আচ্ছা, কখনো কোনো সিনেমা দেখার পর কি এমন হয়েছে যে আপনি সারারাত ঘুমাতে পারেননি? কোনো সিনেমা কি আপনার হৃদয়ে এতটাই গভীরভাবে দাগ টেনেছে যে বেশ কয়েকদিন সেই সিনেমা নিয়ে ভাবতে আপনি বাধ্য হয়েছেন? অথবা কোনো সিনেমা কি আপনার নিজের ও আশেপাশের মানুষজন সম্পর্কে দৃষ্টিভঙ্গি পাল্টে দিয়েছে? আপনাকে নতুন কোনো আশার কিরণ দেখিয়েছে কিংবা নতুনভাবে অনুপ্রেরিত হতে উৎসাহ দিয়েছে? জানি না, অন্য কারো সাথে এমনটা হয়েছে কি না। তবে ‘ওয়ান্ডার’ নামক একটি সিনেমা আমার জীবনে এমন এক নতুন উদ্যম ও বার্তা বয়ে এনেছিল।
‘ওয়ান্ডার’ সিনেমাটির সাথে মূলত ৯০তম অস্কারে নানা ক্যাটাগরিতে মনোনয়ন প্রাপ্ত সিনেমাগুলো নিয়ে ঘাঁটাঘাঁটি করতে গিয়ে পরিচিতি হয়েছিল। তবে মজার ব্যাপার হলো, সিনেমা কিন্তু অস্কারে সেরা চলচ্চিত্র, সেরা অভিনেতা, সেরা অভিনেত্রী, সেরা পরিচালক অথবা সেরা চিত্রনাট্য এসব কোনো শাখাতেই মনোনয়ন পায়নি। সিনেমাটি এমন এক শাখায় মনোনয়ন পেয়েছিল যা কি না অনেকের চোখই এড়িয়ে যাবে। তাছাড়া সিনেমাটি দেখার পেছনের প্রভাবক হিসেবে আরও একটি উপাদান কাজ করেছে। সেটি হলো, সিনেমার অন্যতম চরিত্রে অভিনয়কারী অভিনেত্রী জুলিয়া রবার্টস। আর সিনেমা শেষ করে ওঠার পর, মুখ দিয়ে শুধু একটি শব্দই বের হয়েছিল, “বিস্ময়কর!”
২০১২ সালে আমেরিকান লেখক আর. জে. প্যালাসিও ‘ওয়ান্ডার’ নামে একটি উপন্যাসের জন্ম দিয়েছিলেন। এই শিশুতোষ উপন্যাসটি সেই বছর নিউ ইয়র্কের বেস্ট সেলার হিসেবে ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল ও পুরো বিশ্বব্যাপী পাঁচ মিলিয়নের বেশি বইটির কপি বিক্রি হয়েছিল। সিনেমার প্লট অথবা অন্যান্য বিষয়ে প্রবেশ করার আগে সিনেমাটি কীভাবে নির্মাণ হয়েছি সেই ব্যাপারে বরং মজার কিছু তথ্য তুলে ধরা যাক।
২০১২-১৭ সাল পর্যন্ত এই পাঁচ বছর নানা চড়াই-উতরাই পার করে অবশেষে আলোর মুখ দেখেছিল ‘ওয়ান্ডার’ সিনেমাটি। ২০১২ সালের দিকে প্রথমে কথা ছিল জন অগাস্ট উপন্যাস থেকে সিনেমাটির চিত্রনাট্য লিখবেন। কিন্তু পরের বছর সেই দায়িত্বভার গিয়ে পড়ে জ্যাক থ্রোনের হাতে। ২০১৪ সালে সিনেমার জন্য পরিচালক হিসেবে জন ক্রোকিডাসকে নিযুক্ত করা হলেও পরের বছর আবার তার স্থানে পল কিংকে নেওয়া হয়েছিল। সেই সময়ে আবার চিত্রনাট্যকার ছিলেন স্টিভেন কনরাড।
