ভাগ্যপূরণ কি আদৌ সম্ভব?
যদি আপনাকে বলা হয়, কীভাবে স্বপ্নে দেখা গুপ্তধন খুঁজে পাওয়া যায়, কীভাবে ভাগ্যের পথে শুন্য হাতে রওনা দিয়ে সে পথেই জীবনসঙ্গিনীকে পাওয়া যায়, তেমন কাহিনী নিয়ে একটি গল্প আছে। আপনি কি চাইবেন না গল্পটি জানতে?
এরকম একটা রূপকথার মতো গল্পের সাথে বাস্তব জীবনের মিলই বা কতটুকু, জানতে ইচ্ছা হচ্ছে না?
অথচ সে গল্পের বইটি পড়লেই দেখবেন, রূপকথা নয়, আধ্যাত্মিক ও বাস্তব জীবনের উপলব্ধি নিয়েই লেখা সেটি। বিশ্বের অন্যতম বেস্ট সেলিং সেই বইটির নাম ‘দ্য আলকেমিস্ট’, লিখেছেন ব্রাজিলিয়ান লেখক পাউলো কোয়েলহো। পাউলো কোয়েলহো যে ক’টি বই লিখেছেন, তার ভেতরে সবচেয়ে বেশি বিক্রিত ও জনপ্রিয় বই ‘দ্য আলকেমিস্ট’।
বইটির প্রকাশনা ও ব্যাপ্তি
পাওলো কোয়েলহোর এ বইটি তার দেশ ব্রাজিলে ১৯৮৮ সালে পর্তুগিজ ভাষায় প্রথম প্রকাশিত হয়। তখন এটি বেস্ট সেলিং লিস্টে না থাকলেও, পরবর্তীতে এটি আন্তর্জাতিকভাবে সর্বোচ্চ বিক্রিত বইয়ের তালিকার মধ্যে স্থান করে নেয়। ১৯৯৩ সালে ইংরেজিতে অনুবাদ হওয়া এ বইটি এখন পর্যন্ত প্রায় ৬৫ মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়েছে। বিশ্বব্যাপী বইটির বিক্রি ক্রমশ বেড়েই চলেছে এবং এখন পর্যন্ত সবচেয়ে বেশি ভাষায় অনুবাদ করা বইও এটিই।
‘দ্য আলকেমিস্ট’ এর জনপ্রিয়তার কারণ
‘দ্য আলকেমিস্ট’ বইটি সমগ্র বিশ্বে জনপ্রিয় শুধু নয়, বইটি ৬৭টি ভাষায় অনুবাদ করা হয়েছে এবং ১৮টি দেশে সর্বকালের সেরা বিক্রিত বইয়ের তালিকায় শীর্ষে রয়েছে। ‘দ্য আলকেমিস্ট’ এর অভাবনীয় এই সাফল্যের অন্যতম কারণ এর গল্পের পটভূমি। গল্পের পটভূমি নিয়ে বলতে গেলে প্রথমত আসে মেষপালক সান্টিয়াগোর প্রাত্যহিক জীবনের বর্ণনা, যা পাঠককে তাদের নিয়মিত জীবনের সাথে মেলবন্ধন তৈরি করতে সাহায্য করে। বইটির কেন্দ্রীয় বার্তাগুলির মধ্যে একটি হলো, আধ্যাত্মিক হলেই তা বাস্তবতা বিরোধী না। অর্থাৎ আধ্যাত্মিকতা বাস্তব জীবনেরই একটি অংশ, যা আমাদের জীবনকে বুঝতে আরও সহজ করে।
প্রকৃতপক্ষে, আমরা যা হৃদয় থেকে চাই বা সত্যিই কামনা করি, সেগুলো আসলে মহাবিশ্বের বার্তা। সেই ব্যক্তিই সত্যিকার অর্থে জীবিত, যে তার স্বপ্নগুলোকে বাস্তবে রূপ দেওয়ার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে।
দ্বিতীয়ত, ‘দ্য আলকেমিস্ট’ একটি সহজবোধ্য শৈলীতে বলিষ্ঠভাবে লিখিত গল্প, যা পাঠকের কাছে এর কাহিনীকে প্রাঞ্জল করে তোলে। শুধু তাই নয়, গল্পে ধর্মীয় ও নৈতিকতার যে রীতি তুলে ধরা হয়েছে, তা অনেকটা আমাদের ছোটবেলায় পড়া রূপকথার আমেজ দেয়। ফলে গল্প পড়তে পাঠক কখনো বিরক্ত হয় না। সাথে সাথে গল্পটা মানুষের জীবনদর্শনগুলোকে খুব সহজে বুঝতে সাহায্য করে। লেখক তার লেখনীতে আধ্যাত্মিকতার সাথে বাস্তবের যোগসূত্র তৈরি করে পাঠককে জীবনের বেশ কিছু দর্শন সহজে অনুধাবন করতে সাহায্য করেছেন।
