জীবকূলের প্রায় সকল প্রাণীই ভালোবাসার প্রগাঢ় মেলবন্ধন ও মায়াতে আবদ্ধ। ভালোবাসার জন্য অনেক সময় কড়া মূল্য চুকাতে হয়। ১৯৩৩ সালে প্রাইমেট বর্গীয় বিশালাকার গরিলা-সদৃশ প্রাণীর সাথে এক হোমো স্যাপিয়েন্সের ভালোবাসাকে ‘কিং কং’ নামে সাদাকালো পর্দায় উপস্থিত করেছিলেন পরিচালক মেরিয়ান কুপার। এর ঠিক ৭২ বছর পর ২০০৫ সালে পরিচালক পিটার জ্যাকসন এই কাহিনিকে আবারও নিয়ে আসেন রূপালী পর্দায়, চোখধাঁধানো ও দৃষ্টিনন্দন সিজিআই-ভিএফএক্সের সাথে। তখন ভালোবাসা, অ্যাডভেঞ্চার, আর ট্র্যাজেডির এক অনুপম মিশ্রণ দেখতে পায় দর্শক। সিনেমার অস্কার উইনিং ভিজুয়াল ইফেক্ট, ইমোশনাল স্টোরিলাইন একে বানিয়ে দেয় মডার্ন এক কাল্ট ক্লাসিক। মাস্টারপিস এই সিনেমার অজানা যত দিক নিয়েই আজকের এই আয়োজন।
সিনেমার পূর্বপ্রস্তুতি
হলিউডের বিখ্যাত পরিচালক পিটার জ্যাকসন একাধারে ছিলেন কিং কং সিনেমার পরিচালক, প্রযোজক, ও সহকারী লেখক। এই সিনেমা মূলত আসল কিং কং সিনেমার দ্বিতীয় রিমেক, যা ১৯৩৩ সালের ‘কিং কং’ মুভির অ্যাডাপ্টেশন। এর প্রথম রিমেক আসে ১৯৭৬ সালে, জন গুইলারমিনের পরিচালনায়। পিটার জ্যাকসনের ১৯৯৬ সালের হরর/ফ্যান্টাসি সিনেমা The Frighteners দেখে মুগ্ধ হয়েছিল ইউনিভার্সাল পিকচার্সের কলাকুশলীরা। পরে ইউনিভার্সাল তাকে ১৯৫৪ সালের হরর/সাই-ফাই ‘Creature from the Black Lagoon’ সিনেমার রিমেক বানানোর প্রস্তাব দেন। কিন্তু ইউনিভার্সাল যখন জানতে পারে পিটার ‘কিং কং’ এর পাঁড় ভক্ত, তখন পিটারকে তারা কিং কং রিমেকের অফার দেয়।
কিংকং মুভির স্ক্রিপ্ট ১৯৯৬ সালেই লিখে ফেলেছিলেন পিটার। কিন্তু ১৯৯৭ সালে একই ধাঁচের মুভি ‘গডজিলা’ মুক্তি পেয়ে যাওয়াও, তিনি আরও কিছু সময় নেন। ১৯৯৮ সালে গরিলার মুভি ‘Mighty Joe Young’ মুক্তি পায়। এরপর আবার ২০০১ সালে আসে ‘Planet of the Apes’। তখন কিংকং নিয়ে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়ে যান তিনি। এর মধ্যে আবার দ্য লর্ড অভ দ্য রিংস মুভি নিয়ে ব্যস্ত হয়ে যাওয়ায় কিং কং নিয়ে ভাবারও সুযোগ পাননি। দ্য লর্ড অভ দ্য রিংস ট্রিলজি শেষ হবার পর এই ট্রিলজির রাইটার ফিলিপা বোয়েন্সকে নিয়ে আসেন পিটার, এবং লিখতে দেন কিং কং এর স্ক্রিপ্ট।
সিনেমা তৈরির অনুপ্রেরণা
