“এক সকালে গ্রেগর সামসা অস্বস্তিকর সব স্বপ্ন থেকে জেগে উঠে দেখল সে তাঁর বিছানায় এক দৈত্যাকার পোকায় রূপান্তরিত হয়ে পড়ে আছে”
মাত্র ঊনচল্লিশ বছরের সংক্ষিপ্ত জীবনে অল্প কিছু লেখার মাধ্যমে বিংশ শতাব্দীর আধিপত্যশীল ও অন্যতম প্রধান লেখক ফ্রানৎস কাফকা। তার সবচেয়ে বিখ্যাত গল্প ‘মেটামরফোসিস’ (রূপান্তর)- এর প্রথম লাইন এটি। বিশ্বসাহিত্যের সকল গল্পের মাঝে একে সবেচয়ে বিখ্যাত বাক্য বললেও অত্যুক্তি হবে না। কী করে একটি মাত্র বাক্যে পুরো গল্পটির আভাস দেয়া যায় এবং একইসাথে পুরো গল্পটি পড়ার জন্যে আগ্রহী পাঠককে আকৃষ্ট করা যায়, তার উৎকৃষ্ট উদাহরণ ‘মেটামরফোসিস’।
গল্পের প্রধান চরিত্র গ্রেগর সামসা একজন ভ্রাম্যমাণ সেলসম্যান। কোনো এক সকালে নিজের ক্লান্ত জীবনের ভাবনা নিয়ে ভাঙা ঘুমে অদ্ভুত এক স্বপ্ন দেখে জেগে উঠে নিজেকে একটি বিশাল আকৃতির পোকা হিসেবে আবিষ্কার করে গ্রেগর। গল্পের নামকরণের যথার্থতা চোখে পড়ে প্রথম দৃশ্য থেকেই। পোকা হয়ে যাওয়ার এ পরিবর্তনের আগ পর্যন্ত বাবা, মা ও ছোট বোনের সাথে থাকা সংসারে গ্রেগর সামসা ছিল পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তি। অফিসের কাজের দুর্বিষহ কষ্টের মাঝে এ রূপান্তর তাকে দায়িত্বের পীড়ন থেকে মুক্তি দিলেও বিবেকের দংশন তাকে জ্বালাতে থাকে সর্বক্ষণ। এ গল্পের প্রথম অংশ দেখায় নেতিবাচক রূপান্তর- যে রূপান্তর একজন সুস্থ ও উপার্জনক্ষম মানুষের পরগাছা হয়ে ওঠাকেই বর্ণনা করে। এক্ষেত্রে পোকাকে নিকৃষ্টতার প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করা যায়- যা কিনা আত্মঘৃণার সর্বশেষ বিন্দু বলে উল্লেখযোগ্য।
প্রথমে ঘরের অন্যরা গ্রেগরের ওপর নির্ভরশীল থাকলেও এ পর্যায়ে সকলে কাজে নিযুক্ত হয় এবং গ্রেগর অন্যদের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়ে। এ সময় তার বাহ্যিক দৈহিক কাঠামোর সাথে সাথে পরিবর্তন হয় তাদের আচরণও। প্রাথমিকভাবে পরিস্থিতির ভয়াবহতায় ধাক্কা খেলেও নিজেদের সামলে নেয় তারা।
পরবর্তী সময় দেখা যায় নির্জীব পরিবারের রূপান্তর। জীবনকে সচল রাখার জন্যে পরিবারের প্রতিটি সদস্যের সক্রিয় হয়ে ওঠা এবং হঠাৎ উদ্ভূত পরিস্থিতি মোকাবেলায় একত্রে সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও কাজ করা। আর সবশেষে সক্রিয়তার চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে নিজ পরিবারের একজনকে অস্বীকার করা এবং তার মৃত্যুতে বিপদ কেটে যাওয়ার স্বস্তিতে অবকাশ যাপন করা।
