
গোপন বিষয়ের প্রতি মানুষের আকর্ষণ চিরকালের। আর সে কারণেই ইলুমিনাতি, ফ্রিম্যাসনরি, নাইটস টেম্পলারসহ বিভিন্ন গুপ্ত সংগঠনের প্রতিও মানুষের আকর্ষণ সহজাত। কিন্তু কোনো বিষয় গোপন হলে যে সমস্যাটা হয়, নির্ভরযোগ্য তথ্যের অপ্রাতুলতার সুযোগে জন্ম নেয় ষড়যন্ত্র তত্ত্ব, ডালপালা মেলে গুজব। আর তার প্রতিক্রিয়ায় অনেকে যেটুকু নির্ভরযোগ্য তথ্য আছে, সেটুকুও বিশ্বাস করতে অনীহা প্রকাশ করে। ফলে তৈরি হয় দুই প্রান্তিক অবস্থান।
এর থেকে মুক্তির উপায় কী? নিঃসন্দেহে তথ্য অনুসন্ধান এবং গবেষণা। গুপ্তগোষ্ঠী ফ্রিম্যাসনরিদেরকে নিয়ে ঠিক এ কাজটিই করেছেন গবেষক ড. মো. আদনান আরিফ সালিম, তার ‘ফ্রিম্যাসনারি’ বইয়ে।
ফ্রিম্যাসনরি হচ্ছে মূলত রাজমিস্ত্রিদের একটি ভ্রাতৃসংগঠন, যারা বিভিন্ন রীতিনীতি পালন করে। তারা বিভিন্ন গোপন চিহ্ন এবং প্রতীক ব্যবহার করে এবং এসবের মাধ্যমে একে অপরকে চিনতে পারে। তাদের সদস্যপদের বিভিন্ন ধাপ আছে এবং উপরের দিকের পদের রীতিনীতিগুলো তারা নিচের দিকের সদস্যদের কাছ থেকে গোপন রাখে।
ফ্রিম্যাসনরিদেরকে সেই অর্থে গুপ্তগোষ্ঠী বলাটা একটু কঠিন। কারণ তাদের অস্তিত্ব পুরোপুরি গোপন না। বিভিন্ন দেশে প্রকাশ্যেই তাদের বিচরণ আছে। কিন্তু তাদের উদ্দেশ্য এবং কার্যক্রম কিছু কিছু ক্ষেত্রে গোপন এবং সন্দেহজনক। বিশ্বের অনেক দেশেই তাই তাদের কার্যক্রম নিষিদ্ধ হয়েছে। বিশ্বের অনেক অঘটনের পেছনে তাদেরকে দায়ী করা হয়েছে। কারা এই ফ্রিম্যাসনরিরা, তাদের উৎপত্তি কোথা থেকে, তাদের বিস্তৃতি কতটুকু, জায়নিজমের সাথে তাদের সম্পর্ক কী, দেশে দেশে মুসলমানদের সাথে তাদের বৈরিতার কারণ কী, এসব নানান প্রশ্নের উত্তর পাওয়া যাবে ‘ফ্রিম্যাসনারি’ বইটিতে।

বইটির লেখক ড. মো. আদনান আরিফ সালিম নিজে একজন গবেষক, ইতিহাসবিদ। বাংলাদেশ উন্মুক্ত বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতিহাসের সহকারী অধ্যাপক তিনি। পত্রপত্রিকার মাধ্যমে ২০০০ সাল থেকে লেখালেখি শুরু হলেও অনলাইনে কমিউনিটি ব্লগে, নিজের ওয়েবসাইটে এবং ফেসবুকে লেখালেখির জন্যও তিনি পরিচিত। অনলাইনে অবশ্য তিনি সালিম অর্ণব নামেই বেশি পরিচিত। ফ্রিম্যাসনরিদের মতো নির্মাণকার্যের সাথে যুক্ত একটি গুপ্তগোষ্ঠীকে নিয়ে ইতিহাসের একজন সহকারী অধ্যাপক বই লিখতে আগ্রহী হবেন, তাতে আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই।
