১
তারেক মাসুদ ছিলেন শৈল্পিক মনন সম্পন্ন চলচ্চিত্রকার। এমন এমন একটা সময়ে তিনি এসেছিলেন, যখন সিনেমা মানেই ‘ঢিসুম ঢিসুম, ভিশুয়া ভিশুয়া’ ধাঁচের কিছু মারামারি আর বেখাপ্পা রকম কিছু নাচানাচির সমন্বয়। ঐ সময়টায় অশ্লীলতার অবস্থান ছিল সর্বোচ্চে। বাংলা চলচ্চিত্রে এখনো এই অবস্থা রয়ে গেছে। এমন পরিবেশ থেকে সৃজনশীল কোনো সৃষ্টিকর্মের জন্ম দেয়া অনেক কঠিন। এ পরিবেশ ও সীমাবদ্ধতা পেরিয়ে যিনি ভালো মানের কোনোকিছু উপহার দিতে পারে তাকে বিপ্লবীই বলা যায়। প্রায় শত বছর ধরে এই দেশে চলচ্চিত্র নির্মিত হচ্ছে, এই লম্বা ইতিহাসে বাংলা চলচ্চিত্রকে আন্তর্জাতিক মানে নিয়ে যাবার জন্য সবচেয়ে বড় ভূমিকা রেখেছেন তারেক মাসুদ।
জীবদ্দশায় চলচ্চিত্র পরিচালকই ছিলেন, বই-টই লিখেননি বলতে গেলে। লিখলেও সেসব একক বই ছিল না। এমনিতে পত্র-পত্রিকায় চলচ্চিত্র বিষয়ক লেখা লিখতেন টুকটাক। তার জীবনের ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা, স্মৃতিকথা, চলচ্চিত্র সম্বন্ধীয় কোনো বিষয়ে তার অনুভূতি কিংবা মতামত ইত্যাদি নিয়ে সময়ে সময়ে তিনি কিছু না কিছু লিখেছেন। সেগুলোকে একত্র করে সুন্দরভাবে সাজিয়ে একটি বই করতে চেয়েছিলেন জীবদ্দশায়। কিন্তু একাধিকবার চেষ্টার পরেও আটকে থাকে বইয়ের কাজ। হয়তো ভেবেছিলেন আরো কিছুদিন গেলে তো আর কোনো সমস্যা নেই। কিন্তু কে জানতো এমন মর্মান্তিক সড়ক দুর্ঘটনায় তিনি মারা যাবেন? তার মৃত্যুর পর তার লেখা প্রবন্ধগুলোকে একত্র করে চলচ্চিত্রযাত্রা নাম দিয়ে একটি বই প্রকাশ করা হয়। তার স্ত্রী ক্যাথরিন মাসুদের তত্ত্বাবধানে এটি প্রকাশিত হয়। খুব বেশি লেখালেখি না করলেও তার ভেতরে লেখালেখি প্রোথিত ছিল। একবার বলেছিলেন “চলচ্চিত্রকার না হলে লেখক হওয়ার চেষ্টা করতাম।” এ থেকে বোঝা যায় লেখালেখির একটা সুপ্ত সত্তা সবসময়ই তার মাঝে ছিল।
২
তারেক মাসুদ ছিলেন মাদ্রাসার ছাত্র। পরিবেশ ও শিক্ষার একটা প্রভাব প্রকট বা প্রচ্ছন্নভাবে সবসময় থেকেই যায়। মাদ্রাসায় পড়া ছেলে পরবর্তীতে চলচ্চিত্রকার হয়ে যাওয়াটা সাধারণ কথা নয়। তারেক মাসুদ কোনো একভাবে প্রভাবের বলয় থেকে বেরিয়ে এসেছিলেন এবং ভালো মানের কিছু চলচ্চিত্র নির্মাণ করেছিলেন। এই শিক্ষাজীবন তার নির্মিত চলচ্চিত্রগুলোতে প্রভাব রেখেছে। তার সিনেমায় এই ব্যাপারগুলো বারবার এসেছে। নিজে