চলচ্চিত্রপ্রেমীদের মনে ডিজনির ছবিগুলো সবসময়ই একটি বিশেষ আবেদন বহন করে। এমন অনেক চলচ্চিত্রপ্রেমীকেই খুঁজে পাওয়া যাবে, যারা বড় হয়ে অন্যান্য ‘পরিণত’ কাহিনী ও বিষয়বস্তুর ছবি দেখতে অভ্যস্ত হলেও, ছোটবেলার প্রায় পুরোটাই ব্যয় করেছে ডিজনির কাল্পনিক রূপকথার ভূবনে।
তবে ডিজনির ছবির বিশারদ হওয়াটা খুব জরুরি কিছু নয়। মোটামুটি যারা ডিজনির চার-পাঁচটি ছবিও অন্তত দেখেছেন, তারা নিশ্চয়ই ছবিগুলোর মধ্যে কিছু অন্তর্নিহিত মিল খুঁজে পেয়েছেন।
যেমন ধরুন, ডিজনির প্রায় সকল ছবিতেই একজন কমবয়েসি নায়ক বা নায়িকা থাকে। আর তার সাথে থাকে একজন বিশ্বস্ত সহচর। নায়ক বা নায়িকাকে টেক্কা দেয়ার মতো একজন ভয়ংকর বা নিষ্ঠুর খলনায়কেরও (কিংবা খলনায়িকার) উপস্থিতি থাকে। জাদুবিদ্যা কাহিনীতে একটি বড় ভূমিকা পালন করে, এবং কাহিনীর একপর্যায়ে মূল চরিত্রের বড় ধরনের কোনো রূপান্তর ঘটে- হতে পারে সেটি শারীরিক, কিংবা মানসিক। মনোমুগ্ধকর সঙ্গীত থাকে দর্শকশ্রোতাকে সুরের ভেলায় ভাসিয়ে নিয়ে যেতে। এছাড়া ভালোবাসা, আত্মবিসর্জন, প্রতিবন্ধকতা ও ঝুঁকির মাধ্যমে কাহিনী একটি মধুর সমাপ্তির দিকে এগিয়ে চলে।
তবে ডিজনির ছবিতে এই বিষয়গুলো যেমন অবধারিত, তেমনই আজকাল কিছু জিনিস নিশ্চিতভাবেই থাকে ডিজনির ছবি থেকে অনুপস্থিত। কী সেগুলো? ২০১৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত পিট’স ড্রাগন ছবির পরিচালক ডেভিড লোয়ারি এইন’ট ইট কুল নিউজকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে খোলাসা করেছেন তা।
যখন আপনি ডিজনির সাথে চুক্তি স্বাক্ষর করেন, তখন সেখানে লেখা থাকে আপনার ছবিতে তিনটি বিশেষ জিনিস রাখা যাবে না – শিরশ্ছেদ, শূলে চড়ানো এবং ধূমপান।
লোয়ারি তার সাক্ষাৎকারে এটি অবশ্য নিশ্চিত করে বলেননি যে, এই নিয়মগুলো কি কেবল শিশুতোষ চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেই প্রযোজ্য, নাকি প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য নির্মিত ছবিতেও। তবে ধূমপান নিষিদ্ধের বিষয়টিতে যারা অবাক হচ্ছেন, তাদের জ্ঞাতার্থে জানানো যাচ্ছে, ২০১৫ সাল থেকেই এই নিয়মটি চলে আসছে। সে বছর ওয়াল্ট ডিজনি কোম্পানির চেয়ারম্যান ও সিইও বব আইগার সব ধরনের ডিজনি চলচ্চিত্র থেকে ধূমপান নিষিদ্ধ করেন। ব্যতিক্রম কেবল আর-রেটেড ছবিগুলো, কিংবা সাধারণ ছবির সেসব দৃশ্য, যেখানে ঐতিহাসিক যথার্থতা প্রদর্শনের জন্য ধূমপানের কোনো বিকল্প নেই।
অনেকেই হয়তো লেখাটি পড়ে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন এই ভেবে যে, পিনোকিও সেই ১৯৪০ সালেই মুক্তি পেয়ে গিয়েছিল। কারণ ছবিটি যদি বর্তমান সময়ে নির্মিত হতো বা মুক্তি পেত, তাহলে বিলিয়ার্ড খেলার ফাঁকে পিনোকিওর সিগার ফোঁকার বিখ্যাত দৃশ্যটি অবশ্যই কাটা পড়ত। এছাড়া বদলে যেত আরো কিছু ধ্রুপদী ছবি, যেমন- ১০১ ডালমেশিয়ানস, পিটার প্যান, হারকিউলিস, আলাদিন ইত্যাদি, যেখানে ধূমপানের দৃশ্য রয়েছে।
অবশ্য শিরশ্ছেদের বিষয়টি ডিজনি তাদের পথচলার শুরু থেকেই এড়িয়ে এসেছে। যেমন- অ্যালিস’স অ্যাডভেঞ্চার্স ইন ওয়ান্ডারল্যান্ডে কুইন অব হার্টস বিষয়টির ইঙ্গিত দিয়েছিল বটে, কিন্তু পর্দায় তাকে কখনোই এমন কিছু করতে দেখা যায়নি। তবে একটি বিষয় মোটামুটি নিশ্চিতভাবেই বলা যায় যে, দ্য লায়ন কিং আজকের দিনে নির্মিত হলে সেটির সেই ভীতিপ্রদ শেষ দৃশ্যটিও আর থাকত না। কারণ আজকের ডিজনি যেকোনো মাত্রাতিরিক্ত সহিংসতাকেই সমর্থন করে না!
