১৯৮০ এর দশককে বলা হয় সায়েন্স ফিকশন সিনেমার স্বর্ণযুগ। বর্তমান সময়ের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি তখন ছিল না, সুতরাং চোখ ধাঁধানো স্পেশাল ইফেক্ট বা অ্যানিমেশন নয়; গল্পের গাঁথুনি, অভিনয়শৈলী আর পরিচালকের মুনশিয়ানা- এই তিন মশলা ব্যবহার করে বানানো হত একেকটি কালোত্তীর্ণ সিনেমা। আর হ্যাঁ, রূপসজ্জা বা মেকআপ শিল্পীদের ভুলে গেলে চলবে না, তাদের উদ্ভাবনীমূলক শৈল্পিক হাতের ছোঁয়ায় প্রাণ পেত সিনেমাগুলোর কল্পিত চরিত্র- ভিনগ্রহের প্রাণী থেকে শুরু করে দৈত্যাকৃতির ভৌতিক জীব- সবকিছুই পর্দার আড়ালে কাজ করে যাওয়া এই রূপসজ্জা শিল্পীদের অবদান।
সায়েন্স ফিকশন সিনেমা বেশ কয়েক জনরা’র হতে পারে। কোনোটা ফ্যান্টাসি ঘরানার, কোনোটা সাসপেন্স, কোনোটা আবার ধুন্ধুমার অ্যাকশন। তেমনই এক জনপ্রিয় ঘরানা হচ্ছে হরর-সায়েন্স ফিকশন। কল্পবিজ্ঞানের পটভূমির সাথে ভৌতিক উপাদানের মিশেলে বানানো হয় হরর/সাই ফাই সিনেমা। ভবিষ্যতের পৃথিবীতে আধিভৌতিক কর্মকাণ্ডই মূলত এসব সিনেমার সারবস্তু। আজ আপনাদের আশির দশকের কিংবদন্তীতুল্য এক হরর/সাই ফাই সিনেমা সম্পর্কে জানানো হবে।
সিনেমা: দ্য থিং (The Thing)
পরিচালক: জন কারপেন্টার
আইএমডিবি রেটিং: ৮.২
কাহিনী সংক্ষেপ
জনমানবহীন অ্যান্টার্কটিকায় হঠাৎ বাতাস চিরে বেরিয়ে আসে গুলির শব্দ। তুষার আচ্ছাদিত মেরুঞ্চলে একটি হেলিকপ্টার তাড়া করছে এক কুকুরকে। সিনেমার প্রথম দৃশ্যে এমনটা দেখতে পারবেন দর্শকরা। রাইফেল নিশানা করে বারবার গুলি করছে হেলিকপ্টার আরোহী, পাইলট উড়ুক্কু যানটির নিয়ন্ত্রন সামলাতে হিমশিম খাচ্ছেন। কিন্তু প্রতিবারই নিশানা ব্যর্থ হওয়ায় বেঁচে যায় কুকুরটি। অবশেষে আমেরিকান বিজ্ঞানীদের গবেষণাগারে এসে হাজির হয় আপাতদৃশ্য নিরীহ এই চারপেয়ে প্রাণীটি। হেলিকপ্টারটি মূলত নিকটবর্তী নরওয়ের বিজ্ঞানীদের গবেষণাগার থেকে এসেছিল। আচমকা নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে হেলিকপ্টারটি বিধ্বস্ত হয়। মারা যায় দুই আরোহী।
ঘটনাস্থল পরিদর্শনে আসে আমেরিকান বিজ্ঞানীদের কয়েকজন। আরোহীদের পরিচয় জানতে পেরে নরওয়েজিয়ান গবেষণাগারে যাওয়ার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে তারা। কিন্তু নরওয়ের বিজ্ঞানীদের ঘাঁটিতে পৌঁছে তাদের পিলে চমকে যায়। আশ্চর্যরকমভাবে জায়গাটা নিস্তব্ধ আর নিঃসঙ্গ। কোনো মানুষের টিকিটাও দেখা যাচ্ছে না। কিংকর্তব্যবিমূঢ় আমেরিকানরা সহসাই আবিস্কার করে এক বিচিত্র দর্শন উড়োযান। দেখে মনে হবে, সেটি পৃথিবীর কোনো প্রাণী নয়, যেন ভিনগ্রহের অচেনা সত্তার কীর্তি। বিজ্ঞানীদের জন্য অপেক্ষা করছিল আরও একটি চমক, এক অদ্ভুতুড়ে প্রাণীর ঝলসানো লাশ। মানুষ কিংবা পশু নয়, সেই পোড়া শরীরটি কোনো অজানা ভুবনের বাসিন্দার।