মাদ্রাসার ছাত্র ছিলেন বলেই হয়তো মাদ্রাসার পরিবেশ ও বাস্তবতাকে চমৎকারভাবে ফুটিয়ে তুলতে পেরেছিলেন। মাটির ময়না চলচ্চিত্রে তার স্পষ্ট প্রতিফলন দেখা যায়। আর একটি চলচ্চিত্র নির্মাণ করতে গেলে একজন পরিচালককে কত ধরনের ঝামেলা প্রতিবন্ধকতা পেরিয়ে যেতে হয় তার কোনো ইয়ত্তা নেই। কত কিছুই না দেখতে হয়। কতকিছুই না বিবেচনা করতে হয়। কত কিছুই না সহ্য করতে হয়। তার দ্বারা নির্মিতআদম সুরত, মুক্তির গান, মাটির ময়না প্রভৃতি চলচ্চিত্র নির্মাণ করার সময় এসব ঝামেলা তাকে অতিক্রম করতে হয়েছে। এই ঝামেলাগুলোর চমৎকার বয়ান দেয়া আছে চলচ্চিত্রযাত্রা বইটিতে।
মাটির ময়না চলচ্চিত্রটি নিয়ে বড় একটি লেখা আছে তার বই চলচ্চিত্রযাত্রাতে। কত চরাই-উৎরাই পেরিয়ে, কত শ্রমের বিনিময়ে মাটির ময়না নির্মিত হয়েছে এবং ভাগ্যক্রমে কত কত জায়গায় এটি প্রশংসিত হয়েছে তার কথা-স্মৃতিকথা লিখেছেন এখানে। ২০০২ সালে এটি মুক্তি পেয়েছিল। ঐ সময় The Pianist, About Schmidt-ও মুক্তি পেয়েছিল। এই দুটি চলচ্চিত্র এখন ক্লাসিকের মর্যাদা অর্জন করেছে। মাটির ময়নাও এদের কাতারে ছিল। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিযোগিতায় এদের সাথে লড়েছিল এবং এদের মতো পুরষ্কার অর্জন করেছিল। এই অজানা কথাগুলো গ্রন্থিত আছে তার চলচ্চিত্রযাত্রা বইটিতে।
৩
বইতে লেখকের (চলচ্চিত্রকারের) কিছু ব্যক্তিগত স্মৃতিকথাও স্থান পেয়েছে। পড়লে বোঝা যায় কী দারুণ এক জীবন কাটিয়েছিলেন তারেক মাসুদ! বাণিজ্যিক চলচ্চিত্র থেকে দূরে সরে শৈল্পিক চলচ্চিত্র তৈরির পেছনে ঘুরতে ঘুরতে কত অসাধারণ মানুষের দেখা করতে পেরেছেন এবং তাদের সান্নিধ্য পেয়েছেন। এস. এম. সুলতান, আলমগীর কবির, সত্যজিৎ রায় প্রভৃতি বাঘা বাঘা ব্যক্তিত্ব। শৈল্পিক সিনেমার পেছনে লেগে না থাকলে এটা সম্ভব হতো না।
একজন পরিচালক যখন অভিমান করে নিজের দেশে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কারের জন্য নিজের বানানো সিনেমা জমাই দেন না, তখন বুঝতে হবে চলচ্চিত্র নিয়ে ঐ দেশটিতে কতটা সমস্যা লুকিয়ে আছে। পুরষ্কার প্রদান কমিটির নির্বাচনে ব্যাপক নীতিগত সমস্যা আছে। বাংলাদেশ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরষ্কার নামক জিনিসটি মনে হয় দেশের অন্য সকল ক্ষেত্রের মতোই কলুষিত। বাংলার যে সিনেমা ফ্রান্স, যুক্তরাষ্ট্র, মধ্যপ্রাচ্য সহ পুরো দুনিয়াতে সমাদৃত ও প্রশংসিত হয়, কিন্তু বাংলাদেশেই নিষিদ্ধ হয় কিংবা একটা পুরষ্কারও পায় না, তখন বুঝতে হবে সমস্যাটা আসলে অন্য জায়গায়। তারেক মাসুদ অভিমান করেছিলেন, তার জেদ ছিল, রুচির বোধ ছিল, ইগো ছিল এবং প্রত্যেকটিই তার অবস্থান থেকে যৌক্তিক।
