
গোয়েন্দা বই পড়তে আমরা সকলেই ভালবাসি। ইংরেজি সাহিত্যে সাহিত্যের এই ধারা বেশ পুরাতন হলেও বাংলা সাহিত্যের জন্য তা খুব বেশি পুরনো নয়। বাংলা সাহিত্যের প্রথম মৌলিক গোয়েন্দা কাহিনীর লেখক হিসেবে মানা হয় পাঁচকড়ি দেকে। উনার গল্পে ছিলেন দুইজন প্রধান গোয়েন্দা। একজন অরিন্দম বসু আরেকজন দেবেন্দ্রবিজয় মিত্র। তবে গোয়েন্দাকাহিনীর দিক থেকে সর্বপ্রথম সাফল্যের চূড়ায় ওঠে সম্ভবত শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘ব্যোমকেশ’। তবে জনপ্রিয়তার সবচেয়ে শীর্ষস্থানে যে গোয়েন্দা চরিত্রের নাম থাকবে তিনি হলেন ‘ফেলুদা’। সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদা! তিনিই বাংলা সাহিত্যে গোয়েন্দা কাহিনীকে প্রতিষ্ঠিত করে যান। আজ আমরা শুনবো বাংলা সাহিত্যের একই সাথে তুখোড় এবং বিখ্যাত কয়েকটি গোয়েন্দা চরিত্র সম্বন্ধে।
ব্যোমকেশ বক্সী

Image Courtesy: shamprotik.com
শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়ের সৃষ্ট তুমুল জনপ্রিয় এক চরিত্র। বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে মধুর গোয়েন্দা মানা হয় ব্যোমকেশকে। এ চরিত্রটি আমাদের পুরো উপমহাদেশেই বেশ জনপ্রিয়। ব্যোমকেশ বক্সীর প্রথম আবির্ভাব হয় সত্যান্বেষী গল্পের মধ্য দিয়ে। ব্যোমকেশ বক্সীর বন্ধু অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়ের কলমে ব্যোমকেশের অভিযানগুলোর বর্ণনা ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। ১৩৩৯ বঙ্গাব্দ থেকে ব্যোমকেশকে নিয়ে সিরিজ গোয়েন্দা গল্প লেখা শুরু করেন শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়। শরদিন্দু খুব সহজ এবং সাবলীল ভাষায় লিখতেন। ১৩৩৯ থেকে ১৩৪৩ বঙ্গাব্দ পর্যন্ত ১০ টি গল্প লেখার পর পাঠকদের আর ভাল লাগবে না ভেবে দীর্ঘ ১৫ বছর ব্যোমকেশকে নিয়ে আর কোন গল্প তিনি রচনা করেননি। এরপর তিনি আবার ‘চিত্রচোর’ গল্পটি দিয়ে ব্যোমকেশ সিরিজ পুনরায় চালু করেন। তিনি ব্যোমকেশ সিরিজের মোট তেত্রিশটি গল্প লিখেছেন এর মাঝে বিশুপাল বধ গল্পটি তিনি শেষ করে যেতে পারেননি। ব্যোমকেশ বক্সীকে নিয়ে বেশ কিছু সিনেমা তৈরি হয়েছে। এর মাঝে বলিউডের একটি সিনেমাও আছে।
ফেলুদা
ফেলুদা! সে তো এক কিংবদন্তী। সত্যজিৎ রায়ের নিজ হাতে গড়া চরিত্র। ফেলুদার পুরো নাম প্রদোষচন্দ্র মিত্র। ১৯৬৫ সালের ডিসেম্বর মাসে সন্দেশ পত্রিকায় “ফেলুদার গোয়েন্দাগিরি” প্রথম প্রকাশিত হলে চারদিকে সাড়া পড়ে যায়। ১৯৬৫ থেকে ১৯৯৭ সাল পর্যন্ত ফেলুদার মোট ৩৫ টি সম্পূর্ণ এবং ৪ টি অসম্পূর্ণ গল্প এবং উপনযাস প্রকাশিত হয়েছে। ফেলুদার ঠিকানা ২১ রজনী সেন রোডে। তার প্রধান সহকারি খুড়তুতো ভাই তোপসে এবং লেখক লালমোহন গাঙ্গুলি ওরফে জটায়ু।

