ষড়যন্ত্র বা ষড়যন্ত্রকারীদের নিয়ে চলচ্চিত্রের ছড়াছড়ি সারা বিশ্বজুড়ে। আমাদের চারপাশে যা ঘটে, রূপালি পর্দায় কমবেশি তারই প্রতিফলন আমরা দেখতে পাই। এই বিশ্বে ঘটে যাওয়া নানা ষড়যন্ত্রকে ভিত্তি করে নির্মিত হয়েছে অসাধারণ বেশ কিছু চলচ্চিত্র। কনস্পিরেসি থিওরি নিয়ে তৈরি এসব সিনেমা এমন কিছু তত্ত্ব দর্শকদের সামনে নিয়ে আসে যেগুলো বিশ্বাস করতে চায় অনেক দর্শকই। কিন্তু এত বিশ্বাসযোগ্য হয়েও এসব তত্ত্ব শেষমেষ তত্ত্বই থেকে যায়। চলুন তাহলে জেনে আসা যাক পৃথিবীতে ঘটে যাওয়া ঐতিহাসিক কিছু কনস্পিরেসি থিওরি নিয়ে নির্মিত হওয়া অসাধারণ কয়েকটি সিনেমার কথা।
১) দ্য ইনসাইডার (১৯৯৯)
সত্য ঘটনার উপর ভিত্তি করে ১৯৯৯ সালে নির্মিত এই চলচ্চিত্রটি নির্দেশনার দায়িত্বে ছিলেন স্বনামধন্য পরিচালক মিশেল ম্যান। সাথে রয়েছে আলপাচিনো ও রাসেল ক্রোর দুর্দান্ত অভিনয়। ১৫৮ মিনিটের ‘দ্য ইনসাইডার’ সিনেমাটি কনস্পিরেসি থিওরির এক অসাধারণ রসায়নের উপর ভিত্তি করে নির্মিত।
তামাক শিল্পের সাথে যুক্ত জেফ্রি উইগ্যান্ড একটি নিউজ চ্যানেলের স্প্যাশাল শো-তে এসে স্বীকার করতে চান যে, তামাক আসলে কতটা ক্ষতিকর এবং এই ইন্ডাস্ট্রির লোকজন প্রোডাক্টে নেশাজাতীয় দ্রব্যের মাত্রা ইচ্ছে করে বাড়িয়ে দিচ্ছে স্বার্থের কারণে। কিন্তু শেষমেষ তামাক শিল্পের মাথা এবং নিউজ চ্যানেলের লোভের মাঝে পড়ে কীভাবে তার কন্ঠরোধ করা হয় সেটা নিয়ে আবর্তিত হয়েছে গল্পের প্রেক্ষাপট।
২) জেএফকে (১৯৯১)
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট জন এফ. কেনেডির খুনের মামলার পুরনো ফাইল নিয়ে ফের তদন্ত শুরু করেন একজন নিউ অরলিন্স ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি, নাম জিম মরিসন। আস্তে আস্তে এফবিআই এর দেওয়া তথ্যের ফাঁক-ফোঁকর থেকে উঠে আসে ভিয়েতনাম যুদ্ধের যোগসূত্র। ১৯৯১ সালে অলিভার স্টোনের বিতর্কিত এই সিনেমাটি মুক্তি পায়। ছবির মূল অভিনেতা কেভিন কস্টনার। চলচ্চিত্রটিতে বেশ কিছু বিতর্কিত প্রমাণ হাজির করা হয় এবং এই হত্যাকান্ডের ষড়যন্ত্রের সাথে কারা জড়িত তা-ও তুলে আনার চেষ্টা করা হয়। সে সময় এই সিনেমা আমেরিকান সুধী সমাজে নানা বিতর্কের সৃষ্টি করে।
৩) ব্লো আউট (১৯৮১)
ড্রেসড টু কিল, ক্যাজুয়ালটিস অফ ওয়ার এর মতো অসাধারণ ছবির পরিচালক ব্রায়ান ডি পালমারের এক অনবদ্য সৃষ্টি ব্লো আউট। চলচ্চিত্রটি ১৯৬৬ সালে নির্মিত মিকেলাঞ্জেলো আন্তোনিওনির ব্লো-আপ সিনেমা থেকে অনুপ্রাণিত। এতে অভিনয় করেছেন জন ট্রাভোল্টা এবং ন্যান্সি অ্যালেনের মতো অসাধারণ সব অভিনেতা-অভিনেত্রী।
গল্পের মূল পটভূমি এরকম- জ্যাক টেরি একজন পেশাদার সাউন্ড টেকনেশিয়ান। নিজের প্রয়োজনে বিভিন্ন সাউন্ড রেকর্ড করে বেড়ান তিনি। হঠাৎই একদিন আমেরিকার এক রাষ্ট্রপতি পদপ্রার্থীর কার ক্র্যাশের রেকর্ডিংয়ের অডিও ধারণ করে ফেলেন তিনি। এরপর সেই খুনের তদন্ত করতে পাগলপ্রায় অবস্থা হয় তার। এভাবে তার হাতে আসে কিছু অদ্ভুত তথ্য। সেই থেকে সরকারের হাত থেকে প্রাণ বাঁচাতে পালিয়ে বেড়ায় জ্যাক।