তিনটি অংশে বিভক্ত এ গল্পের প্রতিটি ধাপেই দেখা যায় পরিবর্তন। কখনো তা ইতিবাচক, কখনো নেতিবাচক- আবার কখনোবা একের মিশেলে অন্য আরেক রূপান্তর। মোটামুটি সমান দৈর্ঘ্যের তিন অংশের মাঝে প্রথম ও দ্বিতীয় অংশের মধ্যকার ব্যবধান একদিনের, আর দ্বিতীয় ও তৃতীয় অংশের ব্যবধান অনিশ্চিত কালের। প্রথম অংশের শেষ হয় বাবার তাড়া খেয়ে গ্রেগরের ঘরে প্রবেশের মাধ্যমে, দ্বিতীয় অংশে আপেল দ্বারা প্রাণঘাতী আক্রমণ এবং সবশেষে গ্রেগরের মৃত্যুতে। প্রথম বিপর্যয় থেকে আসে ভারি মূর্ছার মতো ঘুম, দ্বিতীয়টি থেকে আসে মূর্ছা যাওয়া ও বিপজ্জনক ক্ষত এবং তৃতীয়টি থেকে মৃত্যু। গল্পের তিনটি অংশের কাঠামোতেই দেখা যায় শুরুতে একটি মূর্ছার মধ্য দিয়ে জেগে ওঠা ও পরিবারের সাথে একাত্ম হওয়ার প্রচেষ্টা। আর শেষ হয় পরিবারের আঘাতে বিচ্ছিন্ন হওয়ার মধ্য দিয়ে। শেষ অংশে যখন বোন বোঝায়, গ্রেগর আসলে তাদের পরিবারের কেউ না, সে আসলে একটি কীট তখন নিজেকে অবাঞ্ছিত বলে স্বীকার করে নেয়ার মধ্য দিয়ে নিজেকে বিচ্ছিন্নতার হাতেই সঁপে দেয় সে এবং গ্রহণ করে মৃত্যুকে।
বিজ্ঞানসম্মত বাস্তবতা থেকে অনেক দূরবর্তী প্রেক্ষাপটে তৈরী এ গল্পে অবাস্তব কল্পনার ঘটনারাজির বাস্তব ধারায় চিত্রণের বিরোধ ও মিলন গল্পটিকে দাঁড় করায় অদ্ভুত কোনো স্বপ্নের কাঠগড়ায়। রিয়ালিস্ট আবহের মাঝে ছুঁড়ে দেয়া এক এক্সপ্রেশনিস্ট বোমা এ গল্প। উদাহরণস্বরূপ বলা যায় পোকাটির কথা। প্রথমত, একজন মানুষের বাহ্যিক অবয়ব সম্পূর্ণ পরিবর্তনকে এতটা সরলভাবে লেখক তুলে ধরেছেন, যেন এ খুব স্বাভাবিক একটি ঘটনা। আবার সে পোকাটির প্রকৃতি বর্ণনাও ঠিক যৌক্তিক নয়। এ যেন লেখকের নিজের তৈরি কোনো এক অদ্ভুত পরজীবী। গ্রেগর পোকা হয়ে যে বীভৎস জীবন কাটায়, লেখক সেই অভিজ্ঞতাকে জড়িয়ে দেন সঙ্গীতের সাথে। খাবারে অনাগ্রহী গ্রেগরের পুষ্টির উৎস হয়ে ওঠে সঙ্গীত।
গল্পে গ্রেগর শুধু নিষ্ঠুরতার শিকারই নয়, পরিবারের জন্যে আত্মত্যাগের এক প্রতীক হয়েও সামনে আসে সে। নিটশেয়ান ক্ষমতার কামনায় বেঁচে থাকা পরিবারের বাকি সদস্যরা বসন্ত বেলায় খুশিমনে ট্রেনে ঘুরতে বেড়োয়। নিটশের মতে, বিজয়ী জীবিত ব্যক্তিরা তাদের অতীত ভুলে গিয়ে পৃথিবীতে লড়াই করে টিকে থাকার জন্যে সামনে তাকায়, তেমনি তারাও মেয়ের বিয়ে দিয়ে বংশ টিকিয়ে রাখতে বদ্ধপরিকর।
ব্যক্তিজীবনের ছাপ কাফকার প্রতিটি লেখায় বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। এ গল্পেও তার ভিন্নতা দেখা যায়নি। গল্পের আধিপত্যশীল ও ক্ষমতার প্রতীক দাম্ভিক বাবা, স্নেহপরায়ণ অথচ সিদ্ধান্ত গ্রহণে অক্ষম নীরব মা এবং ভালোবাসার প্রিয় বোন- সবই লেখকের ব্যক্তিক জীবনকে ফুটিয়ে তোলে। রূপান্তরের পর দুঃসহ পারিবারিক জীবনে দেখা যায় আত্মজৈবনিক ব্যাখ্যার জোয়ার। এছাড়া, প্রতিটি কাজে আত্মতৃপ্তির মাঝে ফুটে ওঠা আত্মসমালোচনা ব্যক্তি কাফকাকেই বর্ণনা করে বারংবার।
