ডেভিড লাওরি পরিচালিত ‘দ্য গ্রীন নাইট’ মধ্যযুগের খেয়ালী উপকথার উপর নির্মিত মুভি। শুরুর দিকের দৃশ্যাবলীতে শুভ্র তুষার, আবছায়া কুয়াশা আর পতনশীল ছাইয়ের আধিক্য দেখা যায়। এই উপস্থাপন দর্শককে আসন্ন পরাবাস্তব অভিজ্ঞতার জন্য প্রস্তুত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। সিনেমার শুরুতেই দর্শক যেন নিজেকে আবিষ্কার করে তার সত্তার বাইরে, ভুলে যায় দৈনন্দিন যাপিত জীবনের ক্লেশ। এই যে অনুভূতি, সেটির রেশ সিনেমা শেষ হওয়ার পরও থেকে যায় বহুক্ষণ।
সিনেমার গল্প সাজাতে গিয়ে লাওরি শরণাপন্ন হয়েছেন চতুর্দশ শতকের একটি বীরোচিত রোমান্স সাহিত্যকর্মের, যেটির নাম ‘স্যার গাউইন অ্যান্ড দ্য গ্রীন নাইট’। প্রাচীন ইংরেজি ভাষায় এই ধরনের বেশ কিছু পদ্যসাহিত্য রয়েছে। যেগুলোর নায়ককে কোন একটি অভিযাত্রায় যেতে দেখা যায়। অভিযানের ঘটনাবলীর বর্ণনা আর মূল চরিত্রের নায়কোচিত কর্মকাণ্ডের স্তুতিই এসব সাহিত্যকর্মের মূল বিষয়।
মূল মধ্যযুগীয় সাহিত্যটি পুরুষত্ব, বীরত্ব, ধর্মতত্ত্ব আর পাপবোধের এক অনবদ্য বয়ান। তবে পরিচালক একে বর্তমানকালের দর্শকদের উপযোগী করে সাজিয়েছেন। মধ্যযুগীয় নাইটদের পরাক্রমশীলতা নিয়ে অন্যান্য যেসব চলচ্চিত্র নির্মিত হয়, সেগুলোতে আমরা মূল চরিত্রের সর্বেসর্বা রূপ দেখি। কিন্তু এই পন্থা থেকে দূরে সরেছেন লাওরি। বরং ‘নাইটরা সবসময় বীরত্বসূচক কাজ করবেন’, সাধারণের কাছে এই ধরনের যে প্রত্যাশা বিরাজ করে, সেই প্রত্যাশাকেই প্রশ্নবিদ্ধ করেছেন তিনি। ফলে চিত্রনাট্য রচনাকালে ইচ্ছা করেই তিনি মূল সাহিত্যের বিভিন্ন ঘটনার অদলবদল করেছেন। মূল চরিত্রাভিনেতা নির্বাচনের সময়ও এই ধারা বলবৎ থেকেছে। মূল রচনার শ্বেতাঙ্গ নাইটের বদলে পর্দায় দেখা গেছে অশ্বেতাঙ্গ দেব প্যাটেলকে। এই নিয়ে আর্থারিয়ান সাহিত্য বিশারদরা তার উপর রুষ্ট হতে পারেন।
তবে দর্শককে বুঁদ করে রাখার জন্য যা যা করা দরকার, তা যথাযথই করা হয়েছে। শুরু থেকেই লাওরির অনবদ্য শৈল্পিক দৃষ্টিভঙ্গি, আর দেব প্যাটেলের ক্যারিয়ার সেরা পারফরম্যান্স দর্শকদের গল্পের ভেতরে নিয়ে যাবে। পুরো সিনেমাজুড়ে বিরাজ করে একধরনের শৈল্পিক সংবেদনশীলতা। যার ফলে চতুর্দশ শতকের ইংল্যান্ডে চরিত্রদের মিথস্ক্রিয়া ফুটে ওঠে বাস্তবসম্মতভাবে। যেন গল্পের ঘটনাগুলো দর্শকের চোখের সামনেই ঘটছে। মনস্তত্ত্ব আর রূপকথার অনবদ্য সংমিশ্রণ এই সিনেমা।
