দু’হাজার উনিশ সালটি ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে খুব গুরুত্বপূর্ণ হতে চলেছে। ২০১৪ সালে যে ঘনঘটার মধ্যে দিয়ে নরেন্দ্র মোদী দেশের প্রধানমন্ত্রী হয়েছিলেন, এই বছরে মানুষ রায় দেবেন যে তা তাদের জীবনে আক্ষরিক কতটা পরিবর্তন এনেছে। বলা হয়, সেবছর মোদী জিতেছিলেন প্রযুক্তি-ভিত্তিক প্রবল জনসংযোগের মাধ্যমে; প্রকৃত মাটির সঙ্গে যোগাযোগ তাতে কমই ছিল। পাঁচ বছর পরে এবার বোঝার পালা যে মোদী আদতে কতটা মাটির সঙ্গে নিজেকে মেশাতে পেরেছেন।
তবে এই প্রশ্নের উত্তর আপাতত ভবিষ্যতের গর্ভে থাকলেও, পরিস্থিতি তপ্ত শুরু হতে করবে জানুয়ারি মাস থেকেই। বছরের প্রথম মাসটিতেই ভারতের চলচ্চিত্র জগৎ বলিউডে মুক্তি পাবে দুটি হিন্দি ছবি- ‘ঠ্যাকারে’ এবং ‘দ্য এক্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার’। প্রথমটি হিন্দুবাদী রাজনৈতিক দল শিবসেনার প্রতিষ্ঠাতা প্রয়াত বাল ঠ্যাকারের উপরে তৈরি, যার মুখ্য চরিত্রে রয়েছেন প্রখ্যাত অভিনেতা নওয়াজুদ্দিন সিদ্দিকী আর অপরটি ভারতের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংহের উপরে চলচ্চিত্রায়িত, যার মুখ্য চরিত্রে বর্ষীয়ান অভিনেতা অনুপম খের। খের-অভিনীত চলচ্চিত্রটি ইতিমধ্যেই চারিদিকে শোরগোল ফেলেছে। ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের নেতা এবং সমর্থকদের দাবি, সাধারণ নির্বাচনের কয়েক মাস আগে এই ছবি আদতে তাদের দলকে লক্ষ্য করে তৈরি। শাসকদল ভারতীয় জনতা পার্টি অবশ্য তা মানতে রাজি নয় এবং খের সাহেবের বক্তব্য, এমন বিরোধিতা বোঝায় যে কেন এদেশে বাকস্বাধীনতার ধারণা বিপদগ্রস্ত।
অনুপম খেরের বাকস্বাধীনতার যুক্তিকে খণ্ডানো যায়
খেরের বক্তব্য খণ্ডানো যায়ই। ক্ষমতাহারাদের নিয়ে বাকস্বাধীনতার উদযাপন খুব কঠিন কাজ নয়। এর আগে ‘ইন্দু সরকার’ বলে একটি ছবি মুক্তি পেয়েছিল ভারতে, যেটি আরেক কংগ্রেস প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর জরুরি অবস্থার জমানাকে লক্ষ্য করে বানানো হয়েছিল; বিতর্ক দেখা দিয়েছিল সেবারও। যদিও বতর্মানের নরেন্দ্র মোদী সরকারের উপরে এখনও কোনো চিত্র পরিচালক কোনো প্রকল্প নিয়ে জনসমক্ষে আসেননি। হয়তো পরিকল্পনা রয়েছে বানানোর, যখন পরিস্থিতি অনুকূল থাকবে। খের পশ্চিমের উদাহরণও তুলেছেন; বলেছেন ওদেশে রাজনৈতিক চলচ্চিত্র বানিয়েও অস্কার জেতা যায়; সেখানে দলীয় সমর্থন নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। ঠিক কথা, কিন্তু সে সংস্কৃতি যেমন একপেশে নয়, তেমনই তা রাতারাতিও গড়ে ওঠে না।
