বাংলাদেশের ইতিহাসে এ-যাবৎ যে’কজন আদর্শবাদী বুদ্ধিজীবী এবং মৌলিক চিন্তাবিদ আবির্ভূত হয়েছেন, তাদের মধ্যে আবুল ফজল (১ জুলাই, ১৯০৩-৪ মে, ১৯৮৩) মহিমাস্বাতন্ত্র্যে সমুজ্জ্বল। পরিতাপের বিষয়, হাল আমলে তার চর্চা বা মননশীল পঠনপাঠন খুব একটা দেখা যায় না। ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, সাহিত্যের চত্বর এবং সমাজমানস থেকে হীনতা, সঙ্কীর্ণতা, পশ্চাৎপদতা, ধর্মীয় উন্মাদনা, ভেদবুদ্ধি ও অন্ধ গোঁড়ামির অপচ্ছায়া দূর করার নিমিত্তে গত শতকের পুরোভাগ জুড়ে যাঁরা আমাদের দেশে মানব-মুক্তি ও মানস-মুক্তির মুক্ত হাওয়া ছড়িয়ে দিতে নিরলস কাজ করেছেন, সাহিত্য-শিল্পী আবুল ফজল তাঁদের অন্যতম পুরোধা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নকালে তিনি আকৃষ্ট হন ১৯২৬ সালে প্রতিষ্ঠিত, মুক্তবুদ্ধি চর্চার প্রতিষ্ঠান ‘ঢাকা মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ এবং সক্রিয়ভাবে অংশ নেন তাদের ‘বুদ্ধির মুক্তি’ (১৯২৬-৩১) আন্দোলনে। মহাত্মা আবুল হুসেন, কাজী আবদুল ওদুদ, কাজী মোতাহার হোসেন, মোতাহের হোসেন চৌধুরী, কাজী আনোয়ারুল কাদির প্রমুখ চিন্তাবিদের সান্নিধ্যে এসে তিনি প্রয়াসী হন চৈতন্যের পশ্চাৎগামীতা, ধর্মীয় ও সামাজিক জাড্য প্রভৃতি অবক্ষয়ী ভ্রান্তির চোরাবালিতে আটকে থাকা বাঙালি মুসলমান সমাজে চৈতন্যের নবজাগরণ সৃষ্টিতে।
সাহিত্য সমাজের অন্য সভ্যদের মতো তিনিও উপলব্ধি করেছিলেন, ঔপনিবেশিক শাসনের পাশাপাশি সংস্কারাচ্ছন্নতা, সঙ্কীর্ণ মনোবৃত্তি, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যবাদ এবং সামাজিক অশিক্ষা-কুশিক্ষার নিগড় থেকে তদানীন্তন মুসলিম মানস ও সুস্থবুদ্ধিকে মুক্ত না করলে সমাজের প্রকৃত উন্নতি কখনো সম্ভব হবে না। সাহিত্যসমাজ ও বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের অন্যতম সংগঠক এবং বিখ্যাত ‘জ্ঞান যেখানে আড়ষ্ট, বুদ্ধি যেখানে সীমাবদ্ধ, মুক্তি সেখানে অসম্ভব‘ স্লোগান সম্বলিত মুখপত্র ‘শিখা’ পত্রিকার সম্পাদনা মানবতন্ত্রী আবুল ফজলের মনোজগতে সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে, ‘বুদ্ধির মুক্তি’ আন্দোলনের শিখাকে আপনহৃদয়ে তিনি জ্বালিয়ে রেখেছিলেন জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত। সেই শিখার এক গ্রন্থরূপ ‘মানবতন্ত্র’।
