২০১৫ সালের কথা। বলিউড ভাইজান মেগাস্টার সালমান খান নিয়ে এলেন নতুন এক সিনেমা। ভারত ছাপিয়ে আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও দারুণ ব্যবসা করল সে চলচ্চিত্র। নাম ‘বজরঙ্গি ভাইজান’। শ্রেণীগত ছাঁচে বিচার করলে একে মানবিক ভালোবাসার ছবির কাতারে ফেলা যায়। ধর্ম, রাজনীতি ও সীমান্তের ব্যবচ্ছেদকে তোয়াক্কা না করে সিনেমাটি যেন আবারও প্রমাণ করল ‘সবার উপরে মানুষ সত্য, তাহার উপরে নাই’ বচনের সত্যতা।
নিয়তির ফেরে পাকিস্তান থেকে ভারতে হারিয়ে যাওয়া বাকশক্তিহীন বালিকা মুন্নীকে বজরঙ্গি ভাইজান পবন কুমার চতুর্বেদীর এক অপ্রত্যাশিত ও মহাপ্রতিকূল সফর কাহিনিই সিনেমার মূল গল্প। মুক্তির আট বছর পেরিয়ে গেলেও কৃতজ্ঞতা, মমতা, ভালোবাসা, আনন্দ-হাসি-কান্নার এবং নানা ঘটনাপরম্পরার অনুপম মিশ্রণে গড়া বজরঙ্গি ভাইজান এখনো স্থান দখল করে আছে অসংখ্য সিনেপ্রেমীর হৃদয়কোণে। সর্বমহলে ভূয়সী প্রশংসা কুড়ানো চলচ্চিত্রটির অজানা কতক দিক নিয়েই আজকের এই আয়োজন।
১.
বজরঙ্গি ভাইজান হিসেবে বলিউডের ভাইজান সালমান খানকে সকলের মনে ধরলেও সালমান খান কিন্তু এই চরিত্রের জন্য প্রথম পছন্দ ছিলেন না। সিনেমার প্রযোজক রকলাইন ভেঙ্কাটেশ এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন, এই ফিল্মের মূল চরিত্রে অভিনয়ের জন্য ভারতীয় ফিল্ম ইন্ডাস্ট্রির নানা খ্যাতনামা অভিনেতার দ্বারস্থ হন তিনি। প্রায় ৪-৫ বছর ধরে বিভিন্ন অভিনেতার দ্বারে দ্বারে ঘুরেছে এই সিনেমার স্ক্রিপ্ট। যাওয়া হয়েছে তামিল সুপারস্টার রজনীকান্ত, তেলুগু অভিনেতা আল্লু অর্জুন, কন্নড় ইন্ডাস্ট্রির জনপ্রিয় নায়ক পুনিত রাজকুমার এবং বলিউডের পারফেকশনিস্ট আমির খানের কাছে, শোনানো হয়েছে সিনেমার গল্প।
কিন্তু সবাই নির্দিষ্ট কোনো কারণ দেখিয়ে তা নাকচ করে দিয়েছেন। তবে শোনা যায়, এই সিনেমাটি সালমান খানের কাছে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব তার বন্ধু আমির খানই না-কি দিয়েছিলেন প্রযোজককে। স্ক্রিপ্টটি সালমান খানের বেশ পছন্দ হওয়ায়, তিনি এতে নিজ খুশিতেই গ্রিন সিগন্যাল দেন।
২.
২০১২ সালের অক্টোবর মাসে টাইম অভ ইন্ডিয়া পত্রিকায় এক আর্টিকেল ছাপা হয়। ওই আর্টিকেলে বজরঙ্গি ভাইজান সিনেমার গল্পের মতো প্রায় একইরকম এক ঘটনার বর্ণনা দেওয়া আছে। জাতিগতভাবে ভারতীয় এক বাকশক্তিহীন মেয়ে এই সমস্যার মুখোমুখি হয়েছিল। ২১ বছর বয়সী ওই মেয়ের নাম ছিল গীতা। ধারণা অনুযায়ী, সমঝোতা এক্সপ্রেস নামক ট্রেনের মাধ্যমে সে পাকিস্তানের সীমানায় এসে পড়ে ভুলক্রমে। ১৯৯৯/২০০০ সালে লাহোর রেল স্টেশনের পুলিশরা তাঁকে ওই স্টেশনে খুঁজে পায়। এর এক যুগ পর আনসার বার্নি নামে এক পাকিস্তানী মানবাধিকার কর্মীর সহায়তায় গীতাকে পৌঁছে দেওয়া হয়েছিল তার পরিবারের কাছে। বার্নির ভাষায়, মেয়েটি একটু-আধটু হিন্দি লিখতে জানত। তার শুধু মনে ছিল, তার ভাইয়ের সংখ্যা সাত এবং বোনের সংখ্যা তিন। নদী পেরিয়ে বিস্তীর্ণ এক মাঠের প্রান্তে তার বাড়ি।
৩.
