Welcome to Roar Media's archive of content published from 2014 to 2023. As of 2024, Roar Media has ceased editorial operations and will no longer publish new content on this website.
The company has transitioned to a content production studio, offering creative solutions for brands and agencies.
To learn more about this transition, read our latest announcement here. To visit the new Roar Media website, click here.

পঞ্চায়েত: ওয়েব সিরিজে গ্রামীণ ভারতের প্রতিফলন

কিছুদিন যাবৎ ভারতীয় ওয়েব সিরিজের গল্পগুলোতে বেশ আধিপত্য দেখা যাচ্ছে পৌরাণিক কাহিনীর। স্যাক্রেড গেমসে প্রচ্ছন্নতার মধ্য দিয়ে শুরু, এরপর ‘অসুর’, ‘সমান্তর’ ও হালের ‘পাতাল লোক’। প্লটগুলোতে লক্ষ করা যাচ্ছিল হিন্দু পুরাণের গভীর প্রভাব। হিন্দু পুরাণকে বর্তমান সমাজের অসঙ্গতির সাথে খুব শৈল্পিকভাবে জুড়ে দেওয়া হযেছে সিরিজগুলোতে। ফলস্বরূপ প্রতিটি সিরিজই পেয়েছে তুমুল দর্শক জনপ্রিয়তা। যেহেতু পৃথিবীজুড়ে করোনা মহামারি চলছে, তাই বড় পর্দায় আপাতত বন্ধ আছে সিনেমা রিলিজ। এ সুযোগে ক্রাইম ড্রামা জনরার এসব ওয়েব সিরিজ রীতিমতো ঝড় তুলে দিচ্ছে দর্শক জনপ্রিয়তার। তবে স্রোতের বিপরীতে আজ অন্যরকম একটি গল্পের কথা বলতে চাই।

সম্প্রতি অ্যামাজন প্রাইম মুক্তি দিয়েছে টিভিএফ-এর ওয়েব সিরিজ ‘পঞ্চায়েত’। গতানুগতিক মুভি বা সিরিজ থেকে বেরিয়ে একটি অন্যরকম গল্পের কথা বলা হযেছে এ সিরিজে। অভিনয়, গল্প, সংলাপ প্রত্যেক বিভাগেই দুর্দান্ত নৈপুণ্যের দ্বারা তৈরি করা হয়েছে এই সিরিজ।

গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্র অভিষেক ত্রিপাঠী চরিত্রে অভিনয় করা জিতেন্দ্র কুমার শহুরে ছেলে। সবে ইঞ্জিনিয়ারিং পাশ করেছেন। বেশ কিছু চাকরির জন্য আবেদনও করেছিলেন, কিন্তু সিজিপিএ কম থাকায় পেছনে পড়েছেন কর্পোরেট চাকরির দৌড় থেকে। তাই একরকম বাধ্য হয়েই হাতে থাকা একমাত্র চাকরির জন্য রাজি হতে হয় তাকে। গ্রাম পঞ্চায়েত সচিব হিসেবে চলে যান উত্তর প্রদেশের গ্রাম ফুলেরায়। শুধু গ্রাম বললে আসলে ফুলেরার স্বরূপ বোঝা যায় না। তাই গল্পে বারবার করেই বলা হচ্ছিল ‘রুরাল ইন্ডিয়া’।

ভারতীয় গ্রাম বলতেই যারা বোঝেন শাহরুখের ‘স্বদেশ’ সিনেমার চরণপুর কিংবা গ্রাম মানে যাদের কাছের ওয়াসিপুর, তাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া হলো ভারতীয় গ্রামের এক অন্যরকম চিত্রায়ন। কোনো অতিমানবীয় কাহিনী নয়, বরং গ্রামীণ সমাজের বাস্তবতার নিরীখে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে গ্রামের প্রকৃত সমস্যাগুলো। অশিক্ষা, কুসংস্কার, বর্ণবৈষম্য, লিঙ্গবৈষম্য- এসব বিষয়ের চিত্রায়নে পরিচালক এতটাই সফল যে এক মুহূর্তের জন্যেও মনে হবে না, অতিরিক্ত কিছু করা হচ্ছে।

