নেটফ্লিক্স, অ্যামাজন প্রাইম ভিডিওর মতো অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোর বদৌলতে বিশ্বব্যাপী ওয়েব সিরিজ ধারণাটি বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। তাদের দেখাদেখি আমাদের বাংলাদেশেও আজকাল নিয়মিতই ওয়েব সিরিজ নির্মিত হচ্ছে বটে, কিন্তু আদতে তার বেশিরভাগই ঘণ্টা দুয়েকের একটি টেলিভিশন প্রোডাকশনকে পনেরো-বিশ মিনিট করে মোট ছয় থেকে আটটি ‘এপিসোডে’ ভাগ করা ছাড়া আর কিছুই নয়।
সে কারণে বাংলাদেশি ওয়েব সিরিজগুলো এতদিন যতটা না সম্ভাবনা জাগিয়েছে, তার চেয়ে ঢের বেশি হতাশারই জন্ম দিয়েছে। ফলে বাংলাদেশের অনলাইন প্ল্যাটফর্মগুলোতে নতুন কোনো ওয়েব সিরিজ আসার কথা শুনলে এখন আর খুব একটা আশান্বিত হয় না মন, বরং আরো একটি আশাভঙ্গের প্রস্তুতিই যেন সেরে ফেলে। তবে ‘আগস্ট ১৪’ নামের ওয়েব সিরিজটি গোড়া থেকেই খানিকটা ভিন্ন ধরনের অনুভূতির জন্ম দিয়েছিল।
প্রথম কারণটিই হলো নির্মাতা হিসেবে শিহাব শাহীনের নাম। টেলিভিশনে রোমান্টিক ঘরানার নাটক, টেলিফিল্ম বানিয়ে হাত পাকানো এই সুনির্মাতা ‘ছুঁয়ে দিলে মন’-এর মতো চলচ্চিত্রও বানিয়েছেন। তাই তার কাজ যে ঠিক কেমন মানের হবে, তা নিয়ে কোনো সন্দেহের অবকাশ থাকে না। বরং সাম্প্রতিক সময়ে নিজের স্বস্তির জায়গা যে রোমান্টিক ঘরানা, সেখান থেকে বেরিয়ে এসে তিনি ভিন্নধর্মী কাহিনী পর্দায় তুলে আনছেন বলে, তার কাজ থেকে বৈচিত্র্যের প্রত্যাশাও বেড়ে গেছে বহুগুন।
আর দ্বিতীয় কারণ হলো এই সিরিজের ট্রেইলার। শুরুতেই সেখানে জানিয়ে বলে দেয়া হয়েছে, এর কাহিনী আবর্তিত হয়েছে ‘সত্য ঘটনার অনুপ্রেরণায়’। এটুকু দেখেই যে কেউ নড়েচড়ে বসতে বাধ্য হবেন। কেননা, সত্য ঘটনার ছায়া অবলম্বনে খুব বেশি নাটক-সিনেমা তো আমাদের দেশে নির্মিত হয় না। আর হলেও, সেগুলোর পরিণতি হয় ‘রানা প্লাজা’ কিংবা ‘শনিবার বিকেল’-এর মতো। ফলে পর্দায় কোনো সত্য ঘটনার উপস্থাপন দেখতে পাওয়া বাংলাদেশি দর্শকদের জন্য নিঃসন্দেহে পরম প্রাপ্তি।
এর পরেই যে প্রশ্নটি আসে, সেটি হলো- কোন সত্য ঘটনার কথা বলা হচ্ছে এখানে? সেটিও আপনি আঁচ করতে পারবেন ট্রেইলার থেকেই। সেখানে বলা হয়েছে:
“১৪ তারিখ রাত সাড়ে দশটার দিকে রফিক স্যার বাসায় আসেন। এরপর কেউ আর তাকে বাসা থেকে বেরোতেও দেখেনি, ঢুকতেও দেখেনি। তারপর তার বড় মেয়ে তুশি ভোরবেলা বাসা থেকে বেরিয়ে যায়…”
