ডিজিটাল এ যুগে বসে অন্য দেশ বা অন্য দেশের অনুকরণ ছাড়াও যে আমাদের দেশের চলচ্চিত্র ভালো কিছু সিনেমা তৈরি করে সাফল্য বয়ে নিয়ে আসতে পারে, তা প্রমাণ হয়ে গিয়েছে বিগত কতক বছরেই। কে বলেছে যে বর্তমানে ভালো কাজ কিছুই হচ্ছে না? আরে, ভালো কাজের পরিমাণ যদি হতো ভুরিভোজের মতো, তাহলে কি আমরা এত সহজে ভালো কাজের মর্ম বুঝতে পারতাম? ভালো কাজের সংখ্যা হয় কম, কিন্তু তার মান হয় অন্তরে গেঁথে থাকার মতোই।
এইতো বেশ কিছুদিন আগেই তোলপাড় করা জুঁই নারিকেল তেলের বিজ্ঞাপনের কথাই ধরুন না কেন? খুব সামান্য একটি দৃশ্যপটের অবতারণায় মাত্র দেড় মিনিটের বিজ্ঞাপনে নারীর প্রতি শারীরিক নির্যাতনের মাধ্যমে যে সামাজিক প্রেক্ষাপটের করুণ চিত্র দারুণভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে তা সত্যিই অভাবনীয়। নেপাল, ভুটান, ভারত সহ নিউইয়র্ক টাইমস- এমন কোনো জায়গা নেই যেখানে এই বিজ্ঞাপনের বিষয়টি কড়া নাড়ে নি একবারের জন্যে হলেও। সব জায়গায় তুমুল প্রশংসা কুড়িয়েছে সেই বিজ্ঞাপন। কোনো রকম কপি পেস্ট ছাড়া খাঁটি বাংলাদেশী এই বিজ্ঞাপনটি কান ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে দেখানোর ঘটনা বাংলাদেশের ইতিহাসেই প্রথম।
বিজ্ঞাপন বা সিনেমা যা-ই বলি না কেন, এসব মিডিয়া জগতের মাধ্যমে যত সহজে ভালো কিছু জনসাধারণকে বোঝানো যায়, হাজারো মাইকিং বা চিৎকার-চেঁচামেচি, জনসমাবেশ দ্বারা তা সম্ভব নয়।
তবে হ্যাঁ, সিনেমা বা চলচ্চিত্রের বিষয়বস্তু অবশ্যই মান সম্মত এবং নজরকাড়া হলে তখনই তার ঠিকানা হতে পারে আমার-আপনার মতো আমজনতার অন্তরে অন্তরে। বর্তমান যুগ উন্নত বিশ্বের সাথে তাল মিলিয়ে উন্নত প্রযুক্তির দ্বার প্রান্তে হলেও আজও অনেককেই বলতে শোনা যায়, আমাদের ষাট, সত্তর, আশির দশকের পরিচালক, অভিনেতা-অভিনেত্রীরাই ছিলেন সত্যিকারের সেরাদের সেরা। স্বীকার করছি যে, তাদের প্রতিভা অতুলনীয়। তাই বলে যে বর্তমানে ভালো কোনো চলচিত্র বা সিনেমা নির্মাণ হচ্ছে না, সে কথার বিরুদ্ধে জোরালো সমর্থন রইলো। আর সে জন্যেই, রোয়ার বাংলা‘র মাধ্যমেই তুলে ধরছি বাংলাদেশের এমন কিছু সেরা সেরা সিনেমার কথা যা সত্যিই হলিউড, বলিউডের সিনেমাগুলোর সাথে সমান তালে তাল মেলাতে সক্ষম।
“বো…জো নাই ব্যাপারটা?” -হ্যাঁ, খুব পরিচিত শোনাচ্ছে কি এই শব্দটা? অসাধারণ একটা সিনেমা ‘আয়নাবাজি’তেই কিছু বিশেষ অংশে ব্যবহার হয়েছে এই শব্দটি আঞ্চলিক টিউনে। প্রথমেই আসি সেই সেরা মুভি সম্পর্কে এমন কিছু বিষয় নিয়ে যা সত্যিই বলতে বাধ্য করে যে হাজারো অরাজকতা, দুর্নীতি, সামাজিক অবক্ষয়ের মাঝেও বাংলাদেশে এখনও ভালো কিছু করা সম্ভব, যদি মনোযোগ আর সদিচ্ছেটা ঠিক মনের ভেতর থেকেই আসে।