কেন্দ্রীয় চরিত্রে জিতেন্দ্র কুমার; Image source: socialnews xyz

গল্পের দ্বিতীয় প্রধান চরিত্র বৃজভূষণ পাণ্ডে চরিত্রে অভিনয় করেছেন রঘুবীর যাদব। বৃজভূষণ পাণ্ডে ফুলেরা গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধান। প্রকৃতপক্ষে এ গ্রামের পঞ্চায়েত প্রধানের পদটি সরকার কতৃক নারীদের জন্য সংরক্ষিত হওয়ায় বৃজভুষণ পাণ্ডে তার স্ত্রী মঞ্জু দেবীকে নির্বাচনে দাঁড় করান এবং জিতেও যান। কিন্তু গৃহিণী মঞ্জু দেবী ঘরের কাজ সামলাতে ব্যস্ত থাকায় মূলত স্বামীই পঞ্চায়েত পরিচালনা করেন। গ্রামের সবাই তাকেই প্রধানজি বলে ডাকেন। কাগজে-কলমে প্রধান মঞ্জু দেবী হলেও গ্রামের আসল প্রধান তিনিই। তবে গ্রামের প্রধান তিনি হলেও বাড়ির প্রধান কিন্তু মঞ্জু দেবীই। তাই প্রশাসনিক কাজে সবেকর্তা হলেও স্ত্রী মঞ্জু দেবীকে বেশ মেনে চলেন তিনি। গল্পে মঞ্জু দেবী চরিত্রে অভিনয় করেছেন নীনা গুপ্তা। নিঃসন্দেহে রঘুবীর যাদব ও নীনা গুপ্তা দুজনই গুণী ও অভিজ্ঞ অভিনেতা। তাদের দু’জনের মধ্যবর্তী সংলাপে পারিবারিক আবহ দৃশ্যমান, যা দর্শককে হারিয়ে যেতে বাধ্য করবে। তাদের দু’জনের জুটি পুরো গল্প জুড়ে এক নির্ভেজাল বিনোদনের খোরাক যোগাবে।

পঞ্চায়েত সিরিজের একটি দৃশ্যে রঘুবীর যাদব ও নীনা গুপ্তা; Image souce: amazon.com

এছাড়াও গল্পের পার্শ্বচরিত্রে অভিনয় করা প্রত্যেক শিল্পীই তাদের অভিনয় দক্ষতা দ্বারা গল্পটিকে উপভোগ্য করে তুলেছেন। সহকারী পঞ্চায়েত প্রধান চরিত্রে অভিনয় করা ফয়সাল মালিক ছিলেন অনবদ্য। ডেপুটি পঞ্চায়েত প্রধান হিসেবে তার অভিনয়ে তিনি একজন পুরোদস্তর গ্রাম্য মানুষের প্রতিনিধিত্ব করেছেন। তবে কঠিন সময়ে পঞ্চায়েত প্রধানকে পেছন থেকে শক্তি যোগানোর ব্যাপারটা তার চরিত্রটিকে শক্তিশালী করে তুলেছে। খারাপ সময়েও পাশে থেকে তিনি মূলত প্রধানের বিশ্বস্ততার পরিচয় দিয়েছেন। চরিত্রের প্রয়োজনে তার অভিনয় ছিল বেশ সাবলীল। পঞ্চায়েত অফিসের অফিস সহকারী চরিত্রে চন্দন রায়ের অভিনয়ও বেশ প্রশংসনীয়। শিক্ষিত হলেও গ্রাম্য পিছুটান তাকে বেশিদূর এগোতে দেয়নি। তাই কিছুটা কুসংস্কারাচ্ছন্ন হিসেবে দেখানো হয়েছে এই চরিত্রটিকে। কিন্তু চ্যালেঞ্জিং এই চরিত্রে বেশ প্রশংসনীয় অভিনয় করেছেন তিনি।