নিরীক্ষার জন্য মৃতদেহটি নিয়ে নিজেদের ঘাঁটিতে ফিরে যায় আমেরিকানরা। আঁধার নেমে আসে বরফরাজ্যের আকাশে। কনকনে ঠাণ্ডার নিষ্ঠুরতা উপেক্ষা করে গবেষকদল নেমে পড়ে ঝলসানো লাশের রহস্য উদঘাটনে। এরপর কী অপেক্ষা করছে তাদের জন্য? কেনই বা হেলিকপ্টারের আরোহীরা মেরে ফেলতে চেয়েছিল সেই কুকুরটি? এসব প্রশ্নের উত্তর পেতে দেখতে হবে শ্বাসরুদ্ধকর উত্তেজনার এই হরর/সাই ফাই ক্ল্যাসিক। সিনেমাটির অসম্ভব সাসপেন্স আর ভয়াবহতা আপনাকে কুঁকড়ে যেতে বাধ্য করবে। তবে দেরী না করে দেখে ফেলুন ১০৯ মিনিটের সিনেমাটি। প্রচারণার সময় সিনেমার পোস্টারে ট্যাগলাইন হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছিল, “এনিটাইম, এনিহোয়্যার, এনিওয়ান”। শব্দত্রয়ী জানান দিচ্ছে, বিপদ আসতে পারে যেকোনো সময়ে, যে কেউ হতে অন্য ভুবনের আততায়ীর শিকার।
টুকরো গল্প
হরর সিনেমা নির্মাতাদের মধ্যে দ্রষ্টব্য স্থানীয় একজন হলেন জন কারপেন্টার। তার বানানো সিনেমাগুলো পরবর্তী প্রজন্মের পরিচালকদের প্রেরণা জুগিয়েছে অবিরাম। জন কারপেন্টার শুধু ভৌতিক সিনেমা পরিচালকের পরিচয়ে সীমাবদ্ধ থাকতে চাননি। একবার ভাবলেন, পঞ্চাশের দশকের সিনেমা ‘দ্য থিং ফ্রম এনাদার ওয়ার্ল্ড’ পুনঃনির্মাণ করবেন। যেই ভাবা সেই কাজ। ১৯৮২ সালে প্রযোজনা সংস্থা ইউনিভার্সাল পিকচার্স এর সাথে তৈরী করলেন সর্বকালের অন্যতম শ্রেষ্ঠ এই সাই ফাই সিনেমা। যদি বলা হয় সর্বশ্রেষ্ঠ রিমেক সিনেমা কোনটি? সে ক্ষেত্রেও দ্য থিং এর নাম তালিকার উপরের দিকেই থাকবে নিঃসন্দেহে।
দ্য থিং সিনেমায় মুখ্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন কার্ট রাসেল। আরো রয়েছেন উইলফোরড ব্রিমলি, কিথ ডেভিড, টি কে কার্টার প্রমুখ। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এই সিনেমায় কোনো নারী অভিনেতার দেখা পাবেন না। সম্পূর্ণ সিনেমায় কোন নারী অভিনেতার উপস্থিতি নেই। শুধুমাত্র একটি দৃশ্যে কম্পিউটারে এক নারীকন্ঠ শোনা যায়। জন কারপেন্টারের স্ত্রীর কন্ঠ ব্যবহার করা হয়েছে সেখানে।
কারপেন্টারকে একবার জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, তার নিজের বানানো সিনেমার মধ্যে সবচেয়ে প্রিয় কোনটি? তিনি অকপটে জবাব দিয়েছিলেন, ‘দ্য থিং’। আশির দশকে বড় বাজেটের হরর সিনেমা বানানো এক দুর্লভ ঘটনা। বেশীরভাগ ব্যবসাসফল হরর সিনেমার বাজেটই ছিল বড়জোর ১ মিলিয়ন ডলার বা সামান্য বেশী। কিন্তু দ্য থিং এর বাজেট ছিল ১০ মিলিয়ন ডলার! তৎকালীন