সিনেমা জগতের দুই মাস্টারক্লাস, ‘দ্য লর্ড অভ দ্য রিং’ এবং ‘দ্য হবিট’ ট্রিলজির জন্য যদি কোনো জিনিস বড়সড় এক ধন্যবাদ প্রাপ্য থাকে, তা হচ্ছে কিং কং। কারণ, ‘কিং কং’ না থাকলে পিটার কখনো চলচ্চিত্র নির্মাতা হতেন কি-না, তা নিয়ে সন্দেহ থেকে যায়। ৯ বছর বয়সে পিটার ‘কিং কং’ (১৯৩৩) দেখেছিলেন, যা তাকে সেই ছেলেবেলাতেই চলচ্চিত্র নির্মাতা হবার অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল। ১২ বছর বয়সে তিনি কিং কং মুভি বানানোর পরিকল্পনা করে ফেলেছিলেন, নিজের ঘরে থাকা এক ক্যামেরা দিয়ে। বাচ্চাদের ফ্যান্টাসির জ্বালানি একসময় ফুরিয়ে এলেও, সেটা হয়নি পিটার জ্যাকসনের ক্ষেত্রে। নিজ স্বপ্নকে আঁকড়ে ধরে রেখেছিলেন তিনি, যার ফলে হলিউডের সেরা নির্মাতাদের কাতারে তার নামও উচ্চারণ করা হয়।
সিনেমার কুশীলব
আলোচনা করা যাক, এই মুভির কুশীলব নির্বাচনের ব্যাপারে। প্রথমে পিটার জ্যাকসন কার্ল ড্যানহাম চরিত্রের জন্য রবার্ট ডি নিরো, জর্জ ক্লুনির মতো অভিনেতাকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিন্তু কেউই তাতে রাজি হননি। এরপর রোল যায় ‘দ্য লর্ড অভ দ্য রিংস’ ট্রিলজির গ্যান্ডালফ চরিত্রে অভিনয় করা ইয়ান ম্যাককেলেনের কাছে। কিন্তু ওই সময় ইংল্যান্ডে এক থিয়েটার নাটকে ব্যস্ত থাকায়, তিনিও অপারগ ছিলেন। পরে এই চরিত্রের জন্য বেছে নেওয়া হয় আমেরিকান অভিনেতা জ্যাক ব্ল্যাককে। অ্যান ড্যারো চরিত্রের জন্য অডিশন দিয়েছিলেন নাটাইল পোর্টম্যান। কিন্তু তিনি অল্পবয়স্কা হওয়ায় তাকে নেওয়া হয়নি। জ্যাক ড্রিসকল চরিত্রের জন্য পরিচালকের মাথায় প্রথম এবং একমাত্র চয়েজ ছিলেন অ্যাড্রিয়েন ব্রডি। স্ক্রিপ্ট খতম হবার পর তার কাছেই সবার প্রথমে যান পরিচালক। লর্ড অভ দ্য রিংস ট্রিলজিতে গলুমের মোশন ক্যাপচার করা অভিনেতা অ্যান্ডি সারকিসকে পিটার নিয়েছিলেন কিং কংয়ের মোশন ক্যাপচারের জন্য। এটা এছাড়াও তিনি মুভিতে নাবিক লাম্পির রোলে অভিনয় করেছিলেন।
উচ্চতার বিভ্রান্তি
১৯৩৩ সালের কিং কং মুভি প্রমোশনের সময় এই কথা বলা হয়েছিল যে, কিং কংকে ৫০ ফুট লম্বা দেখানো হবে। এবং সিনেমায় ৫০ ফুট লম্বাই দেখানো হয়েছিল কংকে। কিন্তু আকার-আকৃতির অনুপাতে কং উচ্চতা ২৫ ফুট হবার কথা। সঠিক এই অনুপাত পিটার নিজ মুভিতে প্রয়োগ করে, কিং কংয়ের উচ্চতা ২৫ ফুটই রেখেছিলেন। কিন্তু ‘কং: স্কাল আইল্যান্ড’ (২০১৭) মুভিতে কংয়ের উচ্চতা ছিল ১০৪ ফুট। ২০২১ সালের মুক্তিপ্রাপ্ত ‘গডজিলা ভার্সেস কং’ মুভিতে কংয়ের উচ্চতা আরও বেশি, ১৫২ ফুট, যা পিটার জ্যাকসনের কং থেকে ১২৭ ফুট বেশি লম্বা।
সুদানীয় অভিনেতা
