Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

নেশা লাগিল রে: বহুমাত্রিক গল্পের সংকলন

মোহিনীর গান যেন প্রতিধ্বনি সৃষ্টি করে চেয়ারম্যানের ছেলে সৌরভের বুকেও। একখণ্ড ‘বাংলাদেশ’ নিয়ে লড়তে গিয়ে কবে, কখন স্বাধীনচেতা শবনম ভীরু দিগন্তের প্রেমে পড়ে যায়, সে জানে না; আবার অত্যন্ত সুপুরুষ শরিফের গলায় গলা মিলিয়ে হিম-রক্তের পরমেশ্বরীরা বলে ওঠে, “রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই”। জেকের সাহেব কিংবা সাইম-আশরাফদের জীবনের রহস্য উদঘাটনে বেরিয়ে পড়া অথবা গানের শিক্ষিকার হাত ধরে জীবনে নতুন করে বাঁচতে শেখা তিন তরুণীর গল্প। নতুবা, বাবা-মেয়ের ভালবাসা, সুবোধের বুড়ো বয়সে প্রেমে পড়া, আশিকের আলোর ঠিকানার খোঁজ মিলবে কি?

এমন সব গল্পের ঝুলি কখন যে আপনার মন জয় করে হারিয়ে যাবে অজানায়, তা হয়তো আপনি নিজেও টের পাবেন না।

যে গল্পগুলো নেশায় ডোবায়; Image credit: Loknath

বইটির নাম মূলত এতে থাকা প্রথম গল্পের নামানুসারেই রাখা হয়েছে। প্রচ্ছদকারী জুলিয়ান বইয়ের নামানুসারে একদম পরিপূর্ণ একটি প্রচ্ছদ করেছেন। লেখিকা তার নানীজান, মামাতো বোন, বন্ধু মিশকাত এবং একজন শিক্ষিকাকে উৎসর্গ করেছেন, যারা সকলেই এখন পরকালের বাসিন্দা।

নিজ বইয়ে অটোগ্রাফ দিচ্ছেন লেখিকা; Image Credit: Shanta Nazneen

লেখিকার কথা

লেখিকা শান্তা নাজনীন বর্তমান সময়ের একজন জনপ্রিয় লেখিকা। পাঠকসমাজে তার এই বইটি সে জনপ্রিয়তা প্রতিনিধিত্ব করছে প্রথমদিক থেকেই। লেখালেখি তার কাছে নেশার মতোই বলা চলে। আর সেই নেশাকে হয়তো পরিপূর্ণ একটি রূপ দিতে নহলী শান্তা নাজনীনের ভেতরে লুকিয়ে থাকা লেখক সত্ত্বাকে বের করে এনে পরিচয় করিয়ে দিয়েছেন এই পাঠকসমাজের কাছে। এছাড়াও এই বইয়ে লেখিকার আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহারের দক্ষতা দেখে তার প্রশংসা না করে থাকা যায় না।

বইটিতে লেখিকার সকল গল্পের আলোচনা একে একে তুলে ধরা হলো আগ্রহী পাঠকদের জন্য।

নেশা লাগিল রে

একটি রোমান্টিক গল্প, যেখানে বাউল দলের গায়িকা মোহিনী ও চেয়ারম্যানের ছেলে সৌরভের ভালোবাসার গল্প ফুটে উঠেছে। মোহিনী বিপদে পড়ে সৌরভের সাহায্য চাইতে গেলে গ্রামের লোকজন তাদের একসাথে দেখে ভুল বুঝে সালিশ ডাকে। এই পরিস্থিতিতে সৌরভের বাবার জাত যায় যায় অবস্থা। ঠিক তখনই তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং গল্প নতুন মোড় নেয়। এভাবেই এগিয়ে যেতে থাকে কাহিনি।

নেশার প্রথম দর্শন; Image Credit: Author 

আঁধারের ইতিকথা

“শুধুমাত্র ‘বাবা একদিন ফিরবেন’ এই আশাটুকু নিয়ে আজও বেঁচে আছে।”