আয়নাবাজি
সবার প্রথমে যে জিনিসটা নজর কেড়েছে সিনেমাটি দেখার সময় সেটা হলো, আমাদের প্রিয় রাজধানী শহরের বর্ষা চিত্র। অনেক পরিচালক মনে করেন দেশের বাইরে শ্যুটিং করলেই বুঝি ছবি হিট। কিন্তু আয়নাবাজি ছবির মাধ্যমে পরিচালক সুনিপুণভাবে ক্যামেরা শ্যুট দক্ষতার মাঝেই বুঝিয়ে দিয়েছেন বাংলাদেশের প্রকৃতি সত্যিকার অর্থে কতটা অপরূপ সৌন্দর্যের পসরা সাজিয়ে নিজ মহিমায় উদ্ভাসিত হয়ে উঠতে পারে! মূলত ঢাকা শহরে বর্ষা বন্দনার রূপচিত্র ধারণে মোটেও কার্পণ্য করেনি আয়নাবাজি।
তারপরেই আসি সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বিষয়ে। আমিও গিয়েছিলাম দর্শক হয়ে বসুন্ধরা সিটির স্টার সিনেপ্লেক্সের বড় পর্দায় দেশীয় চলচ্চিত্রের মুগ্ধতায় বিমোহিত হতে। সত্যি বলতে কী, সিনেমাটিতে সাউন্ড ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের সাবলীল ব্যবহারে ছবিটির প্রতিটি মুহূর্তই যেন জীবন্ত হয়ে ধরা দেয় দর্শকদের মাঝে।
সাউন্ড সিস্টেমের কারসাজি যদি দুর্বল হয়, তবে কিন্তু যেকোনো মুভি দেখার মুহূর্তে ‘শেষ হচ্ছে না কেন?’- এমন একটা মন মানসিকতা এসে ভর করে যা আয়নাবাজি ছবিটির দেখার ক্ষেত্রে মোটেও কাজ করে না। তাছাড়া ছবির গানগুলোর কথা ও সুর অসাধারণ আবহ তৈরি করে। ভালোলাগার গানগুলোর কথা যেন না বললেই নয়।
যা দেখছো তা , তা না না,
সব দেখা, জানা না,
এক দুনিয়া, ফানা ফানা, আরেক দুনিয়া, যাওয়া মানা ।
…
না বুঝি দুনিয়া, না বুঝি তোমায়
আমার কি দোষ খালি পাপ জমাই।
এক আধ্যাত্মিক চিন্তা জগতের কথাই যেন গানের মাঝ থেকে অন্য এক জগতে টেনে নিয়ে যায়। সর্বশেষ, ছবিটির কাহিনী ঠিক দর্শকদের আকর্ষণকে প্রতিটা মুহুর্তেই ধরে রাখার মতন। কীভাবে একজন ভোলা ভালা, সাদাসিধে বেশধারী ক্রিমিনাল আমাদের চারপাশে ঘুরে বেড়ায় তার বাস্তব প্রতিচ্ছবি স্পষ্ট ফুটিয়ে তোলা হয়েছে আয়নাবাজির ‘আয়না’ চরিত্রের মাধ্যমে। এ যেন মানুষের মাঝে ভালো এবং মন্দ দুটো দিকেরই নিদর্শন উন্মোচন করে।
যারা কাজের চাপে বা অন্য যেকোনো ব্যস্ততায় এখনও সিনেমাটি দেখার মত সুযোগ করে উঠতে পারেননি, কাহিনীখানা প্রকাশ করে তাদের উৎসাহে জল ঢেলে দিতে চাই না। আশা করি, অবশ্যই অবশ্যই দেখবেন।
পরিচালক – অমিতাভ রেজা।
প্রযোজক – কনটেন্ট ম্যাটারস লিমিটেড।
কাহিনী এবং চিত্রনাট্য – গাউসুল আলম শাওন এবং অনম বিশ্বাস।
মূল চরিত্র অভিনেতা – চঞ্চল চৌধুরী, পার্থ বড়ুয়া।
মূল অভিনেত্রী – মাসুমা রহমান নাবিলা।
অপরাধধর্মী থ্রিলার সিনেমাটির মুক্তি পেয়েছে ২০১৬ সালে।
অজ্ঞাতনামা [OGGATONAMA – The unnamed]