১৪ আগস্ট তারিখ, তুশি নামকরণ, পরবর্তী বিভিন্ন বিচ্ছিন্ন দৃশ্য, কিংবা ট্যাগলাইনগুলো থেকেই স্পষ্ট হয়ে যাওয়া যায়, এখানে বলা হচ্ছে ২০১৩ সালের সেই চাঞ্চল্যকর জোড়া খুনের কথা, যেখানে মালিবাগের চামেলীবাগের এক ফ্ল্যাটে ঐশী নামের এক কিশোরী কফির সঙ্গে ঘুমের বড়ি খাইয়ে বাবা-মাকে কুপিয়ে হত্যা করেছিল।
এছাড়া ট্রেইলারেই যেসব সাহসী দৃশ্যের অবতারণা ঘটে, সেই সঙ্গে হাড় হিম করা একটি নেপথ্য সঙ্গীতের মাধ্যমে রোমাঞ্চকর ও ভীতিপ্রদ আবহের জন্ম দেয়া হয়, তাতে থ্রিলারপ্রেমী যে কারো বাকেট লিস্টেই ‘মাস্ট ওয়াচ’ হিসেবে জায়গা করে নিতে বাধ্য এ সিরিজটি।
তবে এ তো গেল শুধু ট্রেইলারের কথা। ইতোপূর্বে এমন অনেক দৃষ্টান্ত দেখা গেছে, যেখানে ট্রেইলারে খুব প্রতিশ্রুতিশীল কিছু একটার ইঙ্গিত দেয়া হলেও শেষ পর্যন্ত দেখা গেছে, নিতান্তই গড়পড়তা কনটেন্ট হাজির করা হয়েছে দর্শকের সামনে। ফলে ‘আগস্ট ১৪’-এর বেলায়ও এমন কিছুর পুনরাবৃত্তির আশঙ্কা একেবারে উড়িয়ে দেয়া যাচ্ছিল না।
কিন্তু সব শঙ্কা-সংশয় দূর হতে খুব একটা সময় লাগেনি। প্রথম এপিসোডের মিনিট দশেক পেরোতেই বোঝা গেছে, অন্তত এই একটি বেলায় ট্রেইলারে যতটা গর্জন ছিল, মূল কনটেন্টেও বর্ষণ ঠিক ততটাই। কিংবা কে জানে, হয়তো আরো বেশিই।
কাহিনী জমাট বাঁধতে কিছুটা সময় লেগেছে বটে, এবং মূল ঘটনার ব্যাপারে আপনার তেমন ধারণা না থাকলে পর্দায় আসলে কী হচ্ছে, তা বুঝতে কিছুটা বেগ পেতেও হতে পারে। তবু যে কারণে আপনার চোখ পর্দায় সেঁটে থাকবে, সেটি হলো অসাধারণ নির্মাণ।
ডিটেইলিংয়ের দিকে এতটা যত্নশীল হতে বাংলাদেশি নির্মাতাদের সাধারণত দেখা যায় না। কিন্তু শিহাব শাহীন তা ছিলেন। প্রথম এপিসোডেই যখন দেখা যাবে, ১৫ আগস্ট সকালের যথার্থতা বজায় রাখতে রাস্তায় বঙ্গবন্ধুর ছবিসহ ব্যানার ঝুলছে, মাইকে ভেসে আসছে ঐতিহাসিক ৭ই মার্চের ভাষণ, তখন আপনাআপনিই আপনার মনে এক মুগ্ধতার সৃষ্টি হবে।
এই ডিটেইলিং মোটামুটি পুরো সিরিজ জুড়েই বজায় রাখা হয়েছে। যেমন- একপর্যায়ে শোনা গেছে নেপথ্যে ‘লুঙ্গি ডান্স’ গানটি। অনেকে হয়তো ভ্রু কুঁচকে ভাবতে পারেন, আবার হিন্দি গানের আমদানি কেন? অথচ ভেবে দেখুন, ২০১৩ সালের মাঝামাঝি সময়টায় রাস্তাঘাটে কি এই গানটিই সবচেয়ে বেশি শোনা যেত না? তাহলে একজন নির্মাতা যদি ২০১৩ সালের ওই সময়টির পুনর্নিমাণ করতে চান, তাহলে নিজের কাজের প্রতি কতটা দায়িত্ববান হলেই কেবল তিনি এতটা পারফেকশন বজায় রাখতে পারেন!