৪) সেভেন ডেজ ইন মে (১৯৬৪)
১৯৬৪ সালে নির্মিত আমেরিকান পলিটিক্যাল থিওরি নিয়ে নির্মিত হয়েছে ‘সেভেন ডেজ ইন মে’ চলচ্চিত্রটি। সিনেমাটির পরিচালনায় ছিলেন জন ফ্রাঙ্কেনহেমার। বার্ট ল্যাঙ্কাস্টার, কার্ক ডগলাস, ফ্রেড্রিক মার্চ এবং এভা গার্ডনারের মতো অভিনেতারা এতে অভিনয় করেন। গল্পের মূল বিষয়বস্তু- আমেরিকার সামরিক কর্তাস্থানীয় ব্যক্তিবর্গ দেশের প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে গর্জে ওঠেন। প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে ক্ষমতা কেড়ে নেয়ার জন্য পরিকল্পনা করেন। এর পেছনে রয়েছে একটি চুক্তি। আমেরিকার প্রেসিডেন্ট, তার দেশের সামরিক বাহিনীর কর্তাব্যক্তিদের অবগত না করেই রাশিয়ার সাথে একটি বিশেষ চুক্তিতে সমর্থন করেন।
৫) মিউনিখ (২০০৫)
২০০৫ সালে মুক্তি পাওয়া মিউনিখ চলচ্চিত্রটির পরিচালনায় ছিলেন হলিউডের খ্যাতিমান পরিচালক স্টিভেন স্পিলবার্গ। ১৯৭২ সালে গ্রীষ্মকালীন অলিম্পিকের আসর বসেছিল জার্মানির মিউনিখে। কিন্তু অলিম্পিক শুরুর আগেই অলিম্পিক ভিলেজে ঘটে যায় এক মর্মান্তিক হত্যাকাণ্ড। সেই ‘ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর’ দিনটিতে প্রাণ হারান ১১ জন ইসরায়েলি ক্রীড়াবিদ এবং একজন জার্মান পুলিশ অফিসার। এ ঘটনার পেছনের ষড়যন্ত্র আর ঘটনার প্রতিশোধ নিতে ইসরায়েলি গুপ্তচর সংস্থা মোসাদের নানা পরিকল্পনা এবং তা বাস্তবায়নের প্রতিশোধগাঁথাই চিত্রিত হয়েছে চলচ্চিত্রের পর্দায়।
৬) অল দ্য প্রেসিডেন্টস ম্যান (১৯৭৬)
ওয়াশিংটন পোস্টের দুই সাংবাদিক বব উডওয়ার্ড এবং পল বার্নস্টেইনের তদন্তে উঠে আসে ওয়াটারগেট কেলেঙ্কারি। এই দুই সাংবাদিকের তথ্যের উপর ভিত্তি করে তৎকালীন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট নিক্সন ইস্তফা দিতে বাধ্য হন। তাদেরকে তথ্য দিয়ে সাহায্য করেছিলো ডিপথ্রোট নামের অজ্ঞাতনামা এক সূত্র। প্রতিবেদন তৈরির পুরো ঘটনা এবং এর প্রতিক্রিয়া নিয়ে সম্পূর্ণ সত্যি কাহিনীর উপর ভিত্তি করে নির্মিত হয় অল দ্য প্রেসিডেন্টস ম্যান চলচ্চিত্রটি। অ্যালান জে পাকুলারের পরিচালনায় পলিটিক্যাল থ্রিলারধর্মী সিনেমাটি মুক্তি পায় ১৯৭৬ সালে। অভিনয়ে ছিলেন রবার্ট রেডফোর্ড এবং ডাস্টিন হফম্যানের মতো তারকারা। সেই বছর সিনেমাটি একাডেমি অ্যাওয়ার্ড অর্জন করে।
৭) কেপ্রিকর্ন ওয়ান (১৯৭৭)
মানুষ কি সত্যিই চন্দ্র বিজয় করেছিল, নাকি পুরোটাই সাজানো কোনো ছায়াছবি? এ নিয়ে রয়েছে নানা বিতর্ক। পিটার হেইমসের নির্দেশনা ও পরিচালনায় ১৯৭৭ সালে মুক্তি পাওয়া কেপ্রিকর্ন ওয়ান এই কনস্পিরেসি থিওরির ওপর ভিত্তি করে নির্মিত এক অনবদ্য চলচ্চিত্র।