‘মানবতন্ত্র’ মূলত একটি মননশীল প্রবন্ধগ্রন্থ। পাঁচটি প্রবন্ধ নিয়ে এর প্রথম প্রকাশ ১৯৭৩ সালে, মুক্তধারা প্রকাশনী থেকে। প্রবন্ধগুলো পাকিস্তান আমলেই লিখিত এবং বিচ্ছিন্নভাবে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় প্রকাশিত। হাওলাদার প্রকাশনী থেকে ২০১৬ সালে প্রকাশিত হলে পূর্বের পাঁচটি প্রবন্ধের সাথে যুক্ত হয় ‘বুদ্ধির মুক্তি’ নামে আরো একটি প্রবন্ধ। বাকি প্রবন্ধগুলো হলো ‘মানবতন্ত্র’, ‘ধর্ম ও রাষ্ট্র’, ‘সভ্যতার সংকট’, ‘সংস্কৃতি’, ‘আগামী দিনের সভ্যতা: একটি কল্পনা’ এবং ‘মানবকল্যাণ’। প্রবন্ধগুলোতে সমাজ, রাষ্ট্র, ধর্ম এবং আধুনিক সভ্যতা-সংস্কৃতি বিষয়ে অগ্রণী বুদ্ধিজীবী এবং প্রগতিশীল প্রাবন্ধিক আবুল ফজলের মৌলিক চিন্তাদর্শন লিপিবদ্ধ হয়েছে।
প্রাক-পাকিস্তান যুগে পূর্ববঙ্গের মুসলিমপ্রধান বাঙালিদের দুরবস্থা দেখে পণ্ডিত আব্দুর রাজ্জাকের মতোই আবুল ফজলের ধারণা ছিল অনাগত পাকিস্তান হবে একটি শুদ্ধ ন্যায়ানুগ রাষ্ট্র। ধর্মভিত্তিক জাতীয়তাবাদী নেতারা উপেক্ষিত বাঙালি মুসলমানের মনে এ রকম ধারণা প্রতিষ্ঠা করতে এত সুচারুরূপে সক্ষম হন যে আবুল ফজলের মতো সাম্প্রদায়িক রাজনীতির প্রতি বিদ্বিষ্ট, উদারনৈতিক মানবতাবাদী বুদ্ধিজীবীও আটকে পড়েন প্রতারণার ফাঁদে। সেসময় তার রচিত ‘কায়েদে আজম’ নাটকে ধুরন্ধর মোহাম্মদ আলী জিন্নাহকে তিনি উপস্থাপন করেন মহতী মানবতন্ত্রী হিসেবে এবং স্বপ্নের জাল বুনেছিলেন যে তার নেতৃত্বেই পাকিস্তানে মানবতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে।
তার সেই ভুল ভাঙতে দেরি হয়নি। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি প্রত্যক্ষ করলেন মুদ্রার উল্টো পিঠ। ১৯৫৭ সালে প্রকাশিত ‘রাঙাপ্রভাত’ উপন্যাসে তিনি সমাজতন্ত্র-ঘেঁষা ন্যায়ানুগ রাষ্ট্রনীতিকে জাতীয় আদর্শরূপে গ্রহণের কথা বললেন, প্রতিক্রিয়াশীল পাকিস্তানী শাসকচক্র এবং তাদের অনুগত বুদ্ধিজীবীরা তাকে চিহ্নিত করল পাকিস্তান-বিরোধী, ইসলাম-বিরোধী রূপে। মাসিক সমকাল পত্রিকায় ‘মানবতন্ত্র’ প্রবন্ধটি তিনি লিখেছিলেন সেসময়েই এবং এই হীন ঘটনার উল্লেখ করে তিনি আক্রমণ করলেন তদানীন্তন অসহিষ্ণু রাষ্ট্রনীতিকে,
…এদের সম্বন্ধেই বার্নার্ড শ’র বিখ্যাত উক্তি, “Beware of that man whose God is in heaven”, একটু বদলিয়ে বললে কথাটা আরো প্রত্যক্ষ হয়, “যাদের আল্লা শুধু ঠোঁটে আর তসবিতে, তাদের থেকে সাবধান!”
