তার নৈতিক বাধাবিপত্তি, সুবিধা-অসুবিধার একটা বিশদ ধারণা পাবেন পাঠক।
বইটির লেখক আরাফাত রহমান বর্তমানে ইউনিভার্সিটি অব ক্যালিফোর্নিয়া রিভারসাইডে জেনেটিক্স, জিনোমিক্স ও বায়োইনফর্মেটিক্স বিষয়ে পিএইচডি গবেষণা করছেন। অন্তর্জালে বিজ্ঞান ব্লগের সহপ্রতিষ্ঠাতা ও সম্পাদক তিনি। বাংলা ভাষায় জেনেটিক্সের হাতে গোনা কয়েকটি বইয়ের মধ্যে অনবদ্য এক সৃষ্টি লেখকের তৃতীয় বই ‘জেনেটিক্স: বংশগতিবিদ্যার সহজ পাঠ‘।
বইটির বিষয়বস্তু তার গবেষণাসংশ্লিষ্ট হওয়া ও অন্তর্জালে নিয়মিত বিজ্ঞান বিষয়ক লেখালেখি বংশগতির মতো জটিল একটা বিষয়কে অনেক সাবলীল ভঙ্গিতে তুলে ধরতে সহায়তা করেছে। জীববিজ্ঞানের শিক্ষার্থী কিংবা বিজ্ঞান অনুসন্ধিৎসু পাঠক মাত্রই বইটি থেকে উপকৃত হতে পারবেন, জেনেটিক্সের মজার জগতের রোমাঞ্চও উপলব্ধি করবেন বেশ ভালোমতোই। তবে জীববিজ্ঞানের বেশ কিছু ইংরেজি শব্দের বাংলা পরিভাষা ব্যবহার ও কিছু ক্ষেত্রে দীর্ঘ বাক্যের বিন্যাস পড়ার স্বাভাবিক গতিতে কিছুটা বাধার সৃষ্টি করতে পারে। তবে এতে বইয়ের মূল বিষয়বস্তু আহরণে বিন্দুমাত্র সমস্যার সৃষ্টি হবে না! সব মিলিয়ে বাংলা ভাষায় বিজ্ঞান বিষয়ক বইয়ে অনন্য এক সংযোজন হয়ে থাকবে বইটি।
সংক্ষিপ্ত বই পরিচিতি
বই: জেনেটিক্স: বংশগতিবিদ্যার সহজ পাঠ
লেখক: আরাফাত রহমান
প্রকাশক: দি ইউনিভার্সিটি প্রেস লিমিটেড এবং প্রকৃতি-পরিচয় প্রকাশন
প্রচ্ছদ শিল্পী: সব্যসাচী হাজরা
পৃষ্ঠাসংখ্যা: ২০৭
মুদ্রিত মূল্য: ৪৩০ টাকা