সময়ে কোনো প্রযোজক এত বড় বাজেটে হরর সিনেমা বানানোর সাহস দেখাতেন না। কারপেন্টার তার সবচেয়ে প্রিয় সিনেমার পেছনে ঢেলে দেন অক্লান্ত পরিশ্রম আর সৃষ্টিশীলতা। আরেকজন মানুষের কথা বিশেষভাবে বলতে হবে। তিনি হলেন রব বটিন, দ্য থিং এর রুপসজ্জা আর স্পেশাল ইফেক্ট শিল্পী। মাত্র ২২ বছর বয়সে তিনি দ্য থিং এর জন্য তৈরী করেন অবিশ্বাস্য দক্ষতায় তৈরী কিছু স্পেশাল ইফেক্ট। হরর/সাই ফাই সিনেমায় এ ধরনের স্পেশাল ইফেক্ট কতটা গুরুত্বপূর্ণ সে কথা তো আগেই জানিয়েছি।
দ্য থিং প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেয়েই প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে আরেক সাই ফাই ক্ল্যাসিক ‘ব্লেড রানার’ এর সাথে। দুটো সিনেমার বেশ সাদৃশ্য রয়েছে। দুটোই কালজয়ী সাই ফাই সিনেমার তকমা পেয়েছে, আবার দুটো সিনেমাই মুক্তির পর বক্স অফিসে মুখ থুবড়ে পড়ে। দর্শক টানতে ব্যর্থ হয়। আজ প্রায় তিন দশকেরও বেশী সময় পর জনপ্রিয়তা ধরে রাখা সিনেমাগুলো ব্যবসাসফল হতে পারেনি, ভাবতেও অবাক লাগে। জন কারপেন্টার দুঃখ করে বলেছিলেন, দ্য থিং এর বক্স অফিস বিপর্যয়ে খুব কষ্ট পেয়েছিলেন তিনি।
দ্য থিং এর পটভূমি অ্যান্টার্কটিকার বরফের রাজ্য। সিনেমাটি কেন্দ্র করে সেখানে বেশ চমৎকার এক সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে। অ্যান্টার্কটিকায় ব্রিটিশ বিজ্ঞানীদের যত গবেষণা কেন্দ্র রয়েছে, সবকটিতে প্রতি বছর ২১ জুন ঘটা করে দেখা হয় সিনেমাটি। ‘মিডউইন্টার ফেস্টিভ্যাল’ নামের এক উৎসব উপলক্ষে আয়োজন করা হয় এই মুভি নাইট।
দ্য থিং এ যে নরওয়েজিয়ান বিজ্ঞানীদের গবেষণাকেন্দ্র ধ্বংস হয়ে যায়, সেখানে ঘটে যাওয়া কাহিনী উপজীব্য করে ২০১১ সালে মুক্তি পায় একই নামের আরেকটি সিনেমা, এর নামও দ্য থিং। মূল সিনেমায় কোনো নারী চরিত্র না থাকলেও এই নতুন সিনেমায় প্রধান ভূমিকায় রয়েছেন এক তরুণী। বিজ্ঞানের ছাত্রী কেট লয়েড এর চরিত্র রুপায়ন করেছেন মেরি এলিজাবেথ উইন্সটেড। নির্মাতারা বলছেন, ২০১১ সালের সিনেমাটি মূল সিনেমার প্রিক্যুয়েল, সুতরাং দুটি সিনেমার মধ্যে ভিন্ন যোগসূত্র আছে। যদি নতুন প্রিক্যুয়েল নির্মাণশৈলীতে মূল সিনেমার ধারেকাছেও আসতে পারেনি। জন কারপেন্টার দ্য থিং এর প্রিক্যুয়েল তৈরী হচ্ছে জেনে বেশ উচ্ছসিত হন। এমনকি তিনি নিজে একটি ছোট চরিত্রে অভিনয় করার আগ্রহ প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু শিডিউল জটিলতার কারণে তা আর সম্ভব হয়নি।
তা আর দেরী কেন, বাতি নিভিয়ে বসে পড়ুন ‘দ্য থিং’ দেখার জন্য। ভয় পাবেন, কথা দিচ্ছি!
ফিচার ইমেজ: ওয়ালপেপার অ্যাবিস