বজরঙ্গি ভাইজান সিনেমায় নওয়াজ উদ্দিন সিদ্দিকের নাটকীয় আবির্ভাব সকলেই মনে রাখবে। পর্দায় দেখা যাচ্ছিল, তিনি করাচির রেল সংলগ্ন ফুটওভার ব্রিজের কাছে দাঁড়িয়ে সংবাদ পরিবেশন করতে চাচ্ছেন, কিন্তু ক্যামেরার সামনে দিয়ে বারবার লোকজনের যাতায়াতের কারণে সেই পরিবেশন বিঘ্নিত হচ্ছে। এই অংশটুকু বাস্তব এক কাহিনি থেকেই নেওয়া হয়েছে। মজার ব্যাপার হলো, পাকিস্তানি ওই সাংবাদিকের নামও ছিল চাঁদ নবাব। মজার ছলে ভিডিওটি তার বন্ধুরা ইউটিউবে “Funny Pakistani News Reporter” শিরোনামে আপলোড করেছিল। শেষমেশ, কবির খান ওই ভিডিও থেকে জীবন্ত এক চরিত্র বের করে এনেছেন।
৪.
শুরুতে পাকিস্তানি সাংবাদিক চাঁদ নবাব চরিত্রের জন্য চুক্তিবদ্ধ হয়েছিলেন বলিউড সেনসেশন ইমরান হাশমি। পরে তার কাছে চরিত্রটির স্ক্রিনটাইম কম মনে হওয়ায়, তিনি তা ছেড়ে দেন। এরপর সেই স্থানে নওয়াজউদ্দিনকে নেওয়ার বুদ্ধি কবির খানকে সালমান খানই দিয়েছিলেন। বজরঙ্গি, মুন্নির পর গল্পে তৃতীয় গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র ছিল এই সাংবাদিক। নওয়াজউদ্দিনের সাথে ‘কিক’ সিনেমার পরেই সালমান নওয়াজের প্রতিভা সম্পর্কে ধারণা পেয়েছিলেন। তাই, তিনি নওয়াজের বেছে নেওয়ার পরামর্শ দেন। বাকিটা তো ইতিহাস…
৫.
মুন্নি চরিত্রের জন্য শিশুশিল্পী বেছে নিতে পরিচালককে ভালোই বেগ পোহাতে হয়েছে। প্রায় হাজারখানেকের মতো বাচ্চার অডিশন নেওয়া হয়েছিল এর জন্য। শুধু ভারত নয়, খোঁজ চালানো হয়েছে ইরান এবং আফগানিস্তানেও। শেষমেশ মুন্নির খোঁজ পাওয়া গেলো দিল্লিতে। হারশালি মালহোত্রা এই চরিত্রে দুর্দান্ত অভিনয় করে সকলের মন জয় করে নিয়েছে।
৬.
বজরঙ্গি ভাইজান সিনেমার ক্লাইম্যাক্স দেখে তো সকলের চোখের কোণেই জল জমেছিল। কিন্তু সেই ক্লাইম্যাক্সের দৃশ্যায়ন করাটা একটু জটিল ব্যাপারই ছিল। কারণ, ক্লাইম্যাক্সের ওই শ্বেতশুভ্র তুষারগিরি স্থানটা ছিল সমুদ্রপৃষ্ঠ থেকে প্রায় ১২,০০০ হাজার ফুট উপরে। এবং এর তাপমাত্রা ছিল -১০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। আমাদের উপমহাদেশের বেশিরভাগ মানুষকে এরকম তাপমাত্রা মোটামুটি অস্বস্তিতেই ফেলে দেয়।
৭.
সিনেমা নির্মাণ শুরুর আগেই ঝামেলার মুখোমুখি হতে হয়েছিল সিনেমার পরিচালক কবির খানকে। বজরঙ্গি ভাইজান নামক একটি সিনেমা তৈরি হবে, এই ঘোষণা দেওয়ার পর মোট সাতটি মামলা মামলা খেয়েছিলেন তিনি। এমনকি সিনেমার নাম পরিবর্তনের জন্য পিআইএল (পাবলিক ইন্টারেস্ট লিটিগেশন) আরোপ করা হয়েছিল কবির খানের বিরুদ্ধে।
৮.
