২০০৩ সালের সেপ্টেম্বরের এক রাতে অজ্ঞাত এক ফাঙ্গাসের আক্রমণে সারাজীবনের জন্য বদলে যায় ‘The Last of Us‘ সিরিজের চিরচেনা পৃথিবী। এইচবিও-র এই সিরিজের প্রথম এপিসোডে দর্শকরা প্রত্যক্ষ করে সেই ভয়াল রাতের ঘটনা। পেদ্রো পাসকাল অভিনীত জোওল মিলারের মেয়ে স্যারাহর দৃষ্টিকোণে আমরা কোর্ডিসেপস নামক এই ফাঙ্গাসের আক্রমণের সূত্রপাত দেখতে পাই। ‘লাস্ট অব আস’ গল্পে পরিচিত পৃথিবীর ইতি ঘটে সেই ভয়াল রাতের পরবর্তী দুই-তিন দিনের মধ্যেই। এই ঘটনার ২০ বছর পরের পোস্ট-অ্যাপোক্যালিপ্টিক পৃথিবীতে বেঁচে থাকা অবশিষ্ট মানবজাতিকে নিয়েই ‘দ্য লাস্ট অব আস’ সিরিজের গল্প।
এইচবিওর সিরিজটি অ্যাডাপ্ট করা হয়েছে Naughty Dog কর্পোরেশনের একই নামের ভিডিও গেইম থেকে। ২০০৩ সালে মুক্তি পাওয়া গেইমের প্রথম পর্বের গল্পই নিয়ে আসা হয়েছে প্রথম সিজনে। একটি ভালো মানের সিরিজ হওয়ার পাশাপাশি দ্য লাস্ট অব আসের রয়েছে আরেক অসাধারণ অর্জন: ভিডিও গেইমের সফল এডাপ্টেশন!
“Tomb Raider”, “Prince of Persia”, “Mortal Kombat”, “Hitman”, “Resident Evil”, “Uncharted”– জনপ্রিয় প্রায় সকল ভিডিও গেইমকেই সাফল্যের সাথে সিনেমা বা টিভির পর্দায় এডাপ্ট করার চেষ্টা হলিউড চালিয়ে যাচ্ছে বহু বছর ধরে। অধিকাংশ ক্ষেত্রেই সেই প্রচেষ্টা বিফলে গেছে। গেইমারদের থেকে শুরু করে সাধারণ দর্শক- কাউকেই সন্তুষ্ট করতে পারছিল না হলিউড এসব এডাপ্টেশন দিয়ে।
তারপর এলো এইচবিওর The Last of Us। এইচবিও-র সিরিজ হওয়া সত্ত্বেও ভিডিও গেইম অ্যাডাপ্টেশন হিসেবে সিরিজের বিপক্ষে কাজ করছিল হলিউডের অসন্তোষজনক ট্র্যাক রেকর্ড। কিন্তু ‘Chernobyl’ খ্যাত নির্মাতা ক্রেইগ মেইজিন আর ‘লাস্ট অব আস’ গেইমের ক্রিয়েটর নীল ড্রাকম্যান এমন এক সিরিজ উপহার দিলেন যে পূর্বের সকল কার্স খণ্ডিত করে সিরিজটি হয়ে উঠল সর্বসমাদৃত। গেইমার থেকে শুরু করে সাধারণ দর্শক, ক্রিটিক সবাই প্রশংসায় পঞ্চমুখ। ভিউয়ার রেটিংসের দিক থেকেও এইচবিওর মেগাহিট House of the Dragon এর সমতুল্য হয়ে উঠল। কীভাবে সকল প্রত্যাশা ছাপিয়ে এমন ফেনোমেননে পরিণত হলো সিরিজটি? আর এই সিরিজের সাফল্য থেকে কী কী শিক্ষা নেওয়ার আছে ভবিষ্যৎ ভিডিও গেইম অ্যাডাপ্টেশনের?