স্কাল আইল্যান্ডের আদিবাসীদের ভূমিকায় অভিনয়ের জন্য সুদান থেকে কৃষ্ণাঙ্গ অভিনেতাদের আনা হয়েছিল। তাদের অনেকেই ইংরেজিতে কথা বলতে পারত। এজন্য অনুবাদকের ব্যবস্থা করতে হয়েছিল প্রোডাকশন টিমকে। ঘণ্টার পর ঘণ্টার ব্যয় করে তাদের উপর প্রস্থেটিক মেকআপ করা হয়েছিল, যা তাদের পুরো জংলি রূপে উপস্থাপন করেছিল।
স্পেশাল ক্যামিও
প্রয়াত ক্লাসিক আমেরিকান অভিনেত্রী ফ্রে রে, যিনি ১৯৩৩ সালের কিং কং মুভিতে অ্যান ড্যারোর ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন, তাকে পিটার জ্যাকসন তার মুভিতে ছোট এক ক্যামিয়োর প্রস্তাব দিয়েছিলেন। কিং কং (২০০৫) মুভির শেষ দৃশ্যে ‘It was Beauty killed the Beast’ ডায়লগের জায়গায় ফ্রে রে’র থাকার কথা ছিল। কিন্তু সিনেমার প্রোডাকশনের কাজ যখন শুরু হয়, তখনই ইহলোকের মায়া ত্যাগ করে পরপারে পাড়ি জমিয়েছিলেন তিনি। এজন্য এই পরিকল্পনা আর সফল হয়নি। নইলে দারুণ এক ইস্টার এগ এবং ক্যামিও থাকত সিনেমার শেষে।
কিং কং গেম
কিং কং মুভির পাশাপাশি ২০০৫ সালে বিখ্যাত গেম নির্মাতা কোম্পানি ‘Ubisoft’ এক গেম লঞ্চ করে ‘Peter Jackson’s King Kong: The Official Game of the Movie’ নামে। গেমটি মূলত স্কাল আইল্যান্ডের অ্যাডভেঞ্চারের উপর ভিত্তি করে বানানো, যেটাতে এমন সব কাহিনি আর প্লট বর্ণিত আছে, যা থিয়েটার কাটে বাদ দেওয়া হয়েছিল।
ভিজুয়াল ইফেক্ট
কিং কং ছিল দৃষ্টিনন্দন ও চমৎকার সব ভিজুয়াল ইফেক্টের সমাহার। এই মুভিতে সব মিলিয়ে প্রায় ২৪০০ ভিজুয়াল ইফেক্ট শট ব্যবহার করা হয়েছে, সংখ্যায় যা ছিল যা বিগ বাজেটের স্টার ওয়ার্সের প্রিকুয়াল আর লর্ড অভ দ্য রিংসের চেয়েও বেশি। দ্য লর্ড অভ দ্য রিংসে কাজ করার সময় ভিএফএক্স আর সিজিআই সম্পর্কে অনেক বেশি জ্ঞানার্জন করেছিলেন পিটার। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়েছিলেন কিং কং মুভিতে। সিনেমার পুরো ভিএফএক্স সামলেছে ‘Weta Digital’ কোম্পানি।
গরিলার সাথে সখ্য
পিটার জ্যাকসন মুভিতে কংয়ের আচরণ মানুষের মতো দেখাতে চাননি। সেজন্য গরিলা নিয়ে অনেক বেশি পড়াশোনা করেছিলেন তিনি। তবে, রূপালী পর্দায় নিখুঁতভাবে কিং কংকে ফুটিয়ে তোলার সর্বোচ্চ কৃতিত্বটা হলো অভিনেতা অ্যান্ডি সারকিসের। গরিলার অভিব্যক্তি আয়ত্ত করতে তিনি লন্ডনের এক চিড়িয়াখানায় গিয়েছিলেন গরিলার সাথে দেখা করতে। সেখানে জাইরে নামের এক গরিলার সাথে দারুণ সখ্য গড়ে উঠেছিল তার। চরিত্রে অধিক নৈপুণ্য আনার জন্য তিনি আফ্রিকা মহাদেশের দেশ রুয়ান্ডার চিড়িয়াখানায়ও গিয়েছিলেন।