সেই প্রবন্ধে আবারও তিনি পাকিস্তান রাষ্ট্রের পক্ষে পারলৌকিক ধর্মতন্ত্রের বদলে লৌকিক-মানবতাবাদী উদার রাষ্ট্রনীতিগ্রহণ বিধেয় বলে উল্লেখ করেন। উগ্রপন্থী পাকিস্তান সরকার মাসিক সমকালের সেই সংখ্যা বাজেয়াপ্ত করে। প্রতিকূলতার মুখোমুখি হয়েও সত্যভাষণে সোচ্চারকণ্ঠ আবুল ফজল যেন ‘মানবতন্ত্র’-এর ধারাবাহিকতায় লিখলেন ‘ধর্ম ও রাষ্ট্র’ প্রবন্ধ। পাকিস্তানকে ‘ইসলামী প্রজাতন্ত্র’ ঘোষণার দাবিতে যখন এক শ্রেণির মানুষ হয়ে পরেছে অত্যুৎসাহী, নানা যুক্তিতর্ক এবং উপমা-উদাহরণ দিয়ে ধর্মকে রাষ্ট্রযন্ত্র থেকে দূরে রাখার কিংবা রাষ্ট্রকে কোনো বিশেষ ধর্মের ঘেরাটোপে বন্দি না করার পক্ষে আবুল ফজল জোরালো বক্তব্য উপস্থাপন করলেন ‘ধর্ম ও রাষ্ট্র’ প্রবন্ধে।
‘আগামী দিনের সভ্যতা: একটি কল্পনা’ এই সংকলনের দীর্ঘতম প্রবন্ধ। আবুল ফজল দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন অশরীরী বিষয়ে হাত দিতে যাওয়া আধুনিক রাষ্ট্রের পক্ষে আত্মহত্যার নামান্তর। রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষে ধর্মকে হাতিয়ার করতে গেলে ফাঁকি আর গোঁজামিলের ছদ্মবেশ পরিয়ে প্রকারান্তরে ধর্মকেই হতমান করা হয়।সমসাময়িক নানা আবিষ্কারের উদাহরণ টেনে তিনি এমন এক সভ্যতার কল্পনা করেছেন, যা কেবলমাত্র নৈতিক বোধ, সৌন্দর্য চেতনা, দায়িত্বজ্ঞান এবং সর্বোপরি জীবনের মূল্যবোধ দ্বারা চালিত হয়ে গড়বে সর্বমানবহিতৈষী উদারনৈতিক বিশ্ব।
‘সভ্যতার সংকট’, ‘সংস্কৃতি’ ও ‘মানবকল্যাণ’ বিষয় ও ভাবগত দিক থেকে পূর্বোক্ত প্রবন্ধ তিনটির থেকে আলাদা। ‘সভ্যতার সংকট’-এ আবুল ফজল আশঙ্কা করেছেন যান্ত্রিকতা ও মাত্রাতিরিক্ত আরামবাহুল্য সমাজ চিন্তা ও দর্শনের শক্ত ভিত্তিচ্যুত হয়ে পড়লে মুহুর্মুহু ট্র্যাজিক পরিণতির হাত থেকে তার রেহাই নেই। এই সংকট বিশেষভাবে চিন্তাহীনতার সংকট, দর্শনশূন্যতার সংকট। এ বিষয়ে তার সুতীক্ষ্ণ বিশ্লেষণ,
আমরা শুধু বাঁচতেই চেয়েছি, চাইনি নিজের অস্তিত্বকে ফলপ্রসূ করে চারদিকে ছড়িয়ে দিতে। মনের তথা চিন্তার দিক দিয়ে ইতিহাসের মোকাবেলায় আমরা খুঁজে পাইনি কোনো নতুন হাতিয়ার, অর্থাৎ কোনো নতুন সত্যের, যা সাহিত্য ও শিল্পের বিভিন্ন ক্ষেত্রে প্রতিফলিত হয়ে জাতীয় মানসে কোনো নতুন সম্পদের অবদান রাখতে পারে। মননশীলতার ক্ষেত্রে এমন বন্ধ্যাত্ব ইতিপূর্বে ইতিহাসের অন্য কোনো পর্বে দেখা যায়নি।
এ সংকটের সমাধান তিনি খুঁজেছেন ‘সংস্কৃতি’ ও ‘মানবকল্যাণ’ প্রবন্ধে। তিনি মনে করেন, সুসংস্কৃতির চর্চাই সভ্যতার পশ্চাৎপদতাকে রোধ করতে পারে,
মানব-ধর্মের সাধনাই সংস্কৃতি এবং একমাত্র এ সাধনাই জীবনকে করতে পারে সুন্দর ও সুস্থ।
