সব মানুষেরই জীবনে একবারের জন্য হলেও জনমানবহীন বন্য প্রান্তরের স্বাস্থ্যকর অথচ একঘেয়ে পরিবেশের অভিজ্ঞতা নেয়া উচিত, যাতে নিজেকে পুরোপুরি নিজের উপর নির্ভরশীল হিসেবে খুঁজে পেতে আর তারপর নিজের সত্যিকারের গোপন শক্তির সন্ধান লাভ করতে পারে।
-হারুকি মুরাকামি
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পরপর পৃথিবী দুই ক্ষমতাধর রাষ্ট্রের দখলে চলে যায়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র এবং সোভিয়েত ইউনিয়ন (বর্তমান রাশিয়া)। গোটা দুনিয়ায় নিজেদের শক্তি প্রদর্শন শেষে মহাকাশ জয় নিয়ে এক নতুন প্রতিযোগিতায় মেতে উঠে এই দুই পরাশক্তি। তারই ফলশ্রুতিতে ১৯৫৭ সালের ৪ অক্টোবর সোভিয়েত ইউনিয়ন সর্বপ্রথম মানব নির্মিত স্যাটেলাইট স্পুটনিক ১ উৎক্ষেপণ করে। উৎক্ষেপণের স্থান ছিল কাজাখস্তানের বাইকানোর স্পেস সেন্টার। ডায়ামিটারে ৫৮ সেন্টিমিটারের স্পুটনিকটি ২৩ ইঞ্চি ব্যাসের এবং ৮৩.৬ কিলোগ্রামের একটি ছোট বলের মতো ছিল দেখতে। প্রতি ৯৬ মিনিট ১২ সেকেন্ডে একবার পৃথিবী ঘুরে আসত।
একই বছরের নভেম্বরের ৩ তারিখ আবারো স্পুটনিক ২ নামক আরেকটি স্যাটেলাইট মহাকাশে পাঠাতে প্রস্তুতি নেয় সোভিয়েতরা। কিন্তু এবার শুধুমাত্র যান্ত্রিক স্যাটেলাইটই নয় বরংচ জ্যান্ত কুকুর লাইকা সহ স্পুটনিক ২ উৎক্ষেপণ করা হয়। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডল ছাড়িয়ে যাওয়া প্রথম জীবন্ত প্রাণী ছিল লাইকা। কিন্তু স্যাটেলাইটটা পৃথিবীতে আর ফেরত আনা সম্ভব হয়নি। ধারণা করা হয়, হয়তো কয়েক ঘণ্টা কিংবা কয়েক দিনই টিকে থাকতে পেরেছিল লাইকা; পরের বছর এপ্রিল মাসে ‘স্পুটনিক ২’ স্যাটেলাইটটি ধ্বংস হয়ে যায়। চিরকালের জন্য মহাকাশে হারিয়ে যায় লাইকা। জীবিত অবস্থায় স্পুটনিক ২ এর জানালা গলে মহাকাশে লাইকা কী দেখতে পেয়েছিল? এক বিশাল শূন্যতার রাজ্য? নাকি এক অপার নিঃসঙ্গতার জগত?
