প্রেম আর বিরহের চিরন্তন রূপ নিয়ে যে কয়টি উপাখ্যান বিশ্বসাহিত্যে অমরত্ব লাভ করেছে, রাধা-কৃষ্ণের প্রেমকাহিনী তার মধ্যে অন্যতম। মধ্যযুগের বাংলা সাহিত্যে বিশাল একটি জায়গা দখল করে আছে এই প্রেমকাহিনী। শ্রীকৃষ্ণকীর্তন কাব্য দিয়ে শুরু, তারপর অজস্র পদাবলী রচিত হয়েছে এ প্রেমকাহিনী নিয়ে। এমনকি রাধা-কৃষ্ণের এ প্রণয়লীলা থেকে উদ্ভব হয়েছিল আলাদা ধর্ম-দর্শন। উদ্ভব ঘটেছিল বৈষ্ণব ধর্মমত ও সাহিত্য। এসব সাহিত্য বোষ্টমীরা গ্রামে গ্রামে গিয়ে পড়ে শোনাত সাধারণ মানুষদের।
সেসময় গদ্যের প্রচলন ছিল না। কবিতার ছন্দে মনে রাখা হতো এসব কাহিনী। আধুনিক যুগে এসে কাব্যের সিংহাসনে ভাগ বসিয়েছে গদ্য, উপন্যাস। কিন্তু প্রেমকাহিনী হিসেবে রাধা-কৃষ্ণের আবেদন কমেনি মোটেও। সে কারণেই একবিংশ শতাব্দীর শেষার্ধের একজন পুরোদস্তুর আধুনিক সাহিত্যিক হয়েও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় রাধা-কৃষ্ণের প্রেম নিয়ে লিখেছেন আধুনিক উপন্যাস- ‘রাধাকৃষ্ণ’।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের পৌরাণিক তিনটি উপন্যাস সংকলনের প্রথম উপন্যাস ‘শকুন্তলা’। এ সংকলনের দ্বিতীয় উপন্যাস হলো এই রাধাকৃষ্ণ। রাধা ও কৃষ্ণের প্রেমকাহিনীর পৌরাণিক প্রেক্ষাপটে একটু চোখ বুলিয়েই আমরা প্রবেশ করব এই উপন্যাসের আলোচনায়।
উত্তর ভারতের একটি বিখ্যাত শহর মাথুরা। পৌরাণিক যুগে এ শহরে কংস নামক একজন অত্যাচারী রাজা ছিল। কংসের মা ছিলেন মাথুরার রানী পদ্মাবতী। কিন্তু তার পিতা ছিল একজন রাক্ষস। সে কারণে কংসের চরিত্রের মধ্যে হিংস্রতার দিকটি ছিল স্বভাবজাত। দেবকী নামে কংসের একজন বৈপিত্রেয় বোন ছিল। পরিণত বয়সে সে বোনের সাথে বাসুদেব নামক এক ব্যক্তির বিবাহ হয়। বোনের বিবাহ অনুষ্ঠানে কংস এক দৈবীবাণী শুনতে পায়, যাতে বলা হয়- দেবকী ও বাসুদেবের কোনো এক সন্তান রাজা কংসকে হত্যা করে মাথুরার রাজা হবে। কংস এ দৈববাণী শুনেই দেবকী-বাসুদেব দম্পতিকে জেলে বন্দী করে।
জেলে থাকাকালে এ দম্পতির ঔরসে ছয়টি সন্তান জন্ম নেয়। এদের প্রত্যেককে কংস হত্যা করে। কিন্তু সপ্তম সন্তান বলরাম এবং অষ্টম সন্তান কৃষ্ণ দৈব সহায়তায় কংসের হাত থেকে রক্ষা পায়। এর মধ্যে জন্মের রাতেই কৃষ্ণকে নিয়ে তার পিতা বাসুদেব গোপনে জেল থেকে পালিয়ে যান। তিনি কৃষ্ণকে নিয়ে মাথুরা থেকে প্রায় দশ ক্রোশ দূরে গোকুল নামক একটি গ্রামে যান। গোকুলে বাস করতো নন্দ ও যশোমতীর নামক এক গোয়াল দম্পতি। কাকতালীয়ভাবে সেই রাতে নন্দ ও যশোমতীর ঘরে একটি কন্যা সন্তান জন্ম নেয়। বাসুদেব গোপনে সেই কন্যাকে সরিয়ে তার স্থলে কৃষ্ণকে রেখে আবার জেলে ফিরে আসেন। সুতরাং নন্দ ও যশোমতী কৃষ্ণকে নিজেদের সন্তান মনে করেই লালন পালন করতে থাকেন।
