“দক্ষিণ আমেরিকা এবং ক্যারিবীয় অঞ্চলের অস্তিত্ব না থাকলেও এই উপন্যাস থেকেই তা সৃষ্টি করা সম্ভব হতো ” – ফ্রেড ডা’অগিয়ার, গার্ডিয়ান
উপন্যাস মাত্রই একটা জগৎ সৃষ্টির প্রচেষ্টা। কখনো বাস্তবের অনুকরণে, কখনো পুরোটাই কল্পনার আশ্রয়ে। এই ক্ষেত্রে মাকোন্দো ব্যতিক্রম। আদতে মাকোন্দো গ্রাম না, স্বতন্ত্র এক পৃথিবী; যা লৌকিক এবং অলৌকিকের ব্যবধান ভেঙে নিয়ে যায় ভিন্ন বাস্তবতায়। মহাকাব্যিক ধাঁচে একটা বংশের আদ্যোপান্ত বিবরণ, সময় সম্পর্কে ধারণা, ল্যাটিন আমেরিকার ইতিহাস এবং সেই সাথে জাদু-বাস্তবতার চমকপ্রদ প্রয়োগের উদাহরণ মাকোন্দোর আখ্যান।
উত্তর আমেরিকা এবং ইউরোপের সাহিত্যে আধুনিকতা এবং কিউবায় ভ্যানগার্ডিয়া শিল্প-আন্দোলনের অনুপ্রেরণা ছিল এই উপন্যাস। মূলত এটিই নোবেল এনে দিয়েছে গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেসকে (১৯২৭-২০১৪ খ্রি.)। শুধু গত শতাব্দীর নয়, বিশ্বসাহিত্যের ইতিবৃত্তে মার্কেসের এই সৃষ্টি একটি মাইলফলক।
১৯৬৭ সালে স্প্যানিশ ভাষায় লিখিত বইটির নাম “Cien Anos de Soledad” যা তিন বছর পরেই ১৯৭০ সালে ইংরেজিতে One Hundred Years of Solitude নামে অনূদিত হয়। বাংলায় “নিঃসঙ্গতার একশ বছর” নামেই স্বীকৃত।
জনৈক প্রুডেনসিও আগু্ইলারের সাথে মোরগযুদ্ধে নামলেও শেষ পর্যন্ত বিবাদটা ব্যক্তিগত দিকে গড়ায়। রাগের মাথায় তাকে হত্যা করেন হোসে আর্কেদিও বুয়েন্দিয়া। কিন্তু মৃত্যুর পরেও পিছু ছাড়ে না প্রুডেনসিও। শেষ পর্যন্ত ভিটেমাটি ছেড়ে পরিবার নিয়ে থিতু হন নদী পাশের জনহীন এক গ্রাম মাকোন্দোতে। সেই থেকে পরিচিত পৃথিবীর সাথে যোগাযোগহীন জঙ্গলাকীর্ণ স্থানে বুয়েন্দিয়া বংশের প্রতিষ্ঠা।
হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়া এবং স্ত্রী উরসিলা ইগুয়ারান দিয়েই শুরু। তারপর পরবর্তী ছয় প্রজন্ম ধরে বসবাস মাকোন্দোতে। নাম আর চারিত্রিক সাদৃশ্য অনেকটা দ্বিধায় ফেলে দেবার মতো হলেও পেছনে আছে গভীর তাৎপর্য এবং রহস্য। লেখকের চোখে দেখলে, প্রজন্মের ব্যবধানে মানুষের ভেতরে বাস্তবিক অর্থে বড় কোনো পরিবর্তন আসে না। ঘুরে-ফিরে আসে আদিম স্বভাবগুলোর পুনরাবৃত্তি।
