Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

মার্জিনে মন্তব্য: লেখালেখির বিচার-ব্যবচ্ছেদ

“হারমোনিয়ামে ওস্তাদের সাহায্যে একদিনেই সা-রে-গা-মা চিনে নেওয়া সম্ভব। ওস্তাদ যদি না থাকতেন, আর হারমোনিয়াম যদি হাতে পেতাম, বিশ বছর টিপতে টিপতে একদিন ঠিকই সা-রে-গা-মা খুঁজে বের করতে পারতাম। তারপরে তো গান! মাঝখান থেকে বিশটা বছর চলে যেত স্বর আবিষ্কারেই। লেখার ব্যাপারেও ওই কথা। গুরু পেলে বিশটা বছর বেঁচে যায়। আমারই আক্ষরিক অর্থে বিশ বছর লেগেছে বাংলা ক্রিয়াপদের নানা রূপ আর তাদের একেক রকম মেজাজ ও প্রয়োগ বুঝতে। ওই বিশটা বছর আমি আর ফেরত পাব না। আমার প্রথম বিশ বছরের অনেক লেখাতেই দাগ রয়ে গেছে কাঁচা শিক্ষানবিশির। বিষয়ের দিক থেকে যতটা উচ্চতায়, তার অনেক নিচেই থেকে গেছে তখন আমার আঙ্গিক-বোধ ও গদ্য-পদ্যের ভাস্কর্য নির্মাণ।” -সৈয়দ শামসুল হক

পৃথিবীর তাবৎ চিত্রকর্ম কিংবা সাহিত্য বিবিধ ইন্টারপ্রেটেশনের জন্ম দেয়। বক্তব্য, উপস্থাপনা, রচনাগুণ, প্রাঞ্জলতা, উপস্থাপনের কৌশল আর আঙ্গিকের কারণে একটি লেখা অনন্য হয়ে ওঠে। সুলেখক কিংবা সু-পাঠকের জবানিতে এ ধরনের ইন্টারপ্রেটেশন আলাদা মর্যাদা পায়।

বিস্ময়ের সাথে লক্ষ্য করি- এক মোনালিসা চিত্রকর্ম কী পরিমাণ বক্তব্য সৃষ্টি করেছে, অবিশ্বাস্য ইন্দ্রজালের সূত্রপাত ঘটিয়েছে! অথচ একটা সময় এই বিষয়টি নিয়েই কৌতূহল কম এবং  বিরক্তি সৃষ্টি হয়েছিল বেশি। সত্য কথা বলতে, মোনালিসার লিঙ্গ পরিচয়, তার ভ্রুর অনুপস্থিতি, কেবল এ দুটি বিষয়ে প্রশ্ন কিংবা জানাশোনা আবদ্ধ ছিল, ছবিটি নিয়ে আমার মতামত এইটুকুর মধ্যেই আটকা ছিল।

অথচ ড্যান ব্রাউনের ‘দ্য ভিঞ্চি কোড’ পাঠের পর লেখনীটিকে ঘিরে যে অজস্র সমালোচনা, তথ্য, তত্ত্ব, চিত্রকর্ম তৈরি-‍বিদ্যা কিংবা এ জাতীয় বিষয়বস্তুর সম্মিলন ঘটতে পারে বা যৌক্তিক কারণেই এগুলো ঘটা উচিত, আমার মনে এ বোধটুকুর সচেতন রেখাপাত হয়েছিল। মনে হয়েছিল, ড্যান ব্রাউন আমার চোখের সামনে থেকে এমন একটি পর্দা সরিয়ে দিয়েছেন, যে পর্দার অপর পাশের সবকিছু আমার কাছে অভিনব এবং নতুন।

ভিঞ্চির প্রায় প্রতিটি চিত্রকর্মের পেছনের ইতিহাস, তথাকথিত গোপন-সংঘের সাথে তার সম্পৃক্ততা আমাকে এক অন্য ভুবনের সন্ধান দেয়। যে কারণেই হোক, ছবি আঁকার চেয়ে ছবির পেছনের কাহিনী আমাকে এক অপার্থিব অনুভূতির সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়। সালভাদর দালির বেশ কয়েকটি চিত্রকর্ম নিয়েও আমার বিপুল আগ্রহ জন্মায়। এছাড়া, চিত্রকর্ম দেখে না বোঝার আক্ষেপ চিরদিনের মতো লোপ পায় আমার। এখন বুঝি বা না বুঝি, একটি চিত্রকর্ম কিংবা সাহিত্যকর্ম যে এলেবেলে কোনো সৃষ্টি নয়, এ ধারণা আমার কাছে পরিষ্কার।