এই গল্পটি মূলত পরিবারহীন এক ২৭-২৮ বছর বয়সী ছেলে সাইম এবং এলাকার বড় ভাই আশরাফকে ঘিরে। যে গল্পের মাঝে হারিয়ে ফেলেও পরে সাইম হঠাৎ তার পুরনো ভালবাসাকে ফিরে পায়। আশরাফ ভাইয়ের সাইমের প্রতি ভালোবাসা এবং অবদানও আপন বড় ভাইয়ের থেকে কম নয়। রক্তের সম্পর্ক ছাড়াও কিছু মানুষ আপন হয়, তারই প্রতিফলন দেখা যায় এ গল্পে।

গানের ওপারে

এ গল্পে শিক্ষা, বন্ধুত্ব, শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মধ্যকার আত্মার সম্পর্ক, স্নেহের মায়া, আত্মসম্মানবোধ এবং জীবনবোধ এসব বিষয় ফুটিয়ে তুলেছেন লেখিকা। প্রতিটি চরিত্রই কোনো না কোনোভাবেই হার না মানা সাহসী নারীর প্রতিচ্ছবি হিসেবে ফুটে উঠেছে।

যদিদং হৃদয়ং তব, তদিদং হৃদয়ং মম

প্রথমদিকে গল্পটি অতি সাধারণ মনে হলেও শেষদিকে এর আসল আকর্ষণ পাওয়া গেছে। গল্পে বিলেতবাসী হবার স্বপ্নে বিভোর এক ব্যক্তির বিলেতি কোনো মেয়েকে বিয়ে করার ইচ্ছা থাকলেও হঠাৎ সে পথে দেখা হওয়া এক যুবতীর প্রেমে পড়ে যায়। এমন গল্পকে অতি সাধারণই বলা চলে, তবে শেষদিকে দেখা যায়, এটি প্রেমে পড়া বা ভালোবাসার এক মিষ্টি পরীক্ষা। যার ফলে অতি সাধারণ গল্পকেও লেখিকা ভিন্নভাবে তুলে ধরতে সক্ষম হয়েছেন, এমনটা বলা যায়।

বুকের বাঁপাশে

একজন কিশোর নিজের অজান্তেই কীভাবে সন্ত্রাসী হয়ে ওঠে? তাকে জড়িয়ে বেঁচে থাকা তার পাশের মানুষগুলোর যে করুণ অবস্থা হয়ে থাকে, সবকিছু খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরা হয়েছে এ গল্পে।

বিজয়ের গান

গল্পটি মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে লেখা। গল্পে একজন মেডিক্যাল ছাত্রীর ডায়েরির পাতা থেকে তার স্মৃতিগুলো তুলে ধরা হয়েছে। এ রোজনামচা থেকে পাঠক পরিচিত হবে নীরবে-নিভৃতে দেশের জন্য প্রাণ উৎসর্গ করা এক প্রেমিক কবি মুক্তিযোদ্ধার।

নির্ভরতার হাত

শান্তা নাজনীন এ গল্পে আমাদের ব্যতিক্রম একজন সৎমায়ের সাথে পরিচিত করেছেন। যে সৎমা আপন হয়ে তার সন্তানদের ভালোবাসলেও বিনিময়ে কেবল ফিরে পেয়েছেন ঘৃণা আর অপবাদ। শেষদিকে এ গল্পে ভালোবাসায় সন্ধান মেলে একজোড়া নির্ভরতার হাতের।

সম্পত্তি

“মানুষ পৃথিবী ছেড়ে চলে যায়, পড়ে রয় সম্পত্তি। আসে নতুন কোনো ভাগীদার, জন্ম নেয় সম্পত্তি হাতিয়ে নেয়ার নতুন লড়াই!”

একটি পরিবারকে ঘিরে আবর্তিত হয় ‘সম্পত্তি’ গল্পটি। যে গল্পে ‘যেমন কর্ম, তেমন ফল’ বাক্যের দিকেই ইঙ্গিত করা হয়েছে। গল্পের গভীরতা বুঝতে গল্পের একটি লাইনই বোধহয় যথেষ্ট,

“বিধাতা হয়তো কাউকে কাউকে তার পাপের শাস্তি ইহজীবনেই দিয়ে দেন।”

ফাগুনের দিন

গল্পটি আমাদের ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের সময়কার গল্প। তবে ভাষা আন্দোলনের বিভিন্ন ঘটনার পাশাপাশি এখানে এক যুগলের মধুর ভালোবাসার কথা তুলে ধরা হয়েছে।