বইটির পাতায় পাতায় এ বিষয়ে লেখকের গবেষণা এবং অক্লান্ত পরিশ্রমের প্রমাণ মেলে। যে বিপুল পরিমাণ তথ্য তিনি ২৬৪ পৃষ্ঠার বইটিতে উপস্থাপন করেছেন, এবং প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে সহায়ক তথ্যসূত্র ও টিকা হিসেবে যে বিশাল তালিকা দিয়েছেন, তাতে বুঝতে কষ্ট হয় না এ ব্যাপারে তিনি নিজে কত বেশি ঘাঁটাঘাঁটি করেছেন। কিছু কিছু জায়গায় বইটিকে অতিরিক্ত তথ্যের ভারে ভারি মনে হতে পারে, কিন্তু লেখকের সহজ-সরল, গতিশীল বর্ণনাভঙ্গির কারণে পড়তে মোটেও বিরক্তি আসে না।
বইটিতে মোট দশটি অধ্যায় আছে। এরমধ্যে সবচেয়ে আকর্ষণীয় একটি অধ্যায়ের শিরোনাম হচ্ছে ‘বাংলাদেশে ফ্রিম্যাসনারি’। বাংলাদেশেও যে একসময় প্রকাশ্যে ফ্রিম্যাসনদের অস্তিত্ব ছিল, নিজেদের নামে তাদের লজ ছিল, এবং বাংলাদেশে তাদের বিভিন্ন কার্যক্রমের কথা, গুরুত্বপূর্ণ সদস্যদের কথা যে খোদ বিদেশীদের রচিত একাধিক বইয়ে উঠে এসেছে, এই তথ্য অনেক সাধারণ পাঠককেই ধাক্কা দিতে পারে। বাংলাদেশে ফ্রিম্যাসনদের অস্তিত্বের সন্ধান খুঁজে বের করার জন্য লেখক যে পরিমাণ গবেষণা করেছেন, বিভিন্ন স্থানে গিয়েছেন বা সম্ভাব্য ফ্রিম্যাসনদের খোঁজে নির্মাণ শ্রমিকদের সাথে কথা বলেছেন, তা পাঠকদেরকে মুগ্ধ করতে বাধ্য হবে।

‘ফ্রিম্যাসনারি’ বইটি পূর্ণাঙ্গ একক বই হিসেবে ড. সালিমের প্রথম বই। তবে বইটি প্রথমে তিনি রচনা করেছিলেন স্নাতক দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী থাকার সময়। এবার তিনি সেটিরই দ্বিতীয় সংস্করণ নিয়ে হাজির হয়েছেন। তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন, প্রথমবার রচনার সময় জ্ঞান এবং অভিজ্ঞতার সীমাবদ্ধতার কারণে বইটিতে প্রচুর ভুল এবং অপ্রমাণিত তথ্যের ভিত্তিতে গৃহীত অনুসিদ্ধান্ত রয়ে গিয়েছিল। আর সেজন্য এবার তিনি বইটিকে আমূল পাল্টে ফেলে নতুন করে পাঠকদের সামনে হাজির করেছেন।
অবশ্য এবারও বইটিতে সমালোচনার উপাদান খুঁজে পাওয়া সম্ভব। প্রথমত, বইটিতে প্রচুর ইংরেজি উক্তি অনুবাদ না করে সরাসরি উদ্ধৃত করা হয়েছে। ফলে যাদের ইংরেজিতে দক্ষতা কম, তারা বইটি পড়লেও এর সবচেয়ে মূল্যবান অংশগুলোরই অর্থ বুঝতে পারবেন না। দ্বিতীয়ত, বইটিতে তথ্য বিন্যাসে আরেকটু চিন্তাভাবনার অবকাশ ছিল। বইটি শুরু হয়েছে চমৎকারভাবে, কোনো সন্দেহ নেই। এতে প্রচুর গুরুত্বপূর্ণ তথ্যও আছে, কিন্তু ফ্রিম্যাসনরিরা কারা, তাদের উদ্দেশ্য কী, এই বিষয়ে পরিষ্কার ধারণা পেতে পাঠককে অপেক্ষা করতে হবে চতুর্থ অধ্যায় পর্যন্ত। যারা ফ্রিম্যাসনরিদের সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ, তাদের জন্য এই অভিজ্ঞতা অস্বস্তিকর হতে পারে।