অনেকদিন ধরে চলতে থাকা বাংলাদেশী চলচ্চিত্রের বাজে অবস্থা দেখে লেখক একদিকে যেমন হতাশার দীর্ঘশ্বাস ছেড়েছেন, তেমনই আবার মানসম্পন্ন চলচ্চিত্র নির্মাণের ব্যাপারে বেসরকারি টিভি চ্যানেলগুলোর এগিয়ে আসাতে খুব আশাবাদীও হয়েছেন। সিনেমা হলের শিল্প যেখানে ধুকে ধুকে মরছে সেখানে টিভি চ্যানেলের উদ্যোগে নির্মিত সিনেমা অন্তত কিছুটা হাল ধরতে পারবে। উল্লেখ্য, দিনের পর দিন যে কাট-পেস্ট, কপি-পেস্ট ও বস্তাপচা সিনেমা দিয়ে ঢালিউড ভরে গিয়েছিল তা থেকে উৎরানোর একটা ক্ষীণ আলোক রেখা দেখায় বেসরকারি টিভি চ্যানেল, যেমন Channel i, ATN, ntv ইত্যাদির উদ্যোগের ফলে নির্মিত সিনেমাগুলো।
লেখক আবার এই প্রক্রিয়ার কতগুলো সমস্যার কথাও বলেছেন। টিভি চ্যানেলগুলোতে নির্মিত সিনেমায় বিজ্ঞাপন থাকবেই যা সিনেমার ক্ষেত্রে দর্শকদের জন্য একদমই আয়েশজনক নয়। সিনেমায় দর্শকই আসল। দর্শকদেরই যদি ভালো সিনেমার প্রতি, সিনেমা হলে এসে ভালো সিনেমা দেখার প্রতি আগ্রহ করে তোলা না যায়, তাহলে দেশের চলচ্চিত্র শিল্প ভালো একটা অবস্থানে আসবে কী করে?
৪
এবার একটু বইয়ের নেতিবাচকতার দিকে চোখ ফেরাতে পারি। বইয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বিষয়বস্তুর উপস্থিতি আছে তা ঠিক, কিন্তু বিষয়গুলো অনেক এলোমেলো। বিভিন্ন সময়ে প্রকাশিত কতগুলো লেখাকে একত্র করে বইটি বের করেছে তো, তাই একসাথেই চলচ্চিত্রের ইতিহাস, চলচ্চিত্র সমালোচনা, নিজের স্মৃতিচারণা, অনুভূতি, চলচ্চিত্র ভাবনা এক বইয়ে ঠাই পেয়েছে। রবীন্দ্রনাথের উপন্যাস চিত্রায়নে সত্যজিৎ রায়ের কয়েকটি সিনেমাকে মূল্যায়ন করে একটি লেখা আছে, লেখাটা মানসম্পন্ন লাগেনি।
বইতে বেশ কতগুলো লেখার পুনরাবৃত্তি হয়েছে। যদিও বইয়ের প্রথমে সূচনায় ক্যাথরিন মাসুদ তা উল্লেখ করেছিলেন। কিন্তু আস্ত একটা নিবন্ধই যদি স্বল্প কিছু পার্থক্য নিয়ে রিপিট হয়, তখন সেটা ভালো দেখায় না। পাঠকের জন্য বিরক্তির কারণ হয়ে দাঁড়ায়। এক্ষেত্রে যেকোনো একটা লেখা রেখে বাকিটা ফেলে দেয়াই উত্তম। কিংবা দুটো লেখাকে মিলিয়ে একটা লেখা করে ফেললেও হয়ে যায়।
