তুমি কি তাকে পরকীয়ায় সন্দেহ করো?
না, সেরকমটি নয় মহামান্য বিচারক।
তুমি কি নিশ্চিত এই ব্যাপারে?
হ্যাঁ। আমি নিশ্চিত।
তোমার স্বামী কি পরকীয়ায় আসক্ত?
না, জনাব।
কোনোভাবে কি কাঠগড়ায় দাঁড়ানো লোকটি তোমার জীবননাশের হুমকি দিয়ে আসছিল?
না!
তাহলে আদালতের শরণাপন্ন হয়ে ডিভোর্স চাওয়ার ভিত্তি কী?
কারণ, সে (স্ত্রী) আর তাকে ভালোবাসতে পারে না।
ইসরায়েলের অন্যতম আলোচিত-সমালোচিত কোর্টরুম ড্রামা ফিকশন গেট: দ্য ট্রায়াল অব ভিভিয়ানা আমসালেম। হিব্রু ভাষায় গেট শব্দটি দিয়ে বোঝানো হয় ধর্মীয় রীতিতে ‘বিবাহবিচ্ছেদ’। ইহুদী ধর্মে কোনো নারী তার স্বামীকে সরাসরি তালাক দিতে পারেন না। এজন্য উক্ত ব্যক্তির কাছে তালাকপ্রাপ্তির অনুরোধ করতে হয়। অনুগ্রহ করে যদি সেই পুরুষ ধর্মীয় আদালতের মাধ্যমে তাকে তালাক দিতে সম্মত হয়, তবেই ধর্মীয় বিধিবিধান অনুসারে পরস্পরের সম্পর্ক ছিন্ন হয়। ২০১৪ সালের হিব্রু ভাষার চলচ্চিত্রের গল্প ভিভিয়ানা নামে এমন একজন বিচ্ছেদপ্রত্যাশী নারীর। চলচ্চিত্রটি আপনাকে বৈবাহিক সম্পর্কের জটিলতা নিয়ে ভাবাবে। দ্বিধাগ্রস্ত করে তুলবে খানিকটা সময়ের জন্য। তদুপরি, সিনেমার নির্মাণ প্রক্রিয়া একজন একনিষ্ঠ দর্শক হিসেবে কাহিনিতে গভীরভাবে নিবিষ্ট করবে।
বিশ বছর আগে বিয়ে হয়েছে ভিভিয়ানা আমসালেম এবং এলিশা আমসালেমের। সম্পর্কের প্রথম দিন থেকেই কোথাও একটা গরমিল আঁচ করতে পারেন স্ত্রী। দেখতে দেখতে চার সন্তান-সন্ততির বাবা-মা হন তারা। কিন্তু ঐ যে- সম্পর্কটা আসলে কোনোভাবেই ঠিকঠাক যাচ্ছিল না। কারো কোনো বিবাহ বহির্ভূত সম্পর্ক ছিল না, কিংবা এলিশা স্ত্রীকে মারধর করতো এমন কথাও ভিভিয়ানা কোর্টে উপস্থাপন করেননি। আর এতেই অবাক তিন বিচারক। ফলে তাদের বিশ বছরের সম্পর্কের ইতি টানাকে অবিশ্বাস্য ও অযৌক্তিক মনে হচ্ছে।
পক্ষান্তরে, আমরা জানতে পারি, আরও প্রায় দশ বছর আগে থেকেই ভিভিয়ানা আলাদা হয়ে যাবার জন্য ভালভাবেই ভেবেছেন। এলিশার সাথে কথাও বলেছেন এ নিয়ে। তবে অজ্ঞাত কারণে এলিশা বরাবরই নিশ্চুপ থেকে গেছেন। তাই শেষপর্যন্ত দ্বারস্ত হতে হয়েছে আদালতের। এখানে লক্ষ্যণীয় ব্যাপার হলো, কোর্টে কেউ কারো নামে সরাসরি দোষারোপ বা বিষোদগার করছেন না। উল্টো কিছু কিছু ব্যাপারে একে অন্যের প্রতি সহানুভূতিশীল আচরণ দেখাচ্ছেন। সব মিলিয়ে ভালোবাসা ফিকে হবার কারণ আরাধ্য থেকে যাচ্ছে র্যাবাইদের কাছে। ধর্মীয় আদালতে মুখোমুখি দম্পতির ভিন্ন ভিন্ন অনড় অবস্থানে থাকার নিমিত্তে বিচারকদের (Rabbis) অপারগতা আদালতের গ্রহণযোগ্যতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে। তদুপরি, বিচারপ্রক্রিয়া পরিকল্পিতভাবে ধীর করে দেয়ার প্রয়াসও গুরুত্বসহকারে দেখানো হয়। ফলে সহজীকরণ করলে আপনি বুঝতে পারবেন- এটি একপক্ষের সময়ক্ষেপণের চলচ্চিত্র।