জিপসিরা মাঝে মাঝেই আগমন করে মাকোন্দাতে। সাথে নিয়ে আসে বাইরের পৃথিবীর বিভিন্ন প্রযুক্তি। মেধাবী, কৌতূহলী এবং বুদ্ধিমান হোসে আর্কাদিও তা সাগ্রহে গ্রহণ করে, সেই সাথে চর্চা করে আলকেমি। তৈরি করে সোনার মাছ। তার বৈশিষ্ট্য প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বাহিত হয়েছে পতন পর্যন্ত।
রহস্যময় জিপসি মেলকিয়াদেস হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার হাতে একটা পাণ্ডুলিপি তুলে দেয়। বস্তুত তা ছিল বুয়েন্দিয়া বংশের আদ্যোপান্ত বিবরণ। আমৃত্যু চেষ্টা করেও তার পাঠোদ্ধার করতে পারেননি তিনি। দুই পুত্রের মধ্যে হোসে আর্কাদিও লাভ করে তার শারীরিক সক্ষমতা আর উদ্দামতা এবং অরেলিয়ানো পায় আধ্যাত্মিক মনোযোগ। ঘটনা বিস্তৃত হয়েছে এভাবেই।
সময় নিয়ে অভিনব এক খেলা খেলেছেন মার্কেস। অতীত, বর্তমান আর ভবিষ্যৎ যেন হাত ধরাধরি করে এগিয়ে গেছে। বিশেষ করে ভবিষ্যতে ঘটবে বলে কিছু কথা এমনভাবে বর্ণনা করেছেন, যেন অতীতের প্রত্যক্ষ ঘটনার মতোই সেগুলো নিশ্চিত।‘বহু বছর পর ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়িয়ে কর্নেল অরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার মনে পড়বে সেই বিকেলের কথা; যেদিন তাকে সঙ্গে নিয়ে বরফ আবিষ্কার করেছিল তার বাবা’– উপন্যাসের প্রথম লাইনটার মতো এমন অভিব্যক্তি তাই খুব সাধারণ।
রক্ষণশীল এবং উদারপন্থীদের মধ্যকার সংঘর্ষ, গৃহযুদ্ধ, নিদ্রাহীনতার মহামারী কিংবা দীর্ঘদিনব্যাপী বৃষ্টিপাত ধাপে ধাপে উঠে বুননের মতো। অরেলিয়ানো উদারপন্থী দলে গিয়ে কর্নেল অরেলিয়ানোতে পরিণত হলেন; তুখোড় আর বিখ্যাত বিদ্রোহী যোদ্ধা। তবে শেষ বয়সে ফিরে গেলেন ঘরে সোনার মাছ তৈরিতে। মগ্ন থাকলেন ফায়ারিং স্কোয়াডে যাবার আগে পর্যন্ত। ধীরে ধীরে মাকোন্দো একটি রূপকথার গ্রাম থেকে পরিণত হয় কোলাহলপূর্ণ নগরে। নিযুক্ত করা হয় নতুন মেয়র।
মোটা দাগে একশ‘র বেশি বছর জুড়ে বুয়েন্দিয়া বংশের জন্ম, মৃত্যু, প্রেম, যৌনতা কিংবা বিয়ের মতো বিষয়াদি বিবৃত হয়েছে। তাদের কেউ ছিল নিষ্ঠুর, উদ্দাম, কামুক এবং প্রায়শ পতিতার আশ্রয়মুখী। আবার কেউ ছিল শান্ত এবং নিঃসঙ্গ; বন্ধ কক্ষে সোনার মাছ তৈরি এবং প্রাচীন পাণ্ডুলিপির পাঠোদ্ধারে মগ্ন। বংশের মেয়েরাও যে স্বাভাবিক ছিল, তা নয়। কেউ মাটি খেয়ে কাটিয়েছে সময়, কেউ হঠাৎ বাগানে গিয়ে অদৃশ্য হয়ে গেছে। কেউ হাত পুড়িয়ে ফেলে ঢেকে রেখেছে কালো কাপড়ে।