একচেটিয়া বর্ণনা কৌশলের মাধ্যমে গল্প বলার এক ধ্রুপদী উদাহরণ মেটামরফোসিস। পুরো গল্পটি বর্ণনা করে গ্রেগরের সীমিত দৃষ্টিতে। একইসাথে সে কথক, প্রধান চরিত্র এবং বন্দী। ছোট ঘরের মাঝে আবদ্ধ থেকে শুধু শোনার মাধ্যমে যে পৃথিবীকে গ্রেগর ধারণ করে, তা-ই বুঝতে হয় পাঠককে। ‘মনে হয়’, ‘বোধ হয়’, ‘যেন বা’- দিয়ে শুরু হয় তার সকল বাক্যের। সবকিছুই প্রতিষ্ঠিত ধারণা ও ভাবনার ওপর। এক্ষেত্রে অন্যদের দৃষ্টিকোণ জানা কিংবা বোঝার সুযোগ নেই পাঠকের। আবার অন্যদিকে আত্মসমালোচনায় মগ্ন গ্রেগরকে বারবার দেখা যায় দু’টি দৃষ্টিকোণ উপস্থাপনের মাধ্যমে একটি ভারসাম্য প্রতিষ্ঠার প্রয়াসে লিপ্ত।
জটিল ও দ্বন্দ্বপীড়িত মনস্তত্ত্বের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত হওয়া ঘটনারাজিতে একদিকে ফুটে ওঠে আত্মপক্ষ সমর্থনে বলা দৃষ্টিকোণ, অন্যদিকে ফুটে ওঠে কর্কশ আত্মসমালোচনা ও অপরাধবোধ। আবার এ মনস্তত্ত্বের যে বস্তুনিষ্ঠতা, তাও মূলত প্রধান চরিত্র গ্রেগরেরই মনোগত ব্যাখ্যা।
খুদে উপন্যাস বা নভেলা হিসেবেও পরিচিত এ গল্পটি ১৯১৫ সালের অক্টোবরে একটি মাসিক সাহিত্য পত্রিকায় প্রথম প্রকাশিত হয়। পরবর্তীতে বই আকারে প্রকাশ করার সময় এর প্রচ্ছদে প্রকাশকের পোকাটি এঁকে দেখানোর সিদ্ধান্তের কথা জানতে পারা মাত্রই চিঠি লিখে কাফকা জানান, কোনোভাবেই পোকাটি এঁকে দেখিয়ে দেয়া যাবে না। গল্পটির মূল জার্মান নাম ডি ফারভানডলুঙ (Die Verwandlung)।
এই গল্পে পাঠকের সবচেয়ে চমৎকৃত হবার দিকটি হলো ফ্যান্টাসি ও বাস্তবতার সম্মিলন। বর্তমান পৃথিবীর তথাকথিত আধুনিক মানুষেরা জীবনযাপনের দুর্বিষহতায় ও সামাজিক অন্যায়-অবিচার দেখেও কিছু করতে না পারার মানসিক যন্ত্রণায় প্রতিটি মুহূর্ত নিজেকে যে কীটের সাথে তুলনা করে, গল্পে তার বাস্তবায়ন করে দেখানো হয়েছে। আর পুরো গল্প জুড়ে কেউই এ অবৈজ্ঞানিক ঘটনায় কোনো সন্দেহ পোষণ করেন না- যেন বা এ স্বাভাবিক, যেন বা এরকম ঘটনা অহরহই ঘটে থাকে। তবে এত এত হতাশার মাঝেও আশার রূপ দেখেছেন লেখক। সব শেষ হলেও আসলে শেষ না হয়ে নতুন উদ্যমে অন্যদের এগিয়ে চলা সেই আশাকেই বাস্তবিক রূপ প্রদান করে।
মানুষের মধ্যকার দ্বন্দ্ব, বিচ্ছিন্নতা ও মনোজাগতিক টানাপোড়েনই বারবার ফুটে উঠেছে ফ্রানৎস কাফকার লেখায়। তবে মেটামরফোসিস গল্পে মানুষের সেই ভাবনাকে সত্যিকার অর্থে একটি অবয়ব প্রদান করেছেন কাফকা। নিঃসন্দেহে গল্পটি বিশ্বসাহিত্যের এক অনন্য সম্পদ।