বজরঙ্গি ভাইজান সিনেমার অন্যতম জনপ্রিয় গান ‘তু জো মিলা’তে গলা মিলিয়েছিলেন বলিউডের অন্যতম যশস্বী সঙ্গীতশিল্পী প্রয়াত কৃষ্ণকুমার কুন্নাথ ওরফে কেকে। মজার ব্যাপার হলো, জনপ্রিয় এই গান রেকর্ড করা হয়েছিল সুদূর অস্ট্রেলিয়ার শহর সিডনিতে। এই গানের মাধ্যমেই আবার একত্রিত হয়েছিলেন ‘কেকে-প্রিতম জুটি’, গোটা একটা জেনারেশনের কাছে যা পরিপূর্ণ এক নস্টালজিয়ার নাম।
৯.
বজরঙ্গি ভাইজান চলচ্চিত্রে সালমান খান আউটক্লাস পারফরম্যান্স দেওয়ার পরেও সেই বছর সেরা অভিনেতা ক্যাটাগরিতে ফিল্মফেয়ার পুরষ্কার থেকে বঞ্চিত হন। ওই পুরষ্কার জোটে বাজিরাও মাস্তানি চলচ্চিত্রের নায়ক রণবীর সিংয়ের কপালে।
১০.
ভারতীয় সিনেমায় ইতিহাস সৃষ্টি করা সিনেমা বাহুবলির সাথে সুদৃঢ় এক সম্পর্ক রয়েছে বজরঙ্গি ভাইজান সিনেমার। দুটি সিনেমারই গল্প এবং চিত্রনাট্য লিখেছিলেন বিজয়েন্দ্র প্রসাদ। সম্পর্কে তিনি বাহুবলি সিনেমার পরিচালক রাজামৌলির পিতা। বাহুবলি ২০১৫ সালে ১০ জুলাই, এবং বজরঙ্গি ভাইজান সিনেমা মুক্তি পেয়েছিল এর এক সপ্তাহ পর ১৭ জুলাই। দুটি সিনেমাই বক্স অফিসে সুপারহিট ট্যাগ পেয়েছিল।
১১.
শুরুতে, বজরঙ্গির চরিত্রে অভিনয়ের কথা ছিল বলিউড গ্রিক গড ঋত্বিক রোশনের, বাবা রাকেশ রোশনের পরিচালনায়। কিন্তু সিনেমার স্ক্রিপ্টরাইটার বিজয়েন্দ্র প্রসাদ চাচ্ছিলেন রাকেশ রোশন এই সিনেমায় সহ-প্রযোজক হিসেবে অংশগ্রহণ করুক। যেহেতু রাকেশ রোশন এই পর্যন্ত কারও সাথে সহ-প্রযোজনায় অংশ নেননি, তাই তিনি সিনেমাটি থেকে সরে আসেন। পরবর্তীতে চরিত্রটি দক্ষিণ ভারতের তিন তারকা এবং আমির খান থেকে ঘুরে-ফিরে সালমান খানের হাতে গিয়ে পৌঁছায়।
১২.
সিনেমায় কারিনা কাপুরের ‘রাসিকা’ চরিত্রটির স্ক্রিনটাইম বা গভীরতা খুব বেশি নেই। তবুও কারিনা এই সিনেমায় কাজ করতে রাজি হয়েছিলেন সালমান খানের সাথে তার সুসম্পর্ক থাকায়। এই জুটি একসাথে বজরঙ্গি ভাইজানের আগে “কিঁও কি” (২০০৫)”, “ম্যাঁয় অর মিসেস খান্না” (২০০৯) “বডিগার্ড” (২০১১) সিনেমায় একসাথে জুটি বেধেছিলেন। এর মধ্যে বডিগার্ড ছিল ম্যাসিভ হিট। চরম দর্শকপ্রিয়তা কুড়িয়েছিল এই সিনেমা।
১৩.