আপনি যদি ইতিমধ্যেই ভেবে থাকেন যে, কল্পবিজ্ঞানের কোনো জটিল রহস্য বা সূত্র কিংবা বিজ্ঞানের কোন বিষয় নিয়ে বিস্তর আলোচনা করবো তাহলে ভুল ভাবছেন। আজকের আলোচনা জনপ্রিয় লেখক হারুকি মুরাকামির উপন্যাস স্পুটনিক সুইটহার্ট নিয়ে। যেহেতু নামটার সাথে স্পুটনিক জুড়ে দেয়া হয়েছে এবং লেখক নিজেও স্পুটনিকের একটা সংক্ষিপ্ত ব্যাখ্যা দিয়েছেন দ্য কমপ্লিট ক্রনিকল অফ ওয়ার্ল্ড হিস্ট্রি বইটি থেকে। তাই উপরোক্ত পূর্ব-কথনটুকু রিভিউতেও সংযুক্ত করে দেয়ার প্রয়োজনবোধ দেখা দিয়েছে।
কলেজ টলেজ সব বাদ দিয়ে সুমিরে একজন উপন্যাসিক হওয়ার চেষ্টায় আছে। নাওয়া খাওয়ার খেয়াল নেই, সারাদিন বই পড়ে আর লেখালেখি করে। দুনিয়ার সাথে ওর একমাত্র যোগাযোগ হল শুধু মাত্র মাঝ রাতে একমাত্র বন্ধুকে ফোন দিয়ে উঠিয়ে অসংখ্য কথা বলা। এমন সময় সে প্রেমে পড়ল তার চেয়ে বয়সে অনেক বড় একজন বিবাহিতা নারীর। অমনি তার জীবনটা বদলে গেল। প্রেমিকাকে চাইলে লেখালেখি হয় না, লেখালেখি চাইলে প্রেম বাদ দিতে হবে। সুমিরে শেষ পর্যন্ত কোনটা বেছে নিল? ওর সিদ্ধান্ত কি শেষ পর্যন্ত কাল হয়ে দাঁড়াল? সম্পর্কের জটিলতা, পরাবাস্তবতা ও অসীম বিষণ্ণতায় ভরপুর আরেকটি মুরাকামিয় উপন্যাস।
আমরা দুজন চমৎকার ভ্রমণসঙ্গী ছিলাম, কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমরা আসলে স্রেফ নিজেদের ভিন্ন ভিন্ন কক্ষপথে চলতে থাকা একাকী একতাল ধাতব বস্তুর চেয়ে বেশি কিছু ছিলাম না। দূর থেকে দেখে ওগুলোকে সুন্দর খসে পড়া তারার মতো দেখালেও, বাস্তবে ওগুলো বন্দিশালার বাইরে আর কিছু ছিল না। আমরা দুজনেই যার যার মতো একাকী বন্দি হয়ে ছিলাম, কোথাও যেতে পারছিলাম না। যখন এই দুই স্যাটেলাইটের কক্ষপথ একটা আরেকটাকে অতিক্রম করে তখন আমরা একত্র হতে পারি। এমনকি আমরা হয়তো একজন আরেকজনকে মন খুলে তুলে ধরতে পারি। কিন্তু সেটা শুধুমাত্র অল্প সময়ের জন্য। পরের মুহূর্তেই আমরা আবার নিঃসঙ্গ হয়ে পড়ি। যতক্ষণ না আমরা পুড়ে গিয়ে একসময় নিঃশেষ হয়ে যাই।
-হারুকি মুরাকামি
কে
মূলত কে হচ্ছে এই উপন্যাসের গল্পকথক এবং অন্যতম প্রধান চরিত্র। ২৫ বছর বয়সী গল্পকথক আদতে কিন্ডারগার্টেন স্কুলের একজন শিক্ষক। সমাজে বাসে করেও সমাজ বিচ্ছিন্ন, নিঃসঙ্গ আর পরিপূর্ণ একা গল্পকথক। নির্দিষ্ট কোনো কারণ নেই তবুও নিজের পরিবারের সাথে কেন যেন নিজেকে মানিয়ে নিতে পারেনি কে; এমনকি পারেনি সমাজে বাস করা অন্যান্য মানুষগুলোর সাথে মানিয়ে নিতে। তাই, শিক্ষক গোত্রীয় সমাজের হয়েও নিঃসঙ্গতা আর একাকীত্ব আঁকড়ে ধরে বেঁচে আছে সে। তবে জৈবিক চাহিদা তো আর নিঃসঙ্গতা কিংবা একাকীত্বকে পরোয়া করে না। আর জৈবিক চাহিদাই তাকে তাড়িত করে নিজের ক্লাসেরই ছাত্রের মায়ের সাথে বিছানায় যেতে। কিন্তু তবুও কোথাও যেন একটা শূন্যতা রয়েই যায় কে’র জীবন জুড়ে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে থাকাকালীন পরিচয় হয়েছিল সুমিরের সাথে। খুব অদ্ভুত ধরনের এই মেয়েটার প্রেমে পড়ে যায় কে। কিন্তু কেন জানি কখনোই মনের কথাটা মন খুলে বলতে পারে না। অথচ ঘণ্টার পর ঘণ্টা ফোনে কথা বলে ওরা। সুমিরের প্রতি এক ধরনের যৌন আকাঙ্ক্ষাও অনুভূত করে সে। কে বুঝতে পারে না, এ কি কেবলই নিঃসঙ্গতার জন্যে তৈরি হওয়া দৃষ্টিবিভ্রমতা নাকি শূন্যতার অবগাহন?
