সাম্প্রতিককালের সবচেয়ে জনপ্রিয় হরর মুভিগুলোর কথা বলতে গেলে অবধারিতভাবেই চলে আসবে জেমস ওয়ানের ইনসিডিয়াস কিংবা কনজুরিং সিরিজের কথা। সেই কনজুরিং সিনেমাটিক ইউনিভার্সেরই পঞ্চম ছবি ‘দ্য নান’ মুক্তি পেয়েছে এ বছরের সেপ্টেম্বরের ৬ তারিখে। মুক্তির আগে থেকেই ‘দ্য নান‘কে নিয়ে মুভিপ্রেমীদের উত্তেজনা ছিল চরমে। প্রযোজকেরা দাবি করেছিলেন, এটি হতে যাচ্ছে কনজুরিং ইউনিভার্সের সবচেয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন অধ্যায়। শুধু তা-ই নয়, দর্শকদের অভিযোগে ইউটিউবে বিভিন্ন ভিডিওর মাঝে বিজ্ঞাপন হিসেবে প্রচার করা এই মুভির পাঁচ সেকেন্ডের একটি টিজার নামিয়ে নেয়া হয়। কারণ হঠাৎ করে আসা নানরূপী পিশাচ ভালাকের ভয়াবহ চেহারা সহ্য করতে পারেননি অনেকেই। আধিভৌতিক মুভিটি কি আসলেই সকলের আশা মেটাতে পারল কি না, তা নিয়েই আমাদের আজকের এই আয়োজন।
মুভির কাহিনী শুরু হয় রোমানিয়ার দক্ষিণ ট্রানসিলভানিয়ার একটি নিরিবিলি গ্রামে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষ হবার অর্ধযুগ পার হলেও এলাকাটি এখনো আগের অবস্থায় ফিরে যেতে পারেনি, যুদ্ধের ধ্বংসলীলার চিহ্ন যেন এখনো বহন করে চলেছে। সকালের শান্ত আবহাওয়ায় ফুরফুরে মেজাজে শিস দিতে দিতে বের হয়েছে ফ্রেঞ্চি। স্থানীয় মিশনারিতে নানদের কাছে খাবার পৌঁছে দেয়াই তার কাজ। সেখানে পৌঁছে থমকে যায় সে। প্রাসাদোপম বাড়িটির বিশাল ঘন্টার সাথে ফাঁসির দড়ি পেঁচানো অবস্থায় ঝুলে আছে এক নানের লাশ। আত্মহত্যা মহাপাপ জেনেও কেন এই কাজ করলেন সিস্টার ভিক্টোরিয়া? পৈশাচিক শক্তির হাত থেকে বাঁচিয়ে রাখতে চাওয়া ঐ চাবিটার মধ্যেই বা কী আছে?
এদিকে গোপনে ভ্যাটিকানে এই ব্যাপারটি নিয়ে শুরু হয়েছে ফিসফাস। গুরুতর ঘটনাটি রাখঢাক করে রাখা হয়েছে আইন প্রশাসনের কাছে। বিশপের অনুরোধে ঘটনাটির পেছনের জমাট বেঁধে থাকা ঘোর রহস্য ভেদ করার দায়িত্ব নিলেন মধ্যবয়সী ফাদার বার্ক। তিনি কিন্তু যেই সেই ব্যক্তি নন, অতিপ্রাকৃতিক বিভিন্ন বিষয়ে ভালোই ধারণা আছে তার। তিনি সঙ্গী হিসেবে বেছে নিলেন সিস্টার আইরিনকে, যিনি এখনো নান হিসেবে শপথই গ্রহণ করেননি। বিশেষ কিছু আধ্যাত্মিক ক্ষমতা থাকার কারণে অতিপ্রাকৃতিক ব্যাপারে আইরিনের অভিজ্ঞতা অন্যদের তুলনায় একটু হলেও বেশি।
রোমানিয়ার সেই গ্রামে পৌঁছানোর পরে তাদেরকে পথ দেখায় সেই ফ্রেঞ্চিই।বিপদের মাত্রা ভালোমতো টের না পাওয়ার কারণেই হোক বা সিস্টার আইরিনের প্রতি নিষিদ্ধ আকর্ষণের কারণেই হোক; হাসিখুশি এই ফ্রেঞ্চ-কানাডিয়ান কৃষকও তাদের অভিযানের সাথে জড়িয়ে পড়ে। মুখে কিছু না বললেও ফাদার বার্ক আর সিস্টার আইরিন কিন্তু ভালোভাবেই টের পেয়েছেন অশুভ এই পিশাচের উপস্থিতিকে। এদিকে মিশনারির অন্যান্য নানেরা কঠোর সন্ন্যাসব্রত পালন করছেন এই ভয়াল শক্তিকে ঠেকিয়ে রাখার জন্য। এরপরেই শুরু হয় চরম উত্তেজনাপূর্ণ এক অধ্যায়। পদে পদে তাদের ওপরে ধেয়ে আসতে থাকে বিপদ। ফাদার বার্কের অতীতের অনুশোচনাকে পুঁজি করে তাকে পর্যুদস্ত করতে থাকে সেই পিশাচ। তবে সুযোগ পেয়েও অজ্ঞাত কারণে সিস্টার আইরিনের তেমন কোনো ক্ষতি করে না।
