ওয়াল স্ট্রিট-নিউ ইয়র্কের শেয়ার বাজারে মাসখানেক আগে ঘটে গেছে এক বিস্ময়কর ঘটনা। সাধারণ মানুষ একজোট হয়ে মোটামুটি যুদ্ধই করছে বলা যায় বড় বড় হেজ ফান্ডগুলোর বিরুদ্ধে। শুধু যুদ্ধ করছে বললে ভুল হবে। শুরুর লড়াই এরই মধ্যে জিতে গেছে রেডিট নামক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম থেকে একত্রিত হওয়া এই ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা। সম্মিলিত প্রচেষ্টায় তারা মেলভিন ক্যাপিটাল (Melvin Capital) নামের ১৩ বিলিয়ন ডলার হেজ ফান্ডকে এতটাই ক্ষতি স্বীকারে বাধ্য করেছে যে তাদেরকে Citadel আর Point72 নামের অন্য দুটি হেজ ফান্ডের কাছ থেকে ২.৭৫ বিলিয়ন ডলার নিতে হয়েছে ‘রেসকিউ ক্যাপিটাল’ হিসেবে।
কিন্তু কীভাবে শুরু হলো এই পুরো ঘটনা? সাধারণ মানুষই বা কেন এভাবে উঠেপড়ে লাগল হেজ ফান্ডগুলোর বিরুদ্ধে? কী হবে এই যুদ্ধের পরিণতি? আর এ থেকে ভবিষ্যত অর্থনীতিই বা কীভাবে প্রভাবিত হবে? এই সবকিছু বুঝতে হলে আমাদের বুঝতে হবে ‘Short selling’ নামের ধারণাকে।
Short Selling কী?
আইডিয়াটি খুবই সাধারণ। কোনো একটা কোম্পানি শেয়ার আমি ধার করব। ধার করে বিক্রি করব। অল্প সময় পরে আবার সেই শেয়ার আমি কিনে নেব। আর যার কাছ থেকে ধার করেছিলাম তাকে ফেরত দেব। এখন আমি যে দামে প্রথমে বিক্রি করেছিলাম আর যে দামে পরে কিনলাম, তার যে পার্থক্য সেটাই আমার মোট লাভ বা লোকসান।
তাহলে একদম সাধারণ জ্ঞানেই বোঝা যায়, Short selling করে একজন লাভবান হবে যদি বিক্রি করার সময় বেশি দামে বিক্রি করে, কেনার সময় কম দামে কেনা যায়। Short seller-রা মূলত সেটাই করে। একটি কোম্পানির শেয়ারের মূল্য সময়ের সাথে সাথে কমতে থাকবে, তার উপরেই মূলত একজন Short seller বাজি ধরে।
এবার আসা যাক বর্তমান ইস্যুতে। দেখা যাক কীভাবে ওয়াল স্ট্রিটে শুরু হলো এক দশকের মধ্যে ঘটা সবচেয়ে স্মরণীয় এই ঘটনা। গল্পের শুরু গেমস্টপ কর্পোরেশন (GameStop Corporation) ও মেলভিন ক্যাপিটাল নামের দুটি জায়গা থেকে।
গেমস্টপ এবং মেলভিন
গেমস্টপ ইলেকট্রনিক গেমসের রিটেইল চেইন শপ যারা গেমসের ডিভিডি, কনসোল এ ধরনের জিনিস বিক্রি করে থাকে। এই চেইন শপ বেশ কিছুদিন ধরেই লোকসান করছিল কারণ গেম কেনার জন্য এখন দোকানে যাবার দরকার আসলেই পড়ে না। আর এই মহামারীর মধ্যে যেখানে মানুষ বাইরে যাওয়াই কমিয়ে দিয়েছে, সেখানে ভিডিও গেমস কিনতে দোকানে যাওয়ার মতো মানুষ আসলেই অনেক কম। ভিডিও গেমস এর দোকানকে ‘অপ্রয়োজনীয় সেবা’ হিসেবে দেখিয়ে অনেক জায়গাতেই সরকারি নির্দেশ দেয়া হয়েছিল এই সময়ে তাদের দোকান বন্ধ রাখার জন্য। গত এপ্রিলেই নিজেদের অনেকগুলো শাখা বন্ধের ঘোষণা দিয়েছিল গেমস্টপ। সব মিলিয়ে তাদের ব্যবসা যে খুব তাড়াতাড়ি লাভের মুখ দেখবে- এমনটা কেউই আশা করেনি। ওয়াল-স্ট্রিটে গেমস্টপের শেয়ারের দাম নেমে গিয়েছিল ৩.২৫ ডলারের কাছাকাছি।
আর মেলভিন ক্যাপিটাল নিউ ইয়র্ক স্টক এক্সচেঞ্জে কাজ করা একটি হেজ ফান্ড। এই ফার্মের প্রতিষ্ঠাতা গ্যাব্রিয়েল প্লটকিন, যিনি এর আগে নিউ ইয়র্কের অন্য একটি হেজ ফান্ড গ্রুপ এস.এ.সি. ক্যাপিটালে কাজ করতেন। ২০১৪ সালে এস.এ.সি. ক্যাপিটালের বিরুদ্ধে বেশ কিছু প্রতারণার অভিযোগ ওঠে এবং অনেকের শাস্তি হয়। ওই ঘটনার পর প্লটকিন এস.এ.সি. ক্যাপিটাল ছেড়ে এসে মেলভিন ক্যাপিটাল প্রতিষ্ঠা করেন। ফোর্বস ম্যাগাজিন ২০১৭ অনুযায়ী প্লটকিন সবচেয়ে বেশি আয় করা হেজ ফান্ড ম্যানেজারদের তালিকায় ২০ নম্বরে ছিলেন।