‘মার্জিনে মন্তব্য’ প্রবন্ধের লেখক সৈয়দ শামসুল হক কোড ভেঙেছেন, ড্যান ব্রাউন যেমন চিত্রকর্ম বোধগম্যতার ক্ষেত্রে ভিঞ্চির অনবদ্য আঙ্গিক আবিষ্কার করেছেন। লেখক অসংখ্য কোড ভেঙে বাংলা সাহিত্যের সেরা সেরা লেখনীগুলোর কলকব্জা একটা একটা করে খুলে এগুলোর অন্তঃকরণ দেখিয়ে আমাদের পরিতৃপ্ত করতে চান। বোঝাতে চান, “দেখ, লেখক কতটা ভেবে লেখেন, কতটা জেনে লেখেন!”

সৈয়দ শামসুল হক; Image: bdnews

আমরা বাঙালিরা যেন জন্মগতভাবেই কবি। বলতে দ্বিধা নেই, আমাদের অতীত অত্যন্ত সমৃদ্ধ ও মর্যাদাপূর্ণ ছিল। হারিয়ে খুঁজছি আমরা নিজেদেরকে। কেন জানি মনে হয়, বেনিয়াদের মতো হতে গিয়ে আত্মপরিচয় ভুলে আমরা ভীষণ লাঞ্ছনার জীবন-যাপন করে চলেছি। অথচ সভাকবির কবিতায়, স্বভাব কবিদের ভুলে-ভরা অথচ খাঁটি আবেগ ভরা মর্সিয়া পুঁথিতে, আরাকান রাজসভায় পরিবেশিত আলাওলের প্রাজ্ঞ রচনাশৈলী আর মধ্যযুগের বড়ু চণ্ডীদাসের শ্রী-কৃষ্ণকীর্তন অতীত বাংলার ইতিহাসে আমাদের গৌরবোজ্জ্বল, সুদীপ্ত শিখাটি আজও জ্বলন্ত।

রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কখনোই তার লেখা নির্দিষ্ট কোনো সৃষ্টির বুক চিড়ে, তার ব্যবচ্ছেদ করে কোনো একটি সার্বজনীন ব্যাখ্যাকে নির্দিষ্ট করেননি, বরং তিনি তা পাঠকদের বোধ, বোধি, প্রজ্ঞা, বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ দক্ষতার উপর এগুলোর ভাবার্থ বোঝার কিংবা এগুলোর শিল্পগুণ মূল্যায়ন করার ভার ছেড়ে দিয়েছেন। অথচ সেখানে সৈয়দ শামসুল হক তার ‘মার্জিনে মন্তব্য’ গ্রন্থে গল্প লেখার কলাকৌশল, বাক্যের ব্যবহার, শব্দ-জ্ঞান, আঙ্গিক বোঝানোর ক্ষেত্রে রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক গৃহীত সম্ভাব্য সকল কৌশলের একান্ত নিজস্ব ধারণার তর্ক-যোগ্য ব্যাখ্যা তুলে ধরেছেন।

কখনো তিনি কবিগুরুর অনন্য ছোটগল্পগুলোকে নিয়ে গড়ে ওঠা নানা বক্তব্য, জনপ্রিয় ব্যাখ্যাগুলোতেও তার মতকে ভিত্তি ধরে এগিয়ে গেছেন, এর পেছনে থাকা যুক্তিগুলোকে তিনি প্রতিষ্ঠা করার প্রয়াস পেয়েছেন, তার মতো করে ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেছেন।

১২১ পৃষ্ঠায়, গল্পের কলকব্জা অংশে লেখক প্রথমে ‘পোস্টমাস্টার’ গল্পটি হুবহু তুলে দেন আমাদের জন্য। এরপর লাইন ধরে ধরে গল্পটির মধ্যকার নির্যাসকে তুলে আনেন। সাহিত্যের কঠিন ভাবগুলোকে সহজ এবং সুগম করে পাঠককে ভাববার সুযোগ করে দেন, আলোচনা করেন রবীন্দ্রনাথের সৃষ্টির অসাধারণত্ব নিয়ে, তার শ্রেষ্ঠত্ব কিংবা আঙ্গিক বর্ণনার স্বাতন্ত্র্য নিয়ে।