দুর্ঘটনাক্রমেই ফাদার আবিষ্কার করে ফেলেন সেই পিশাচের পরিচয়। মধ্যযুগে ইউরোপের অন্ধকার সময়ের কথা অনেকেরই জানা। সেসময়েই ভালাকের আবির্ভাব ঘটেছিল পৃথিবীতে। সেসময় তাকে ঠেকানো হলেও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময়ে সে আরেকবার সুযোগ পেয়ে যায়। দুমুখো ড্রাগনের পিঠে চড়া ডানাওয়ালা দেবদূতের মতো তার আসল চেহারা। কিন্ত ধর্মকে বুড়ো আঙুল দেখিয়েই সে ভর করতে চায় নানদের ওপরে।
সিস্টার রোজ প্যাকুয়েট নামের এক নান জানিয়েছেন, মুভিতে ক্যাথলিকদের দুটি মূল বিশ্বাসকে কেন্দ্র করেই মুভির কাহিনী গড়ে উঠেছে। প্রথমত, শয়তান আসলেই আছে। আর দ্বিতীয়ত, মা মেরিই পারেন যেকোনো অশুভ পরিস্থিতির মোকাবেলা করতে। অবশ্য অনেকের মনে প্রশ্ন আসতে পারে, চার্চের মতো পবিত্র জায়গায় প্রার্থনারত নানদেরকে আক্রমণ করার ক্ষমতা এই পিশাচ পেলো কোথা থেকে।
এই কাহিনী প্রভাব ফেলেছিল মুভির কলাকুশলীদের ওপরেও। মুভির সেটকে একজন ক্যাথলিক পাদ্রীকে দিয়ে পরিশুদ্ধ করে নেয়া হয়েছিল।
সব মিলিয়ে ‘দ্য নান’ যথেষ্ট উপভোগ্য ছিল। মুভির ভালো দিক বলতে গেলে অ্যাটমোসফেয়ারিক হররের দিক দিয়ে একে দশে দশ দেয়া যেতে পারে। হরর মুভির একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক, সাউন্ড ডিজাইন অসাধারণ ছিল। সারাউন্ড সিস্টেমে দেখার সময় মনে হতে পারে, যেন বাচ্চা ছেলেটি ফিসফিসিয়ে দর্শকের কানের কাছেই ‘ফাদার’ বলে উঠল।
তাছাড়া অভিনয়ের দিক দিয়েও সবাই সেরাটাই দিয়েছেন। মুভির প্রধান চরিত্রে সিস্টার আইরিনের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন ‘আমেরিকান হরর স্টোরি’খ্যাত তেইসা ফারমিগা। তিনি আবার ‘দ্য কনজুরিং’ এর দুই পর্বেই লরেন ওয়ারেনের ভূমিকায় অভিনয় করা সুঅভিনেত্রী ভেরা ফারমিগার আপন ছোট বোন। সেই কারণে পরিচালক প্রথমে তেইসা ফারমিগাকে নিতে রাজি হননি। কিন্তু পরে অডিশনে শতাধিক অভিনেত্রীর সাথে পাল্লা দিয়ে হার্ডির মন জয় করে নেন তিনি। হার্ডির মতে, “তেইসা তার অভিনয় দিয়ে পুরো পরিবেশটাই পাল্টে দিতে পারেন“।
