মুশকান জুবেরির কথা মনে আছে? সেই যে অদ্ভুত নামের এক রেস্তোরাঁর মালিক, জাদুকরী হাতের রাঁধুনি, যার খাবারের মধ্যে নেশা ধরানো স্বাদ? মনে আছে সেই সুন্দরপুর গ্রামের কথা, ‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি’ নামের রেস্তোরাঁটি যেখানে অবস্থিত, যেখানে পাঁচজন যুবক একে একে গিয়ে নিখোঁজ হয়ে গিয়েছিল? কিংবা মনে আছে ডিবির তুখোড় অফিসার নুরে ছফার কথা, যে মুশকান জুবেরিকে প্রায় ধরি ধরি করেও শেষ পর্যন্ত ধরতে পারেনি?
হ্যাঁ, প্রায় কাছাকাছি নামের ‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও আসেননি’ উপন্যাসটা হচ্ছে জনপ্রিয় থ্রিলার লেখক ও অনুবাদক মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিনের সেই ‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও খেতে আসেননি‘ উপন্যাসেরই সিকুয়েল। এবং যদিও প্রথমটা এর তুলনায় বেশি অসাধারণ, কিন্তু বলা যায় জমজমাট এই মৌলিক থ্রিলারটি মোটামুটি সফল একটা সিকুয়েল।
উপন্যাসটির কাহিনী শুরু হয় পূর্ববর্তী উপন্যাসের ঘটনার তিন বছর পর থেকে। মুশকান জুবেরি পালিয়ে যাওয়ার পর তিনটি বছর পেরিয়ে গেলেও এখনও তাকে ভুলতে পারেনি ডিবি অফিসার নুরে ছফা। এভাবে তার চোখ ফাঁকি দিয়ে এতো বড় একজন অপরাধী পালিয়ে যাবে, এটা বিশ্বাস করতেই তার কষ্ট হয়। আর তাই সে জুবেরিকে খুঁজে বেড়ায় রাস্তাঘাটে, মানুষের ভিড়ে, এবং অবশ্যই রবীন্দ্রনাথ সম্পর্কিত বিভিন্ন জায়গায়, যেমন একুশের বইমেলায়।
এরমধ্যেই হঠাৎ একদিন নুরে ছফার ডাক পড়ে প্রধানমন্ত্রীর পিএস আশেক মাহমুদের বাসায়। মুশকান জুবেরির শিকারদের মধ্যে একজন ছিল আশেক মাহমুদের এক ভাগ্নে। এখন নিজের মৃত্যুপথযাত্রী বোনকে সান্ত্বনা দেওয়ার জন্য তিনি সিদ্ধান্ত নেন, নিজের সর্বোচ্চ ক্ষমতা ব্যবহার করে তিনি তার ভাগ্নের মৃত্যুর পেছনে দায়ী ব্যক্তিকে খুঁজে বের করবেন, তাকে বিচারের মুখোমুখি করবেন। সেজন্যই মুশকান জুবেরিকে খুঁজে বের করার দায়িত্ব তিনি তুলে দেন নুরে ছফার হাতে।
দীর্ঘ তিন বছর পর শুরু হয় নুরে ছফার নতুন অভিযান। ডিবির অবসরপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কেএস খানের পরামর্শ অনুযায়ী সে নতুন সূত্রের খোঁজে আবারও ছুটে যায় ঘটনাস্থলে। ফিরে আসে সেই পুরাতন চরিত্রগুলো – টংয়ের দোকানদার রহমান মিয়া, ইনফর্মার আতর আলি, ডাক্তার আসকার, মাস্টার রমাকান্তকামার। সেখানে পাওয়া সূত্র ধরে ছফা ছুটে যায় কলকাতায়। মুশকান জুবেরি কি আসলেই কলকাতায় আত্মগোপন করে আছে? ছফা কি পারবে তাকে খুঁজে বের করতে? তারচেয়েও বড় প্রশ্ন, মুশকান জুবেরি কি আসলেই অপরাধী? নাকি ডাক্তার আসকার যেরকম দাবি করছেন যে, মুশকান জুবেরির বিরুদ্ধে ক্যানিবালিজমের যে অবিশ্বাস্য অভিযোগ তিনি এর আগে তুলেছিলেন, সেটা আসলে পুরোই বানোয়াট? একের পর এক নতুন নতুন প্রশ্ন এসে পাঠককে বিভ্রান্ত করতে থাকে, আর লেখকও ছফা এবং কেএস খানকে দিয়ে একটু একটু করে সেগুলোর জট খোলানোর মধ্য দিয়ে কাহিনী এগিয়ে নিতে থাকেন।