ঘটনার সূত্রপাত
ঘটনার শুরু যখন রায়ান কোহেন নামক একজন বিনিয়োগকারী গেমস্টপের দূরবস্থা চলাকালে এর ১৩% শেয়ার কিনে নেন এবং চেষ্টা করতে থাকেন গেমস্টপের ব্যবসাকে ই-কমার্স হিসেবে সম্প্রসারণ করার। মূলত তিনি চাচ্ছিলেন বিশ্বখ্যাত ই-কমার্স অ্যামাজনের সাথে প্রতিযোগিতায় নামতে। কোহেনের এই চেষ্টার ফলে শেয়ার বাজারে গেমস্টপের শেয়ারমূল্যের কিছুটা উন্নতি হয়।
ঠিক সেসময় মাঠে নামে মেলভিন ক্যাপিটালসহ আরো কিছু হেজ ফন্ড। তারা বাজি ধরে গেমস্টপের বিরুদ্ধে। মেলভিনের ধারণা ছিল, আমাজনের বিরুদ্ধে এই অসম লড়াইয়ে গেমস্টপ হারতে বাধ্য। আর সেক্ষেত্রে গেমস্টপের শেয়ারের দাম আবার পড়ে যাবে। তারা একে শর্ট সেলিংয়ের একটি মোক্ষম সুযোগ হিসেবে ধরে নেয় এবং গেমস্টপের বিশাল অংকের শেয়ারকে শর্ট সেল করা শুরু করে। আর সেখান থেকেই মেলভিন ক্যাপিটালের দুর্ভোগের সূত্রপাত, যার সূচনা করে WSB নামের এক অনলাইন কমিউনিটি।
WSB বনাম হেজ ফান্ড: ডেভিড-গোলিয়াথের লড়াই
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম রেডিট (Reddit) এর একটি বিশেষত্ব হচ্ছে, এখানে নির্দিষ্ট বিষয়ভিত্তিক অনলাইন কমিউনিটি গড়ে তোলা যায়। এ ধরনের একটি কমিউনিটি ছিল WSB বা r/Wallstreetbets। মূলত স্টক ট্রেডিংয়ের বিভিন্ন আইডিয়া নিয়ে এই কমিউনিটিতে আলোচনা হতো। এই চ্যানেলেই প্রথমবারের মতো একজন উল্লেখ করেন যে মেলভিন ক্যাপিটাল বিশাল অংকের গেমস্টপ শেয়ারকে শর্ট সেল করছে। চ্যানেল মেম্বারদের আহবান করা হয় গেমস্টপের শেয়ার কেনার জন্য যেন শেয়ারের দাম বাড়ানো যায়।
মেলভিনের বিরুদ্ধে একজোট হয়ে গেমস্টপের শেয়ারের দামকে আকাশচুম্বী করার এই ডাকে অভূতপূর্ব সাড়া আসে, যার প্রভাব দেখা যায় গেমস্টপের শেয়ারের দামে। শেয়ার বাজারে যখন কোনো কোম্পানির শেয়ারের অনেক চাহিদা থাকে তখন সাধারণ চাহিদা-যোগান নিয়মের মতোই সেই শেয়ারের মূল্য বাড়তে থাকে। এখানেও তা-ই হলো। ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা একজোট হয়ে যখন গেমস্টপের শেয়ার কেনা শুরু করল, বাড়তে থাকল গেমস্টপের শেয়ারের দাম, আর সেই সাথে বাড়তে থাকল মেলভিনসহ অন্যান্য শর্ট সেলার হেজ ফান্ডগুলোর ক্ষতির পরিমাণ।
বিলিয়ন ডলারের হেজ ফান্ডগুলোর চক্ষুশূল হয়ে দাঁড়াল এই ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীরা। অনেক বিশেষজ্ঞ বলতে থাকলেন, এভাবে একজোট হয়ে শেয়ারের দাম বাড়ানোর চেষ্টা করা বাজারে অস্থিতিশীলতা নিয়ে আসবে। অনেকে সতর্ক করল যে বিনিয়োগকারীরা তাদের সমস্ত বিনিয়োগ হারাবে, কারণ গেমস্টপের শেয়ারের দাম দ্রুতই আবার নেমে যাবে। কিন্তু এসব মতামতকে যেন পাত্তাই দিল না রেডিট-আর্মি।
যে গেমস্টপের একটা শেয়ারের দাম জানুয়ারির শুরুতে ছিল ১৯ ডলার, জানুয়ারির ২৭ তারিখ যখন শেয়ার বাজারে লেনদেন শুরু হয় তার দাম গিয়ে দাঁড়ায় ৩৫৪ ডলারে! পরাজয় স্বীকার করে গেমস্টপের শর্ট সেলার হেজ ফান্ডগুলো। মেলভিন ক্যাপিটাল বাধ্য হয় ধার করে বিক্রি করা সমস্ত শেয়ার পুনরায় কিনে নিতে। সেই সাথে তারা শিকার হয় বিশাল অংকের ক্ষতির। ধারণা করা হচ্ছে, এই গেমস্টপ-কান্ডে হেজ ফান্ডটি ৫৩% ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে। শুধু মেলভিন ক্যাপিটাল নয়, পয়েন্ট ৭২, সিট্রন ক্যাপিটালসহ এরকম আরো অনেকগুলো হেজ ফান্ড নিজেদের বিশাল অংকের অর্থ খুইয়েছে ক্ষুদ্র বিনিয়োগকারীদের নিয়ে গঠিত এই রেডিট-আর্মির কাছে।