স্যার গাউইন (দেব প্যাটেল) কিং আর্থার (শন হ্যারিস) এবং কুইন গুইনিভিয়ের (কেট ডিকি) ভাগ্নে। তার মায়ের নাম মরগান লা ফে (সারিতা চৌধুরী), যিনি ডাকিনীবিদ্যার সাথে জড়িত বলে রাজ্যে কানাঘুষা আছে। শুরুতে তার প্রেমিকা এসেল (অ্যালিসিয়া ভিকান্দার) এবং মায়ের সাথে খানিকটা কথাবার্তার পর গাউইন চলে যায় রাজপ্রাসাদে। ক্রিসমাস উপলক্ষে সেখানে জাঁকজমকপূর্ণ এক ভোজসভার আয়োজন করা হয়েছে। ভোজসভায় গিয়ে গাউইন কিং আর্থারের নাইটস অফ দ্য রাউন্ড টেবিলের সদস্যদের দেখতে পায়, যাদের মতো সম্মান সে নিজেও পেতে চায়। রাজপ্রাসাদে একটি চমক তার জন্য অপেক্ষা করছিল। কেননা, রাজা এবং রানী তাকে তাদের সাথে বসতে বলেন। গাউইন তখনও নাইট হয়নি এবং নাইট না হলে সাধারণত কেউ এ ধরনের সুযোগ পায় না।
পাশে গিয়ে বসলে রাজা তার কাছ থেকে একটি বীরোচিত কাজের বর্ণনা শুনতে চান। কিন্তু গাউইনের ঝুলিতে এমন কোনো মহৎ কাজ নেই। তাই সে নিজের বীরত্বগাথা শোনাতে পারে না। রাজা আর তার কথোপকথন চলে খুব ঢিমেতালে, যার মাধ্যমে পরিচালক দর্শকদের জানান দেন যে, তারা কোনো অ্যাকশন ফিল্ম দেখতে বসেনি। এই সংক্রান্ত আরো একটি সংকেত সিনেমার শুরুতেই দেওয়া হয়।
গাউইন বা রাজা কেউই জানত না যে, এই ক্রিসমাসে তাদের উভয়ের মনোবাসনাই পূর্ণ হবে। গাউইনের ঝু্লিতে জমা পড়বে নিজের বীরত্বগাথা আর রাজা শোনার বদলে চোখের সামনেই দেখতে পারবেন ভাগ্নের সাহসিকতা। রাজাকে বলার মতো কিছু করতে পারেনি বলে যখন নায়ক লজ্জায় অবনত, ঠিক তখনই প্রাসাদের দরজা হাট করে খুলে যায়! আর প্রবেশ করে গল্পের ভিলেন দ্য গ্রীন নাইট, যার নামে রাখা হয়েছে এই চলচ্চিত্রের নাম। অর্ধ-মানব আর অর্ধ-বৃক্ষ এই গ্রীন নাইটের চরিত্রে অভিনয় করেছেন রালফ ইনেসন।
অতিকায় গ্রীন নাইট ভোজসভায় দাঁড়িয়ে রাজাকে বলে, সে একটি ‘ক্রিসমাস গেম’ খেলতে চায়। রাজার চারপাশ পরিবেষ্টিত করে রাখা নাইটদের দিকে চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দেয় গ্রীন নাইট। সে বলে তাদের কেউ যদি তাকে আঘাত করার মতো সাহসী হয়, তাহলে তাকে নিজের হাতে থাকা অস্ত্র দিয়ে দেবে। কিন্তু তার একটা শর্ত আছে। আজ থেকে ঠিক এক বছর পর ঐ নাইটকে যেতে হবে গ্রীন নাইটের আবাসস্থলে, সঙ্গে করে নিতে হবে তার অস্ত্রটি। সেখানে নাইট তাকে যে জায়গায় আঘাত করেছে, ঠিক সেই জায়গায় সে-ও নাইটকে আঘাত করবে।
রাউন্ড টেবিলের সাহসী নাইটদের কেউও যখন চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করতে এগিয়ে আসে না, তখন সামনে আসে গাউইন। রাজা তার হাতে তরবারি ধরিয়ে দেন, আর স্মরণ করিয়ে দেন, এটা শুধুমাত্র একটা খেলা। রাজার তরবারি দিয়ে গাউইন আঘাত করে গ্রীন নাইটকে। যার ফলে তার শিরচ্ছেদ ঘটে। কিন্তু সবাইকে অবাক করে দিয়ে মিথিক্যাল গ্রীন নাইটের শরীর চলতে শুরু করে এবং নিজের কর্তিত মস্তকটি কুড়িয়ে নেয়। এরপর অট্টহাসিতে উদ্ভাসিত হয় এবং ঘোড়ায় সওয়ার হয়ে চলে যেতে থাকে। কিন্তু যাওয়ার আগে গাউইনকে এক বছর পরে চ্যালেঞ্জের ২য় অংশ পূর্ণ করতে হবে এটি স্মরণ করিয়ে দিতে ভোলে না।
