গোপাল ভাঁড় আর তার সাথে রাজা কৃষ্ণচন্দ্রকে চেনে না এমন মানুষ খুব কম। গোপাল ভাঁড় ছিলেন বুদ্ধির রাজা। মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র নিজেও ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী।
সময়টা ১৭৫৬। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা বসলেন বাংলার সিংহাসনে। এর পর পরই পলাশীর যুদ্ধের সময় ইংরেজ সরকারের চেলা জগৎ শেঠ সাহায্য নেন এই কৃষ্ণনগরের রাজার। আড়ালে থেকে সাহায্য করেন তিনি। একসময় তাকে জেলেও যেতে হয়। পলাশীর যুদ্ধে বিজয়ের পরে এই জগৎ শেঠ কৃষ্ণচন্দ্রকে অনেক সোনা-দানা, হীরা-জহরত উপহার দেন। মীর জাফরের পরে তার জামাতা মীর কাসেম যখন বাংলার সিংহাসনে বসেন, এরপরে তিনি টের পেলেন- জগৎ শেঠ তাঁর বিরুদ্ধে শুরু করেছে চক্রান্ত। মীর কাসেম নিজের আসন হারাবার ভয়ে মেরে ফেললেন একসময়ের বিশ্বস্ত জগৎকে। এদিকে বন্ধুর মৃত্যু সংবাদে বেশ চিন্তায় পড়ে যান কৃষ্ণচন্দ্র। বন্ধুর দেয়া সেই সোনাদানা বিলিবন্টন করে দেন তার অধীনস্ত খাস কিছু লোকের মাঝে। এর মাঝে একজন ছিলেন দুর্গাগতি দেব রাই।
এরপরে নানা ঘটনাপ্রবাহে সেই সোনাদানা চাপা পড়ে যায় কালের গহ্বরে।
অনেক কাল পরের কথা। আবির, ঝিনুক আর তাদের প্রিয় সোনা দা ওরফে ইতিহাসের শিক্ষক সুবর্ণ সেন। এই আবির আবার সোনাদার ভাইপো। নিজের কাকাকে সে দাদা বলে ডাকে, কারণ বয়সের পার্থক্য কম। আবির আর ঝিনুকের বিয়ে ঠিক হয়ে আছে। তিনজনের মধ্যে ছোটখাট খুনসুটি চলতে থাকে। ঝিনুকের জন্মদিনে তাদের হাতে আসে দুর্গাগতি দেব রাই নামের কোনো এক ব্যক্তির ছোরা। ছোরার গায়ে লেখা ছিল আরেকটি নাম- ‘মাহাতাব চাঁদ’। কে এই ছোরার আসল মালিক সেটা নিয়ে সবাই বেশ সন্দিহান। কোনো এক চোরাচালান গ্রুপের কাছ থেকে এটা কব্জা করেন এই তিন পান্ডবের পরিচিত মি. সরকার।
ছোরাটা সেই পুলিশ অফিসার মি. সরকারের বাড়ি থেকেও আবার চুরি যায়। অন্যদিকে সুবর্ণ সেন ক্লাসে পড়াতে পড়াতে এক ছাত্রের কাছ থেকে জানতে পারেন কিছু চমকপ্রদ তথ্য। ডাম্বেল তথা ডাম্বুরোপাণী দেব রায়ের দেশের বাড়ি বনপুকুরিয়া। আর তাদের বাড়িতে দুর্গাপুজোয় আসতেন স্বয়ং মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র। এই সিনেমা থেকেই জানা যায়, বর্তমানে যে ধাঁচে দুর্গাপুজো হয়, সেটার প্রচলন হয়েছিল মহারাজার হাত ধরেই। প্রসঙ্গক্রমে জানা যায়, সেই যে ছোরা, সেটা ছিল এই দেব রায় পরিবারের সম্পত্তি। এই পরিবারের বুড়ো ঠাকুরদা ছিলেন সেই দুর্গাগতি দেব রায়। ডাম্বেলের দেয়া পুজোর নিমন্ত্রণ রক্ষা করতে তাদের পৈতৃক বাড়িতে যায় খাবার পাগল আবির, তার ভাবী স্ত্রী ঝিনুক এবং তাদের দুজনের প্রিয় সোনা দা।