কিন্তু সিদ্দিকীর ‘ঠ্যাকারে’ আর মোদী অনুরাগী অনুপম খেরের ‘মনমোহন’-এর আলাদা তাৎপর্য আছে
এই লেখার উদ্দেশ্য মনমোহন সিংহের উপরে তৈরি ছবি নিয়ে নয়। বরং অন্য একটি বিষয় নিয়ে, যা এই লেখককে আশা যোগায়। সেটি হল ‘ঠ্যাকারে’ এবং ‘দ্য এক্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার’-এর মুখ্য শিল্পীচয়ন। ‘ঠ্যাকারে’-র ক্ষেত্রে সিদ্দিকীকে বেছে নেওয়ার মধ্যে রয়েছে ভারতীয় গণতন্ত্রের এক সফলতা এবং আজকের তুমুল অন্তঃসারশূন্য চিলচিৎকারের মধ্যে তা আমাদের আশান্বিত করে এই দেশের গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ নিয়ে।
বছর দুয়েক আগে, সিদ্দিকী খবরের শিরোনামে এসেছিলেন একটি নেতিবাচক কারণে। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর মাসে জম্মু ও কাশ্মীরের উরিতে পাকিস্তানী হানাদারদের আক্রমণে প্রাণ হারান বেশ কয়েকজন ভারতীয় জওয়ান। সারা দেশজুড়ে ছি-ছিক্কার পড়ে যায়। দাবি ওঠে পাকিস্তানী শিল্পীদেরও এদেশে ঢুকতে দেওয়া চলবে না। বলিউড থেকেও এমন দাবি ওঠে এবং খোদ সিদ্দিকী তা সমর্থন করেন, নিজের পেশাগত সংহতিকে উপেক্ষা করেও। বলেন, “সবার উপরে দেশ।” আর সেই দেশেই তিনি যখন নিজের জায়গা উত্তরপ্রদেশের বুধনাতে রামলীলা অনুষ্ঠানে যোগ দিতে যান, তাকে আটকানো হয়। বলা হয়, যার নামে ‘দিন’ রয়েছে তাকে হিন্দুদের অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হবে না। সিদ্দিকীকে যে তার সংখ্যালঘু পরিচয়ের জন্যে সেদিন আটকানো হয়েছিল, সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। আর এই বিরোধিতা করেছিল যেই দলটির প্রতিষ্ঠাতার ভূমিকায় সিদ্দিকী অভিনয় করছেন, সেই শিবসেনাই।
এ কি তবে সিদ্দিকীর ‘ক্রিয়েটিভ রিভেঞ্জ’?
আজ যখন সিদ্দিকী প্রয়াত বাল ঠ্যাকারের ভূমিকায় উপনীত হচ্ছেন, বলা চলে কোথাও যেন তিনি একটি ‘ক্রিয়েটিভ রিভেঞ্জ’ আজ নিলেন আজকের সাম্প্রদায়িক রাজনীতির বিরুদ্ধে এবং সেটাই ভারতীয় গণতন্ত্রকে এই দুর্দিনেও আশা যোগায়। শিল্পীদের কোনো সীমা থাকে না- ভৌগোলিক বা ধর্মগত, এবং ঠ্যাকারের মতো একজন কট্টর হিন্দুবাদী চরিত্রকে পর্দায় ফুটিয়ে তোলার গুরুদায়িত্ব যখন পান সিদ্দিকীর মতো একজন সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের মানুষ, তখন মনে হয়: “এই তো, ভারতীয় গণতন্ত্রের মৌলিক ধারণা আজও, এত আক্রমণের মুখেও, অটুট রয়েছে। এখানে আজও সংকীর্ণ সাম্প্রদায়িকতার ঊর্ধে শিল্পী এবং শিল্প উঠতে পারে। আর যতদিন শিল্প তার মতো করে নিঃশ্বাস নিতে পারছে একটি সামাজিক-রাজনৈতিক পরিমণ্ডলে, ততদিন সেখানে গণতন্ত্র জীবিত আছে বলে আশ্বস্ত হওয়া যায়।