২০১৬ থেকে ২০১৭ এর মাঝামাঝি পর্যন্ত সিনেমার জন্য অভিনয়শিল্পীদের বাছাইকরণ চলেছিল। অতঃপর প্রধান চারটি চরিত্রের জন্য জুলিয়া রবার্টস, জ্যাকব ট্রেম্বলি, ওয়েন উইলসন ও ইসাবেলা ভিডোভিককে চুক্তিবদ্ধ করা হয়। শেষমেশ, ২০১৭ সালে এসে সিনেমাটির নির্মাতারুপে চূড়ান্তভাবে স্টিফেন চবস্কিকে নিয়োগ করা হয়। সিনেমাটির চিত্রনাট্যকার হিসেবে থ্রোন, কনরাড ও চবস্কি তিনজনই মিলিতভাবে কাজ করেছেন।
“জানি, আমি ১০ বছর বয়সী বাকি সব সাধারণ শিশুদের মতো নই। মানে, আমি সাধারণ কাজকর্মই করি। আইসক্রিম খাই, নিজের বাইসাইকেলে চড়ে বেড়াই। খেলাধুলায় বেশ পারদর্শী আমি। মানে, আমার এক্স-বক্সে আর কি। মাইন ক্রাফট, বিজ্ঞান ও হ্যালোউইনে সাজতে আমি বড্ড ভালোবাসি। বাবার সাথে লাইটসেবার দিয়ে খেলতে ভালোবাসি। আর আমার বড় বোনকে রেগেমেগে আগুন করে দিতে। আর একজন স্বাভাবিক শিশুর মতো কোনো একদিন মহাকাশে পা রাখার স্বপ্ন দেখি। শুধু যখন আমি এসব করি তখন আমাকে বাকিদের মতো স্বাভাবিক দেখায় না। এমনকি আমার জন্মটাও স্বাভাবিক ছিল না। …”
মাথায় মহাকাশচারীদের মতো হেলমেট পরে বিছানায় লাফাতে লাফাতে মহাকাশের শূন্য ভাসমান থাকার অনুভূতি উপভোগ করতে সচেষ্ট একটি দশ বছরের বালক নিজের সম্পর্কে উপরের কথাগুলো বলছিল। এমন এক দৃশ্য দিয়েই সিনেমাটি শুরু হবে। এই একটি দৃশ্যই আপনাকে সিনেমা সম্পর্কে আসলে আগ্রহী করে তোলার কথা। আর একবার আগ্রহ জেগে গেলে, এই বিস্ময় বালকের সাথে আপনিও ঘুরে আসবেন তার বিস্ময় জগতে।
হয়তো প্রথম দৃশ্যের কথা পড়ে, ভাবছেন, “সিনেমার কাহিনীটা আসলে কী?” তাহলে চলুন, অল্প কথায় জেনে আসা যাক সিনেমার কাহিনী সম্বন্ধে।
‘ওয়ান্ডার’ মূলত ফ্যামিলি-ড্রামা জনরার একটি সিনেমা। সিনেমাতে এমন একটি পরিবারের গল্পকে তুলে ধরা হয়েছে যেখানে মা-বাবা তাদের দুই ছেলেমেয়েকে নিয়ে দারুণ সুখে-শান্তিতে বসবাস করছিলেন। তাদের পরিবারে ছিল না কোনো ভালোবাসার কমতি অথবা কোনো ধরনের অভাব-অনটন। একটি সুখী পরিবারে যা যা উপাদান প্রয়োজন, সবই তাদের হাতের মুঠোয় এসে ধরা দিয়েছিল। কিন্তু বিধাতা দুনিয়াতে কাউকে পুরোপুরি অর্থাৎ শতভাগ সুখ কপালে দিয়ে পাঠান না। তাই তো, এই সুখী পরিবারেও একটা দুঃখের রেশ বিদ্যমান ছিল। কী সেটা, চলুন জেনে আসি।