তার বারবার মনে হয়েছে, না জেনে কেবল মূহুর্তের প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ হয়ে লিখে চলা কবিতা বা সাহিত্যকে স্বীকার করা সঙ্গত নয়। তিনি আক্ষেপ করেছেন, তার জীবনের শুরুর দিকের রচনা নিয়ে, যে লেখার পেছনে থাকা প্রেরণাকে ভিত্তি ধরে মূল্যায়ন করলে তা কেবল লেখকের প্রতি সহানুভূতি প্রদর্শন বৈ কিছু নয়। তাই তিনি নবীন লেখকদের সময় বাঁচানোর চেষ্টা করেছেন। তিনি লেখার জন্য নবীন-কাঁচা লেখকদের প্রয়োজনীয় কৌশলগুলো শিখে লিখতে বসতে তাগাদা দিয়েছেন।

স্কুল ম্যাগাজিনে লেখা চেয়েছে। সেখানে শতকরা পঁচাশি ভাগ কবিতা। খাতা-কলম নিয়ে বসলেই তরতর করে লিখে ফেলা যায়, এ কথাটি কে না শুনেছে এ জীবনে। এই যে ইচ্ছে হলেই লেখা যায় এ ধারণা মানুষকে কবি সাহিত্যিকদের অত্যন্ত দীনভাবে জানার বিশ্রীরকম সংস্কৃতির সৃষ্টি করেছে। সৃষ্টি করেছে অপ-সাহিত্য। 

মার্জিনে মন্তব্য-এর প্রচ্ছদ

কেন এ সমস্যাটির সৃষ্টি? কেন মানুষ ভাবে চাইলেই তরতর করে লিখে ফেলা যায়? কেন মানুষ মনে করে সে উত্তরাধিকারসূত্রে নিজ ভাষায় সুখপাঠ্য রচনা লেখার যোগ্যতা অর্জন করে ফেলেছে? সে সাহিত্য সাধনা কেন করবে? কার জন্য করবে? এর লক্ষ্য কী? উপজীব্য কী? ভাষা কেমন হবে? পাঠককে কোন আঙ্গিকে, কত দূরত্ব থেকে একটি বোধের আঙ্গিক বর্ণনা বক্তব্য প্রকাশের উদ্দেশ্য অর্জনে সহায়তা করবে? একজন কবির আদৌ কি তার কোনো লেখার অন্তর্নিহিত অর্থ প্রকাশ করার দায় আছে? কেন আছে? কেন নেই? থাকলেও তার প্রকাশভঙ্গি কী?

আমরা যারা লিখতে চাই, তাদের মনে কি এ প্রশ্নগুলোর উদয় হয়? আমরা কি এই প্রশ্নগুলো সামনে নিয়ে লিখি বা এ সংক্রান্ত প্রশ্ন বা জিজ্ঞাসাগুলোকে কখনো যৌক্তিক মনে করি? এ প্রশ্নগুলো ছাড়া অন্য কোনো স্বতন্ত্র প্রশ্ন কি আমাদের মনকে তাড়িত করে? লেখক হিসেবে তার সামাজিক কোনো দায় আছে কি?

মূলত এসব প্রশ্নের অবতারণা করা, কাঙ্ক্ষিত উত্তর খোঁজা, মাঝে মাঝে লেখকের একান্ত ব্যক্তিগত নির্দেশনার মধ্য দিয়ে ‘মার্জিনে মন্তব্য’ প্রবন্ধটি এগিয়ে যায়। কখনো তিনি গহীন অন্ধকারে কুপি ধরে নবীনকে এগিয়ে নেন, মূহুর্তকাল অপেক্ষা করেই তিনি সেই কুপিটি কেড়ে নিয়ে ঘোর অন্ধকারের মধ্য দিয়ে নবীন লেখককে একান্ত নিজস্ব আলো সৃষ্টির কথা বলে এগিয়ে যেতে প্রেরণা দেন। দূর থেকে লেখকের নির্দেশিত শব্দগুলো শোনা যায়, তিনি কাঁচা লেখককে একেবারে অকূল পাথারে ছেড়ে দিয়ে চলে যান না।

সাকিব আল হাসানকে এক ক্রীড়া সাংবাদিক জিজ্ঞেস করেছিলেন, এই যে আপনি বাংলাদেশের মতো একটি দেশের ছেলে হয়েও বিশ্বের বাঘা বাঘা অলরাউন্ডারদের পেছনে ফেলছেন, আপনার কি বিস্ময় হয়?