দ্য লাস্ট অব আস – সফলতার গল্প
লাস্ট অব আসের বিপুল সাফল্যের পেছনে সবচেয়ে বড় ভূমিকা সম্ভবত সোর্স ম্যাটেরিয়ালের। প্রথম দেখায় জম্বি মারার অ্যাকশন গেইম মনে হলেও লাস্ট অব আস এর চেয়ে অনেক গভীর ও মানবীয় গল্পসম্পূর্ণ একটি গেইম। এই গেইমের মূল আকর্ষণ জম্বি মারা নয়, বরং মূল চরিত্র জোওল আর এলির মধ্যে তৈরি হওয়া আবেগপূর্ণ অতি শক্তিশালী ও প্রভাবশালী এক মানবীয় গল্প।
এই হিউম্যান এলিমেন্টকেই মুখ্য ধরে ক্রেইগ মেইজিন আর নীল ড্রাকম্যান সাজিয়েছেন সিরিজটি। এতে গেইমাররা তো সন্তুষ্ট হয়েছেনই, সাথে সাধারণ দর্শকরাও খুব সহজে একীভূত হতে পেরেছেন। কেনই বা হবেন না? একমাত্র মেয়েকে হারিয়ে জীবনের হাল ছেড়ে দেয়া বিষাদগ্রস্ত এক বাবা, ধ্বংসপ্রাপ্ত পৃথিবীতে মানুষের টিকে থাকার আর ক্ষমতার লড়াই, ধ্বংসের মাঝে খুঁজে পাওয়া ভালোবাসা, বন্ধুত্ব- এসবের সাথে নিজেকে সম্পর্কিত করতে তো প্রায় সব মানুষই পারেন। গেইমে থাকা বিস্তৃত গল্পগুলোকে দক্ষ লেখনী, মুগ্ধকর পরিচালনা আর ক্যারিশম্যাটিক অভিনয়ের মাধ্যমে অতি মানবিক ও হৃদয়গ্রাহী করে তোলা হয়েছে।
সিরিজের গল্প গঠন করা হয়েছে দুই প্রকারের এপিসোডের মাধ্যমে- জোওল আর এলির মূল অ্যাডভেঞ্চারের গল্পসম্বলিত এপিসোড, সাথে আছে আরেক প্রজাতির এপিসোড যেখানে নির্দিষ্ট কতিপয় চরিত্রের উপর ফোকাস করে লাস্ট অব আসের জগতকে বিকশিত করা হয়েছে। এই দ্বিতীয় প্রজাতির এপিসোডগুলো সিরিজকে বাকিসব ভিডিও গেইম অ্যাডাপ্টেশন থেকে আলাদা করেছে, বিশেষ করে প্রথম সিজনের তৃতীয় এপিসোড। “Long, Long Time” টাইটেলের এই এপিসোডে দর্শকরা পরিচিত হয় বিল আর ফ্র্যাংকের সাথে। অ্যাপোক্যালিপ্সের মাঝে গড়ে ওঠা হৃদয়স্পর্শী এক ভালোবাসার গল্প রয়েছে এখানে। এই তৃতীয় এপিসোডের মধ্য দিয়েই দ্য লাস্ট অব আস দর্শকমহলে তুমুল সাড়া ফেলে। ক্রেইগ মেইজিনের রাইটিং, পিটার হোরের ডিরেকশন এবং নিক অফারম্যান আর মুর্যে বার্টলেটের অসাধারণ অভিনয়ের মধ্য দিয়ে এক ঘণ্টার এই এপিসোডে অনস্ক্রিনে দেখা অন্যতম সুন্দর লাভ স্টোরি দেখানো হয়েছে।
একইভাবে পঞ্চম এপিসোডে দুই ভা, স্যাম আর হেনরি ও সপ্তম এপিসোডে এলি আর রাইলির গল্পগুলো এই সিরিজের ড্রামাটিক দিককে শক্তিশালী করেছে। ক্লিকারের আতঙ্ক, ইনফেক্টেডের সাথে লড়াই করার থ্রিল, আর গল্পের টুইস্ট এন্ড টার্নের মজার পাশাপাশি এরকম গ্রাউন্ডেড, মানবিক দিকগুলো এই সিরিজের মেইনস্ট্রিম সাফল্যের পেছনে অনেক বড় ভূমিকা রেখেছে।