সুমিরে
মেয়েটাকে ঠিক সুন্দরী বলা যাবে না। বলতে গেলে মেয়েলী স্বভাবের কিছু ওর মধ্যে নেই। খুব বেশী লম্বাও না বরংচ একটু খাটো। চাপা ভাঙা, চওড়া মুখ, আর ছোট একটা নাক। চিরুনির স্পর্শ না পাওয়ায় ওর চুলগুলো সবসময়ই পাখির বাসা হয়ে থাকে। মোটা ফ্রেমের একটা চশমা ওর চেহারাটাকে প্রায় ঢেকে রাখে; কেননা ওর দৃষ্টিশক্তি ছিল করুণ। বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি করে কথা বলায় পটু সে আর রসবোধও অসাধারণ। তবে ওকে কখনো জোরে হাসতে দেখা যায়নি। তবে তাও সুমিরের মধ্যে কিছু একটা আছে, যে কারণে লোকজন ওর প্রতি আকর্ষিত হয়। এই কিছু একটা খুঁজে বের করা বা ভাষায় প্রকাশ করা মুশকিল তবে অনুভব করা অনেক সহজ।
সবকিছু ছেড়ে সুমিরে উঠেপড়ে লেগেছে একজন ঔপন্যাসিক হতে। সুমিরের বাবা ঝামেলা করতে চাইলেও সৎমা ওকে এই ব্যাপারে বেশ সাহায্য করেছে। কিন্তু তাও ওর মনে হয় মায়ের জায়গাটা আজীবন শূন্যই রয়ে যাবে। প্রায় সময়ই রাতের বেলা বাসার সামনের ফোনবুথটা থেকে গল্প কথককে ফোন দিয়ে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কথা বলে সুমিরে। এক বিয়ের অনুষ্ঠানে সুমিরের পরিচয় হয় মধ্যবয়সী সুন্দরী নারী মিউয়ের সাথে। আচমকাই সুমিরের অনুভূত হয় যে এই নারীর প্রেমে পড়েছে সে। একটা সময় লেখালেখির জন্য সবকিছু ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করলেও এখন মিউয়ের সাথে এক মুহূর্ত কাটানোর জন্যে সবকিছু ছেড়ে দিতে ইচ্ছে করে সুমিরের।
মিউ
মধ্যবয়সী বিবাহিত এক রমণী। জাতীয়তা অনুসারে কোরিয়ান হলেও জন্ম আর বেড়ে ওঠা জাপানে। তবে পড়ালেখা করেছে ফ্রেঞ্চ মিউজিক একাডেমীতে। একটা সময় কনসার্ট পিয়ানিস্ট হিসেবে মঞ্চ মাতালেও, কোনো এক অদ্ভুত কারণে বর্তমানে সে দারুণ সব ওয়াইন আমদানিকারক হিসেবে পারিবারিক ব্যবসার হাল ধরেছে। সুমিরের সাথে প্রথম সাক্ষাতে জ্যাক কেরুয়্যাককে মিউ ভুলক্রমে ‘স্পুটনিক’ বলে ফেলেছিল যেখানে বলার কথা ছিল ‘বিটনিক’। আর এই ভুলই সুমিরের কাছে মিউকে ‘স্পুটনিক সুইটহার্ট’ রূপে প্রতিস্থাপিত করে।
অন্য এক সাক্ষাতে সুমিরেকে চাকরির প্রস্তাব দেয় মিউ এবং সাথে করে ইউরোপে নিয়ে যায়। এক রাতে মিউ তার গোপন অতীতকে তুলে ধরে সুমিরের সামনে। যে অতীতে মিউ নিজের অন্য সত্ত্বার কাছে পরাজিত হয়েছিল। আর পরের দিন সকালে জ্ঞান ফিরে দেখে কোন এক অদ্ভুত কারণে তার মাথার চুল সব সাদা হয়ে গিয়েছে; প্রথম পড়া তুষারের মতোই ধবধবে সাদা। চুলটাকে রঙ করে কালো করতে পারলেও অতীতটাকে কোন রঙেই গাঢ় করতে পারে না মিউ। এই ঘটনার পরপরই মিউ গল্প-কথককে ফোন করে আর জানায় গ্রীসের এক দ্বীপে সুমিরে হারিয়ে গিয়েছে। ওকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। যেন একদম হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে।