সিরিজের প্রথম খণ্ডের মতোই রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও আসেননি উপন্যাসেও লেখক মোহাম্মদ নাজিম উদ্দিন ছোট ছোট অধ্যায়ে তার সহজ, গতিশীল গদ্যে কাহিনীকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। প্রথম খণ্ডের তুলনায় দ্বিতীয় খণ্ডটিকে কিছুটা ধীর গতির মনে হতে পারে। প্রথম খণ্ডটি একেবারে প্রথম অধ্যায় থেকেই পাঠককে চুম্বকের মতো বইয়ের পাতায় আটকে রাখতে পারে, প্রতিটি অধ্যায় শেষ হওয়ামাত্রই পাঠক পরে কী হয়েছে জানার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। সে তুলনায় সিকুয়েলটি প্রায় অর্ধেক পর্যন্ত কাহিনী পাঠককে আকৃষ্ট করতে কিছুটা ব্যর্থ। কাহিনী এগিয়ে যায় অনেকটা দায়সারাভাবে, অনেক ক্ষেত্রে বর্ণনাগুলোকে অপ্রয়োজনীয় বলে মনে হয়। ৩৬৬ পৃষ্ঠার (কলকাতা সংস্করণ, বাংলাদেশ সংস্করণে মোট পৃষ্ঠা ৪৩২) বইটির ১৮১ পৃষ্ঠা পার হওয়ার পর ছফা যখন কলকাতায় যায়, তখন থেকেই কেবল কাহিনী জমে উঠতে শুরু করে, এবং পাঠক প্রথম খণ্ড পড়ার সময়ের মতো অনুভূতি ফিরে পায়।
সিকুয়েল লেখার কাজটি সব সময়ই একটু কঠিন। বিশেষ করে প্রথম খণ্ড যদি তুমুল জনপ্রিয়তা অর্জন করে, তাহলে দ্বিতীয়, তৃতীয় খণ্ডে পাঠকের চাহিদা পূরণ করা আরও বেশি কঠিন হয়ে পড়ে। তারপরেও সব দিক বিবেচনায় দ্বিতীয় খণ্ডে নাজিম উদ্দিন কাহিনী বেশ ভালোভাবেই সাজিয়েছেন। উপন্যাসে মুশকান জুবেরি চরিত্রটি একটু কম মনোযোগ পেয়েছে, কিন্তু সেটা কাহিনীর স্বার্থেই। পুরো উপন্যাস আবর্তিত হয়েছে নুরে ছফার তদন্ত কার্যক্রমকে কেন্দ্র করেই। কিন্তু তার তদন্তের গতি প্রকৃতি নির্ধারণ করে দিয়ে কাহিনীর মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করেছেন এসকে খান।
নতুন চরিত্রের মধ্যে রহস্যময় সুস্মিতা সমাদ্দার অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে কাহিনীতে স্থান করে নিয়েছে। আর পিএস আশেক মাহমুদের চরিত্রটি নিঃসন্দেহে উপন্যাসের সবচেয়ে সুনির্মিত চরিত্রগুলোর মধ্যে একটি। কাল্পনিক চরিত্র হলেও এর মধ্য দিয়ে বাংলাদেশের ক্ষমতার শীর্ষে থাকা আমলাদের অকল্পনীয় ক্ষমতা, সেই ক্ষমতার অপব্যবহারের একটি চিত্র ফুটে ওঠে। উপন্যাসের প্রথম অর্ধেক যে কিছুটি ধীর গতির, তার একটা কারণ অবশ্য চরিত্র নির্মাণ। লেখক অত্যন্ত সময় নিয়ে প্রায় প্রতিটি চরিত্রের অতীত জীবনের বিভিন্ন ঘটনা তুলে ধরেছেন। এই বর্ণনাকে আপাতদৃষ্টিতে অপ্রয়োজনীয় মনে হলেও চরিত্রগুলোর বৈশিষ্ট্য নির্মাণ করতে এর কোনো বিকল্প নেই।