বইটিতে লেখকের অবস্থান কিছুটা ষড়যন্ত্র তত্ত্বের পক্ষে বলেও মনে হতে পারে। লেখক অবশ্য একেবারে শেষে গিয়ে ষড়যন্ত্র তত্ত্বের ব্যাপারে পুরো একটি অধ্যায় রচনা করেছেন। কিন্তু এর আগে প্রতিটি অধ্যায়ের ভেতরে কোনো বিখ্যাত ব্যক্তি ফ্রিম্যাসনরি কিনা, অথবা কোনো নির্দিষ্ট কর্ম ফ্রিম্যাসনরিদের দ্বারা সম্পাদিত হয়েছিল কিনা, এগুলো বর্ণনা করা সময় তিনি কোথায় “মনে হয়”, “সম্ভবত”, “ধারণা করা করা হয়” জাতীয় শব্দগুলো ব্যবহার করেছেন, আর কোথায় নিশ্চিতভাবে তথ্য-প্রমাণ দিয়ে বক্তব্য উপস্থাপন করেছেন, এ ব্যাপারে সচেতন পাঠককে লক্ষ্য রাখতে হবে।

বইটিতে অনেক বইপত্র থেকে প্রচুর তথ্য উল্লেখ করা হয়েছে। কিছু কিছু ক্ষেত্রে অবশ্য এটাকে একটু অতিরিক্ত বলেও মনে হতে পারে। যেমন ফ্রিম্যাসনরি সম্পর্কিত কয়েক ডজন চলচ্চিত্রের নাম, তাদের পরিচালক ও কলাকুশলীর নামসহ উল্লেখ করার এবং পোস্টার সংযুক্ত করে দেওয়ার সার্থকতা কতটুকু, সে প্রশ্ন পাঠকের মনে উঠতেই পারে।
প্রতিটি অধ্যায়ের শেষে রেফারেন্স হিসেবে অনেকগুলো বই এবং জার্নালের নাম দেওয়া হয়েছে। কিন্তু অধ্যায়গুলোর ভেতরে প্রতিটি তথ্য কোন রেফারেন্স থেকে নেওয়া হয়েছে, সেটা পরিষ্কার করা হয়নি। যে পরিমাণ তথ্য বইটিতে আছে, তাতে এটি নতুন পাঠকদের জন্য ছোটখাট রেফারেন্স বই হিসেবে কাজে লাগতে পারত, যদি রেফারেন্সগুলো প্রচলিত নিয়ম মেনে উল্লেখ করা হতো।
তারপরেও সব মিলিয়ে ফ্রিম্যাসনরি বইটি গুরুত্বপূর্ণ। পাঠক বইটি থেকে ফ্রিম্যাসনদের উৎপত্তি, ইতিহাস, বিশ্বের বিভিন্ন দেশে তাদের কার্যক্রম, তাদের বিভিন্ন রিচুয়াল, সদস্যপদ প্রভৃতি সম্পর্কে জানতে পারবে। সেই সাথে বইয়ে সংযুক্ত ছবিগুলো থেকে চিনতে পারবে তাদের ব্যবহৃত বিভিন্ন প্রতীক এবং নকশা। জানতে পারবে জায়নিস্টদের সাথে তাদের সম্পর্কের কথা, দেশে দেশে ইসলামের সাথে তাদের বিরোধিতার কথা এবং রাজনৈতিক, সামাজিক ও ধর্মীয় ক্ষেত্রে তাদের প্রভাবের কথা।
বিশেষ করে যারা গুপ্ত সংগঠনগুলোর অস্তিত্ব কিংবা তাদের গুরুত্ব কিংবা ইতিহাসে এবং সমাজে তাদের প্রভাবের ব্যাপারে সন্দিহান, বইটি তাদেরকে নতুন করে ভাবতে বাধ্য করবে। ফ্রিম্যাসনদের সম্পর্কে বিভিন্ন ইতিহাসবিদের লেখা যতগুলো বইয়ের নাম বইটিতে স্থান পেয়েছে, বিভিন্ন মার্কিন প্রেসিডেন্টসহ বিশ্বের যত জন বিখ্যাত ব্যক্তির ফ্রিম্যাসনরির সাথে সম্পৃক্ততার কথা নিশ্চিতভাবে জানা গেছে, তা জানার পর নিতান্ত অবিশ্বাসী পাঠকও গুপ্তসংগঠনগুলোর ভূমিকাকে গুরুত্বের সাথে বিবেচনা করতে বাধ্য হবেনা। এখানেই বইটি সফল বলে বিবেচিত হবে।
‘ফ্রিম্যাসনারি’ বইটির দ্বিতীয় সংস্করণ আসছে দিব্যপ্রকাশ থেকে। অর্ডার করা যাবে সরাসরি প্রকাশনী থেকে, বাতিঘর থেকে বা পূর্বাশা ডট কম থেকে।