আরো মুগ্ধতা ছড়াবে একদম রিয়েল লোকেশনে দৃশ্যগুলো শ্যুট করা। শান্তিনগর, মালিবাগ, মগবাজার, বেইলি রোড, সুপ্রিম কোর্ট কিংবা রামপুরার মতো চিরচেনা জায়গাগুলোতেই হেঁটে-চলে বেড়াতে দেখা গেছে চরিত্রদের, যার ফলে সত্য ঘটনা উপস্থাপনের বিশ্বাসযোগ্যতাও আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। ‘স্যাক্রেড গেমস’-এর মুম্বাই কিংবা ‘পাতাল লোক’, ‘দিল্লি ক্রাইম’-এর দিল্লি শহরকে দেখে যাদের মনে এতদিন আফসোস ছিল, আমাদের ঢাকা শহরটাকে কেন কোনো থ্রিলার কাহিনীতে এভাবে দেখানো হয় না, যাতে শহরটিও কাহিনীর একটি গুরুত্বপূর্ণ চরিত্রে পরিণত হয়, তাদের মনে এই সিরিজ অবশ্যই এক অন্যরকম তৃপ্তির জন্ম দেবে।
চিত্রনাট্য ও সংলাপ এই সিরিজের আরেকটি শক্তিশালী দিক। খুবই গুরুতর একটি কাহিনীর মাঝে অহেতুক কমিক রিলিফ আনার তেমন চেষ্টা করেননি পরিচালক (শুধু একটি জায়গা বাদে)। বরং তুশির কাহিনীর সমান্তরালে গোয়েন্দা খালেদরূপী শতাব্দী ওয়াদুদের চরিত্রটির পারিবারিক জীবন ও তার মেয়ের অসুস্থতার দিকটি দেখানো ছিল একটি বুদ্ধিদীপ্ত পদক্ষেপ, যার ফলে চিত্রনাট্যের আবেগীয় দিকটিও আরোপিত মনে হয়নি, বরং শেষ দৃশ্যটি হয়ে উঠেছে অনেক বেশি অর্থবহ।
সংলাপে প্রচুর গালাগালি ছিল হয়তো, যা অনেক দর্শকের কাছেই অস্বস্তিকর মনে হতে পারে। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, বাস্তবেও দৈনন্দিন জীবনে উঠতে বসতে এমন ভাষাই আমাদেরকে শুনতে হয়। অনলাইন প্ল্যাটফর্মে এসেও যদি সংলাপের দিক থেকে এই বাস্তবানুগতা মেনে নেয়া না যায়, তাহলে তো চলে না।
একই কথা প্রযোজ্য সিরিজের তথাকথিত ‘সাহসী’ দৃশ্যগুলোর ব্যাপারেও। হ্যাঁ, এমন কিছু দৃশ্য অবশ্যই ছিল যার ফলে সিরিজটি সপরিবারে দেখার মতো নয়। কিন্তু ১৮+ সতর্কবাণী তো শুরুতেই দেয়া ছিল। তাছাড়া আপনি বিদেশী যেসব সিনেমা বা সিরিজ দেখেন, তার কয়টিই বা পরিবারের সবাইকে নিয়ে দেখার মতো?