রাজা কংসের অত্যাচার থেকে গোকুল গ্রামটিও মুক্ত ছিল না। ফলে কৃষ্ণকে নিয়ে নন্দ ও যশোমতী একসময় গোকুল ছাড়তে বাধ্য হয়। তারা স্থায়ী হয় গোকুলের পাঁচ ক্রোশ উত্তরে বৃন্দাবনে। আর এ বৃন্দাবনেই ধীরে ধীরে বেড়ে উঠতে থাকে কৃষ্ণ। শৈশব-কৈশোর হয়ে যৌবনে পদার্পণ পর্যন্ত বৃন্দাবনে দুরন্ত সময় কাটছিল কৃষ্ণের। গ্রাম থেকে গ্রামে ছুটে বেড়ানো, যমুনায় দাপাদাপি, বন্ধুদের সাথে মল্লযুদ্ধ আর দুর্দান্ত রাখালিপনা; এসব করেই বৃন্দাবনে সময় কাটে তার।
এসবের মধ্যে একদিন কৃষ্ণের সাথে দেখা হয় রাধা নামক এক বিবাহিত নারীর। প্রথম দেখাতেই রাধার প্রেমে মাতোয়ারা হয়ে যায় কৃষ্ণ। রাধার প্রেম আমূল বদলে দেয় কৃষ্ণকে। দুঃসাহসিক রাখালের খোলস ছেড়ে কৃষ্ণ হয়ে ওঠে এক চঞ্চল প্রেমিক। তারপর প্রেম নিবেদন, প্রত্যাখান, সমর্পণ, প্রণয়— যেসব নিয়ে তৈরি হয় কিংবদন্তি রাধা-কৃষ্ণের প্রেম কাহিনী।
‘গাছগুলোর মাথায় এসে পড়েছে প্রথম সূর্যের আলো, কিন্তু নিচে এখনো অন্ধকার। রাতের ঘুম এখনো ভাঙেনি, বাগানে শিশিরভেজা কুসুমকলি সবেমাত্র ফুটি ফুটি করছে… এই সময় দূরে শোনা গেল ঘোড়ার ক্ষুরের শব্দ। সে শব্দে ঘুম ভেঙে গেল যশোমতীর….পক্ষিমাতার মত প্রায় ছোঁ দিয়ে সে ছেলেকে বুকে তুলে নিল।’ এমন একটি টানটান উত্তেজনাকর মুহূর্তের বর্ণনার মাধ্যমে শুরু হয় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের রাধাকৃষ্ণ উপন্যাসের কাহিনী।
আগেই যেমনটি বলা হয়েছে। এখানে, যশোমতী গোকুল গ্রামের গোয়াল নন্দের স্ত্রী, কৃষ্ণের পালক মা। রাজা কংসের হাত থেকে কৃষ্ণকে বাঁচানোর রুদ্ধশ্বাস প্রচেষ্টা থেকেই শুরু হয় রাধাকৃষ্ণ উপন্যাসের প্রথম নাটকীয়তা। এখানে প্রথমে মুখ্য হয়ে উঠে তিনটি চরিত্র— যশোমতী, নন্দ, কৃষ্ণ। এ অংশে কিছুটা আঁধারে থেকেই আবির্ভাব ঘটে রাধা চরিত্রের। সাথে সাথে কংসও। এরপর ধীরে ধীরে গল্পের প্রয়োজনে আবির্ভাব ঘটে আরো নানা চরিত্র। পেখম মেলতে থাকে রাধা— পরিচয়ে, রূপে, লাবণ্যে। কংসের রহস্য অবশ্য উন্মোচিত হয় আরো পরে, উপন্যাসের শেষ দিকে গিয়ে।
‘গোকুল ত্যাগ করে চলে এসেছে নন্দ আর তার আত্মীয়, পরিজন, প্রতিবেশী। বৃন্দাবনে গড়ে উঠেছে নতুন আভীরপল্লী। কংসের সৈন্যদের উপদ্রবও কমেছে অনেকটা… একটু বড় হয়েছে কানু।’
বৃন্দাবনে কৃষ্ণ কানু নামেই বড় হতে থাকে। দুরন্তপনা আর চাঞ্চল্যে ভরা এ কানু চরিত্র। ছোটবেলা থেকে গো-চারণকে পেশা হিসেবে গ্রহণ করলেও বন্ধুদের সাথে খেলাধুলা, দৌড়ঝাঁপ, লড়াই নিয়ে সদা ব্যস্ত থাকে সে। ধর্ম-কর্মের কোনো ধার সে ধারে না। বৃন্দাবন আর যমুনা নদী যেন কানুর প্রথম লীলাক্ষেত্রে। ‘কৈশোর ছাড়িয়ে কানু এখন সদ্য যৌবনে পা দিয়েছে। অফুরন্ত প্রাণশক্তিতে সে এখন ছটফটিয়ে মরে। ব্রজ-বৃন্দাবনের সব মানুষ এখন দুর্দান্ত-দুঃসাহসী হিসেবে কানুকে এক নামে চেনে।’