ঘটনার আকস্মিকতায় সবাই হতবিহ্বল হয়ে পড়ে। চমক কেটে সাহসিকতার জন্যে গাউইনের পিঠ চাপড়ে দিতেও ভোলে না কেউ। এরপর দিন যায়, মাস যায়। গাউইনের সাহসিকতার কথা দিকে দিকে ছড়িয়ে যায়। তাকে নিয়ে লেখা হয় স্তুতি সংগীত এবং রচিত হয় নাটক। নিজের জনপ্রিয়তাকে ভালোভাবেই উপভোগ করে সদ্য নাইটহুড পাওয়া গাউইন।
প্রথমে সে এক বছর পরের ঘটনা নিয়ে খুব একটা ভাবে না। মনে করে, গ্রীন নাইট খেলার ছলেই তার আবাসস্থলে যাওয়ার কথা বলেছে। সত্যি সত্যি যেতে হবে না। তবে এক বছর ফুরিয়ে আসলেও যখন লোকজন চ্যালেঞ্জের বাকি অংশের কথা বলে, তার মা এবং মামাও এ ব্যাপারে তাগাদা দেয়; তখন সে বাস্তবতা অনুধাবন করে। শুরু হয় নিজের সাথে নিজের যুদ্ধ। এ সময়ে এসে উন্মোচিত হয় সিনেমার আরেকটি থিম। যেটির সাথে মিলে যায় কামিং-অফ-এইজ সিনেমাসমূহের থিম।
সিনেমার এই পর্যায়ে তার সাথে এসেলের কথোপকথনে যেন পরিচালকের মনোভাবই ফুটে ওঠে। এসেল তাকে বলে, “জীবনে মহৎ হতেই হবে, এই মানদণ্ড কে বেঁধে দিয়েছে? অন্য সবার মতো বাঁচলে ক্ষতি কী?“
তখন এসেলের সাথে তার আচরণে শ্রেণী বৈষম্যের ব্যাপারটিও ফুটে ওঠে।
এতক্ষণ পর্যন্ত যেসব ঘটনা ঘটেছে, সেগুলো আসলে গল্পের প্রস্তাবনা অংশ। এসব ঘটনা গাউইনকে তার বিখ্যাত অভিযাত্রার সম্মুখে এনে দাঁড় করিয়েছে। নিজের সামর্থ্য নিয়ে দোটানায় থাকা নাইট রওনা হয় গ্রীন নাইটের সাথে দেখা করতে। মূল সাহিত্যের সাথে এখানে তফাৎ রয়েছে সিনেমার। মূল সাহিত্যে স্যার গাউইন অভিযাত্রায় নামার আগে থেকেই বিখ্যাত। এই অভিযান কেবল তার সাফল্যের মুকুটে আরেকটি পালক যুক্ত করে।
অন্যদিকে, সিনেমায় গাউইন রাজপরিবারের সদস্য হিসেবে সম্মানিত হলেও, তেমন কোনো সাহসিকতার পরিচয় দিতে পারেনি। যা নিয়ে তার আক্ষেপের সীমা-পরিসীমা ছিলো না। সে যে নাইট হয়েছে, সেটাও বেশিদিন আগের ঘটনা নয়। এই অভিযাত্রাই সিনেমায় তার মাহাত্ম্যের নির্দেশক বলে বিবেচিত হবে। প্রাচীনকালে নাইট হতে হলে পাঁচটি গুণ অবশ্যক বলে মনে করা হতো: বন্ধুত্ব, বদান্যতা, শুদ্ধতা, ভদ্রতা এবং কর্তব্য বা ধর্মনিষ্ঠতা। গ্রীন নাইটের সাথে দেখা করার এই যাত্রাই তাকে এসব গুণাবলি অর্জনের সুযোগ এনে দেয়, যেগুলো মূল সাহিত্যের নায়ক আগেই অর্জন করেছিলেন। ফলে মূল কবিতায় কেবল যাত্রার ভাসা ভাসা বর্ণনা থাকলেও, সিনেমায় এই যাত্রার পুঙ্খানুপুঙ্খ বর্ণনা করা হয়েছে।
যাত্রাপথে তার সাথে একে একে দেখা হয় একজন ঝাড়ুদার (ব্যারি কিওঘান), রহস্যময় নারী (এরিন কেলীম্যান), লর্ড (জোয়েল এডগারটন) এবং লেডির সাথে। এসব চরিত্রের সংস্পর্শে এসেই তার নাইটের গুণাবলি অর্জন করার কথা। তার সাথে একটি শিয়ালকেও সঙ্গী হতে দেখি আমরা। এখানেও সোর্স ম্যাটেরিয়ালের বিপরীতে গিয়েছেন লাওরি। তবে তা নিয়ে বিস্তারিত বলতে গেলে সিনেমা দেখার আসল মজাটাই চলে যাবে।