কে বা গল্পকথক কি শেষমেশ সুমিরেকে জানাতে পারে নিজের মনের কথা? নাকি তার যৌন আকাঙ্ক্ষা কেবলই শূন্যতার অবগাহন মাত্র? সুমিরে ঠিক কোনটাকে বেছে নেয় লেখালেখি নাকি মিউয়ের সঙ্গ? মিউয়ের অন্ধকার অতীতে আসলে কি হয়েছিল? কেনই বা তার মাথার চুল আচমকা সাদা রঙ ধারণ করেছিল? আর সুমিরে? সুমিরের গ্রিসের ঐ দ্বীপে কিভাবে হাওয়ায় মিলিয়ে গেল? সবগুলো প্রশ্নের উত্তরই পাওয়া যাবে স্পুটনিক সুইটহার্ট নামক এই মুরাকামিয় উপন্যাসে।
She shuts the doors and lights and lays her body on the bed
Where images and words are running deep
She has too much pride to pull the sheets above her head
So quietly she lays and waits for sleep
Dream Theater
(Wait for sleep)
স্টেডিয়ামে বসে খেলা দেখতে থাকা এক লোকের মাথায় আচমকাই একটা গল্প নাড়াচাড়া দিয়ে উঠলো। মস্তিষ্কের সেই নাড়াচাড়াটা শরীরেও প্রত্যক্ষ করা গেল। দ্রুত বাসায় ফিরে গল্পটা কলমের সাহায্যে কাগজে লিখে ফেললো। আর একদমই আচমকা গরমের দিনে তুষারপাতের মতোই জনপ্রিয় হয়ে উঠলো এই লেখক। বলছিলাম হারুকি মুরাকামির লেখক হয়ে উঠার সংক্ষিপ্ত গল্প। নিঃসঙ্গতা, একাকীত্ব, সম্পর্কের জটিলতা আর পরাবাস্তবতার জন্য হারুকি মুরাকামি বর্তমানে তুমুল জনপ্রিয় জাপানি লেখক। তাঁর সব কয়টি বই জাপানসহ বিশ্বজুড়েই সমাদৃত এবং বেস্টসেলারের মর্যাদা পেয়েছে। পঞ্চাশটিরও বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে তাঁর লেখা।
ওয়ার্ল্ড ফ্যান্টাসি অ্যাওয়ার্ড, জেরুজালেম অ্যাওয়ার্ড, ফ্রাঙ্ক ও কনর শর্ট স্টোরি অ্যাওয়ার্ড, ফ্রানৎস কাফকা অ্যাওয়ার্ড আছে তাঁর ঝুলিতে। একইসাথে আছে প্রিন্সটন ইউনিভার্সিটিসহ বিশ্বের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রীর মর্যাদা। পাশাপাশি আছে ২০১৫ সালে টাইম ম্যাগাজিনের বিশ্বের ১০০ জন প্রভাবশালী ব্যক্তি মধ্যে নিজের অবস্থান করে নেয়া। তাঁর উল্লেখযোগ্য গ্রন্থসমূহ হচ্ছে- নরওয়েজিয়ান উড, কাফকা অন দ্য শোর, ওয়ান কিউ এইট ফোর, অ্যা ওয়াইল্ড শিপ চেইজ, আফটার ডার্ক ইত্যাদি। গল্প-সংকলন এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য- আফটার দ্য কোয়েক, দ্য এলিফেন্ট ভ্যানিসেশ এবং ব্লাইন উইলো এন্ড স্লিপিং উইম্যান। গত দুই-তিন বছর যাবত সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কারের কথা উঠলেই উঠে আসে হারুকি মুরাকামির কথা।
কেন মানুষকে এতটা নিঃসঙ্গ হতে হয়? এর কারণটা কী? পৃথিবীর লাখ লাখ মানুষ, সবাই আকাঙ্ক্ষায় আকুল, তাকিয়ে আছে অন্যরা এসে তাদেরকে পরিতৃপ্ত করবে, অথচ তারপরেও তাদের আলাদা করে রাখছে। কেন? পৃথিবীর কাজ কি এখানে শুধু মানুষের নিঃসঙ্গতাকে পরিপুষ্ট করা?