তারপর একদিন কানুর সাথে দেখা হয় রাধার। বৃন্দাবনের বিখ্যাত গোয়াল আয়ান ঘোষের স্ত্রী রাধা। রাধাকে দেখার পরের সময় থেকে উপন্যাসে কানু চরিত্রটি শৈশবিক চাঞ্চল্য ছেড়ে প্রবেশ করে যৌবনের অস্থিরতায়। রাধার প্রেমে নেশাতুর কানু শুরু করে একের পর এক প্রথা-ভাংগা কর্মকাণ্ড। এসবে দিশেহারা রাধার করুণ অবস্থা দারুণ নাটকীয়তায় ফুটে উঠেছে উপন্যাসে। মাথুরার হাটে যাওয়ার পথ, খেয়াপারের নৌকা, যমুনার ঘাট, বৃন্দাবনের নিবিড় অরণ্য; রাধা ও কৃষ্ণের প্রেমের প্রতিটি ক্ষেত্রকে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় বেঁধেছেন মোহনীয় সুতোয়।
রাধার সাথে প্রণয় আর বিরহের দোলাচালে বহমান সময়ে একদিন কানু জানতে পারে তার আসল পরিচয়। এরপর শুরু হয় কানুর কৃষ্ণ হয়ে ওঠার গল্প, তৈরি হয় তার রাজা হয়ে ওঠার মঞ্চ। শুরু হয় রাধার চিরবিরহ।‘প্রতি পূর্ণিমার রাতে রাধা সাজতে বসে। তারপর চুপি চুপি চলে যায় যমুনার তীরে। তমাল গাছের নীচে দীপ জ্বেলে দাঁড়িয়ে থাকে। সে আসবে বলে কথা দিয়েছিল, তাই রাধাকে যে অপেক্ষায় থাকতেই হবে।’ কিন্তু রাধার এ বিরহ কি শেষ হবে কখনো?
হিন্দু ধর্মমতে- কৃষ্ণ পরমাত্মা। সেই হিসেবে রাধার সাথে কৃষ্ণের মিলনকে পরমাত্মার সাথে মানবাত্মার মিল হিসেবে দেখা হয়। কিন্তু সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় রাধাকৃষ্ণ উপন্যাসে রাধার সাথে কৃষ্ণের প্রেমকে নিতান্ত মানবিক অনুভূতির স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ হিসেবে দেখিয়েছেন। আয়ান ঘোষের স্ত্রী হয়েও অবহেলার শিকার রাধা। আদিম মানবিক তাড়না থেকেই তিনি কৃষ্ণের প্রেমে মজেছিলেন। উপন্যাসজুড়ে কৃষ্ণের প্রেম নিবেদন কিংবা রাধাকে জয় করার প্রাণান্তকর চেষ্টার মাঝে কোনো দৈব অনুঘটক ছিল না। আর সেই কারণেই মধ্যযুগের রাধা-কৃষ্ণের প্রেমকাহিনী দৈবগণ্ডি ছেড়ে সুনীলের রাধাকৃষ্ণ উপন্যাসে অনেক বেশি বাস্তবিক হয়ে উঠেছে। যদিও সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এই উপন্যাস রচনার ক্ষেত্রে মধ্যযুগের সাহিত্যিক উপকরণ থেকেই কাহিনী বিন্যাস ধার নিয়েছেন।
লেখক নিজেই যেমনটি বলেছেন, “এই কাহিনী রচনায় ভাগবত, শ্রীকৃষ্ণকীর্তন, চণ্ডীদাস, বিদ্যাপতি, পদাবলী, দীনেশচন্দ্র সেনের রচনাবলি থেকে প্রভূত উপকরণ গ্রহণ করা হয়েছে।” যদিও উপন্যাসের ভাব, ভাষাশৈলী ও উপমায় সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় ছিলেন বরাবরের মতোই পার্থিব, দৈবিক নয়।