প্রথম খণ্ডে একটা উল্লেখযোগ্য ত্রুটি ছিল বারবার মোবাইল ফোনের চার্জ শেষ হয়ে যাওয়া। কাহিনীতে কিছু কিছু জায়গায় যেখানে রহস্য তৈরি করা দরকার ছিল, কিন্তু মোবাইল ফোনে যোগাযোগ স্থাপিত হলে সে রহস্য আর জমতে পারত না, সেরকম একাধিক জায়গায় লেখক মোবাইল ফোনের চার্জ শেষ হয়ে বন্ধ হয়ে যাওয়ার অজুহাত তৈরি করেছিলেন, যা রীতিমতো অযৌক্তিক ঠেকেছিল। কিন্তু এবার লেখক এক্ষেত্রে সৃজনশীলতার আশ্রয় নিয়েছেন। চার্জ শেষ না হয়ে এবারের অজুহাতগুলো ছিল কখনও ছফার প্লেনে থাকার কারণে নেটওয়ার্কের বাইরে চলে যাওয়া, আবার কখনও পিএসের প্রধানমন্ত্রীর সাথে জরুরী মিটিংয়ে থাকার কারণে ফোন বন্ধ রাখতে বাধ্য হওয়া।
৩৬৬ পৃষ্ঠার (বাংলাদেশ সংস্করণে ৪৩২ পৃষ্ঠা) একটা উপন্যাসকে মোটামুটি বড়সড় উপন্যাসই ধরা যায়। কিন্তু তারপরেও বইয়ের দ্বিতীয় অর্ধেকে কাহিনী এত দ্রুতগতিতে এগিয়ে যায়, শেষ পর্যন্ত বইটিকে খুব একটা বড় বলে মনে হয় না। বরং ৯৭তম অধ্যায়ে যেখানে ফ্ল্যাশব্যাকে গিয়ে মুশকান জুবেরির কলকাতা পর্বের বিবরণ দেওয়া হয়, মনে হয় সেখানে যেন লেখক বিশাল ঘটনাকে খুব দ্রুত বলে শেষ করে দিতে চাইছেন। এই অংশটুকু এভাবে ফ্ল্যাশব্যাকে না বলে আরো বিস্তারিতভাবে কাহিনীর ভেতরে ভেতরে কয়েকটা অধ্যায়জুড়ে বললেই হয়তো আরো ভালো হতো। কারণ এমনিতেও উপন্যাসে যেসব টুইস্ট ব্যবহার করা হয়েছে, সেগুলো সেই অর্থে খুব চমকপ্রদ না। মনোযোগী পাঠকের পক্ষে সেগুলো আগেভাগেই অনুমান করা সম্ভব।
বইয়ের নাম প্রথম খণ্ডের নামের সাথে এত মিলিয়ে রাখা হয়েছে কেন, বইটি পড়ার আগে তা নিয়ে পাঠকের মনে প্রশ্ন জাগতে পারে। কিন্তু বইটি পড়লেই বোঝা যায়, এই নামটিই যৌক্তিক ছিল। সব মিলিয়ে ‘রবীন্দ্রনাথ এখানে কখনও আসেননি’ একটি মোটামুটি আকর্ষণীয় থ্রিলার। যদিও সিকুয়েল, তবুও কাহিনী এমনভাবে বর্ণনা করা হয়েছে, কেউ চাইলে প্রথমটি না পড়েও এটি পড়তে পারবে। বইটি বাংলাদেশে প্রকাশিত হয়েছে বাতিঘর প্রকাশনী থেকে। গুডরিডসে এর রেটিং ৩.৪৯/৫ (প্রথম খণ্ডের রেটিং ছিল ৩.৯৮/৫)।
আশা করা যায় লেখক শীঘ্রই এর পরবর্তী খণ্ড নিয়ে হাজির হবেন, ফলে বাংলা ভাষায় মৌলিক থ্রিলার জঁনরায় আরেকটি ট্রিলজি যুক্ত হয়ে বাংলা সাহিত্যকে আরেকটু সমৃদ্ধ করবে।
বইটি অনলাইনে কিনতে চাইলে ক্লিক করতে পারেন নিচের লিংকে-