তারপর লেখক একাধিক বার বলেছেন- “সেলুলয়েডে শুটিং করলেই সেটা চলচ্চিত্র হয়ে ওঠে না। যেমন কোনো ধ্রুপদী চলচ্চিত্র টেলিভিশনে দেখালে তা টেলিফিল্ম বা নাটক হয়ে যায় না। এর জন্য টিভি নাটকের ভাষা থেকে কিছুটা ভিন্ন চলচ্চিত্রের ভাষাটির দিকেও আমাদের খেয়াল রাখা দরকার।” খুবই চমৎকার ও ওজনদার কথা। যেহেতু এই কথাটি ভাবনার জন্ম দেয়, তাই পাঠকের এই চাহিদা হতেই পারে- নাটক বা সিরিয়াল থেকে চলচ্চিত্রের ভাষা আলাদা ঠিক কীভাবে, কোন দিক থেকে? একটা ভাষায় ঠিক কী কী বৈশিষ্ট্য থাকলে তা চলচ্চিত্রের ভাষা হবার যোগ্যতা অর্জন করবে? বেশ কয়েকবার এই কথাটি বলেছেন, কিন্তু কোথাও এটা পরিষ্কার করেননি। এটার দরকার ছিল। অল্প কিছু লাইনে এক বা দুই পৃষ্ঠার মাঝেই তা পরিষ্কার করে দিতে পারতেন। তাহলে জিজ্ঞাসু পাঠক তৃপ্ত হতো।
৫
‘জাতীয় চলচ্চিত্র আর্কাইভসের ২০ বছর’ শিরোনামের প্রবন্ধে বাংলাদেশের চলচ্চিত্রের বর্তমান অবস্থা ও ভবিষ্যৎ নিয়ে এক মন খারাপ করা অনুভূতির প্রকাশ করেছেন। একটি দেশের ইতিহাসের সংরক্ষণের জন্য স্বাধীন একটি আর্কাইভ থাকা জরুরী। কখন কোন জিনিস কাজে লাগে তা বলা যায় না। আজকের একদম তুচ্ছাতিতুচ্ছ জিনিসও একসময় হয়ে যেতে পারে দারুণ মূল্যবান কোনো তথ্য। সেই লক্ষ্যে ১৯৭৮ সালের দিকে ‘জাতীয় চলচ্চিত্র আর্কাইভস’ গঠন করা হয়। প্রথম দিকে এই প্রতিষ্ঠানটি খুব ভালোও করে। কিন্তু রাজনৈতিক কারণে সরকার বদলের সাথে সাথে ধীরে ধীরে আর্কাইভসের গলার টুটি চেপে ধরা হয়। অকালে মুমূর্ষু হয় এবং ঐতিহাসিকভাবে মূল্যবান অনেক কিছু নষ্ট হয়। এই দুর্দিন থেকে বাঁচতে তিনি সরকারের কাছে স্বায়ত্ত শাসিত একটি সংস্থারও দাবী করেন। এটি নিয়ে প্রচুর আফসোস করেছেন চলচ্চিত্রযাত্রাতে। আশা-হতাশা, হাহাকার-উল্লাস ইত্যাদি সব মিলিয়ে বইটি ভালো হয়েছে।
চলচ্চিত্রযাত্রা প্রকাশের পরের বছর ২০১৩ সালে চলচ্চিত্রলেখা নামে একই প্রকাশনী থেকে আরো একটি বই প্রকাশিত হয়, যেখানে তার লেখা চিত্রনাট্য ও গান সংকলিত হয়। এমন মেধাবী একজন চলচ্চিত্রকার এত আগে মারা যাবেন, এটা মেনে নিতে বেশ কষ্ট হয়। এরকম ব্যক্তিত্বের বেঁচে থাকা উচিৎ শত শত বছর। কিছু কিছু আফসোস আছে কখনো শেষ হবার নয়, তারেক মাসুদের এভাবে চলে যাবার ঘটনাটিও সেরকমই একটি আফসোস।
ফিচার ছবি- BDNews24