জেকের সাহেব ও তার সঙ্গী

এ গল্পের মোজাম্মেল সাহেবের মাঝে পাঠকেরা হুমায়ূন আহমেদ সৃষ্ট মিসির আলীর প্রতিচ্ছবি খুঁজে পাবেন হয়তো। এছাড়াও এখানে হ্যালুসিনেশন এবং ভৌতিক বিশ্বাসের বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার মাধ্যমে সমাধান দেয়া হয়েছে।

বাবা

“ভক্তের তো আর জানা নেই, প্রতিবার অটোগ্রাফ লেখার নামে লেখক তার নক্ষত্র হয়ে যাওয়া বাবাকে উদ্দেশ্য করে এক একটা চিঠি লেখেন!”

বাবা-মেয়ের মধুর ভালবাসা ও বিভিন্ন ঘটনা নিয়ে খুব দারুণভাবে সাজানো হয়েছে গল্পটি। বাবা হতে হলে মানুষের ঠিক কতটা গুণসম্পন্ন হতে হয়, তারই ধারণা পাওয়া যায় এতে।

বাবা-মেয়ের ভালোবাসা আছে এ বইয়ে; Image credit : Author 

একটা গল্প শেষে আরেকটা গল্প শুরুর জন্য যতই সামনের দিকে অগ্রসর হওয়া যায়, মনে হবে, গল্পগুলো আরো বেশি গভীর হতে শুরু করেছে, আরো বেশি সুন্দর ভাব ও বার্তা বহন করছে। এ অনুভূতি পাঠককে ধরে রাখার জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এছাড়াও গল্পগুলোর শিরোনাম গল্পের সাথে খুবই মানানসই এবং গল্পের যথাযথ বার্তা বহন করেছে। এ বইয়ের সবচেয়ে ভালো ব্যাপার হচ্ছে লেখিকার আঞ্চলিক ভাষার ব্যবহার এবং তার গল্প বলার ধরন। 

এছাড়াও বইটির আরেকটি বিশেষ দিক হচ্ছে বইটির সূচিপত্রে। কারণ, বইটির সর্বশেষ গল্প অর্থাৎ এগারো (১১) নং গল্পের নাম ‘বাবা’। এখানে লক্ষ্যণীয় যে, এগারো (১১) একটি প্যালিন্ড্রোমিক সংখ্যা এবং গল্পের শিরোনাম ‘বাবা’ নামটিও একটি বাংলা প্যালিন্ড্রোমিক শব্দ। যার মানে দাঁড়ায়, প্যালিন্ড্রোমিক নং গল্পের প্যালিন্ড্রোমিক নামেই শিরোনাম।

কিছু ঘাটতি

লেখিকা তার বইটিতে এগারোটি গল্পের মধ্যে প্রথম তিনটি গল্পই লিখেছেন পাবনা অঞ্চলের নাম ব্যবহার করে। ‘জেকের সাহেব ও তার সঙ্গী’ গল্পেও ঘুরে-ফিরে সেই পাবনা অঞ্চলেই লেখিকা তার পাঠকদের নিয়ে গেলেন। যা পাঠকের কাছে একঘেয়ে লাগতে পারে। এ জায়গায় লেখিকার একটু ভাবা উচিত ছিল বোধহয়। এখানে ভিন্ন কোনো অঞ্চলের নাম অথবা কাল্পনিক কোনো নাম ব্যাবহার করা যেত। ভিন্ন ভিন্ন নাম ব্যবহারে খুব সুন্দর ভিন্নতা আসত। ছোট্ট একটু ঘাটতি ছাড়া বইটি গল্প সংকলন হিসেবে ভালো। 

বই: নেশা লাগিল রে
ধরন: গল্প সংকলন
লেখিকা: শান্তা নাজনীন
পৃষ্ঠাসংখ্যা: ১২৮
প্রকাশনী: নহলী
প্রকাশকাল: অমর একুশে বইমেলা, ২০২১
মুদ্রিত মূল্য: ২৫০ টাকা

 

This article is in Bangla. It is a review of a story collection book named 'Nesha Lagilo Re' written by Shanta Nazneen.

Featured Image Credit: Author

Related Articles