Image Courtesy: bornelegant.wordpress.com
ফেলুদা শার্লক হোমসের বিশাল বড় ফ্যান ছিলেন যা সত্যজিতের লেখায় বারবার উঠে এসেছে। ফেলুদার প্রধান সহকারী তপেশরঞ্জন মিত্র বা, তোপশে চরিত্রটিও শার্লক হোমসের রচয়িতা স্যার আর্থার কোনান ডয়েলের জন ওয়াটসন চরিত্র থেকে অনুপ্রাণিত। ফেলুদা রহস্যের বসমাধান করতে গিয়ে সাধারণত শারীরিক শক্তি বা, অস্ত্র ব্যবহার করেন না। তার বুদ্ধিই তার প্রধানতম অস্ত্র। তার পর্যবেক্ষণ এবং বিশ্লেষণী ক্ষমতা অসাধারণ। ফেলুদা সিরিজেরর সমস্ত গল্প এবং উপন্যাস ইংরেজি ভাষাতেও অনুদিত হয়েছে।
মাসুদ রানা
মাসুদ রানা বাংলাদেশের জনপ্রিয় কথাসাহিত্যিক কাজী আনোয়ার হোসেনের তৈরি একটি চরিত্র। ১৯৬৬ সালে এর যাত্রা শুরু হয়। প্রথম বইটির না ছিল ধ্বংস পাহাড়। মাসুদ রানার সকল বই সেবা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে। এই সিরিজের চারশরও অধিক বই রয়েছে। সিরিজের প্রথম দুটি বই সম্পূর্ণ মৌলিক। কিন্তু পরবর্তি প্রায় সকল বই অন্যান্য ভাষার বই এর ভাবানুবাদ বা, ছায়া অবল্পম্বনে রচিত। মাসুদ রানা চরিত্রটি জেমস বন্ডের বাঙালি সংস্করণ। মাসুদ রানার প্রথম বইটি কাজী আনোয়ার হোসেন ১০ মাস দীর্ঘ পরিশ্রম করে লিখেন।

Image Courtesy: prothom-alo.com
মাসুদ রানা সেনাবাহিনীর প্রাক্তন একজন মেজর। সে কাল্পনিক এক সংস্থা “বাংলাদেশ কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের সদস্য। সাংকেতিক নাম MR-9. রানা এজেন্সি নামে একটি গোয়েন্দা সংস্থাও তার রয়েছে। ১৯৭১ সালের বাংলাদেশের স্বাধীনতার আগে বইটিতে পাকিস্তান কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের কথা উল্লেখ থাকত। মেজর জেনারেল রাহাত খান হলেন কাউন্টার ইন্টেলিজেন্সের প্রধান। তার অধীনে মাসুদ রানা কাজ করে থাকে।
মাসুদ রানার চিরশত্রুদের কয়েকজন হল বিজ্ঞানী কবীর চৌধুরী, উ সেন প্রমুখ।
কাকাবাবু
বিখ্যাত বাঙালি সাহিত্যিক এবং কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের এক অনবদ্য কাল্পনিক গোয়েন্দা চরিত্র হল কাকবাবু। কাকাবাবুর আসল নাম রাজা রায়চৌধুরী। কাকাবাবু মধ্যবয়েসি এক গোয়েন্দা। তিনি ভারত সরকারের প্রত্নতত্ব বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত এক কর্মকর্তা। কাকাবাবু একবার আফগানিস্তানে গাড়ি চালানোর সময় দুর্ঘটনার কবলে পড়েন। তারপর থেকেই কাকাবাবুর এক পা ভাঙ্গা। হাঁটেন ক্র্যাচে ভর দিয়ে, অতি কৌশলে। তিনি কিছুদিন সিবিআই এর উপদেষ্টাও ছিলেন। তিনি কখনও বিয়ে করেননি।

Image Courtesy: ads1web.com
কাকাবাবু অসম্ভব সাহসী। তিনি তার ভাইপো সন্তু আর সন্তুর বন্ধু চাপাবাজ জোজোকে নিয়ে অনেক রোমহর্ষক অ্যাডভেঞ্চার করেছেন। কাকাবাবু শারীরিকভাবে প্রতিবন্ধী হলেও তার বুদ্ধির জোরে তিনি বিভিন্ন জটিল জটিল সব সমস্যার সমাধান করে বেড়ান। কাকাবাবু প্রথম প্রকাশিত হয় ১৯৭৯ সালে, আনন্দমেলা পত্রিকায়। গল্পের নাম ছিল “ভয়ঙ্কর সুন্দর”। ২০১২ সালে মৃত্যুর আগে পর্যন্ত সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় মোট ৩৬ টি কাকাবাবুর কাহিনী লিখেছেন।
মিসির আলী
মিসির আলী বাংলাদেশের বিখ্যাত কথা সাহিত্যিক এবং ঔপন্যাসিক হুমায়ূন আহমেদের সৃষ্ট এক জনপ্রিয় চরিত্র। এর কাহিনীগুলো রহস্যফগেরা। এগুলোকে ঠিক গোয়েন্দা কাহিনী বলা যায় না। মিসির আলীকেও সেই অর্থে গোয়েন্দা বলা যায় না। কিন্তু তার কাছাকাছি একটা চরিত্রই মিসির আলী। তিনিও গোয়েন্দাদের মতই রহস্যের সমাধান করেন। তাই মিসির আলীর গল্পগুলোকে গোয়েন্দা ঘরানারই ধরা হয়। মিসির আলীর কাহিনীগুলো মানুষের মনস্তাত্বিক বিষয়গুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করে। কাহিনী বাঁধা হয় যুক্তি আর বিজ্ঞানের শক্ত বাঁধনে। এ চরিত্রটি হুমায়ূন আহমেদের আরেক চরিত্র হিমুর সম্পূর্ণ বিপরীত বলা চলে।