সিনেমাটি নিয়ে বলতে গেলে প্রথমেই মনে আসে- ‘নামেই যার পরিচয়’ এমন উক্তি। সিনেমাটির নামের অর্থ সম্প্রসারণ করলে দাঁড়ায়, এমন একজনের কথাই বলা হচ্ছে যার নাম অজ্ঞাত বা অজানা। আসলেই তা-ই। মা, মাটি ও পরিবার-পরিজন ছেড়ে জীবন যুদ্ধের চাকা সচল রাখার দায়ে বিদেশ বিভূঁইয়ে পাড়ি জমানো শ্রমিকদের জীবন পরিণতির করুণ চিত্র ফুটে উঠেছে সিনেমাটির রূপরেখায়। আমাদের দেশীয় গ্রামীণ সংস্কৃতির একটা অংশ জুড়ে খেয়াল করলেই দেখা যায় বেশিরভাগ মানুষই বাপ-দাদার জায়গা জমি বিক্রি করে পরিবারের আয় উন্নতির কথা মাথায় নিয়ে বাইরের দেশগুলোতে পাড়ি জমানোর চিন্তাধারায় মশগুল থাকে। এমন ক্ষেত্রে কপাল খারাপ হলে অনেকে পড়ে ভয়াবহ দালালের খপ্পরে। এর পরিণতি যে কতটা ভয়ংকর হতে পারে সেটাই প্রাধান্য পেয়েছে এই সিনেমাতে।
এটি মূলত বাংলাদেশী বাংলা ভাষার নাট্য চলচ্চিত্র। মানব পাচারের কাহিনী অবলম্বনে তৈরি গল্পটি ২০১৫ সালের একুশে বইমেলায় প্রকাশিত হওয়া বিশিষ্ট বাংলাদেশী অভিনেতা, চলচ্চিত্র নির্মাতা এবং লেখক তৌকির আহমেদের বইয়েরই চলচ্চিত্রায়ন। সিনেমাটি ২০১৬ সালের ১৭ মে ৬৯তম কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হয় এবং জুরি স্পেশাল মেনশন পুরস্কার প্রাপ্ত।
বিখ্যাত প্রয়াত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদের পর দ্বিতীয় বাংলাদেশী চলচ্চিত্রকার হিসেবে তৌকির আহমেদের ‘অজ্ঞাতনামা’ কান চলচ্চিত্র উৎসবে প্রদর্শিত হওয়ার মতো যোগ্যতা অর্জন করে। সুতরাং সিনেমাটিকে ২০১৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত শ্রেষ্ঠ বাংলা সিনেমা বললেও খুব একটা অন্যায় হবে না। এছাড়াও চলচ্চিত্রটি ইতালির গালফ অফ ন্যাপলস ইন্ডিপেনডেন্ট ফিল্ম ফেস্টিভালে প্রদর্শিত হয় এবং সেরা ফিকশন চলচ্চিত্র হিসেবে মনোনীত হয়।
সিনেমাটির প্রথম অর্ধাংশে কেবল বিনোদন আর শেষ অর্ধাংশে চরম উত্তেজনা ও থ্রিলিং পরিণতি চিত্রায়নের মাঝ দিয়ে যেতে যেতে দর্শকদের মনযোগ ধরে রেখে একদম শেষ মুহুর্ত পর্যন্ত টেনে গিয়ে পরিসমাপ্তির বিষয়টি সত্যিই অসাধারণ। ছবিটি দেখতে দেখতে দর্শকদের মাঝে যেন বিরক্তির ভাব বা ক্লান্তির রেখা ফুটে উঠার অবকাশই দেয় না।
দেশের বিশাল অর্থনীতির চাকা সচল রাখার পেছনে যাদের রেমিট্যান্সের টাকার অবদান কোনো অংশেই কম নয়, সেই বিদেশে রপ্তানীকৃত জনশক্তির দায় দায়িত্ব কতটা আসলে সরকারের? সিনেমাটির গল্প থেকে সে প্রশ্নটাই মূলত উঠে আসে। এছাড়াও আরও হাজার হাজার প্রশ্ন কড়া নাড়বে দরজায়। ঐ রপ্তানীকৃত জনশক্তি বিদেশে যখন মৃত্যু বরণ করে, তার লাশটি আনার সিস্টেম আসলে কি? সে দায়িত্ব কার? আমার-আপনার, নাকি আমাদের সরকারের? এমন একটা লাশ নিয়ে সৃষ্ট জটিলতায় আপনি তখন কার কাছে যাবেন? প্রবাসী কল্যাণ মন্ত্রণালয়? শ্রম