সালমান খান এবং কবির খান এই পর্যন্ত মোট তিনটি সিনেমায় একত্রে কাজ করেছেন। সেগুলো হলো এক থা টাইগার (২০১২), বজরঙ্গি ভাইজান (২০১৫), ও টিউবলাইট (২০১৭)। এর মধ্যে এক থা টাইগার এবং বজরঙ্গি ভাইজান সফলতার মুখ দেখলেও ঝিমিয়ে গিয়েছিল টিউব লাইটের আলো। এক থা টাইগার শুধুমাত্র ১ কোটি রুপির জন্য ডমেস্টিক বক্স অফিসে ২০০ কোটির ক্লাবে পা রাখতে পারেনি। ওদিকে মাত্র তিনদিনেই ১০০ কোটির ঘর ছুঁয়ে যায় বজরঙ্গি ভাইজান। টিউবলাইট বক্স অফিস কিংবা সমালোচক মহল কোনোদিকেই তেমন সফলতা কুড়াতে পারেনি।
১৪.
বজরঙ্গি ভাইজান সিনেমায় বক্স অফিসে সুপারহিট হবার ফলে সালমান খান টানা সাতটি হিট ফিল্ম দেওয়ার রেকর্ড বজায় রেখেছিলেন। দাবাং (২০১০), রেডি (২০১১), বডিগার্ড (২০১১), এক থা টাইগার (২০১২), দাবাং ২ (২০১২), জয় হো (২০১৩), কিক (২০১৪), এবং বজরঙ্গি ভাইজান (২০১৫)- এই ছিল সাতটি সিনেমার লাইনআপ। তার এই হিট স্ট্রিক শুধু সাতটি সিনেমাতেই সীমাবদ্ধ থাকেনি। পরবর্তীতে প্রেম রতন ধন পায়ো (২০১৫), সুলতান (২০১৬)- এই দুটি সিনেমাও হিটের তকমা পেয়েছিল। টানা নয় ফিল্মের হিট স্ট্রিক গিয়ে থামে টিউবলাইট (২০১৭) সিনেমার বক্স অফিসে অ্যাভারেজ পারফর্মেন্সের কারণে।
১৫.
এই পর্যন্ত ৬১টি অ্যাওয়ার্ড ক্যাটাগরিতে মনোনয়ন পেয়েছে বজরঙ্গি ভাইজান, যার মধ্যে ৩৪টি ক্যাটাগরির পুরষ্কার নিজ ঝুলিতেও পুরে নিয়েছে সিনেমাটি। এর মধ্যে সিনেমার গল্পের জন্য ফিল্মফেয়ার পুরষ্কার, চার ক্যাটাগরিতে জি সিনে অ্যাওয়ার্ড, ছয় ক্যাটাগরিতে স্ক্রিন অ্যাওয়ার্ড উল্লেখযোগ্য। ২০১৫ সালে চীনের ৬ষ্ঠ ডোবান ফিল্ম অ্যাওয়ার্ডে সেরা বিদেশী চলচ্চিত্রের মনোনয়ন পায় বজরঙ্গি ভাইজান। বক্স অফিসে রীতিমতো টর্নেডো চালিয়ে অল টাইম ব্লকবাস্টার খেতাব পেয়েছিল সিনেমাটি। ১২৫ কোটি বাজেটে নির্মিত সিনেমাটির বিশ্বব্যাপী গ্রস কালেকশন ছিল ৯১০ কোটি রুপি। ভারতে ২৬.৭০ কোটি রুপির এক বাম্পার ওপেনিং কালেকশন দিয়ে বক্স অফিসে শুভসূচনা ঘটায় বজরঙ্গি ভাইজান।
ওপেনিং উইকেন্ডে প্রথম ভারতীয় সিনেমা হিসেবে ১০০ কোটি ডমেস্টিক নেট ক্লাবে প্রবেশ করে সিনেমাটি। চলচ্চিত্রটির ডমেস্টিক গ্রোস, নেট, ও শেয়ার ছিল যথাক্রমে, ৪২২.১৫ কোটি, ৩১৫.৫০ কোটি এবং ১৬২.২০ কোটি রুপি। ভারতে মোট বিক্রিত টিকেটের সংখ্যা (ফুটফলস) ছিল ৩.৫৪ কোটি, যা বিশ্বব্যাপী ডাবিংসহ পাঁচ কোটিতে গিয়ে দাঁড়ায়। ওভারসীসে সালমান প্রথম ২০ মিলিয়ন ডলার আয়ের মাধ্যমে, ২০১৫ সালে ডমেস্টিক ও ওয়ার্ল্ডওয়াইড বলিউডের ‘হায়েস্ট গ্রোসার অভ দ্য ইয়ার’ সিনেমা হয়ে উঠে এটি। এই বজরঙ্গি ভাইজান সিনেমাকে অনেকে সালমান খানের ফিল্ম ক্যারিয়ারের সেরা সিনেমা হিসেবেও অভিহিত করে থাকেন।