মনে আছে, উপরে একজন বিস্ময় বালকের কথা বলেছিলাম? সেই বিস্ময় বালকের নাম হচ্ছে অগি পুলম্যান আর তাকে ও তার পরিবারকে ঘিরেই সিনেমার গল্প রচিত হয়েছে। এই বিস্ময় বালক নিজেকে সবার থেকে আলাদা কেন বলেছিল, জানেন? কারণ তার বাহ্যিক রূপ তার বয়সী বাকি আট-দশটা বালকের মতো ছিল না। অগি একজন ‘ট্রিচার কলিনস সিনড্রোম’ এ আক্রান্ত শিশু। আর এই রোগে আক্রান্ত অন্যান্য মানুষের মতো তার মুখমণ্ডলও বিকৃত অবস্থায় ছিল। তাই অগি যতই মেধাবী হোক না কেন, যতই সুন্দর মনের অধিকারীই হোক না কেন, যত বন্ধুত্বসুলভই হোক না কেন, সে চাইলেও স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে পারতো না।
এই পৃথিবীতে ভিন্নতাকে সবসময় কটু দৃষ্টিতে দেখা হয়ে থাকে। আর সেটা যদি হয়ে থাকে কোনো ধরনের ত্রুটি অথবা দুর্বলতা, তাহলে তো একদম তিলকে তাল করতে উঠে-পড়ে লেগে যায়। এমনটা না হলে, সিনেমার শুরুর দিকে ওগির মা-বাবাকে তাকে জনসম্মুখে স্কুলে পাঠানো নিয়েই কথা কাটাকাটিতে জড়াতে হবে কেন? একজন মানুষ হিসেবে কি স্কুলে যাওয়াটা অগির মৌলিক অধিকারের মধ্যে পড়ে না? তাহলে কেনই বা তাকে জীবনের প্রথম দশ বছর লোক চক্ষুর আড়ালে থাকতে হয়েছিল? আর রাস্তায় বের হলেও সবসময় মুখোশ কিংবা হেলমেটের আড়ালে নিজের চেহারা ঢেকে রাখতে হয়েছিল?
সিনেমার গল্পে অগির সামগ্রিক জীবনের সচিত্র বর্ণনা তুলে ধরার পাশাপাশি তার চারপাশের মানুষজনদের জীবনে তার এই সবার থেকে আলাদা হবার ব্যাপারটা ঠিক কেমনভাবে প্রভাব ফেলছে সেটাও দেখানো হয়েছে। প্রথমে শুরু করা যাক তার পরিবারের কথা দিয়েই। অগির বাবা মানুষটা অত্যন্ত মজার মানুষ ও ছেলের সাথে তার সম্পর্ক “আগে বন্ধু, পরে বাপ” টাইপের। কিন্তু তিনি কি আসলেই চিন্তামুক্ত? কখনো কি নিজের ছেলেকে স্বাভাবিক জীবনযাপন করতে দেখতে ইচ্ছে করে না তার? অগির মা নিজের ক্যারিয়ারকে রসাতলে দিয়েছিলেন শুধু ছেলেকে যাতে সবসময় চোখে চোখে রাখতে পারেন। তিনি অসাধারণ বুদ্ধিমত্তার অধিকারিণী হলেও সেটা প্রকাশ করার অথবা কাজে লাগানো সুবর্ণ সুযোগ শুধু অগিকে লালন-পালন করতে গিয়ে ত্যাগ করেছিলেন।
অন্যদিকে, অগির বড় বোন ভিয়া। মেয়েটা অগিকে প্রাণাধিক ভালোবাসে, তা নিঃসঙ্কোচে বলা যায়। অগির মুখের দিকে তাকিয়ে সে নিজের অনেক ছোট-বড় সুখকে বিসর্জন দিয়ে দিতে পারে। কিন্তু দিনশেষে, সে-ও তো একজন কিশোরী। মা-বাবার পর্যাপ্ত সময় ও মনোযোগ তারও তো মৌলিক চাহিদা। তাই হয়তো মাঝেমধ্যে অগির প্রতি নিজের মা-বাবার আদর-ভালোবাসার আদিখ্যেতা তাকে অল্প হলেও মানসিকভাবে কষ্ট দিচ্ছিল। যদিওবা বড় বোন হিসেবে ভিয়া ছিল অতুলনীয়া।