আর পরবর্তী প্রবন্ধে মানুষকে সংস্কৃতিমনস্ক করতে মানুষের জৈব-অস্তিত্বের পাশাপাশি তার মহত্তর মানবীয় অস্তিত্বের হিতসাধন এবং মানবিক চেতনা-অমিত সম্ভাবনার বিকাশের পরিবেশ সৃষ্টি করাকেই প্রকৃত মানবকল্যাণ বলে উল্লেখ করেছেন ‘মানবতন্ত্রী’ আবুল ফজল। গ্রন্থের সর্বশেষ প্রবন্ধ ‘বুদ্ধির মুক্তি’-তে আলোচিত হয়েছে মুসলিম সাহিত্য সমাজের আদর্শ, উদ্দেশ্য, সার্থকতা ও ব্যর্থতার বিশ্লেষণ। বুদ্ধির মুক্তি আন্দোলনের একজন সক্রিয় সদস্য এবং আদর্শবাদী সংবেদনশীল কর্মী হিসেবে তার ব্যক্তিগত উপলব্ধি ও আশা-প্রত্যাশার কথাও এসেছে এ প্রবন্ধে।
নানা বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ আবুল ফজলের সৃষ্ট সাহিত্যভাণ্ডার। প্রথম জীবনে ছোটগল্প ও উপন্যাস, আর শেষ বয়সে তিনি বেশি ঝুঁকেছিলেন মন্ময় প্রবন্ধ রচনার দিকে। মানুষ ও সমাজের প্রতি দায়বদ্ধ হয়েই তার আদর্শবাদী লেখালেখি। তার সমস্ত সৃষ্টিকর্মের পেছনে একটি সুস্পষ্ট আদর্শ ক্রিয়াশীল, এককথায় বললে সেটি ‘মানবতন্ত্র’। গতানুগতিক ধারায় বহুল প্রচলিত ‘মানবতা’ শব্দটির পরিবর্তে তিনি দৃঢ়ভাবেই ‘মানবতন্ত্র’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। অর্থাৎ তিনি শুধু মানুষের মধ্যে মানবতাবোধের জাগরণ চান না, সমাজ এবং রাষ্ট্র পরিচালনার আদর্শ হিসেবেও উদারনৈতিক মানবতাবাদকে স্থাপনের স্বপ্ন দেখেন। তিনি মনে করেন, মানবতার ব্যাপারে সম্প্রদায় বা জাতিভেদে কোনোরূপ বিরোধ ও উপলব্ধির দ্বান্দ্বিক বৈপরীত্য নেই বলে সহজেই তাকে মানুষের স্থির মিলনকেন্দ্র হিসাবে গড়ে তোলা সম্ভব।
আলোচ্য গ্রন্থের প্রবন্ধগুলোতে আবুল ফজল তার সেই চিন্তার কথাই দ্ব্যর্থহীনভাবে লিখে গেছেন। তার গদ্যশৈলী ঋজু, বিশ্লেষণী এবং ক্ষুরধার। আধুনিক কল্যাণমুখী রাষ্ট্র গঠনের পাথেয় বা যেসব অন্তরায়গুলোকে তিনি চিহ্নিত করে গেছেন, আজও তা সমানভাবে প্রাসঙ্গিক ও তাৎপর্যপূর্ণ। ধর্মান্ধতার ভয়াবহতা কিংবা মূল্যবোধহীন ক্ষয়িষ্ণু সমাজের যে অশনিসংকেত তিনি দিয়ে গিয়েছিলেন বহু আগে, সেই আশঙ্কাকে ভুল প্রমাণ করতে পেরেছি- এ কথা তো আমরা বুকে হাত দিয়ে আজও বলতে পারি না।
আবুল ফজল যে ন্যায়ানুগ রাষ্ট্রের স্বপ্ন দেখেছিলেন, লজ্জার বিষয়- তার বহু যুগ পরেও আমাদের বর্তমান রাষ্ট্রীয় অবস্থান তার সাথে সাংঘর্ষিক। এখানেই মূলত আবুল ফজলের প্রাসঙ্গিকতা- আকাশে আঁধার যত গাঢ় হয়, নক্ষত্ররাজির উজ্জ্বলতা তত বাড়ে, তেমনি এ সময়ের আঁধার যত বাড়ছে, আবুল ফজল আমাদের কাছে তত উজ্জ্বল থেকে উজ্জ্বলতর হচ্ছেন। ‘মানবতন্ত্র’-এর পাঠ পাঠককে আত্মবোধে উদ্দীপ্ত করবে, তার বুদ্ধিবৃত্তিক চর্চাকে পরিশীলিত করবে, সর্বোপরি কল্যাণকর রাষ্ট্র গঠনের পথ সুগম করবে- এই আমাদের প্রত্যাশা।