এদিকে অনেকেই হয়তো লক্ষ্য করে দেখেছেন যে, ডিজনির অধিকাংশ অ্যানিমেটেড ছবিতেই কমবয়েসি প্রধান চরিত্রটি তার মা, কিংবা বাবা-মা উভয়কে ছাড়াই বেড়ে ওঠে। প্রধান চরিত্রটি ছোটবেলাতেই তার মাকে হারিয়েছে, কিংবা পুরো ছবিতে মায়ের কোনো উল্লেখই ছিল না, ডিজনির এমন ছবির তালিকা করতে বসলে বেশ লম্বাই হবে সেটি।
স্নো হোয়াইট, বাম্বি, সিন্ডারেলা, পিটার প্যান, দ্য জাঙ্গল বুক, দ্য ফক্স অ্যান্ড দ্য হাউন্ড, দ্য গ্রেট মাউস ডিটেকটিভ, দ্য লিটল মারমেইড, বিউটি অ্যান্ড দ্য বিস্ট, আলাদিন, পোকাহোন্টাস। দ্য হাঞ্চব্যাক অব নটরডেম, দ্য এম্পেরর’স নিউ গ্রুভ- এই প্রতিটি ছবিতেই প্রধান চরিত্রেরা মাতৃহীন ছিল।
কখনো কি ভেবে দেখেছেন, এমনটি হলো কেন? আপনি না ভাবলেও, এমন অনেকেই আছে যাদেরকে এই প্রশ্নটি তাড়া করে বেড়িয়েছে। তারা দিন-রাত একাকার করে ভেবেছে, কেন পরিবারের সবাই একসাথে মিলে দেখবার মতো ছবিগুলোতে প্রধান চরিত্রকে মাতৃহীন রূপে উপস্থাপন করা হয়েছে। শেষ পর্যন্ত চরিত্রগুলোর মধুর সমাপ্তি হয়তো হয়েছে, কিন্তু মায়ের আদরই যে তারা কখনো উপভোগ করতে পারল না। কেন প্রধান চরিত্রদেরকে মায়ের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ করে দিতে ডিজনি কর্তৃপক্ষের এত অনীহা?