‘দ্য আলকেমিস্ট’ এর জীবনদর্শন ও বিশ্লেষণ
১। Fear is a bigger obstacle than the obstacle itself
যেকোনো স্বপ্ন পূরণের জন্য সবচেয়ে বড় বাধা হলো ভয়। হয়ত স্বপ্ন পূরণের পথে যে বাধাগুলো পড়বে, সেগুলোও এতটা বড় নয় যতটা বড় সমস্যা ভয়।
প্রতিটা বড় ঝুঁকিই বড় সাফল্য বয়ে আনে- এ কথাটা সবসময় মনে রাখা উচিত। যেকোনো নতুন স্বপ্নের পথ অপরিচিত হবে ঠিকই। কিন্তু মনে রাখতে হবে, সেই পথে চলতে চলতেই অন্তরাত্মার দেখা পাওয়া যাবে।
২। What is ‘true’ will always endure
সত্য যত কঠিন আর খারাপই হোক না কেন, তাকে গ্রহণ করা শিখতে হবে। সেই সাথে এটাও মনে রাখতে হবে যে, যদি কোনো কিছু সত্যি হয়, তবে তা কখনোই অমলিন হবে না, হাওয়ায় মিলিয়ে যাবে না।
বইয়ের একটি অংশে লেখক তাই বলেছেন-
“If what one finds is made of pure matter, it will never spoil. And one can always come back. If what you had found was only a moment of light, like the explosion of a star, you would find nothing on your return.”
৩। Break the monotony
গতানুগতিকতা থেকে বিরতি নিতে হবে। জীবনের গতানুতিক ধারা থেকে বের হতে হবে।
অনেকের চোখেই জীবনের নতুনত্ব ধরা পড়ে না। তারা জীবনকে দোষারোপ করেন যার একমাত্র কারণ, তারা আসলে জীবনের প্রতি কৃতজ্ঞ নয়। কৃতজ্ঞতা মানুষের চরিত্রের এক বিশেষ গুণ যা জীবনের আশীর্বাদগুলোকে চিহ্নিত করতে সাহায্য করে এবং জীবনকে একঘেঁয়েমি থেকে মুক্তি দেয়।
৪। Embrace the present
‘দ্য আলকেমিস্ট’ বইয়ের অন্যতম একটি শিক্ষা হলো, বর্তমানে বেঁচে থাকো। জীবন একটা অনেক বড় ভ্রমণ, যেখানে প্রতিটা মানুষ একটা নির্দিষ্ট চরিত্র পালন করছে এবং কোনো চরিত্রই চিরস্থায়ী নয়।
জীবন মানেই গতিশীলতা, জীবন মানে কখনোই স্থিরতা বা স্থিতিশীলতা নয়।
৫। Your success has a ripple-effect
সফলতার একটা তারঙ্গিক পরিবর্তন আছে। যখন আপনি আপনার নিজের ভালো সংস্করণ বের করে আনার চেষ্টা করবেন, তখন দেখবেন আপনার আশেপাশের সবকিছু পরিবর্তন ভালো দিকে হচ্ছে। এই ভালো পরিবর্তন আপনার জীবনযাত্রা, বন্ধু, পরিবার সবখানে প্রতিফলিত হবে। কথাটি এভাবে বলা হয়েছে বইটিতে-
“That’s what alchemists do. They show that, when we strive to become better than we are, everything around us becomes better, too.”