প্রতিষ্ঠাতা বুদ্ধিমান হোসে আর্কাদিও বুয়েন্দিয়ার জীবনটা শেষ হয় আঙিনায় চেস্টনাট গাছের সাথে বাঁধা অবস্থায়। অনেকটা মস্তিষ্কবিকৃত হিসেবে। উরসুলা ছিল সারাটা জীবন পরিবারের প্রতি যত্নশীল। ক্রমশ দৃষ্টিশক্তি হারাতে বসা এই বৃদ্ধা প্রথমবার যে সত্য দেখতে পেলো তা হলো, তার সাবেক ব্যস্ত জীবন তাকে দেখতে দেয়নি কিছুই। তবে গোটা পরিবারকে আরো স্পষ্টভাবে বুঝতে পারা যায় পিলার তারানেরা নামক জনৈকা পতিতার চোখে দেখলে।
গ্রামে নাগরিকতার ছোঁয়া লাগে। চালু হয় নতুন ট্রেন লাইন। পুঁজিবাদী ও সাম্রাজ্যবাদীরা যে সেখানে থাবা বসাবে, তা অনুমেয়। কুখ্যাত ব্যানানা ম্যাসাকারের কথা আনতেও ভুলে যাননি মার্কেস। ১৯২৮ সালের ৫ এবং ৬ই ডিসেম্বর কলম্বিয়ার সান্টা মার্টায় ইউনাইটেড ফ্রুট কোম্পানির শ্রমিকদের উপর গণহত্যা চালানো হয়। মৃত্যুর সংখ্যা ছিল প্রায় ৩,০০০। বুয়েন্দিয়া পরিবারের ইতিহাস বর্ণনায় মার্কেস ল্যাটিন আমেরিকার সত্যিকার ইতিহাসকেও এভাবে টেনে এনেছেন।
একরাশি রহস্যজনক অকালমৃত্যুর পর একদিকে বুয়েন্দিয়া পরিবারের মেয়ে আমারান্তা উরসুলা চলে যায় বাইরে পড়তে। বিয়ে করে ফেলে সেখানকার আধুনিক এক ছেলেকে। নিজের গ্রামের অগ্রগতির জন্য স্বপ্ন দেখার অভ্যাস তার। আর অন্যদিকে বুয়েন্দিয়া বাড়িতে তখন একমাত্র নিঃসঙ্গ মেধাবী পুরুষ অরেলিয়ানো। ঘরে বসে পূর্বপুরুষের মতো মেলকিয়াদেসের দেয়া পাণ্ডুলিপির পাঠোদ্ধার ও সোনার মাছ তৈরিতে বিভোর। বুয়েন্দিয়া বংশের ইতিহাস এখান থেকে বদলে যেতে পারতো। হয়তো গিয়েছিল অনেকটাই। কিন্তু নিষ্ঠুর নিয়তি আমারান্তাকে কেবল গ্রামেই টেনে আনে না, প্রেমে ফেলে অরেলিয়ানোর।
ষষ্ঠ প্রজন্মের পুরুষ অরেলিয়ানো পাণ্ডুলিপির অর্থ বের করতে পারে একসময়। শত বছর আগে মেলকিয়াদেসের লেখা পাণ্ডুলিপির। যখন সে দেখতে পায় তার সদ্যভূমিষ্ঠ শিশুটিকে মৃতাবস্থায় শুকনো থলের মতো টেনে নিয়ে যাচ্ছে পিঁপড়ারা। বিষয়টা তাকে মনে করিয়ে দেয় মেলকিয়াদেসের লেখার তাৎপর্য- ‘বংশের প্রথমজন বাঁধা রয়েছে গাছের সঙ্গে এবং শেষজন যাচ্ছে পিঁপড়ার পেটে’।
শিহরিত অরেলিয়ানোর সামনে একে একে স্পষ্ট হয় তার পূর্বপুরুষদের প্রতিটি ঘটনা আর তার সাথে মিলে যাওয়া মেলকিয়াদেসের সংস্কৃত ভাষায় লেখা ভবিষ্যদ্বাণী। প্রতিটি খুঁটিনাটি তথ্য এমনকি প্রমত্ত প্রেমের সঙ্গিনী আমারান্তা যে আসলে তার খালা- সেটাও। দেখতে পারে আশীর্বাদ আর অভিশাপে একটা বংশের উত্থান এবং পতন।