মানুষের প্রথম মঙ্গল অভিযানে যাওয়ার প্রস্তুতিপর্ব প্রায় শেষ। তবে মহাকাশযান ছাড়ার ঠিক আগমুহূর্তে গোড়ায় গলদ ধরা পড়ে। তারপর নাসার নির্দেশে পুরো অভিযানটিই কঠোর সামরিক নিরাপত্তা বেষ্টিত একটি অঞ্চলে মঙ্গলে অবতরণ নিয়ে সিনেমা নির্মাণ করা হয়। পরবর্তীতে তা এক স্টুডিও থেকে সম্প্রচার করা হয়। তবে এই ষড়যন্ত্রের সন্ধান পেয়ে যায় এক সাংবাদিক। তারপর বিজ্ঞানী এবং সাংবাদিক সকলকেই পড়তে হয় প্রাণের ঝুঁকির মুখে। এই পটভূমিতে তৈরি করা হয়েছিল কেপ্রিকর্ন ওয়ান চলচ্চিত্রটি।
৮) মিসিং (১৯৮২)
১৯৮২ সালে মুক্তি পাওয়া গ্রিক পরিচালক গোস্তা গারবাসের এক অনবদ্য ছবি মিসিং। চলচ্চিত্রটি১৯৭৩ সালে ১১ সেপ্টেম্বর চিলিতে মিলিটারি ক্যুয়ের প্রেক্ষাপটে নির্মিত হয়। চিলির তৎকালীন শাসক সালভাদর আলেন্দকে হত্যা করে ক্যুর মাধ্যমে চিলির শাসন ক্ষমতা দখল নেয় সামরিক শাসক আগাস্তো পেনোসে। এই সময়ে সেখানে ছিলেন মার্কিন লেখক চার্লস হরম্যান। মিলিটারির বিরুদ্ধে কথা বলায় তাদের রোষের মুখে পড়ে হঠাৎ নিখোঁজ হয়ে যান হরম্যান। পরিবার তন্ন তন্ন করে খুঁজতে থাকে তাকে। খুঁজতে খুঁজতে তারা ঠিকই বুঝে ফেলেন যে এই ক্যুর পেছনে হাত রয়েছে সিআইএ’র। বিষয়টি জেনে যাওয়ায় হরম্যানের পরিবারের সাথে কী ঘটেছে তা নিয়েই এগিয়েছে ছবির কাহিনী।
(৯) দ্য ইনগ্লোরিয়াস বাস্টার্ড (২০০৯)
কোয়েন্টিন টারান্টিনো পরিচালিত দ্য ইনগ্লোরিয়াস বাসটার্ড চলচ্চিত্রটি মুক্তি পায় ২০০৯ সালে। ব্র্যাড পিট ও ক্রিস্টোফার ওয়াল্টজজের অভিনীত সিনেমাটির বিষয়বস্তু কনস্পিরেসি থিওরিকে হাতিয়ার করে গড়ে উঠেছে। গল্পের পটভূমি তৈরি হয়েছে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে কেন্দ্র করে। ১৯৪১-৪৪ সাল পর্যন্ত ফ্রান্স নাৎসিদের নিয়ন্ত্রণে ছিল। অস্ট্রিয়া থেকে নাৎসি বাহিনীর সিক্রেট সার্ভিসের এক সেনা কর্মকর্তাকে পাঠানো হয় ফ্রান্সের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ইহুদিদের খুঁজে বের করার জন্য।
সেসময় ফ্রান্সের বাসিন্দা এক যুবক পণ করে দেশ থেকে জার্মান অফিসারদের তাড়ানোর। এই কাজে তার পাশে দাঁড়ায় জিউয়িশ আমেরিকান ট্রুপ বা বাস্টার্ডস। এ গ্রুপের আট সৈন্যকে পাঠানো হয় নাৎসি নিধনে। মানুষের বিকৃত মানসিকতা, মনুষ্যত্বহীনতা, বর্ণবাদ, উগ্র জাতীয়তাবাদের এক বিভৎস রূপ ফুটে উঠেছে সিনেমাটির প্রতিটি ধাপে, আর তার সাথে যুক্ত হয়েছে নানা কনস্পিরেসি থিওরি। চলচ্চিত্রটি ৮২ তম একাডেমী অ্যাওয়ার্ডে সেরা ছবি ও সেরা পরিচালক সহ ৮টি বিভাগে মনোনয়ন পায় এবং ক্রিস্টোফার ওয়াল্টজ সেরা পার্শ্ব অভিনেতার পুরস্কার জিতে নেন।
১০) সিরিয়ানা (২০০৫)
২০০৫ সালে মুক্তি পাওয়া পলিটিক্যাল থ্রিলার মুভি সিরিয়ানা জর্জ ক্লুনি ও ম্যাট ডেমন অভিনীত এক অসাধারণ ছবি। মধ্যপ্রাচ্যের তেল শিল্প নিয়ন্ত্রণের জন্য বিশ্ব ভূ-রাজনীতি, অর্থনীতি ও সমাজের নানা অন্ধকারময় দিক, শিল্পের ভেতরে ক্ষমতার রাজনীতি ও দুর্নীতি এবং কীভাবে তা ঢাকতে কিছু অসাধু ব্যক্তির ষড়যন্ত্রের শিকার হয় সাধারণ ব্যক্তিরা, সেসব চক্রান্তের ছবিই ফুটে উঠেছে পুরো সিনেমা জুড়ে। এই ছবির জন্য জর্জ ক্লুনি শ্রেষ্ঠ পার্শ্ব অভিনেতা বিভাগে একাডেমি পুরস্কার লাভ করেন।
ফিচার ইমেজ: Post-Crescent.com