তারা দুজনেই ভীষণ জেদি আর একগুঁয়ে।
ধর্মমতে আমরা এই ব্যক্তিকে ডিভোর্স প্রদানের জন্য জোর করতে পারি না।
তদ্রুপ, এই মহিলাকেও তার অনিচ্ছায় ফিরিয়ে দিতে পারব না।
এমতাবস্থায় কোর্ট চায় তারা আরও কিছুদিন একসাথে থাকুক, পুনরায় ভেবে সিদ্ধান্ত নিক। কিন্তু শেষমেষ ফলাফল বদলায় না। ভিভিয়ানার নানা কারণে অসহনীয় লাগে এলিশাকে। অন্যথায়, এলিশা মুখে ভালোবাসার কথা বলে গেট প্রদানে অস্বীকৃতির কথা জানায়। মাঝে কয়েক শুনানিতে ইচ্ছাকৃতভাবে অনুপস্থিত থেকে আদালতের কালক্ষেপণ করেন তিনি। কোর্টের পক্ষ থেকে স্পষ্ট জানিয়ে দেয়া হয়, ভিভিয়ানা তার স্বামীকে হাজির করতে না পারলে তাদের পক্ষ থেকে কিছুই করা সম্ভব না, তারা নিরুপায়।
ভিভিয়ানার আইনজীবী কারমেলের সাথে তার অস্পষ্ট সম্পর্কের ইঙ্গিত রয়েছে সিনেমায়। তেমনই, বিচ্ছেদের নেপথ্যের কারণ নিয়েও সৃষ্টি করা হয়েছে ধোঁয়াশা। অপরপক্ষে, কোর্টে এলিশার আইনজীবীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হন সহোদর র্যাবাই শিমন। আদালতে ভাইকে ধর্মভীরু ইহুদি প্রমাণের শত চেষ্টা করা হয় বার বার, যাতে বিচারকগণ সহানুভূতিপ্রবণ আচরণ করেন। এছাড়া, পারিবারিক অনেক মিথ্যা সাক্ষীকে দেখা যায় অনৈর্ব্যক্তিক বক্তব্য প্রকাশ করতে, যেন এলিশা একজন মহৎ, উদারচেতা, ধার্মিক স্বামী বলে প্রতীয়মান হয়।
চলচ্চিত্রে উল্লেখিত দম্পতির পাশাপাশি তাদের দুই আইনজীবী কাহিনি বর্ণনায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। সাক্ষীদের জবানবন্দি আর সাক্ষ্যপ্রমাণের বিভিন্ন পর্যায়ে সময়ে সময়ে গুমোট স্তব্ধ পরিবেশ সৃষ্টি করে নির্মাণশৈলীতে সৃজনশীল মনোভাবের পরিচয় দিয়েছেন পরিচালক রনিত এলকাবেটয ও শ্লোমি এলকাবেটয, যারা কিনা আবার আপন ভাই-বোন। রক্ষণশীল পরিবারে বেড়ে ওঠা বড় বোন শ্লোমির দেখাদেখি রনিত ফিল্ম ডিরেকশনে আসেন। গুরুত্বপূর্ণ আরেকটি তথ্য হচ্ছে গেটের কাহিনি, তাদের বাবা-মায়ের বৈবাহিক সম্পর্কের সূত্র ধরেই সাজানো হয়েছে। অর্থাৎ, সরাসরি যে কথাগুলো তারা কখনো পরিবারে শেয়ার করতে পারেননি, সেই না বলা অনুভূতিগুলো নিয়ে এসেছেন সেলুলয়েডে। প্রটাগনিস্ট ভিভিয়ানা চরিত্রেও থেকেছেন শ্লোমি নিজেই। গেট: দ্য ট্রায়াল অফ ভিভিয়ানা আমসালেম, টু টেইক অ্যা ওয়াইফ (২০০৪) চলচ্চিত্রের সিকুয়েল।
Why do you want her back?