সাকিব কী বলেছিলেন জানেন? তিনি বলেছিলেন, খেলাটি আমি ভালোবাসি। তাই হয়তো আমি বিশ্বের সেরা অলরাউন্ডার, কিন্তু আমার সবচেয়ে আশ্চর্য লাগে যখন একজন লেখক একটি লাইনের পর কোন লাইনটি হবে তা সহজে লিখে চলেন। বিশ্বাস করুন, আমার পক্ষে এ কাজটি জীবনেও সম্ভব নয়। 

সৈয়দ শামসুল হক; Image: Dhaka Tribune

সৈয়দ শামসুল হক লেখার ক্ষেত্রে পাঠ্য, কৌশলের ক্ষেত্রে অব্যর্থ, ভাষার ক্ষেত্রে সংগত একটি স্টাইল খুঁজে এর মধ্যে থাকা দুর্বলতাগুলোকে আবিষ্কার করে, তা দূর করে নির্ভুল একটি সাহিত্যরস সৃষ্টির কথা বলেছেন। রিলকের মতো প্রায় নির্ভুল হয়ে লেখা, সনেটের মতো সংযত, সংক্ষেপিত, ষষ্টক, অষ্টক, মাত্রাবৃত্ত কিংবা পয়ার- সবগুলো ক্ষেত্র শিখে আবেগের উচ্ছ্বাস-নদীতে বয়ে যেতে বলে যান লেখককে।

লেখার কাজটি চর্চার। তবে লেখনীর কলকব্জার তোয়াক্কা না করে কেবল লিখে যাওয়াটি কখনোই উত্তম সিদ্ধান্ত নয়। সৈয়দ শামসুল হক, মানিক বন্দ্যোপাধ্যায় থেকে শুরু করে কবি গুরুর রচনাশৈলী নিয়ে গল্পোচ্ছলে এমন একটি আলাপ চালিয়েছেন যা অবর্ণনীয়, সত্যিকার অর্থে বুঝতে চাইলে ‘মার্জিনে মন্তব্য’ গ্রন্থটি অবশ্যপাঠ্য। তিনি অমর কবিদের কবিতা খুলে বর্ণনা করার পাশাপাশি নিজের কবিতা লেখার যে প্রেরণা, বোধগত উন্মেষ, চিন্তার খোরাক, কিমিয়া নিয়ে খোলামেলা আলোচনা করেছেন।

হলফ করে বলতে পারি, সাহিত্য সম্পর্কে লেখকের আত্মবিশ্বাসী উক্তিগুলো লেখক হিসেবে আপনাকে শুরু করার জন্য একটি প্যাটার্নের সন্ধান দেবে। লেখা হচ্ছে প্রেরণার বিষয়। কোনো কবি কী ভেবে তার অমর কবিতাটি লিখেছেন স্বয়ং কবিকে জিজ্ঞেস করেও এর সদুত্তর কদাচিৎ পাওয়া যায়।

কিন্তু লেখক বলছেন, 

“শিল্পের গাড়ি নিছক প্রেরণার চাকায় চলে না। তিনি গায়ক হন, লেখক হন কী চিত্রকর, তার ভেতরে নিদ্রাহীন দুই পুরুষ- প্রতিভাবান শিল্পী আর নিপুণ ‍মিস্তিরি।”

অসংখ্য বিষয় আছে, মহামূল্য মণির মতো এই বইটিতে। 

নাম: মার্জিনে মন্তব্য || লেখক: সৈয়দ শামসুল হক
প্রকাশক: অন্যপ্রকাশ || অনলাইন প্রাপ্তিস্থান:  রকমারি.কম

This Bangla article is a review of a book named 'Marjine Montobbo' by Syed Shamsul Haque.

Featured Image: bdnews

RB-RF/SM

Related Articles