বাঙালি বাড়ির পুজো। ঐতিহ্য আর গল্পে ভরা। এ বাড়ির সবচেয়ে বয়স্কা ডাম্বেল, পিণাকপাণী আর ত্রিশুলপাণীর পিসি। সেই পিসি নানা গল্প শোনায় অতিথিদের।
নানা আয়োজন সেই বাড়ির রাজকীয় পুজো চলতে থাকে। প্রত্যেকদিনের পুজোতে রয়েছে কিছু চমক। পুজোর সময় যে গান বাজছে, সেই গানে রয়েছে কিছু ক্লু। এদিকে এই তিন পাণ্ডবের সেখানে যাওয়া মেনে নিতে পারেননি প্রবাসী ত্রিশূলবাবু। সর্বদা এই তিনজনের উপর লেগে থাকা ছাড়াও যেন সমগ্র বাড়ি আর নিজ দেশ ভারতের প্রতি ক্ষোভ। এই দেব রায় পরিবারের ঐতিহ্যও তার কাছে বাজে খরচ লাগে। আর সবসময় ফোনে ব্যস্ত কথা বলা নিয়ে। বাড়ির বাকি সবাই বেশ অমায়িক।
এই বাড়ির চতুর্থ ছেলে, না ঠিক ছেলে নয়, আত্মীয় অপু, সবার অপুদা। এই তিন পাণ্ডব, সাথে ডাম্বেলকে নিয়ে লেগে পড়ে গানের কলি থেকে ক্লু নিয়ে রহস্যোদ্ধারে। এদিকে নতুন সাঁতার শেখা আবির দিঘির নোংরা জল থেকে রাতের আঁধারে তুলে আনে এক শঙ্খ। সেই শঙ্খ উদ্ধার করতে গিয়েও মহা বিপত্তি। সেই অতল জলের তলে কেউ আবিরকে আক্রমণ করে বসে। যদিও যথাসময়ে সে ফিরে আসতে পারে। কিন্তু বেশ ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতা হয় তাদের সবার জন্য।
এর মধ্যে পুরো দল মিলে অপুদার বাড়িতে বসে আড্ডা দেয়, রহস্য নিয়ে কথা বলে। এরকম চলতে চলতে একসময় বেশ বিপদে পড়ে এরা। এই দলের সাথে ছিল এই বাড়ির ছোট্ট সদস্য অদৃশ দেব রায়। নিজের ছেলেকে বিপদে দেখে ত্রিশূলবাবু আরো ক্ষেপে যান। পারলে সেদিনই বিদেশ ফেরত যান।
কিন্তু এমন সময়ে ঘটল অদ্ভুত ঘটনা। আরো কিছু ক্লু সামনে এলো এদের। সেই ক্লুতে বলা আছে একটা ম্যাপের কথা। কিন্তু কোথায় সেই ম্যাপ? সেই ম্যাপ খুঁজে পেলেই সন্ধান মিলবে কৃষ্ণচন্দ্রের গুপ্তধনের।
আসলেই কি সোনাদানা আছে? নাকি গুপ্তধনের নামে লুকোনো আছে অন্য কোনো রহস্য? সেই রহস্য জানার জন্য মুভিটা আপনাকে দেখা লাগবেই।
শ্রী ভেঙ্কেটেশ ফিল্মসের ব্যানারে আসা এই লোমহর্ষক গল্পের রচয়িতা শুভেন্দু দাশ মুন্সি। প্রযোজক হিসেবে ছিলেন মহেন্দ্র সোনি আর শ্রীকান্ত মেহতা। সোনাদা সিরিজের দ্বিতীয় মুভি এটি। এই সিরিজের প্রথম ছবি ছিল ‘গুপ্তধনের সন্ধানে’। এরকম থ্রিলার মুভি যেন এপার বাংলা-ওপার বাংলাকে এক করে দিয়েছে। মুভি শেষ হতে হতে আপনি আশ্চর্য হয়ে যাবেন। ফেলুদা, ব্যোমকেশের পরে নতুন এই রহস্যভেদী বাংলার সিনেমা জগতকে বেশ বদলে দিয়েছে।
গৃহবন্দী এই অবস্থায় নিজের মস্তিষ্কে শান দিতে পারেন এই মুভিটি দেখে। দেখা শুরু করলে নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে এক বসায় দেখে উঠবেন। আর কথা দিতে পারি, প্রিয় মুভির তালিকাতে এই মুভি অবশ্যই থাকবে আপনার। আচ্ছা, বনপুকুরিয়ার গুপ্তধনের নাম দুর্গেশগড় হলো কেন বলুন তো?