একটি প্রশ্নই কেবল আসতে পারে, দৃশ্যগুলো কি অবান্তর ছিল, নাকি কাহিনীর প্রয়োজনেই এসেছে? উত্তরটিও খুব সহজ; কাহিনীর প্রয়োজনেই সেগুলো এসেছে। বিদেশী সিনেমা বা সিরিজে আমরা এর চেয়ে অনেক বেশি ‘সাহসিকতা’ দেখে অভ্যস্ত। অথচ এই সিরিজে ততটুকুই কেবল দেখানো হয়েছে, যতটুকু না দেখালেই নয়। আর সেটুকুও খুব রেখে-ঢেকেই দেখানো হয়েছে। এখন আপনি যদি দাবি করেন, ওটুকুও ছেঁটে ফেলা দরকার ছিল, সেক্ষেত্রে তুশি চরিত্রের যথাযথ চরিত্রায়ণ কি সম্ভব হতো?
গোয়েন্দা খালেদের চরিত্রটি নির্মাণেও শিহাব শাহীন পরিমিতিবোধ দেখিয়েছেন। গোয়েন্দা পুলিশ হলেই যে সে সুপারম্যানের মতো হয়ে যাবে, যা খুশি তা-ই করতে পারবে, এসব স্টেরিওটাইপ থেকে বেরিয়ে এসেছেন তিনি। খালেদ চরিত্রটির নাজুকতা-ভঙ্গুরতা যেমন দেখানো হয়েছে, ব্যক্তিজীবন ও কর্মজীবনের টানাপোড়েনও দেখানো হয়েছে, সর্বোপরি প্রতিটি দৃশ্যেই তাকে খুব বাস্তবসম্মত রূপে উপস্থাপন করা হয়েছে, যাতে দর্শকের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতার জায়গাটিতে বিন্দুমাত্র আঁচড় না লাগে।
এবার বলা যাক এই সিরিজের মূল প্রাণ সম্পর্কে। তিনি নিঃসন্দেহে তুশি চরিত্রে অভিনয় করা তাসনুভা তিশা। বহুব্যবহারে ক্লিষ্ট ‘অসাধারণ’ শব্দটিই প্রথম মাথায় আসে তাকে সংজ্ঞায়িত করতে গিয়ে, কিন্তু এই একটি ক্ষেত্রে ঐ বিশেষণটি আক্ষরিক অর্থেই ধরতে পারেন। সিরিজের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত তিনি যেন তুশি হয়েই ছিলেন।
সাধারণত বাংলাদেশি নাটক-সিনেমায় কোনো অভিনেতাকে চরিত্রের এতটা ভেতরে ঢুকে যেতে দেখা যায় না। কিন্তু তিশার বেলায় সেটি দেখা গেছে। তিনি পুরোপুরি তুশি হয়ে গিয়ে তুশির মতো তাকিয়েছেন, হেঁটেছেন, কথা বলেছেন, হেসেছেন। তার চোখ ও শরীরের ভাষা, অভিব্যক্তি, সবকিছুই ছিল দুর্দান্ত। একটি মাদকাসক্ত কিংবা মানসিক ভারসাম্যহীন কিশোরীর চরিত্রে নিজেকে উজাড় করে দিয়েছেন তিনি।
তিশা যখন সাইকোর মতো হেসেছেন, তাতে হয়তো শুধু পর্দার ভেতরে কাজের মেয়েটিই ভয় পায়নি, পর্দার এপাশ থেকে বুকে কাঁপন ধরে যাবে আপনারও। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে চাবিওয়ালাকে ডাকতে তার লাস্যময়ী চাহনী, প্রবল উত্তেজনায় ল্যাপটপের পর্দায় ডুবে যাওয়া, দীর্ঘদিন নেশাদ্রব্য না পেয়ে সমগ্র শরীরে ফুটে ওঠা অসহনীয়তা, কিংবা ক্রাইম সিনে ফিরে গিয়ে নিজের বিবেকের সাথে লড়াই করতে না পেরে হার স্বীকার করে নেয়া, সব ধরনের দৃশ্যপটেই তিশা ছিলেন তার অভিনয়জীবনের তুঙ্গে। ইতোপূর্বে এত ভালো অভিনয় তিনি আগে করেননি। হয়তো এই চরিত্রটিই তার ক্যারিয়ারের মোড় ঘুরিয়ে দেবে।