৬। Make the decision
‘দ্য আলকেমিস্ট’ বইটির অন্যতম শিক্ষা হলো, সিদ্ধান্ত নিতে শেখো। নিজের স্বপ্ন বা লক্ষ্যের দিকে কেউ যদি সিদ্ধান্ত নিতে পারে, তবে সে তার স্বপ্ন পূরণের অর্ধেক পদক্ষেপ নিয়ে ফেলে। বাকি কাজ শুধু সেই পথে লেগে থাকা। আমাদের সবাইকে মনে রাখতে হবে “Actions will flow out of having confidence in your decision; sitting on the fence will get you nowhere”
বইটিতে আরো সুন্দর করে বলা আছে-
“When someone makes a decision, he is really diving into a strong current that will carry him to places he has never dreamed of when he first made the decision.”
৭। Be unrealistic
পৃথিবীতে অনেক বড় বড় আবিষ্কার হতো না, যদি সবাই খুব প্র্যাক্টিকাল চিন্তা করতো বা পৃথিবীটা যেমন আছে তেমন ভাবেই মেনে নিতো। অসাধারণ উদ্ভাবন ও অর্জন তখনই সম্ভব, যখন আপনি অসম্ভবকে উপেক্ষা করতে শিখবেন।
“I see the world in terms of what I would like to see happen, not what actually does.”
৮। Keep getting back up
‘দ্য আলকেমিস্ট’ বইটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হলো, জীবনে ঘুরে দাঁড়ানো শিখতে হবে। মনে রাখতে হবে, আপনি সাতবার না পারলেও আটবারের বার হয়তো আপনার সফলতা আসবে। এমন অনেক লেখক আছেন যাদের শত শত লেখা বাদ পড়ার পরও তারা লেখা ছাড়েননি। অনেক শিল্পী আছেন, যারা প্রতিষ্ঠিত হননি তবুও অনুশীলন করে যাচ্ছেন। কারণ জীবনে যখন সুযোগ আসবে, সেই সুযোগকে কাজে লাগাতে চাইলে তার জন্য আপনাকে তৈরি হতে হবে।
৯। Focus on your own journey
নিজের জীবন সম্পর্কে অবহিত হতে হবে, নিজের ইচ্ছা, আকাঙ্খা, চাহিদা সম্পর্কে পূর্ণ জ্ঞাত হতে হবে।
“If someone isn’t what others want them to be, the others become angry. Everyone seems to have a clear idea of how other people should lead their lives, but none about his or her own.”
অন্যের দ্বারা প্রভাবিত হওয়া খুবই সহজ। কিন্তু এটার ফলাফল খুবই ভয়ানক হবে, যদি সারাজীবন আপনি অন্য আরেকজনের জীবনযাপন করেন। অন্যের কাছ থেকে শিক্ষা বা উপদেশ নেয়ার ভেতর কোন ভুল নেই, কিন্তু তা যেন আপনার জীবনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয় সেদিকেও খেয়াল রাখতে হবে।
১০। Always take action
জীবনে যতক্ষণ শিখবেন ততক্ষণ আপনি জীবিত। আর শেখার জন্য আপনাকে সবসময় সামনে এগিয়ে গিয়ে পদক্ষেপ নিতে হবে। সবসময় মনে রাখতে হবে-
“Once you’re done aiming, pull the trigger.”
‘দ্য আলকেমিস্ট’ বইটি নিজের ভেতর এক ধরনের অনুধাবন তৈরি করে, যা জীবনের দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনে বেশ সহায়ক। বিশ্বের অনেক সফল ব্যক্তিত্ব, যেমন- বিল ক্লিনটন, জুলিয়া রবার্টস, উইল স্মিথ, ম্যাডোনা বইটি পড়ার জন্য পরামর্শ দিয়েছেন। যারা বই পড়তে ভালোবাসেন বা বইটি এখনো পড়েননি, পড়ে ফেলুন, ভালো লাগবে। তার চেয়েও বড় ব্যাপার হলো, ভালো কিছু শিখতে ও জানতে পারবেন।