তবে সে জানাতে কোনো লাভ নেই। অরেলিয়ানোর জন্য পালানোর সমস্ত পথ বন্ধ। কথাগুলো বই থেকে তুলে দেয়াটাই সমীচীন।
“ঘরটা ছেড়ে বের হওয়া সম্ভব না। কারণ অরেলিয়ানোর ঠিক যে মুহূর্তে পার্চমেন্টের অর্থ বের করা শেষ হবে, সেই মুহূর্তেই শহরটাকে নিশ্চিহ্ন করে দেবে উষ্ণ বাতাস। মুছে দেবে মানুষের স্মৃতি থেকে। পরবর্তীকালে আর পুনরাবৃত্তি ঘটবে না ওই লেখার। কারণ নিঃসঙ্গতার একশ বছরে সাজা পাওয়া জাতিগুলোর জন্য দ্বিতীয় আর কোনো সুযোগ দেয়া হয়নি।” (পৃষ্ঠা- ৩৬৬, নিঃসঙ্গতার একশ বছর, অনুবাদ- জি এইচ হাবীব)
গল্পের শুরুটা ছিল বাহ্যিক জগত থেকে বিচ্ছিন্ন এক মাকোন্দোকে দিয়ে। মাঝখানে বিদ্রোহ, খুন, রাজনীতি, পুঁজিবাদ, প্রেম ও যৌনতা ঘটিত টানাপোড়েন, অস্তিত্ব-সংকট প্রভৃতি জড়াজড়ি করে দাঁড়িয়ে। আবার শেষটা ঠিক আগের মতোই এক নিঃসঙ্গ জনহীন বিচ্ছিন্ন মাকোন্দো।
ম্যাজিক রিয়ালিজম বা জাদু-বাস্তবতা বিশ্বসাহিত্যের আলোচিত ক্ষেত্র। এখানে লেখক চরিত্রের পরিপ্রেক্ষিতে বাস্তবতা সৃষ্টি করেন। সমাজের মানুষের চোখে অনেক ভৌতিক অভিজ্ঞতা কিংবা অলৌকিক ঘটনা থাকে। সত্য বলে বিশ্বাস ও চর্চিত হয় নানা অসংজ্ঞায়িত বিষয়াদি। জাদুবাস্তবতার লেখক সেই বাস্তবটাকে তুলে ধরেন। যে পৃথিবী শহুরে যুক্তিনির্ভর চোখে দেখা পৃথিবী থেকে আলাদা।
অর্থাৎ জাদুবাস্তবতা অন্যান্য উপাখ্যান কিংবা সায়েন্স ফিকশনের মতো ধারণা বা সম্ভাব্যতা নির্ভর নয়। অন্য চোখে পৃথিবী দেখার প্রচেষ্টা বা অভিজ্ঞতা। যেখানে লৌকিক আর অলৌকিকের মধ্যে ফারাক নেই। গোড়াতে ল্যাটিন আমেরিকায় এই ধারার ঝোঁক থাকলেও তা আন্তর্জাতিক মহলে এর খ্যাতি ছড়িয়ে যায় দ্রুতই। মার্কেসের “নিঃসঙ্গতার একশ বছর” তার সফলতম প্রয়াস।
চল্লিশের বেশি ভাষায় অনূদিত হওয়া বই One Hundred Years of Solitude। বিশ্বসাহিত্যে যেভাবে নতুন দিক উন্মোচন করে দিয়েছে, সাহিত্যিকদের যেভাবে ভাবিয়েছে; তার তুলনা বিরল। নিউ ইয়র্ক টাইমস্-এ উইলিয়াম কেনেডি খুব সম্ভবত সবচেয়ে সঠিক কথাটাই বলেছেন,
“বুক অব জেনেসিসের পরে প্রথম সাহিত্যিক মাস্টারপিস, যা সমগ্র মানবজাতির পাঠ করা উচিত।”
বই: One Hundred Years of Solitude || লেখক : গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস || অনলাইন প্রাপ্তিস্থান: রকমারি.কম