সম্প্রতি গ্ল্যামারকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে এ প্রশ্নের দুটি সম্ভাব্য ব্যাখ্যা দিয়েছেন ম্যালেফিসেন্টের নির্বাহী প্রযোজন ডন হান, যিনি ইতিপূর্বে কাজ করেছেন দ্য লায়ন কিং ও দ্য নাইটমেয়ার বিফোর ক্রিসমাসের মতো ধ্রুপদী ছবিগুলোতেও।
একটি কারণ খুবই বাস্তবসম্মত। ছবিগুলো মাত্র ৮০ থেকে ৯০ মিনিটের, এবং এগুলোর মূল বিষয়বস্তু হলো বেড়ে ওঠা। ছবিগুলো হলো আপনার জীবনের এমন একটি দিনের কাহিনী নিয়ে, যেদিন আপনাকে জীবনের দায়িত্বগুলো স্বীকার করে নিতে হবে। সিম্বা বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়েছিল, কিন্তু পরে তাকে ফিরে আসতে হয়। অল্প কথায় বলতে গেলে, যদি আপনি বাবা-মাকে বাদ দিয়ে দেন, তাহলে চরিত্রগুলোর পক্ষে বেড়ে ওঠার গতি ত্বরান্বিত হয়। বাম্বির মা মারা গিয়েছে, তাই তাকে এখনই বেড়ে উঠতে হবে- বিষয়টি ঠিক এমন।
এছাড়া হান অপর যে ব্যাখ্যাটি দিয়েছিলেন, সেটি অনেক বেশি মর্মান্তিক, ফলে যে কারো পক্ষেই সেটি হজম করা কষ্টকর হবে।
ওয়াল্ট ডিজনির জীবনীগ্রন্থ “How to Be Like Walt: Capturing the Disney Magic Every Day of Your Life“ থেকে আমরা জানতে পারি, ওয়াল্ট এবং তার ভাই রয় দুজন মিলে ১৯৩৭ সালে তাদের বাবা-মায়ের জন্য লস অ্যাঞ্জেলেসে একটি বাড়ি কিনেছিলেন। এর এক বছর বাদে, নভেম্বরের এক সকালে ওয়াল্টের মা তাকে ফোন করে জিজ্ঞেস করেন, তাদের বাড়িতে যে গ্যাস ফার্নেসটি লিক করছে, সেটিকে সারানো সম্ভব কি না।
ওয়াল্ট তখন তার স্টুডিও থেকে কয়েকজন মিস্ত্রীকে পাঠিয়ে দেন ফার্নেসটি সারানোর জন্য। কিন্তু পরে যখন তার বাবা-মা সেই বাড়িতে ফিরে আসেন, ফার্নেসটি আবারো লিক করে, এবং তার মা মারা যান। এই ঘটনায় প্রচন্ড আঘাত পান ওয়াল্ট। তিনি কখনো কারো সাথে এই বিষয়টি নিয়ে কোনো কথা বলেননি বটে, কিন্তু বুঝে নিতে অসুবিধা হয় না যে মায়ের মৃত্যুর জন্য তিনি নিজেকেই দায়ী করতেন।
ওয়াল্টের মা মারা যান ২৬ নভেম্বর, ১৯৩৮ সালে। ততদিনে ওয়াল্টের স্নো হোয়াইট অ্যান্ড দ্য সেভেন ডোয়ার্ভস ছবিটি মুক্তি পেয়ে দারুণ সাফল্য পেয়ে গেছে, আর পিনোকিও ছবিটির কাজ চলছে।
এই ঘটনার সূত্র ধরে হান বলেন,
এটি খুবই ট্র্যাজিক একটি বিষয় যে তিনি (ওয়াল্ট) মায়ের মৃত্যুর জন্য নিজেকে দায়ী করতেন, যদিও এখানে তার কোনো দোষই ছিল না। আপনারা যদি একটু খুঁজে দেখেন, এ বিষয়ে আরো লেখা পাবেন। তাদের পরিবারের মধ্যেও এটি কোনো গোপন বিষয় ছিল না।
সুতরাং হান যা বোঝাতে চাচ্ছেন তা হলো, মায়ের মৃত্যুর জন্য ওয়াল্ট নিজেকেই দায়ী করতেন বলেই, পরবর্তীতে তিনি তার ছবিগুলোতে প্রধান চরিত্রগুলোকে মাতৃহারা রাখতেন। কারণ হয়তো তিনি বিশ্বাস করতেন, মাতৃহীন চরিত্রগুলোর সাথে তিনি আরো ভালোভাবে একাত্ম হতে পারবেন, পর্দায় সেগুলোকে তুলে ধরতে পারবেন, এবং দর্শকও এমন চরিত্রগুলোর প্রতি বেশি সহানুভূতিশীল হবে।
অবশ্য এ কথাও ভুলে গেলে চলবে না যে, প্রধান চরিত্রগুলোকে মাতৃহীন করা সবসময় ওয়াল্টের নিজের সিদ্ধান্তই ছিল না। অনেকগুলো মূল কাহিনীতেও চরিত্রগুলো মাতৃহীন ছিল, আর তাই ছবিতেও তাদেরকে মাতৃহীন রূপেই দেখানো হয়েছে।
চমৎকার সব বিষয়ে রোর বাংলায় লিখতে আজই আপনার লেখাটি পাঠিয়ে দিন এই লিঙ্কে: roar.media/contribute/