-হারুকি মুরাকামি
দিন বদলেছে, বছর ঘুরেছে, প্রযুক্তি উন্নত হয়েছে। এমনকি মানব সভ্যতা চাঁদেও পা রেখেছে। কিন্তু এতকিছু অর্জন করা সত্ত্বেও মানুষ একটা জিনিসকে কখনোই জয় করতে পারেনি। আর তা হচ্ছে, নিঃসঙ্গতা, একাকীত্ব কিংবা শূন্যতাকে। এখনো এই বিশাল বিশাল ইমারতের শহরগুলোতে মানুষকে নিঃসঙ্গতার বৃত্তে বন্দি হয়ে চক্রাকার জীবনযাপন করতে হয়। ঠিক তেমনি টোকিওর মতো বিশাল এক মহানগরীতে হারিয়ে যাওয়া তিনজন মানুষ নিজেদেরকে খোঁজার চেষ্টা করেন; ভাঙার চেষ্টা করেন নিঃসঙ্গতার চিরন্তন বলয়। ঠিক যেন রাশিয়ান স্যাটেলাইট স্পুটনিক ২ এর যাত্রার অনুরূপে; যেখানে কুকুর লাইকা পৃথিবীর চারিদিকে ঘোরে এবং অবাক দৃষ্টিতে তাকিয়ে অসীম এক শূন্যতার দিকে।
মুরাকামির একটা স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্য আছে, আর সেটা হচ্ছে খুব প্রচলিত আর সাধারণ গল্পটাকেই আরো বেশি সাধারণ রূপে লিখে অসাধারণের তকমা দিতে পারেন উনি। আর তার জলজ্যান্ত প্রমাণ তার বিখ্যাত উপন্যাস – নরওয়েজিয়ান উড। তবে সেদিক থেকে স্পুটনিক সুইটহার্ট খুবই অদ্ভুত, রহস্যময় আর পরাবাস্তবে মাখা এক উপন্যাস। যা মুরাকামির সূক্ষ্ম বিবরণে পূর্ণতা পেয়েছে। মুরাকামি চরিত্রগুলোর নিত্যদিনের সূক্ষ্ম বিবরণগুলো তুলে ধরে পরিপূর্ণতা দেয়ার চেষ্টা করে। যেমন এই উপন্যাসে কয়েকবার উঠে এসেছে গরমের উত্তাপে ঘামে ভিজে শরীরের সাথে লেপ্টে যাওয়া শার্টের কথা কিংবা ঘামের কারণে শার্টে পড়া ছোপ ছোপ সাদা দাগের কথা। অথবা নিঃসঙ্গ একটা মানুষের যৌন আকাঙ্ক্ষার কথা। আর একই সাথে মুরাকামি মানেই নিত্যনতুন সঙ্গীতের খোঁজ পাওয়া; আর সে সঙ্গীতে বিষণ্ণতার সুর থাকে যা যে কোন মানুষের অন্তরকে ছুঁয়ে যাবেই।
উপন্যাসের ধারাবাহিকতায় কিছু জায়গায় পাঠকের ধৈর্যচ্যুতি ঘটতে পারে কথোপকথনের কারণে। বিশেষ করে সুমিরে আর গল্প কথকের কথোপকথনে। কিন্তু উপন্যাস শেষে পাঠক বুঝতে পারবে আদতে অর্থহীন মনে হলেও কথোপকথনগুলো কতটা অর্থপূর্ণ। যদিও কিছুক্ষেত্রে যৌনতার বিবরণ পাঠককে বিব্রত করতে পারে, তবে তা অবশ্যই উপন্যাসের স্বার্থেই বিবৃতি করা হয়েছে। পাঠক উপন্যাসে বাস্তব প্রেক্ষাপট থেকে রহস্যময় আর অদ্ভুত পরাবাস্তবের স্বাদ গ্রহণ করে কখন যে আবার বাস্তবে ফিরে আসবে তা সে ঘুণাক্ষরেও টের পাবে না। কেবল উপন্যাস শেষে একরাশ মুগ্ধতা, শূন্যতা আর বিষণ্ণতায় মনটা কেমন ভারী হয়ে উঠবে।