She’s my destiny and I’m hers.
we will never part.
ব্রেখটীয় পদ্ধতিতে মুভিতে কিছু অস্বস্তিকর কম্পোজিশনের অবতারণা করা হয়েছে। প্রথম শটে আইনজীবী কারমেল সরাসরি দর্শকদের দিকে তথা ক্যামেরায় চোখ রেখে তার বক্তব্য শুরু করেন। তদ্রূপ, কোর্টে ভিভিয়ানা চুলের ক্লিপ খুলে ফেলায় বিচারকদের রুষ্ট ব্যবহারের শিকার হবার পরের সিকুয়েন্সে দীর্ঘ সময় ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে এক্সপ্রেশন দেয়ার অদ্ভুত আরেক শট রয়েছে। এরূপ শটে সাধারণত দর্শককে সামাজিক এবং রাজনৈতিক বাস্তবতার বিষয়ে সজাগ করার উদ্দেশ্য নিয়ে বিভ্রমের বদলে বাস্তবের সাথে সংযোগ স্থাপনের চেষ্টা করা হয়। কোর্টরুম ড্রামা হবার কারণে এতে স্বভাবতই ডায়লগ-নির্ভরতা আছে। তবে ডায়লগের ভাবগাম্ভীর্য ও গভীরতায় তা স্থূলকায় রূপ নেয়নি। যদিও ব্যাকগ্রাউন্ড স্কোর প্রয়োজনের তুলনায় সীমিত বলে কারো কারো কাছে শ্লথগতির সিনেমা বলে মনে হওয়া স্বাভাবিক। তবুও যুক্তিতর্ক, বিবেচনা এবং ধর্মীয় সমালোচনায় শ্লোমির নির্মাণ ইসরায়েলের গণ্ডি পেরিয়ে বিশ্বসিনেমায় চাঞ্চল্য তৈরি করে রাজনৈতিক অভিঘাত এবং তাৎপর্য জানান দিয়ে বহির্বিশ্বের চলচ্চিত্রবোদ্ধাদের আকৃষ্ট করে।
শুরুতে কানসের ডিরেক্টর ফোর্টনাইট সেকশনের প্রিমিয়ার হওয়া ফিল্মটি প্রশংসিত হয়েছে টরন্টো ইন্টারন্যাশনাল ফিল্ম ফেস্টিভ্যালেও। পরে ২০১৪ সালের ইসরায়েলের অফিসিয়াল এন্ট্রি হিসেবে বাছাই করা হয় বিবাহ বিচ্ছেদ সংক্রান্ত এই ফিকশনকে। ২০০০ সাল-পরবর্তী বিশ্বসেরা চলচ্চিত্রের বিবিসি জরিপে নিউ ইয়র্ক ম্যাগাজিনের ক্রিটিক ম্যাট জোলার সেটয ছবিটিকে প্রথম অবস্থানে রেখেছেন। স্ত্রীকে বিচ্ছেদের পেপার হস্তান্তরের মুহূর্তে শপথবাক্য পাঠে এলিশা আটকে যায়। নিজমুখে কোনোভাবেই স্ত্রীকে বলতে পারে না ঐ বাক্য। বার বার মূল্যবান সময় নষ্টের জন্য আদালত থেকে দুজনকেই বের করে দেয়া হয়। শেষে কিছু সময়ের জন্য কোর্টরুমের বাইরে পারিবারিক আলাপচারিতায় দেখা যায় এলিশা ও ভিভিয়ানাকে। কিন্তু তারা সিদ্ধান্ত থেকে সরে না এসে বরং শর্তসাপেক্ষে বিচ্ছেদের পথে হাঁটতে চূড়ান্ত সম্মতি জানায়।
It’s easy to blame the one who yells,
The one who whispers venom is innocent.
চলচ্চিত্র: גט – המשפט של ויויאן אמסלם (Gett: The Trial of Viviane Amsalem)
সাল: ২০১৪
পরিচালক: রনিত এলকাবেটয ও শ্লোমি এলকাবেটয
জনরা: কোর্টরুম ড্রামা