এবার অগির বন্ধুবান্ধবদের কথা বলতে গেলে, প্রথমেই আসবে তার বেস্ট ফ্রেন্ড জ্যাকের কথা। স্কুলে যাবার পর সবার প্রথমে ওর সাথে সে বন্ধুত্ব করেছিল। জ্যাক প্রথম দিকে অগির প্রতি করুণা করলেও একসময় অগিকে তার মন থেকে ভালো লাগতে শুরু করে। যদিওবা তাদের দুজনের মধ্যে মান-অভিমান নামক বাধা বেশ তোড়জোড়ভাবেই এসে দেখা দিয়েছিল। তবে ছোটদের “তোমার সাথে আড়ি” আর কতক্ষণ টেকে? তবে জ্যাক ও অগি দুজনেই দুজন থেকে অনেক কিছু যে শিখেছিল তা মানতেই হবে।
হয়তো জ্যাকের পরিচয় অগির সাথে না হলে সে এতটা সুপ্রসন্ন মনোভাবের ও উদার চিন্তাশীলতা লাভ করতো না। অগি জ্যাককে করে তুলেছিল একজন আদর্শ বন্ধু। আর জ্যাকও অগিকে বন্ধুত্বের সংজ্ঞা বুঝতে শিখিয়েছিল। অগির ভেতর ক্ষমাশীলতা নামক মহানুভব গুণের সঞ্চার করিয়েছিল। আর অগির বান্ধবী সামার ছিল এককথায় অসাধারণ এক মেয়ে। তার মতো মানসিকতা অনেক প্রাপ্তবয়স্ক লোকের মধ্যেঅ লক্ষ্য করা যায় না।
এছাড়া বাকি সহপাঠীরা আসলে সাধারণ শিশুদের মতো আচরণ করেছিল। আর ভিয়ার বান্ধবী মিরান্ডা মেয়ে হিসেবে দারুণ হলেও নিজের পারিবারিক জীবন নিয়ে অসুখী বলেও খানিকটা মানসিক দ্বন্দ্বে ভুগছিল বলে ধরে নেওয়া যায়। আসলে এ চরিত্র এ গল্পে আনার পেছনেও কারণ ছিল। অগি ও ভিয়ার পরিবারের কথা চিন্তা করুন আর মিরান্ডার পরিবারের। একজন শিশু কিংবা কিশোরের সার্বিক বিকাশে পরিবার কতটা শক্তিশালী ভূমিকা রাখে হয়তো এটাই দেখানোর ক্ষুদ্রতম চেষ্টা করা হয়েছে। ভিয়ার বন্ধু জাস্টিন যেকোনো কিশোর প্রেমিকের জন্য আদর্শ হয়ে উঠতে পারে। এই বয়সে এতটা মানসিক পরিপক্বতা খুব কম টিনএজারের মধ্যে খুঁজে পাওয়া যায়।
‘লায়ন্সগেট’ নিবেদিত ‘ওয়ান্ডার’ সিনেমাটি গত বছরের ১৭ নভেম্বর মুক্তি পেয়েছিল। ২০ মিলিয়ন ডলার বাজেটের সিনেমাটি বিশ্বব্যাপী প্রায় ৩০০.৫ মিলিয়ন ডলার আয় করতে সক্ষম হয়েছে। রটেন টমেটোসে ১৫৬ রিভিউয়ের ভিত্তিতে সিনেমাটি ৮৫% রেটিং প্রাপ্ত হয়েছে। অস্কারে ‘বেস্ট মেকআপ ও হেয়ারস্টাইলিং’ ক্যাটাগরিতে মনোনয়ন ছাড়াও সিনেমাটি আরও অনেক পুরস্কারের জন্য মনোনয়ন লাভ করেছিল। সিনেমার শ্রেষ্ঠ অর্জন হচ্ছে হার্টল্যান্ড ফিল্ম ফেস্টিভ্যালে পুরস্কার ও সিয়াটল ফিল্ম ক্রিটিকস অ্যাওয়ার্ড জিতে নেওয়া।
ফিচার ইমেজ: Our Altered Life