উপন্যাস শেষে হয়তো মুরাকামির মতো আপনিও ভাববেন সেই অসীম মহাশূন্যের ভেতর লাইকার কেমন অনুভূতি হয়েছিল? শূন্যতার আরো গভীরে কি শূন্যতাই থাকে? নাকি নিঃসঙ্গতা আর একাকীত্ব মিলে শূন্যতাকে রূপ দেয়? লাইকা কী ভেবেছিল তা কেবল লাইকাই জানে! যেমনটা মুরাকামি জানে তিনি কী ভেবেছেন!! আর উপন্যাস পড়া শেষে আপনিও জানতে পারবেন আপনি কী ভাবছেন।
বইয়ের বাছাইকৃত কিছু উক্তি
- একা থাকার ব্যাপারটা আসলে ভয়াবহ একটা একাকী ব্যাপার। -হারুকি মুরাকামি
- সব গল্প বলার একটা সময় আছে। নাহলে আপনি আপনার ভেতরের গোপনীয়তার কাছে চিরবন্দী হয়ে থেকে যাবেন। -হারুকি মুরাকামি
- আমি অতীতে জীবিত ছিলাম, আর এখনও জীবিত আছি, এখানে বসে তোমার সাথে কথা বলছি। কিন্তু যাকে তুমি দেখতে পাচ্ছ সে আসল আমি নই। আমি যা ছিলাম তার একটা ছায়া মাত্র। তুমি সত্যি সত্যি জীবিত, কিন্তু আমি নই। এমনকি এখন আমি যেসব কথা বলছি সেগুলোও খালি শোনাচ্ছে, যেন প্রতিধ্বনির মতো। -হারুকি মুরাকামি
- আমাদের প্রত্যেকের মধ্যেই বিশেষ কিছু একটা থাকে যা আমরা শুধুমাত্র জীবনের একটা বিশেষ সময়ে পেতে পারি। ছোট একটা অগ্নিশিখার মতো। একজন সাবধানী লোক, ভাগ্যবান কেউ কেউ ঐ শিখাটাকে যত্ন করে বাড়িয়ে তুলতে পারে। চলার পথে একটা মশাল হিসেবে ব্যবহার করতে পারে। কিন্তু একবার শিখাটা নিভে গেলে, সারাজীবনের জন্য তা শেষ। -হারুকি মুরাকামি
- তো এইভাবে আমরা আমাদের জীবন চালিয়ে যাই। ক্ষত যত গভীর আর যত ভয়াবহ হোক না কেন, আমাদের থেকে গুরুত্বপূর্ণ জিনিস চুরি করে নেয়া হোক না কেন-আমাদের হাত থেকে ছিনিয়ে নেয়া হোক না কেন-এমনকি আমাদেরকে যদি পুরোপুরি অন্য মানুষে বদলে ফেলা হয় যার বাইরে আগের চামড়াটাই আছে, তারপরও আমরা আমাদের জীবন এভাবে নীরবে চালিয়ে যাই। আমরা আমাদের জন্য বরাদ্দ সময়ের বিস্তৃতি আগের চেয়েও কাছে টেনে আনি, পেছনে পড়ে গেলে বিদায় জানাই। বারবার, কখনো কখনো নিপুণভাবে, করে যাই প্রতিদিনের অসীম পরিমাণ কাজ। পেছনে ফেলে যাই অপরিসীম শূন্যতার অনুভূতি। -হারুকি মুরাকামি
এই লিংকে আলোচ্য বইটি ছাড়াও হারুকি মুরাকামির সকল বই পাবেন আপনারা।
বই ও সিনেমা সম্পর্কিত চমৎকার সব রিভিউ আমাদের সাথে লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: https://roar.media/contribute/