বক্স অফিস
শুরুর দিকে সিনেমার বাজেট ধরা হয়েছিল ১৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার। কিন্তু ডেভেলপমেন্টের সাথে সাথে বাড়তে থাকে খরচ, যা থেমেছিল ২০৭ মিলিয়ন ডলারে। কাহিনির খাতিরে সিনেমার দৈর্ঘ্য আরও ৩০ মিনিট বাড়িয়েছিলেন পিটার। ফলে ওই সময়ের সবচেয়ে ব্যয়বহুল মুভি ছিল কিং কং। বক্স অফিসে আগুন লাগিয়ে বিশ্বব্যাপী ৫৬২ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করেছিল এই সিনেমা। হয়েছিল ২০০৫ সালের সর্বোচ্চ আয়কৃত সেরা ৫ মুভির একটি। বক্স অফিস ছাড়াও শুধু উত্তর আমেরিকাতেই ৭.৬ মিলিয়ন কপি ডিভিডি বিক্রি হয়েছিল এই সিনেমার, যা থেকে প্রায় ১৯৪ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় হয়। এছাড়াও, টিভি রাইটস থেকে ৩৮ মিলিয়ন, এবং স্যাটেলাইট রাইটস থেকে ২৬ মিলিয়ন ডলার কামায় সিনেমাটি।
পুরষ্কার
বক্স অফিসের পাশাপাশি দর্শক ও সমালোচক মহলেও দারুণ সফলতা কুড়িয়েছিল কিং কং। অস্কারে এই সিনেমা মোট চার ক্যাটাগরিতে মনোনয়ন পেয়েছিল। এর মধ্যে সেরা সাউন্ড এডিটিং, সেরা সাউন্ড মিক্সিং, সেরা ভিজুয়াল ইফেক্ট ক্যাটাগরিতে পুরষ্কার বাগিয়ে নেয় কিং কং। এছাড়াও, স্যাটার্ন অ্যাওয়ার্ডে সেরা পরিচালক, সেরা অভিনেত্রী, এবং সেরা ভিজুয়াল ইফেক্টের পুরষ্কার জিতে এই মুভি।
সিকুয়েল
মনে প্রশ্ন জাগতে পারে, এত সফলতা অর্জনের পরেও কেন সিকুয়েল আসেনি কিং কংয়ের? উত্তরটা হলো, ২০১৩ সালে পিটার জ্যাকসন এর সিকুয়েলেই ফোকাস করতে চেয়েছিলেন, যেখানে তিনি পরিচালক হিসেবে এডাম উইনগার্ড, এবং স্ক্রিপ্ট রাইটার হিসেবে সাইমন ব্যারেটকে বেছে নিয়েছিলেন। সাইমন এই সিকুয়েলের গল্প সেট করেছিলেন প্রথম বিশ্বযুদ্ধের আমলে, যেখানে কিং কংয়ের পূর্বের সময়ের কাহিনি দেখানো হতো।
কিন্তু ইউনিভার্সাল পিকচার্সের ইচ্ছা ছিল না কিং কংয়ের সাথে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের কাহিনি তুলে আনার। সেজন্য উইনগার্ড প্রোডাকশন হাউজকে প্রস্তাব দিয়েছিলেন বর্তমান সময়ের কাহিনির অনুকরণেই মুভির স্ক্রিপ্ট বানানো হবে। কিন্তু ততদিনে কিং কংয়ের রাইটস ওয়ার্নার ব্রোসের কাছে বিক্রি করে দিয়েছিল তারা। তাই মুভির সিকুয়েল আর সফলতার মুখ দেখেনি। এর পরিবর্তে ২০১৭ সালে মনস্টারভার্সে ওয়ার্নার ব্রোস কংকে নিয়ে আসে ‘কং: স্কাল আইল্যান্ড’ মুভির মাধ্যমে।