অফিস সহকারীর চরিত্রে চন্দন রায় ছিলেন বেশ প্রশংসনীয়; Image source: Amazon.com

গল্পের বাকি চরিত্রগুলোও প্রয়োজন অনুসারে নিজ নিজ জায়গা থেকে সর্বোচ্চটা দিয়েছেন। এছাড়াও কাহিনীর সংলাপ ছিল অনবদ্য। গ্রাম্য সংলাপের মাধ্যমে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সূক্ষ্ম রসবোধ। সংলাপগুলো এতটাই অনবদ্য ছিল যে আলাদা করে হাস্যরস সৃষ্টির প্রয়োজন পড়েনি। প্রত্যেকটি সংলাপেই দর্শক নিজের অজান্তেই ঠোঁট বাঁকিয়ে হাসবেন। কাহিনী বর্ণনাতেও বেশ দক্ষতা দেখানো হয়েছে। তাই দর্শককে কাহিনীর ভেতরে ঢুকিয়ে ফেলতে খুব বেশি সমস্যা হয়নি। এছাড়াও নেপথ্যসঙ্গীতও বেশ দক্ষতার সাথে জুড়ে যাবে আপনার মনে। তবে, সিরিজটির মেরুদণ্ড হলো এর অভিনয়। অভিনেতারা ঠিক ততটুকুই অভিনয় করেছেন, যতটুকু ছিল প্রয়োজন। অভিনয় শিল্পের এই পরিমিতি বোধটুকুই মূলত প্রাণবন্ত করে তুলেছে পুরো সিরিজটিকে। পরিচালক দীপক কুমার এখানে বেশ প্রশংসার দাবি রাখেন।

গল্পে কেন্দ্রীয় চরিত্রকে হরহামেশাই নায়ক হিসেবে দেখাবার চেষ্টা করা হয় ভারতীয় ওয়েব সিরিজগুলোতে। কিন্তু এদিক থেকেও ব্যতিক্রম এই সিরিজ। গল্পের কেন্দ্রীয় চরিত্রকে অতিমানবীয় করে তোলার কোনো চেষ্টাই করা হয়নি এখানে। নিঃসন্দেহে অভিষেক ত্রিপাঠী একটি বুদ্ধিদীপ্ত চরিত্র, কিন্তু তাকে মানবীয় বৈশিষ্টের মাধ্যমেই উপস্থাপন করা হয়েছে সিরিজটিতে। অশিক্ষা, কুসংস্কার ও অজ্ঞতা নিয়ে চলতে থাকা এসব মানুষদের পরিবর্তনের জন্য উদ্যোগ নিয়েছেন, আবার পরমুহূর্তেই তার চরিত্রে ফুটে উঠেছে বিরক্তি ও হতাশা। রক্তমাংসের মানুষের মতোই চরিত্রটি নিজেকে ভেঙেছে-গড়েছে পরিস্থিতির শিকার হয়ে। চলতে চলতে গ্রাম্য জীবনে দৈনন্দিন একঘেয়েমিতে অভ্যস্ত হতে থাকেন তিনিও। কিন্তু তার শহুরে সত্ত্বা তাকে যেন পেছন থেকে টেনে ধরে বার বার। অভিষেক ত্রিপাঠীর চরিত্রে অভিনয় করা জিতেন্দ্র কুমার টিভিএফ-এর বদৌলতে অনেক আগে থেকেই দর্শকদের মধ্যে বেশ জনপ্রিয়। তবে ইউটিউবের বাইরে বেরিয়ে এই ওয়েব সিরিজটিতে তিনি প্রমাণ করলেন, তিনি আসলে লম্বা দৌড়ের ঘোড়া।

পঞ্চায়েত সিরিজের একটি পোস্টার; Image source: Amazon.com

তবে সব ছাপিয়ে এ সিরিজের সবথেকে প্রশংসার দাবিদার গ্রামীণ জীবনের সারল্যের শৈল্পিক চিত্রায়ন। গ্রামের সাধারণ মানুষের সারল্য ও ছোট ছোট বিষয়ে সুখ খুঁজে পাওয়া দর্শকদের মুগ্ধ করবে। গ্রামীণ জীবনে সুখের এই অন্যরকম সংজ্ঞায়ন দর্শকদের গভীরভাবে ভাবতে বাধ্য করবে।তবে একটা বিষয় আলাদা করে বলতেই হয়, সিরিজের কোথাও কোনো কুসংস্কার, বৈষম্য ও অজ্ঞতা নিয়ে ব্যক্তিগত কোনো মতামত প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করা হয়নি; কিন্তু সিরিজ শেষে দর্শক এসব সমস্যা নিয়ে ভাবতে বাধ্য হযেছেন।

তবে একটা কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, আট পর্বের এই সিরিজটি শেষে দর্শক সিরিজের দ্বিতীয় সিজনের জন্য দিন গোনা শুরু করবেন। গল্পের একেবারে শেষে নতুন চরিত্রের কাহিনীতে প্রবেশ নিঃসন্দেহে দর্শকদের সে আগ্রহকে আরো বাড়িয়ে দেবে। দেরি না করে এখনই দেখে ফেলতে পারেন টিভিএফ-এর ওয়েব সিরিজ ‘পঞ্চায়েত’।

Related Articles