মূল সাহিত্যের কাব্যিকতার সাথে সিনেমার চিত্রনাট্যকে কুশলতার সাথে মিলিয়ে দেওয়া হয়েছে। থিমগুলোর একটির পর আরেকটির আগমন ঘটেছে কবিতার মতো করেই। একই থিমকে বার বার ব্যবহৃত হতেও দেখা গেছে। এতে করে নায়কের অভিযাত্রা ফুটে উঠেছে সর্পিলাকারে। বার বার স্মরণ করিয়ে দেওয়া হয়েছে গাউইনের পরিণতি তার ইচ্ছার উপর নির্ভরশীল। সে চাইলে তার পরিণতি ভিন্নও হতে পারে। এতে সৃষ্টি হয়েছে স্বপ্নীল আবহ, এবং বাস্তবতা-অবাস্তবতার ভ্রম। ফলে আমরা দেখতে পাই মূল চরিত্রের যাত্রা যতটা কায়িক তার চেয়েও বেশি মানসিক। এই ব্যাপারটি সিনেমা কোম্পানি A24 এর অনেক সিনেমাতেই দেখা যায়।
যেহেতু সিনেমার স্টোরি টেলিং লুজ স্ট্রাকচারের, এক ঘটনা থেকে অন্য ঘটনায় চলে যায় হঠাৎ করেই, সেহেতু দর্শকের মনোযোগ ধরে রাখতে এর টেকনিক্যাল ব্যাপারগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম। এই কাজ ভালোমতোই করতে পেরেছেন সংশ্লিষ্টরা। লাওরির সাথে এই সিনেমাতেও দেখা গেছে তার বিশ্বস্ত সহচর ড্যানিয়েল হার্ট এবং অ্যান্ডু ড্রোজ পালের্মোকে। হার্টের কম্পোজ করা মিউজিক সিনেমার আমেজকে বাড়িয়ে তুলেছে বহুগুণে। আর বিভিন্ন থিমের প্রকাশে পালের্মো ছিলেন অনবদ্য। তার মুন্সিয়ানায় স্বাপ্নিক আবহ, মাদকতাময় পরিস্থিতি থেকে ধরিত্রীর উজ্জ্বল সবুজ ফুটে উঠেছে পরিপূর্ণরুপে। তার ক্যামেরা যেন ভেসে বেড়িয়েছে পুরোটা সময়জুড়ে।
লাওরির সিনেমায় তিনি মহাবিশ্বের বিশালতায় মানুষের গুরুত্ব নিয়ে প্রশ্ন তোলেন। সেই ধারা এখানেও অব্যাহত। তিনি বিশ্বাস করেন, প্রকৃতি থেকে আসা মানুষকে আবার প্রকৃতিতেই ফিরতে হবে। এ সংক্রান্ত উপদেশ গাউইন পায় যাত্রাপথে দেখা হওয়া লেডির কাছ থেকে। তিনি তাকে স্মরণ করিয়ে দেন মানুষের নশ্বরতার ব্যাপারে। বলেন, হয়তো গাউইন গ্রীন নাইটকে পরাজিত করে ফিরবে বীরের বেশে। কিন্তু তাকেও একসময় চলে যেতে হবে। যুদ্ধের ভয়াবহতাসহ আরো নানা ব্যাপারেও সূক্ষ্ম ইঙ্গিত দেখা গেছে সিনেমায়।
দর্শকদের কাছেও চাহিদা আছে দ্য গ্রীন নাইটের। সোজাসাপ্টা স্টোরি টেলিং না থাকার কারণে দর্শক মনোযোগ হারিয়ে ফেলতে পারেন। কোনো পরিস্থিতে মূল চরিত্রের একটি সিদ্ধান্তের ফলাফল কী হতে পারে, তা সবিস্তারে দেখানো হয়েছে এখানে। একই পরিস্থিতিতে ভিন্ন সিদ্ধান্ত নিলে কী হতে পারে তা-ও দেখানো হয়েছে। তাই সিনেমাটি উপভোগ করতে হলে অবশ্যই পূর্ণ মনোযোগ দিতে হবে।
এই সিনেমা আলোচিত হওয়ার জোর দাবি রাখে। একই কবিতা বিভিন্ন মানুষের কাছে যেমন বিভিন্ন রূপে ধরা দেয়, এখানেও ঠিক তাই। এন্ডিংসহ অনেক অংশই ওপেন এন্ডেড। ফলে দর্শক নিজের মতো করে সাজিয়ে নিতে পারবেন কাহিনীকে, বিভিন্ন থিমকে। এর সৌন্দর্য বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে মূলত এর অনির্দিষ্টতার মাঝেই।