Image Courtesy: rokomari.com
মিসির আলী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের একজন সহযোগী অধ্যাপক। তার বয়স ৪০-৫০ এর মাঝে। লম্বাটে মুখ, এলোমেলো দাড়ি, উসকো খুশকো চুল। প্রথমে দেখলে যে কেউ ভবঘুরে ভেবে ভুল করবে। তাঁর স্মৃতিশক্তিও অত্যন্ত ভাল।
তিন গোয়েন্দা
তিন গোয়েন্দা সেবা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত অত্যন্ত জনপ্রিয় একটি কিশোর গোয়েন্দা সিরিজ। মূলত স্কুল পড়ুয়া ছেলে-মেয়েদের মাঝে এর জনপ্রিয়তা ব্যাপক। ১৯৮৫ সাল থেকে বিদেশী কাহিনী অবলম্বনে এ সিরিজ চালু হয়। প্রথম থেকেই সুলেখক রকিব হাসানই এ সিরিজ লেখার কাজ শুরু করেন। তিনি ২০০৩ সাল পর্যন্ত একটানা ১৬০ টি কাহিনী লেখেন। পরবর্তিতে শামসুদ্দীন নওয়াব এই সিরিজটি লেখার কাজ চালাচ্ছেন। প্রথম আলোর এক জরিপে উঠে আসে যে, বাংলাদেশের কিশোর-কিশোরদের পড়া গল্পের বইয়ের মাঝে সবচেয়ে জনপ্রিয় হল তিন গোয়েন্দা। জরিপে ৪৫০ জনের ৮১ জন তিন গোয়েন্দার কথা বলে যা মোট অংশগ্রহণকারীর ১৮%।

Image Courtesy: books.shishukishor.org
তিন গোয়েন্দা গল্পের প্রধান তিন চরিত্র হল, কিশোর, মুসা, রবিন। তারা সবাই আমেরিকা থাকে। তারা তিন গোয়েন্দা নামে এক গোয়েন্দা সংস্থা চালায়। কিশোর যার প্রধান। কিশোর বাঙালি। মুসা আমান বযায়াম্বীর এবং আমেরিকান নিগ্রো। আর রবিন মিলফোর্ড আইরিশ আমেরিকান। সে বই এর পোকা।
গভীর চিন্তামগ্ন থাকলে কিশোর পাশা ক্রমাগত তাঁর নিচের ঠোঁটে চিমটি কাটতে থাকে। মুসা আমানভোজন রসিক। সে বিমান চালাতেও মোটামুটি দক্ষ। রবিন মূলত চলমান জ্ঞানকোষ। তিন গোয়েন্দার কার্ডও আছে। কার্ডে বড় বড় করে লিখা “তিন গোয়েন্দা”। তাঁর ঠিক নিচেই থাকে তিনটি প্রশ্নবোধক চিহ্ন। তাঁর নিচে নিজেদের নাম। তবে পরবর্তিতে কিশোর প্রশ্নবোধক চিহ্নের বদলে আশ্চর্যচিহ্ন ব্যবহার শুরু করে। তিন গোয়েন্দার একটা বিখ্যাত কৌশল হল ভূত-থেকে-ভূতে।
তবে তিন গোয়েন্দা কিন্তু কম সমালোচিত নয়। প্রথমত এর কাহিনীগুলো মৌলিক নয়। কিন্তু এর ব্যাপক চাহিদা এই সমালোচনা আসলে ধোপে টেকেনি। এ সিরিজের ৩০০ এরও বেশি বই আছে।
এছাড়াও বাংলা সাহিত্যে কাজী আনোয়ার হোসেনের কুয়াশা, বুদ্ধদেব গুহর হৃজু বোস, লেখক ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়ের পান্ডব গোয়েন্দা, সমরেশ মজুমদারের অর্জুন, রকিব হাসানের গোয়েন্দা রাজু, মুহাম্মদ জাফর ইকবালের টুনটুনি ও ছোটচাচ্চু পাঠকদের কাছে, বিশেষ করে কিশোর বা, তরুণদের কাছে বেশ জনপ্রিয়। হালের আলোচিত লেখক মোহাম্মদ নাজিম উদ্দীনের জেফরি বেগ গোয়েন্দা চরিত্রটিও বর্তমানে বেশ জনপ্রিয়। এসব চরিত্র নিয়ে না হয় আরেকদিন লেখা যাবে। আজ এ পর্যন্তই। ধন্যবাদ।