এছাড়াও মুভির অন্য অন্য দুই প্রধান চরিত্রে ফাদার বার্ক এবং ফ্রেঞ্চির ভূমিকায় অভিনয় করেছেন ডেমিয়ান বিসির এবং জোনাস ব্লোকেট। মুভির একটি উজ্জ্বল দিক হলো ফ্রেঞ্চির ভূমিকায় অভিনয় করা জোনাস ব্লোকেটের অভিনয়। ব্রেকআউট চরিত্রটি দিয়ে দর্শকের মন জয় করে নিয়েছেন এই বেলজিয়ান অভিনেতা। ফলে মুভিতে হরর আর হিউমারের মাঝে চমৎকার ভারসাম্য এসেছে। কোনো কোনো সময়ে ‘ইনসিডিয়াস’ এর ডেমোনোলজিস্টদেরকেও মনে করিয়ে দিয়েছেন। নাম ভূমিকায় থাকা নান ওরফে পিশাচ ভালাকের ভয়ানক রূপের আড়ালে ছিলেন বনি অ্যারনস।
কাহিনীর শেষের দিকে বেশ ভালো কিছু টুইস্ট দিয়েছে। তবে সবচেয়ে বেশি চমকপ্রদ ছিল একদম শেষের দৃশ্যটি দিয়ে কনজুরিং ইউনিভার্সের মিথোলজির সাথে এই মুভিটিকে সুদৃঢ়ভাবে সম্পৃক্ত করে দেয়ার ব্যাপারটা।
মুভিটি কিছু দিক দিয়ে পিছিয়েও আছে। কাহিনী মোটামুটি অনুমিতই ছিল। মাত্র কিছুদিনের ব্যাপ্তি থাকায় চরিত্রগুলো ভালোভাবে বিকশিত হতে পারেনি।বারবার উপস্থিতি জানান দিলেও মূল চরিত্র ভালাককে মুভির তৃতীয়াংশের আগে স্ক্রিনে তেমন একটা দেখা যায়নি। তাছাড়া, ভালাকের মূল উদ্দেশ্য কিংবা খ্রিস্টান উপকথার সাথে এর সম্পর্ক আরেকটু বিস্তারিতভাবে দেখানোর সুযোগ ছিল।
যেকোনো হরর মুভিতে বিনোদনের একটি জনপ্রিয় উপায় জাম্প স্কেয়ার। কিন্তু ‘দ্য কনজুরিং’ এর ক্ষেত্রে জেমস ওয়ান যেখানে একটু সংযত ছিলেন, সেখানে ‘দ্য নান’ এর পরিচালক করিন হার্ডি একটু বাড়াবাড়িই করেছেন। মাঝে মাঝে মনে হয়েছে, কাহিনীর গভীরতা কম বলে পরিচালক সেটাকে পুষিয়ে দেবার চেষ্টা করছেন। কোনোদিক দিয়েই একে কনজুরিং ইউনিভার্সের সবচেয়ে অন্ধকারাচ্ছন্ন অধ্যায় বলা যায় না।
আইএমডিবিতে মুভিটির এখন পর্যন্ত রেটিং ৫.৭/১০, রোটেন টমাটোসে ২৭%। সাম্প্রতিককালে সাড়া ফেলে দেওয়া হরর মুভি ‘অ্যা কোয়াইট প্লেস‘, ‘গেট আউট‘ কিংবা ‘হেরেডিটারি‘র মতো ভিন্ন স্বাদের তেমন কিছু উপহার দিতে পারেনি মুভিটি। তাই বলে এমন না যে হরর হিসেবে কোনো দিক দিয়ে কমতি ছিল এর। কিন্তু কনজুরিং ইউনিভার্সের কাছে একটু ভিন্নধর্মী কিছুই আশা করেছিল সবাই, দুর্ভাগ্য যে লেখকেরা এই হাইপকে কাজে লাগাতে পারলেন না।
তবে বিভিন্ন ক্ষেত্রে নানা সমালোচনাও ‘দ্য নান’ এর বক্স অফিস সাফল্যকে দমিয়ে রাখতে পারেনি। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এখন পর্যন্ত এটিই কনজুরিং ইউনিভার্সের সবচেয়ে বেশি আয় করা মুভি। মাত্র ২২ মিলিয়ন ডলার বাজেটের মুভিটি উদ্বোধনী দিনেই আয় করে ৫৪ মিলিয়ন ডলার! বিশ্বব্যাপী একত্রিশ দিনে এর সর্বমোট আয় ৩৪৭ মিলিয়ন ডলার।
‘দ্য নান’ সমালোচকদের মন জোগাতে না পারলেও কনজুরিং ইউনিভার্স ঠিকই এগিয়ে চলবে দুর্দমনীয় গতিতে। সামনের বছরেই আসবে অ্যানাবেল মুভির তৃতীয় পর্ব। ২০২০ সালে আসবে দ্য কনজুরিং পার্ট থ্রি। কনজুরিং ২ এর স্পিন-অফ ‘দ্য ক্রুকেড ম্যান’ এরও নির্মাণ কাজ প্রায় শেষের দিকে। ‘দ্য নান’ এর সিক্যুয়েলের সম্ভাবনার কথাও উড়িয়ে দেননি কনজুরিং ইউনিভার্সের নির্মাতা জেমস ওয়ান।