তিশাকে এই সিরিজে দেখার পর আরো একটি ধারণা বদ্ধমূল হয়েছে যে, বাংলাদেশি অভিনয়শিল্পীদের মাঝে আসলে প্রতিভার অতটাও কমতি নেই, যতটা আমরা মনে করি। প্রয়োজন শুধু তাদেরকে ঠিকভাবে কাজে লাগানো, তাদের ভেতর থেকে সেরাটা নিংড়ে আনা। এ কাজটি সব নির্মাতা করতে পারেন না। শিহাব শাহীন তা করে দেখিয়েছেন।
একই রকম সেরাটা তিনি বের করে এনেছেন শতাব্দী ওয়াদুদের ভেতর থেকেও। শতাব্দী পরীক্ষিত অভিনেতা, সুযোগ পেলে ছক্কা হাঁকাতে ছাড়েন না। এই চরিত্রটি তার জন্য সেরকমই মস্ত বড় একটি সুযোগ ছিল নিজের জাত চেনানোর। কিন্তু যেমনটি আগেই বলেছি, তার চরিত্রটির সামনে চ্যালেঞ্জ ছিল ওভার-দ্য-টপ কিছু না করে বসারও। সেই চ্যালেঞ্জে তিনি উতরে গেছেন। আবেগের আতিশায্যে ভেসে না গিয়ে, সংযত অভিনয় করেছেন। লাইমলাইট নিজে কেড়ে না নিয়ে, তিশাকে সেটি নিতে দিয়েছেন; কারণ, সেটিই ছিল কাহিনীর চাহিদা।
সত্যি বলতে কী, ‘আগস্ট ১৪’ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে একটি বিরলতম কাজ, যেখানে একজন অভিনেতাও খুব একটা অতি-অভিনয় করেননি। পরিশীলিত অভিনয় তাই এই সিরিজের একটি বড় ইতিবাচক দিক। তারপরও পার্শ্বচরিত্রদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য শহীদুজ্জামান সেলিম। কর্মজীবনে তিনি কী, তা এ সিরিজে মুখ্য ছিল না। এ সিরিজে তার উপস্থিতি তুশির বাবা হিসেবে। এবং বাবা চরিত্রটিকে তিনিও দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। সন্তানের প্রতি নিজের স্নেহ-ভালোবাসা, সন্তান নষ্ট হতে বসায় অসহায়তা, মনস্তাপ, চরিত্রের এই সব শেডেই তিনি ছিলেন অনবদ্য।
মা হিসেবে মুনিরা মিঠুও মন্দ ছিলেন না। বিশেষ করে আপন মেয়ের হাতে আক্রমণের শিকার হয়ে তার বলা “আমি তোর মা” কিংবা পানি চাওয়ার দৃশ্যগুলো মনে দাগ কাটার মতো। এছাড়া অন্য সকল অভিনেতাই নিজ নিজ চরিত্রে যথেষ্ট ভালো কাজ করেছেন। আলাদা করে বলতেই হবে, কাজের মেয়ে রেশমীর চরিত্রে অভিনয় করা শিশুশিল্পীটির কথা। তার লম্বা সময় ধরে নির্বাক থাকা, ডুকরে কেঁদে ওঠা কিংবা চোখে-মুখে চাপা আতঙ্ক ছাড়া তুশির চরিত্রের ভয়াবহ দিকগুলো ঠিকভাবে উপলব্ধি করা যেত না। তাছাড়া শাওনের করা জিমি চরিত্রটির আশানুরূপ গভীরতা না থাকলেও, শাওন নিজের অংশটুকুতে বেশ সাবলীল অভিনয় করেছেন।