দ্য লাস্ট অব আসের সাফল্য থেকে শিক্ষণীয়
এখন আসা যাক এই সিরিজের সফলতা থেকে বাকি অ্যাডাপ্টেশনের কিছু শেখার আছে কী না সে আলোচনায়। The Last of Us কিছু জায়গায় গল্পের প্রয়োজনে গেইম থেকে কিছু জিনিস পরিবর্তন করলেও মোটের উপর এই প্রথম সিজন গেইমের প্রতি প্রচন্ড ফেইথফুল। বেশ কিছু দৃশ্যে তো ডায়লগ, ভিজ্যুয়ালি গেইমের হুবহু অনুকরণ করা হয়েছে। ওভারঅল গেইমের গল্পে অটল থেকে সিরিজের প্রয়োজনে কিছু অ্যাডজাস্ট করার মাধ্যমেই কাজ করেছে সিরিজটি। ক্রেইগ মেইজিনের সাথে গেইমের ক্রিয়েটর নীল ড্রাকম্যান শো রানার হিসেবে থাকা এই টেকনিক সঠিকভাবে প্রয়োগ করতে গুরুত্বপূর্ণ ছিল। মেইজিন গেইমের গল্পকে টিভির উপযুক্ত করেছেন, অন্যদিকে নিজের সৃষ্টি করা গল্প যাতে নির্ভেজাল থাকে সেদিকটা দেখেছেন ড্রাকম্যান।
তুলনামূলকভাবে অন্যান্য ভিডিও গেইম অ্যাডাপ্টেশনগুলো যে ভুল করে তা হলো গেইম থেকে স্ক্রিনে অ্যাডাপ্ট করতে গিয়ে মূল গেইমের সত্তাই হারিয়ে ফেলে। নিজেদের পছন্দের গেইম নিয়ে হলিউডের যাচ্ছেতাই এই আচরণ গেইমারদের অসন্তুষ্ট করে তোলে, আবার মুভি বা সিরিজে অ্যাডাপ্ট করার পরে গল্পের যে হাল হয় তা সাধারণ দর্শকদের জন্যও আকর্ষণীয় হয় না বেশিরভাগ ক্ষেত্রে। মূল গেইমের প্রতি বিশ্বস্ত থাকা আর ভিন্ন মিডিয়ামে অ্যাডাপ্ট করতে গিয়ে গল্পে পরিবর্তন আনা- এই দুয়ের একটা গ্রহণযোগ্য মিশ্রণই সফল ভিডিও গেইম অ্যাডাপ্টেশনের রেসিপি হতে পারে (সাথে ভালো লেখক, পরিচালক, অভিনেতা, নির্মাতা ইত্যাদি তো আবশ্যক)।
সবকিছুর উপরে আরেকটা কথা থেকেই যায় The Last of Us প্রসঙ্গে- HBO! এই যে মূল গেইমের নির্মাতাকে সরাসরি শো রানার হিসেবে নিযুক্ত করা হলো এটা এইচবিও বাদে অন্য কোনো স্টুডিওতে হয়তো সম্ভব নয়। টিভির শুরু থেকে আজ পর্যন্ত হয়তো এ কারণেই এইচবিও গোল্ড স্ট্যান্ডার্ড। যেখানে পুরো হলিউড হতবুদ্ধি হয়ে আছে ভিডিও গেইম অ্যাডাপ্টেশন নিয়ে, সেখানে এইচবিও এক ভিডিও গেইমের উপর ভিত্তি করে উপহার দিল বছরের অন্যতম সেরা সিরিজ। এখন কে পারবে এরকম সর্বদিক থেকে সফল পরবর্তী আআডাপ্টেশন নিয়ে আসতে সেটাই দেখার বিষয়।