মনমোহন-এর ভূমিকায় যেন খেরও নিলেন এক ধরনের ‘ইন্টেলেকচুয়াল রিভেঞ্জ’
এবার আবার আসা যাক মনমোহন-খের-এর কথায়। ব্যক্তিগতভাবে খের কংগ্রেসের সমর্থক, এ কথা তার অতি বড় শত্রুও বলবে না। মোদী প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পর এই বর্ষীয়ান অভিনেতা নানা মঞ্চে তার মোদী অনুরাগের কথা পরিস্কার জানিয়েছেন। এমনকী, তাকে মোদীর ‘চামচা’ বললেও যে তার বিশেষ আপত্তি নেই, খোলসা করেছেন তাও। এহেন রাজনৈতিক অর্থে পক্ষপাতী খের যখন অপছন্দের একটি দলের এক শীর্ষ নেতার ভূমিকায় অবতীর্ণ হন, তখনও বেশ চমৎকৃত হতে হয়। নিঃসন্দেহে খের একজন প্রতিষ্ঠিত অভিনেতা এবং পেশাগতভাবে তার ব্যক্তিগত ভালোলাগা-মন্দলাগা সেখানে অবান্তর হলে তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই। কিন্তু অপরদিকে, যখন তিনি এমন একজন নেতার ভূমিকায় অভিনয় করছেন যার ভাবমূর্তি জনসমক্ষে সাহসী নয়, যাকে তার দশ বছরের রাজত্বকালে দেখা হয়েছে দলীয় নেতৃত্বের হাতের পুতুল হিসেবে, তখন এটাও মনে হতে বাধ্য যে, খের সিং-এর বিরুদ্ধে এক ধরনের ‘ইন্টেলেকচুয়াল রিভেঞ্জ’ নিলেন। সিং-এর ক্যারিক্যাচার-এর মাধ্যমে যেন নিজের রাজনৈতিক বিশ্বাসের দৃঢ়তাকে আরও একবার প্রতিষ্ঠিত করলেন। এর মধ্যে অবশ্য দোষের কিছু নেই; বরং এই ঘটনাও শিল্পীর স্বাধীনতাকেই গুরুত্বপ্রদান করে আর তা গণতান্ত্রিক ট্র্যাডিশন রক্ষায় যথেষ্ট প্রয়োজনীয়।
‘ঠ্যাকারে’ এবং ‘দ্য এক্সিডেন্টাল প্রাইম মিনিস্টার’- এই দুটি ছবির ক্ষেত্রেই এটা প্রমাণিত যে শিল্পের মাধ্যমে রাজনৈতিক বা সামাজিক মেলবন্ধন ঘটানো যায়। সিদ্দিকীকে হয়তো বাস্তবিক শিবসেনার সমর্থকরা গ্রহণ করবে না তাদের দলে, কিন্তু তিনি যখন তাদের দলের প্রতিষ্ঠাতার ভূমিকায় অভিনয় করে আমজনতার হাততালি কুড়োবেন, তখন তার মধ্যে যে শৈল্পিক সার্থকতা, বাকস্বাধীনতার সার্থকতা, সামাজিক মেলবন্ধনের সার্থকতার প্রকাশ ঘটবে, তা গণতন্ত্রের এক ইতিবাচক বহিঃপ্রকাশ। আবার একজন শিল্পী, যিনি কিনা ব্যক্তিগতভাবে বা ইন্টেলেকচুয়ালি এক ভিন্ন ভাবধারা, আদর্শে বিশ্বাসী তিনি যখন এক বিরোধী রাজনৈতিক শিবিরের সংস্কৃতিকে পর্দায় ফুটিয়ে তুলছেন, তখন ব্যক্তিগত পর্যায়েও তাকে গণতন্ত্রের এক বড় সাফল্য হিসেবে বললে অত্যুক্তি হয় না। আর এই জোড়া সাফল্যের পিছনে রয়েছে চলচ্চিত্রের মতো একটি আধুনিক এবং শক্তিশালী শিল্প।