সিরিজের একদম শুরুতেই রাতের ঢাকাকে পর্দায় রেখে নফসের ব্যাখ্যা দেয়া, কিংবা তারও আগে কলাকুশলীদের নাম দেখানোর সাথে সাথে ‘গভীরে মিশে থাকি, আরো গভীরে চলে যাই’ গানটির উপস্থিতি ছিল মাস্টার স্ট্রোক পর্যায়ে। একইসাথে যেমন এর মাধ্যমে সিরিজ থেকে আপনার কী প্রত্যাশা করা উচিত, সে সম্পর্কে ধারণা পেয়ে যাবেন, তেমনই সিরিজের একটি ডার্ক টোনও আপনার মনে ঢুকে যাবে, যা আপনাকে সঙ্গ দেবে একদম শেষ পর্যন্ত।
বিশেষ সাধুবাদ পাওনা পোশাক পরিকল্পনায় থাকা ফারজানা সান এবং শিল্পে মো: ফারুকের। এছাড়া খৈয়াম শানু সন্ধির আবহ সঙ্গীত, নাজমুল হাসানের ডিওপি কিংবা জোবায়ের আবীর পিয়ালের এডিট, কালার, সাউন্ড ও গ্রাফিক্স, সবই এই সিরিজের মূল্যবান সম্পদ, যা আপনার দেখার অভিজ্ঞতাকে আরো একধাপ উপরে নিয়ে যাবে।
সব শেষে যে বিষয়টি নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন, তা হলো বাংলাদেশে এমন একটি সিরিজের আদৌ প্রয়োজন ছিল কি না, আর থাকলে তা কতটুকু।
প্রথম কথা হচ্ছে, অবশ্যই এমন সিরিজ এসেছে সময়ের প্রয়োজনে। সত্য ঘটনার ছায়া অবলম্বনে নির্মিত ফিকশন পর্দায় দেখার দাবি বাংলাদেশি দর্শকের মনে ছিল বহুদিন ধরে। অবশেষে সেই দাবি মিটল, এবং বেশ ভালোভাবেই মিটল। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে, সীমিত বাজেটে যা বানানো হয়েছে, তা অবশ্যই প্রশংসনীয়।
তাছাড়া এই সিরিজ যে বার্তা দেয়, সেটিও কিন্তু কম মূল্যবান নয়। আমরা এখন এমন একটা সময়ে বসবাস করছি, যখন তরুণ প্রজন্ম মাদকের ভয়াল থাবায় জর্জরিত হয়ে যাচ্ছে। সামাজিক কাঠামোতেও এতটা পচন ধরেছে যে, তাতে করে পরিবারের মতো আদিমতম প্রতিষ্ঠানও হুমকির মুখে পড়ে যাচ্ছে, সন্তান তার বাবা-মাকেও ঠাণ্ডা মাথায় খুন করতে দ্বিধা করছে না। এই যখন আমাদের বর্তমান সমাজবাস্তবতা, তখন বিনোদন মাধ্যমে স্রেফ প্রেম-ভালোবাসা কিংবা কাল্পনিক রহস্য-রোমাঞ্চে সীমাবদ্ধ থাকলে কি আর চলে?
এ ধরনের বিষয়বস্তু নিয়ে আরো বেশি নির্মাণ প্রয়োজন, এবং তা যদি সত্য ঘটনার সরাসরি কিংবা ছায়া অবলম্বনে হয়, তাহলে তো আরো ভালো। শিহাব শাহীনকে ধন্যবাদ সাহসিকতার সাথে বাংলাদেশের বিনোদন জগতে একটা নতুন পথ তৈরি করে দেয়ার জন্য। ‘আগস্ট ১৪’ তো কেবল পথচলার শুরু। এই পথ ভবিষ্যতে দেশের অন্যান্য মেধাবী নির্মাতাদের পদচারণায়ও মুখরিত হয়ে উঠবে, আর আমরা পাব এমনই অসাধারণ সব কনটেন্ট, এমনটিই প্রত্যাশা।