মন্ত্রণালয়? স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়? পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়? স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়? কার কাছে যাবেন? এক এক মন্ত্রণালয় বলতে থাকে দায়িত্ব আমার নয়, কিন্তু সমাধান আসে না কারো কাছ থেকেই- এটাই ফুটে উঠেছে সিনেমাটিতে। একটু ভালো সৎকার ব্যবস্থার আশায় সে দরিদ্র হতভাগ্য পরিবারের শেষ সম্বল জায়গা বিক্রি করা অর্থটুকুও অনিষ্ট হতে হতে পথে নেমে যায় পরিবারটি।
পরিচালনা, চিত্রনাট্য, গল্প ও সংলাপ – তৌকির আহমেদ।
প্রযোজক – ইমপ্রেস টেলিফিল্ম লিমিটেড।
অভিনয় শিল্পী – ফজলুর রহমান বাবু, আবুল হায়াত, শহীদুজ্জামান সেলিম, মোশাররফ করিম, নিপুণ আক্তার সহ আরো অনেকে।
‘অজ্ঞাতনামা’ ছবিটির প্রিমিয়ার অনুষ্ঠিত হয় ২০১৬ সালের ১৬ আগস্ট ঢাকায় এবং ছবিটি মুক্তি পায় ১৯ আগস্ট, ২০১৬।
ভুবন মাঝি
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পটভূমিতে নির্মিত একটি নাট্য চলচ্চিত্র ‘ভুবন মাঝি’। যে মাঝি একজন স্বপ্নদ্রষ্টা, তারই আবার সাংস্কৃতিক, অরাজনৈতিক সীমানার প্রাচীর পেরিয়ে রাজনৈতিক গণ্ডির অলিগলির পথ হেঁটে বিপ্লবী হয়ে ওঠার দিক নির্দেশনাই প্রকাশ পেয়েছে সিনেমাটির মাধ্যমে। সংস্কৃতির আদর্শ কীভাবে রাজনৈতিক আদর্শের উপর বর্তায়, আর তা থেকে কী করে একটা জাতির পরিচয় তুলে ধরে, সেটি সুনিপুণভাবেই গল্পকার প্রস্ফুটিত করেছেন ১৯৭০ সাল থেকে ২০১৩ সালের সময়কেন্দ্রিক দৃশ্যপট সংযোগের মাধ্যমে।
যুদ্ধকালীন সময়ের রাস্তার দু’পাশের দেয়ালে লেখা শ্লোগানের বিষয়টি অসাধারণ উজ্জীবনী শক্তির বহিঃপ্রকাশ চিত্র ধরে রাখে। যুদ্ধকালীন সময়ে একজন সাধারণ মানুষকে এসব শ্লোগান, দেওয়াল লিখন যে কতটা অনুপ্রেরণা যুগিয়েছিল তা না বললেই যেন নয়। জীবন বদলায়, কিন্তু বদলায় না জীবন ও কালের ইতিহাস।
তাছাড়া সিনেমার গানগুলোর মাঝে প্রয়াত ভারতীয় শিল্পী কালিকাপ্রসাদের ‘আমি তোমারই নাম গাই, আমারই নাম গাও তুমি’ গানটি যে আবহ সৃষ্টি করে তা সত্যিই অসাধারণ। ছবিটি মূলত মুক্তিযুদ্ধের আদতে রাজনীতি ও দেশপ্রেমের চেতনায় উৎসরিত।
রচনা ও পরিচালনা – ফাখরুল আরেফিন খান।
প্রধান অভিনয় শিল্পী – কলকাতার পরমব্রত চট্টোপাধ্যায় ও বাংলাদেশের অপর্ণা ঘোষ।
ঢাকার স্টার সিনেপ্লেক্সে চলচ্চিত্রটির উদ্বোধনী প্রদর্শনী হয় ২০১৭ সালের ১ মার্চ এবং ৩ মার্চ সারা বাংলাদেশে ১৫টি প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পায়।
তথ্যসূত্র
১) imdb.com
২) প্রথম আলো
৩) বিডিনিউজ২৪.কম
৪) en.wikipedia.org/wiki/Aynabaji
৫) en.wikipedia.org/wiki/অজ্ঞাতনামা
৬) bn.wikipedia.org/wiki/ভুবন_মাঝি